বলা যায়,খুব প্রাচীন কাল থেকে মানুষের সাহিত্যের মূল প্রকাশভঙ্গী ছিল কাব্য।লেখালেখি আবিস্কার না হওয়া,লেখালেখি আবিষ্কারের পরেও উপাদানসমূহ সহজলভ্য না হওয়া এবং সহজেই স্মরনশক্তিতে গেথে রাখার সুবিধার্থে কাব্যই ছিল প্রথমদিকের সাহিত্য চর্চার মাধ্যম।দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রীস অনেক এগিয়ে ছিল এটা মোটামুটি সহজে বলা যায়, তেমনি সাহিত্যও তারা পিছিয়ে ছিল না।আর সাহিত্যগুলোর মূল উপাদান ছিল লোকেমুখে চলে আসা মিথগুলোই।মিথগুলোর ঐতিহাসিক সত্যতা নেই বললেই চলে,এমনকি প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শনও মিথগুলোকে কোন সত্যতা দিচ্ছে না।তারপরও কোন কোন ঐতিহাসিকের ধারণা মিথের নায়করা হয়তো ছিল কিন্তু সাহিত্যের চিরন্তর প্রকাশভঙ্গি নায়ককে অতি নায়কোচিত করা,কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের দেবতা এসব উপাধি দিয়ে লোকমুখে প্রচারিত করে দেওয়া।যার কারণে হয়তো আমরা তাদের স্বরূপ উদঘাটন করতে পারছিনা।এরকম দশজন গ্রীক পৌরাণিকের বীরযোদ্ধা নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
প্রমিথিউসঃ
প্রমিথিউস ছিলেন গ্রীক পুরানের মানবপ্রেমিক টাইটান (গ্রিক দেববংশ ও মানবজাতির পূর্বপুরুষ)।দেবতা ও টাইটানেরা তাঁকে দূরদর্শী প্রমিথিউস নামে ডাকতেন।প্রমিথিউস সবার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।কিন্তু দেবরাজ জিউস তাঁকে হিংসা করতেন।দূরদর্শী ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা প্রমিথিউস জানতে পারেন দেবরাজ জিউস পৃথিবী থেকে মানবজাতিকে নিমূর্ল করে সেখানে অন্য জীব সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।তিনি মানবজাতিকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন এবং তাদের সাবলম্বী করে তোলার জন্য গ্রিক ও রোমান পুরাণের সবচেয়ে সুদর্শন দেবতা এ্যাপোলো এর স্বর্গের অগ্নিরথ থেকে আগুন চুরি করে নিয়ে মানুষকে দিয়ে আসেন এবং আগুনের ব্যবহার শিখিয়ে দেন।আগুনের ব্যবহার শিক্ষার ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।এতে জিউস প্রমিথিউসের উপর ক্ষিপ্ত হন এবং তাকে শাস্তির বিধান অনুযারী প্রমিথিউসকে ককেশাসের নির্জন চূড়ায় শক্ত শৃঙ্খল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় এবং প্রতিদিন জিউসের ঈগল এসে তার হৃদয় ঠুকরে ঠুকরে খাওয়া শুরু করেতো।এভাবে কয়েকশো বছর চলার পর গ্রিক পুরাণের শ্রেষ্ঠ বীর হার্কিউলিস জিউসের ঈগলকে বধ করে প্রমিথিউসকে ব্রজশৃঙ্খলমুক্ত করেন।প্রমিথিউসের কাহিনী নিয়ে ইংরেজ কবি শেলির কাব্যনাট্য (Prometheus Unbound)বা ’শৃঙ্লমুক্ত প্রমিথিউস’রচিত হয়।
হারকিউলিসঃ
গ্রীক পুরাণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর হারকিউলিস।দেবরাজ জিউস এবং অ্যাকমিনের সন্তান হারকিউলিস।কিন্তু জিউসের স্ত্রী দেবী হেরা হারকিউলিস এভাবে বীর হিসাবে পরিচিতি পাওয়া এবং দেবতা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া সহ্য হয়নি।তাই কৌশলে তাকে দিয়ে তার স্ত্রী সন্তানকে হত্যা করান এবং পাগল বানিয়ে দেন।পরে দেবতারা তাকে এ অবস্থায় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১২টি কঠিন কাজ দেয়।যেগুলো এক এক করে হারকিউলিস সম্পন্ন করে।সে বন্দি প্রমিথিউসকে উদ্ধার করে।উত্তর পূর্ব আকাশে কিরাট মন্ডল এবং ভেগার মাঝখানে তৃতীয় শ্রেণীর কতগুলো উজ্জ্বল তারা দিয়ে একটি মানুষ কল্পনা করা যায়।গ্রীস জ্যোতির্বিদরা এই মন্ডলের নাম দেন হারকিউলিস মন্ডল।
একিলিসঃ
গ্রিক পুরানের দুর্ভেদ্য বীর একিলিস।কথিত আছে,তার শিশু অবস্থায় তার মা তাকে স্টীক্স নদীতে পানিতে ডুবিয়ে ধরলেন শুধু একটা পায়ের গোড়ালী তার হাতে রেখে।যার কারণে খুব অল্প বয়সে তিনি এক দুর্ভেদ্য যোদ্ধা হয়ে উঠেন কিন্তু তার পায়ের গোড়ালী তার দুবর্ল স্থান হিসাবে রয়ে যায়।ট্রজান যুদ্ধে তিনি অসাধারণ যুদ্ধ করেন এবং তার হাতে নিহত হয় গ্রিক পুরাণের আরেকবীর ট্রোজান রাজার বড় পুত্র হেক্টর ।যে যুদ্ধেই তিনি ট্রোজান রাজার ছোট পুত্র প্যারিসের তীরে বিদ্ধ হয়ে মারা যান।প্যারিস জানতেন একিলিসের দূর্বল স্থান তার পায়ের গোড়ালী।তিনি সে বরাবর তীর নিক্ষেপ করেন আর রক্তপাতে একিলিস মৃত্যুর কোলে ডলে পড়েন।সেই থেকে মানুষের দূর্বল স্থান 'একিলিস হিল ' নামে প্রবাদে পরিণত হয়।
হেক্টরঃ
ট্রোজান রাজার বড় পুত্র হেক্টর ছিলেন গ্রীক পুরাণের আরেক বীরযোদ্ধা।ট্রোজান যুদ্ধে ট্রয়ের সেনাপতি।হোমারের ইলিয়াডে হেক্টরের এই মৃত্যুকে তার ভাগ্য বলে অবিহিত করেন।বীরদর্পে লড়ে যাওয়া হেক্টরের একসময় মনে হয়ে ভাগ্য তার প্রতি সুপ্রসন্ন নয়।শেষ পযর্ন্ত একিলিউসের হাতে তার মৃত্যু ঘটে।
জ্যাসনঃ
গ্রীক পুরাণে আরেকবীর জ্যাসন।উত্তরাধিকার সূত্রে যে রাজত্ব জ্যাসন পাওয়ার কথা তা তার চাচা পেলিস নিয়ে নেয়।তবে পেলিস কথা দেয়, সে যদি পঞ্চাশ জন সোনালী পশমে আবৃত বীরের প্রধান হয়ে ফিরতে পারে তবে তাকে তার রাজত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে।বহু দূরে বিপদ সংকুল পথ অতিক্রম করে তাকে এই সোনালী পশম সংগ্রহ করতে হয়।এই বিপদসংকুল পথে সে এবং তার অধিনস্থ যোদ্ধাদের সম্মুখীন হতে হয় মৃত্যু সাইরেনের।তার স্ত্রী মিডার সহযোগিতায় সে এই বিপদ থেকে রক্ষা পায় এবং সে সোনালী পশম আয়ত্ত্বে আনে।
ওডেসাসঃ
ইথাকার রাজা এবং বীর যোদ্ধা।ট্রোজান যুদ্ধে জয়ী হতে গ্রিকদের সহযোগিতা করে।সুমুদ্র পথে ফিরতে গিয়ে তাকে সম্মুখীন হতে অনেক সামুদ্রিক দত্যদের।এতে তার দেশ ইথাকা এবং তার স্ত্রী পেনেলোপ এর কাছে পৌঁছতে তার দশ বছর লেগে যায়।
পারসিয়াসঃ
দেবরাজ জিউস এবং ডানা’র সন্তান পারসিয়াস।বুদ্ধিমত্তা ও বীরযোদ্ধা হিসাবে পৌরাণিকভাবে খ্যাত পারসিয়াম।অপূর্ব সুন্দরী অ্যান্ড্রোমিডাকে দেবরাজ জুপিটারের স্ত্রী জুনোর আক্রোসে সামুদ্রিক দত্যদের উৎসর্গ করার জন্য সমুদ্রের পাশে একটি পাথরে বেঁধে রাখে ।অসহায় অ্যান্ড্রোমিডাকে পারসিয়াম রক্ষা করেন সামুদ্রিক দত্যদের হাত থেকে।পূর্ব-উত্তর দিকে একই সরল রেখায় কয়েকটি তারাকে অ্যান্ড্রোমিডা হিসাবে ধরে এটাকে এন্ড্রোমিডা অঞ্চল হিসাবে চিহিৃত করা হয়।উত্তর আকাশে আরিগা মন্ডল এবং পশ্চিম আকাশে অ্যান্ড্রোমিডা মন্ডলের মাঝখানে একসঙ্গে কতগুলো তারা চোখে পড়ে দেখতে অনেক ইংরেজী (A) এর মত।এটি পারসিয়াস মন্ডল।
অ্যানিয়াসঃ
অ্যানিয়াস গ্রীক এবং রোমান দুই পুরাণে অন্যতম গুরত্বপূর্ণ নায়ক।পুরাণ মতে, তিনি রোম সিটির প্রতিষ্ঠাতা।তিনি ট্রয়ের পক্ষে যুদ্ধের জন্য আসেন।কিন্তু তিনি যখন দেখলেন গ্রীক যুদ্ধ নয় শান্তি চায়,তখন তিনি যুদ্ধ না করে ফিরে গেলেন এবং রোম শহর প্রতিষ্ঠা করেন।
অরপেয়াসঃ
ক্যালিপো এবং এ্যাপোলোর সন্তান।একজন দক্ষ সুরকার।মুহুর্তের মধ্যে তিনি পশু পাখি এমনকি প্রবাহমান নদী তার সুরে মোহিত করে ফেলতেন।যখন তার স্ত্রী ইউরিডিস মারা যান,তিনি পাতালে চলে যান তাকে খোঁজার জন্য।সেখানে তার যাদুতে মুগ্ধ হয় পাতালের প্রধান।তিনি ইউরিডিসকে এক সত্ত্বে আবার পৃথিবীতে আসার অনুমতি দেন যে, অরপেয়াস ইউরিডিসের সামনে থাকবে আর আর ইউরিডিস পেছনে থাকবে।পাতাল থেকে বের না হওয়া পযর্ন্ত অরপেয়াস পেছনে তাকাতে পারবেনা।কিন্তু ইউরিডিসকে দেখার জন্য আকুল অরপেয়াস পেছনে তাকায় আর ইউরিডিস চিরকালের জন্য ভ্যানিশ হয়ে যায়।
থেসুয়েসঃ
অত্যাচারী নরখাদক দত্যদের থেসুয়েস হত্যা করে।দত্যগুলো ক্রিট দ্বীপে ল্যাবিরিন্থে বসবাস করতো।প্রতিবছর তাদের জন্য এথেন্সকে চৌদ্দজন যুবককে পাঠাতে হত ।থেসুয়েস তার বুদ্ধিমত্তা এবং বীরত্বের বলে দত্যদের হত্যা করে।থেসুয়েস ছিল এথেন্সের রাজা এগিয়াস এর পুত্র, যিনি সমুদ্র দেবতা পসিডন নামে পরিচিত ছিলেন।পরবর্তীতে থেসুয়েসও এথেন্সের রাজা হয়।
তথ্যসুত্রঃ-নেট ও মোঃ আবদুল জববার এর তারা পরিচিতি।
তথ্য ছবিসূত্রঃ-নেট।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ দুপুর ২:০০