somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'অন্য বেহুলা': মেমোরিজ অভ আ ক্রিপল্ড ড্যান্সার

১৫ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অন্ধকার একাকার।

যাবতীয় তন্দ্রা বন্ধ করে আমার ঘর জুড়ে অতীতের অদ্ভুত গরম বাতাস বয়ে চলেছে। কপালে, কপোলে ঘামের অজস্র নিদাঘ বিন্দু। প্রতিটি কণায় একটা একটা গতকাল ভর করে আছে যেন। আমার এই ক্ষুদ্র শরীর কি আর পারে এতো এতো ওজনের ভার বইতে?

মনে হয় আমার জন্ম হয়েছিল সূর্যোদয়ের কালে। বৃহস্পতিবার ভোরে। আঁতুরঘরেই আমাকে বোধ হয় শোনানো হয়েছিল গান। চোখ বন্ধ করলেই সেই দারুণ গান এখনও যেন স্পষ্ট শুনতে পাই। বয়স যখন পাঠশালায় যাওয়ার মতোন হল, মনে পড়ে, প্রথম সারা শরীর উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ঝড় এসেছিল। তবলার অতি তীব্র লহরী। সেই সুর-উন্মাদ স্রোতে আমি আছড়ে পড়েছিলাম এক অচিন নদীর ঘাটে।

ঘোর কাজল রাত। আমার জানালা খোলা ঘরে সমস্ত গতকাল ঢুকে পড়েছে জোনাকসমান। যেন আমার প্রতিটি পুরাতন দিন এক একটা জোছনাবিহীন তারা। একলা মানুষ আমি কোন সাহসে, কীসের বলে এতো আগুনজ্বলা স্মৃতির আঘাত সইতে পারি?

ঘর বন্ধ করে বাড়ির সুবিশাল আয়নায় একদিন নিজেকে খুব করে দেখে নিলাম। জানতে চাইলাম কেন গান শুনলেই এই দেহ দুলে ওঠে। কলমি ফুল দেখেছিলাম। কী রং আর কত উদাস। জলের ধারে জীবন তার। মৃদু হাওয়া এলেই কেমন সুন্দর নেচে ওঠে ফুল। আয়নায়
নিজেকে যত শত বার দেখি, তত বার কলমির ফুলের মতোন খোলা আসমানের নিচে, নদীর কোলঘেষা সবুজ মাঠে, বিকেলের আলো সারা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে নাচতে ইচ্ছে করে। ভাবলাম আদতে কলমি ফুল আমি। ভুল করে মানব জীবন।

প্রতিদিন আমার মন চাইত একদিন পালিয়ে যাই। বন্ধ ঘরে যত নাচতে থাকি, যতবার ঘেমে নেয়ে উঠি, মনে হয় সুদূর এক সমুদ্রে চলে যাই। যেখানে আমার সঙ্গে সকল তরঙ্গ দুলে উঠবে তালে। যেখানে সমস্ত দিন রাত কেটে যাবে নৃত্য অপার গীতে। যেখানে আমার অবুঝ, নিঠুর পিতার মতোন ধরে আসা কণ্ঠে কেউ বলবে না- 'তুমি ছেলে, নৃত্য তোমাকে মানায় না। সত্যিকারের পুরুষ হতে হবে তোমায়। নাচ তো কেবল নারীর জন্যে। আর যেন নাচতে না দেখি!'

সারা দুনিয়া ঘুমিয়ে আছে। আর অতীত রাতের সহস্র লক্ষ হাসনাহেনা আমাকে জাগিয়ে রেখেছে। যেন এক একটা ফুলের ঘ্রাণে আমার নৃত্যরত এক একটা ছবি। এই চোখ, প্রায়-অন্ধ নীরব চোখ আর কতখানি তার দেখতে পারে? দীর্ঘশ্বাসের আয়নায় সব আবছা হয়ে আছে।


নাচ আমি ছাড়িনি। এতো এতো কঠিন কষ্ট সইতে হল তবু আমি নাচতে ভুলিনি। সত্যিকারের পুরুষ আমি হতে চাইনি আমার বাবার মতোন। বাবার মতোন অগ্নিচক্ষু ভীতিকর হতে চাইনি। মাকে তিনি আমার জন্যে মেরেছেন পর্যন্ত। যেন আমি নাচতে চাই, আর সব ছেলেদের মতোন ফুটবল খেলি না কেবল মায়ের দোষে। মা যদি মেয়ে না হতেন আমি যেন এক মস্ত ভীষণ পুরুষ হতাম, কেবল পুরুষ!

তবে একটা দিন মনে পড়ে ভীষণ। বাবার মৃত্যর আগেরদিন রাষ্ট্রের এক বড় পুরষ্কার পেলাম। বাবা কতোকাল বাদে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন! পত্রিকায় আমার ছবি তাঁর চোখের জলে ভিজে গেল। বুঝলাম বাবাও সত্যিকারের পুরুষ নন। তিনিও মায়ের মতোন আবেগ ঝরিয়ে অঝোরে কাঁদতে জানেন। কী অসহায় চোখ তখন বাবার । ভিজে ওঠা বুক নিয়ে সারা বিকেল বাবা কাঁদলেন।

পরের দিন বাবার মৃত্যু হয় সাপের বিষে। মনে হল আমি অন্য এক 'মনসামঙ্গল' রচনা করি। পুত্র হয়ে পিতার লাশ ভাসায়ে নিয়ে যাই অন্যলোকে। বেহুলাসমান মদির নাচে দেবালোক মত্ত করে ফিরিয়ে আনি পিতার জীবন। তারপর বহুকাল স্বপ্নে আমি দেখতে থাকি নিজের বেহুলা বেশ। ময়ূর পেখম সাজে আমার এক অতি অপরূপ রূপ।

সারা আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। যেন মেঘের আভাসে আমার ঘরজুড়ে ময়ূর নৃত্যের আরেক আয়োজন চলছে। যেন কোনদিন এই রাত আর ভোর হবে না যদি না আবার আমি তাণ্ডবসমান নেচে উঠি। যদি না ময়ূর পেখমে আরও একবার সাজি। কিন্তু এই রোগাক্রান্ত, পাহীন নিশ্চল দেহ কোন উপায়ে নাচতে পারে মেঘের সাথে? এই এতোকালের পঙ্গুত্ব যেন বৃষ্টির গন্ধে নতুন করে আবার দুর্বিসহ হয়ে উঠল।

যেদিন পা হারালাম সেদিন ছিল আমার নিজের রচনা করা একক নৃত্যনাট্য 'অন্য বেহুলা'র প্রথম সন্ধ্যা। আষাঢ় মাস। বৃষ্টির এক একটা ভারী ফোঁটা এসে জানালায় বিঁধছিল তীরের মতোন। বেহুলা সেজে বসে আছি। বাবার কথা মনে পড়ছিল খুব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম নৃত্য ভঙিমায়। বন্ধ চোখ। বাবার সেই কান্নার দৃশ্য মনে করতেই বন্ধ চোখ আমার ভিজে গেল।

আয়নার ওপাশে কেউ একজন ছিলেন। মানুষ , দেবতা নয়তো অসুর। তিনিই হয়তো চাইছিলেন না পুরুষের বেশে বেহুলার অমন প্রত্যাবর্তন। 'অন্য বেহুলা' তিনি হতে দেন নি।

সেই ভরা বর্ষার বিষাদ বিকেল। আমার বাবার মতোন করে আকাশ কাঁদছিল।
আকাশ পৃথিবীর ছাদ। না পুরুষ , না নারী।
আহত, পঙ্গু সন্তানকে পড়ে থাকতে দেখে পৃথিবীর পিতৃত্ব আকাশসমান কেঁদে উঠল।
পিতার অবুঝ কোমল মন। না পুরুষ, না নারী।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:২৫
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×