somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি চলচ্চিত্র সমালোচনার প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে

২৪ শে জুন, ২০১০ রাত ১১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত ৬ মার্চ ২০১০ তারিখে 'দৈনিক সমকাল'-এ 'থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার' চলচ্চিত্রটির ওপর আমার লেখা একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। ঠিক এক মাস পর একই সংবাদপত্রে আমার সমালোচনাটি সম্পর্কে একটি প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়; লেখক একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, নাম রাজীব মহাজন। সংবাদপত্রে কোন লেখার প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হওয়া একটি স্বাভাবিক এবং সমর্থনযোগ্য ব্যাপার; আমিও আগ্রহ নিয়ে প্রতিক্রিয়াটি পড়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু গভীরভাবে বিস্মিত হলাম লেখাটির মধ্যে একের পর এক খুবই বড় বড় ভুল দেখে। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন বিষয়ে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, আর সেই লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশের প্রথম সারির একটি দৈনিক পত্রিকায়, অথচ সেই লেখার মধ্যে এতগুলি গুরুতর ভুল দেখে তাজ্জব না হয়ে উপায় থাকলো না। অসংখ্য পাঠকের কাছে এই বড় বড় ভুলগুলো পত্রিকার মাধ্যমে পৌঁছে গেল। তাই বাধ্য হয়ে রাজীব মহাজন-এর এই প্রতিক্রিয়ার ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়ার জন্য একটি লেখা তৈরি করে লেখাটি 'দৈনিক সমকাল'-এ পাঠিয়ে দিলাম। আশা ছিল যে আমার লেখাটি প্রকাশিত হলে অন্তত অনেক পাঠক বুঝবেন যে রাজীব মহাজন এর লেখাটি কত বড় ধরনের ভুল তথ্যে ভরা ছিল।

কিন্তু 'দৈনিক সমকাল'-এ যে কোন কারণেই হোক পরবর্তী দুই মাসেও আমার লেখাটি ছাপা হলো না। কেন ছাপা হলো না সেই ব্যাপারে আমাকে কোন কিছু জানানোও হলো না। পাঠকদের স্বার্থে একটি প্রকাশিত লেখার ভুলগুলো নির্দেশ করার পরও যখন সংবাদপত্র লেখাটি প্রকাশ করলো না, তখন আবারো অবাক হলাম। কিন্তু বাংলাদেশের একটি প্রথম সারির সংবাদপত্রে চলচ্চিত্র নিয়ে প্রকাশিত একটি লেখায় এতোগুলি ভুল দেখার পর একজন চলচ্চিত্র গবেষক হিসেবে খারাপ লাগছিলো। তখন আমার পরিচিত কয়েকজন এই ঘটনা শুনে লেখাটি ব্লগে প্রকাশের পরামর্শ দিলেন। ব্লগে এই লেখাটি দেয়ার ব্যাপারে আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, হয়তো অনেক পাঠক, যারা রাজীব মহাজন এর লেখাটি পড়েছিলেন, তাঁদের কাছে আমার এই বক্তব্য কেবল এই ব্লগের মাধ্যমেই আমি পৌঁছে দিতে পারি। রাজীব মহাজন এর কাছেও আমার বক্তব্য আমি কেবল এভাবেই পৌঁছাতে পারি। এছাড়া অন্য পাঠকরা যদি এই লেখার সাথে সংযুক্ত লিংকগুলি থেকে আগের লেখাদুটি এবং আমার এই লেখাটি পড়ে দেখেন, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝবেন যে চলচ্চিত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রেও এখন কতো সহজে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার বহু ভুল-এ ভরা একটি লেখা প্রকাশিত হতে পারে। চলচ্চিত্র যেন আমাদের দেশে এখন এক অতি হালকা বিষয়; অতি সহজে এই বিষয় সম্পর্কে লেখালেখি করা যায়। কিন্তু সেভাবে লিখতে গেলে যে আসলে কী লেখা হয়, তা সচেতন পাঠক ঠিকই বুঝতে পারেন। তবে যারা বুঝছেন না, তাদের বিষয়টি অনুধাবন করা দরকার।

নীচে রাজীব মহাজন-এর প্রতিক্রিয়াটির জবাবে লেখা আমার লেখাটি তুলে দিলাম, যা 'দৈনিক সমকাল'-এ প্রেরণের পরও প্রকাশ করা হয় নি।

চলচ্চিত্র সমালোচনার প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে

নাদির জুনাইদ

'থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার' চলচ্চিত্রটির ওপর 'দৈনিক সমকাল'-এ গত মার্চ মাসে আমি একটি রিভিউ লিখেছিলাম। গত ৬ এপ্রিল ‘আর্ট ফিল্ম না হয়ে কী ক্ষতি হলো’ এই শিরোনামে সেই রিভিউটির একটি প্রতিক্রিয়া 'দৈনিক সমকাল'-এ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদপত্রে কোন লেখার প্রতিক্রিয়া ছাপা হলে আমি তা আগ্রহ নিয়ে পড়ি, কারণ কোন বিষয়ে যৌক্তিকভাবে ভিন্নমত প্রকাশের চর্চাটি অবশ্যই ইতিবাচক ও সমর্থনযোগ্য। কিন্তু প্রতিক্রিয়াটি পড়ে লেখকের বক্তব্য প্রকাশের ভঙ্গি এবং বক্তব্যের মধ্যে একের পর এক ভুলের বহর দেখে খুবই বিস্মিত ও হতাশ হলাম। সংবাদপত্রে প্রকাশিত কোন লেখার মধ্যে এতো ভুল দেখলে সেই ভুলগুলিকে নির্দেশ করা জরুরি হয়ে পড়ে, কারণ অসংখ্য পাঠকের কাছে ভুল তথ্য উপস্থাপিত হোক তা কখনোই কাম্য নয়। তবে এই প্রতিক্রিয়ায় বক্তব্য ও তথ্য প্রদানে ভুলগুলো এতোই প্রকট যে তা বুঝতে বেশির ভাগ পাঠকেরই যে কোন সমস্যা হয়নি সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ নেই।

প্রতিক্রিয়ার লেখক রাজীব মহাজন-এর লেখায় আর্ট সিনেমার প্রতি তার অপছন্দ ফুটে উঠেছে; তিনি ‘অত্যুর’ ছবির কথা বলছেন, ইনডিপেনডেন্ট ছবিকে অত্যুর ছবি হিসেবেও বিবেচনা করা হয় তা বলছেন অথচ প্রশ্ন তুলছেন আর্ট সিনেমা কাকে বলে। চলচ্চিত্রের ইতিহাস সংক্রান্ত যে কোন বই খুললেই রাজীব মহাজন আর্ট সিনেমা কাকে বলে আর আর্ট সিনেমাকেই যে অত্যুর ছবি বলা হয় সেই তথ্যটি জানতে পারবেন। ক্রিস্টিন থম্পসন এবং ডেভিড বর্ডওয়েল লিখিত ‘ফিল্ম হিস্টরি: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন’ বইয়ের উনিশ তম অধ্যায়টির নাম ‘আর্ট সিনেমা অ্যান্ড দ্য আইডিয়া অফ অথরশিপ’; এই অধ্যায়টি পাঠ করলে রাজীব মহাজন আর্ট সিনেমা আর তার উল্লেখ করা ‘অত্যুর’ ছবি যে একই বিষয় তা বুঝতে পারবেন। তিনি আরো বলেছেন যে ‘ইন্ডি’ বা ইনডিপেনডেন্ট ছবিকে ‘অত্যুর ছবি’ ও বলা হয়। ঠিক কথা। তবে চলচ্চিত্র বিষয়ে বই যোগাড় কষ্টসাধ্য হলে তিনি যদি শুধু একবার অনলাইনে যেয়ে উইকিপিডিয়া সাইটে ‘ইন্ডি’ ছবি বিষয়ে যা লেখা আছে তা পড়েন, তাহলে তিনি দেখবেন যে সেখানে লেখা আছে ‘ইন্ডি’ ছবিকে ‘আর্ট ফিল্ম’ হিসেবেও বর্ণনা করা হয়। রাজীব মহাজন অত্যুর ছবি আর ইন্ডি ছবির কথা বলছেন, অথচ এই ধরনের ছবি যে ‘আর্ট সিনেমা’ ধারার ছবি এই সাধারণ তথ্যটি কেন জানেন নি তা বোধগম্য হলো না।

রাজীব মহাজন তার লেখায় আরো বলেছেন আর্ট কবিতা, আর্ট নাটক, আর্ট সঙ্গীত বা আর্ট পেইন্টিং কেন বলা হয় না। চলচ্চিত্রে ‘আর্ট ফিল্ম’ বলতে কোন্ ধরনের চলচ্চিত্রকে বোঝানো হয়, এবং তার সাথে অন্য ধরনের চলচ্চিত্রের পার্থক্য কী সে সম্পর্কে লেখকের পর্যাপ্ত ধারণা থাকলে লেখক নিশ্চয়ই এই প্রশ্নটি করতেন না। এই লেখককে কী এই সহজ তথ্যটিও জানাতে হবে যে কবিতা, নাটক, সঙ্গীত, চিত্রকলার মতো চলচ্চিত্রও একটি শিল্পমাধ্যম, কিন্তু চলচ্চিত্রকে বাণিজ্যিক লাভের উদ্দেশ্যে যতোখানি ব্যবহার করা হয় অন্য আর কোন শিল্পমাধ্যমকে মুনাফা লাভের জন্য ততোখানি ব্যবহার করা হয় না। আর কেবলমাত্র বাণিজ্যিক লাভের উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে তৈরি করা গতানুগতিক, বিনোদন-নির্ভর চলচ্চিত্রের সাথে সের্গেই আইজেনস্টাইন-এর দ্য ব্যাটলশিপ পোটেমকিন, ভিত্তোরিও ডি সিকা’র বাইসাইকেল থীভ্স্, সত্যজিৎ রায়-এর পথের পাঁচালী, ইংমার বার্গম্যান-এর দ্য সেভেন্থ সীল, আকিরা কুরোশাওয়া’র রশোমন এর মতো চলচ্চিত্রের বিশাল ভিন্নতার কারণেই এই চলচ্চিত্রগুলিকে ভিন্ন নামে অভিহিত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই চলচ্চিত্র অধ্যয়নে ‘আর্ট সিনেমা’ নামে একটি স্বতন্ত্র ধারার চলচ্চিত্রের নামকরণ করা হয়েছে। গভীর চিন্তাসমৃদ্ধ, সৃজনশীল নির্মাণশৈলী নির্ভর, বক্তব্যধর্মী, সামাজিক দায়িত্ব সচেতন এবং অবাণিজ্যিক চলচ্চিত্রসমূহকে ‘আর্ট সিনেমা’ নামে অভিহিত করা হয়। চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা এবং পরিচালকের সৃষ্টিশীলতা ‘আর্ট সিনেমা’র গুরুত্বপূর্ণ দিক আর এই ধরনের চলচ্চিত্রসমূহ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত কেবলই বিনোদন যোগানো চলচ্চিত্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

সত্যজিৎ রায়-এর বিখ্যাত ছবি কাঞ্চনজঙ্ঘা কে রাজীব মহাজন বর্ণনা করেছেন ‘শহুরে কিছু ভোগবাদী মধ্যবিত্তকে কেন্দ্র করে ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রতিভূ একটি ছবি’ হিসেবে। সত্যিই তাজ্জব হয়ে গেলাম এই বর্ণনা পড়ে। রাজীব মহাজন কী আদৌ কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিটি দেখেছেন? কিংবা ‘ভোগবাদী সংস্কৃতি’ কথাটির অর্থই কী তিনি বোঝেন? যে ছবিকে ১৯৭২ সালে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ ম্যাগাজিন এ দেয়া সাক্ষাতকারে সত্যজিৎ রায় নিজে বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘পরবর্তীকালের অধিকতর রাজনৈতিক চলচ্চিত্রসমূহের পথপ্রদর্শক’ হিসেবে, সেই ছবিকে যে ব্যক্তি ‘ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রতিভূ’ বলে আখ্যায়িত করতে পারেন, তিনি যে একটি চলচ্চিত্রের অর্থ বুঝতে সম্পূর্ণ অক্ষম তা বুঝতে আর সমস্যা হয় না। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে আমরা দেখি রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথ চৌধুরীকে যিনি স্বাধীন ভারতে পাঁচটি কোম্পানীর চেয়ারম্যান। তার বৃটিশপ্রীতি প্রবল এবং বৃটিশবিরোধী আন্দোলনকে তিনি বর্ণনা করেন ‘সাহেব ঠ্যাঙ্গানোর হিড়িক’ হিসেবে। নিজের বন্ধুদের মতো বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেননি বলে তিনি আনন্দিত, কারণ তা হলে তাকে হয় মারা যেতে হতো না হলে জেলে পচতে হতো। এমন একটি চরিত্রের স্থূলতা ও ভোগবাদসর্বস্বতা সত্যজিৎ স্পষ্ট করে তোলেন একটি দৃশ্যের মাধ্যমে যখন একটি সুরেলা কন্ঠের পাখির ছবি দেখে ইন্দ্রনাথ বলেন যে এই পাখি রোস্ট করে খাওয়া না গেলে তার এই পাখিতে কোন আগ্রহ নেই।

ছবির শেষে বেকার তরুণ অশোক যার একটি চাকুরীর খুবই দরকার সে ইন্দ্রনাথ চৌধুরী’র দেয়া খুব ভাল চাকুরীর প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে কারণ ইন্দ্রনাথের নেতিবাচক মানসিকতা বুঝতে তার দেরী হয় না। তার এই প্রত্যাখ্যানে হতবাক হয়ে ওঠেন ইন্দ্রনাথ, আর ক্ষমতাশালী ইন্দ্রনাথকে নিজের মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পেরে উল্লসিত হয়ে ওঠে দরিদ্র অশোক। ছবিতে ইন্দ্রনাথের অন্যায় মানসিকতাকে তার স্ত্রী ও ছোটমেয়েও মেনে নেয় না, যা ছবির অন্যতম মূল বক্তব্য হিসেবেও দেখানো হয়। আর ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দৃশ্য আর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভোগবাদিতা, সুবিধাবাদিতা, কর্তৃত্ববাদী আর অদেশপ্রেমিক আচরণ আর স্থূলতার তীব্র সমালোচনা উপস্থাপন করেন সত্যজিৎ। আর এই ছবিতে কেবল একটি শহুরে পরিবারের চরিত্রদের দেখেই রাজীব মহাজন ভেবে নিলেন যে এটি ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রতিভূ চলচ্চিত্র। ছবির মূল বক্তব্য বিন্দু পরিমাণ বুঝতে পারলেও এমন হাস্যকর রকমের ভুল মন্তব্য তিনি করতেন না।

তার ভুল মন্তব্যের আরেকটি নমুনা দেখা গেল যখন তিনি বললেন যে ইরানের বিখ্যাত আর্ট ছবি নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে আর্ট ফিল্ম নির্মাতা বলা হলে তিনি নাকী হার্টফেল করবেন। আর্ট ছবির বৈশিষ্ট্য কী, আর্ট ছবি নির্মাতা কারা এবং আব্বাস কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্র সম্পর্কে রাজীব মহাজন এর কোন ধারণা নেই বলেই তিনি এমন উদ্ভট মন্তব্য করতে পেরেছেন। আব্বাস কিয়ারোস্তামি ইরানী নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র ধারার অন্যতম পরিচালক, এবং এই ইরানী নিউ ওয়েভ ধারা সম্পর্কে মেহেরনাজ সাইদ-ভাফা এবং জোনাথন রসেনবাম লিখিত ‘আব্বাস কিয়ারোস্তামি’ বইয়ের ৫৫ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘আব্বাস কিয়ারোস্তামি ১৯৬০ এর দশকে কাজ শুরু করা এবং ১৯৭০ এর দশকে সমৃদ্ধি অর্জন করা সেই প্রজন্মের পরিচালকদের একজন যারা একধরনের ‘আর্টিস্টিক’ ও সমাজ-সচেতন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে ইরানী নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র হিসেবে আখ্যায়িত হয়’। এই বইটি যোগাড় করতে রাজীব মহাজনের সমস্যা হলে তিনি অনলাইনে যেয়ে অতি সহজে দেখে নিতে পারেন উইকিপিডিয়াতে ইরানী নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে এই ধারার প্রবর্তক চলচ্চিত্রকাররা নির্মাণ করেছেন সৃজনশীল আর্ট ফিল্ম যার মধ্যে দেখা যায় রাজনৈতিক ও দার্শনিক বক্তব্যের ঝোঁক এবং কাব্যিক ভাষার ব্যবহার। এবং এই নিউ ওয়েভ ধারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকদের নাম উল্লেখ করার সময় সবচেয়ে প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে আব্বাস কিয়ারোস্তামির নাম। কিয়ারোস্তামি’র বিখ্যাত ছবিগুলি যেমন ‘টেস্ট অফ চেরি’, ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস’ সম্পূর্ণভাবেই বিভিন্ন জটিল দার্শনিক, কাব্যিক এবং রাজনৈতিক উপাদানকে বহন করে যা আর্ট ফিল্ম এর বৈশিষ্ট্য। আর আব্বাস কিয়ারোস্তামি সম্পর্কে রাজীব মহাজন-এর এই অতি-হাস্যকর মন্তব্যই প্রমাণ করে যে কিয়ারোস্তামি’র কাজের প্রকৃতি এবং ইরানের নতুন চলচ্চিত্র ধারার স্বরূপ সম্পর্কে তার আদৌ কোন ধারণা নেই। থাকলে কিয়ারোস্তামি সম্পর্কে এমন একটি মন্তব্য তিনি কোনভাবেই করতে পারতেন না।

রাজীব মহাজন তার লেখায় গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন জার্মান চলচ্চিত্রকার ভিম ভেন্ডারস্ এর নাম। ভিম ভেন্ডারস্ ‘নতুন জার্মান সিনেমা’ ধারার একজন অন্যতম পরিচালক, যে ধারার অন্য বিখ্যাত পরিচালকরা হলেন ফাসবিন্ডার, হারজগ, ক্লুজে, শ্লোনডর্ফ এবং সিবারবার্গ। এই পরিচালকরা জার্মানির তৎকালীন বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রকে প্রত্যাখ্যান করে শৈল্পিক উৎকর্ষকে প্রাধান্য দিয়ে একটি নতুন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়েছিলেন, এবং তাদের ছবি জার্মানির বাইরে মূলত আর্ট ফিল্মের দর্শকদের কাছেই সমাদৃত হয়েছিল। চলচ্চিত্রের নান্দনিক দিককে গুরুত্ব দেয়া এবং সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতির সমালোচনা তুলে ধরা ছিল এই পরিচালকদের কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভিম ভেন্ডারস্ সহ জার্মান নতুন সিনেমা ধারার অন্য পরিচালকরা আগ্রহের সাথে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন মার্কিন আর্ট সিনেমা ধারার বিভিন্ন চলচ্চিত্রকার ফ্রানসিস ফোর্ড কপোলা, হ্যাল অ্যাশবি, স্টিভেন স্পিলবার্গ, মার্টিন স্করসেসী, পিটার বোগদানোভিচ এর কাজ। আর ফারুকী তার নতুন ছবি কোন আর্ট ফিল্ম নয় তা বলেছেন এই কথাটির প্রসঙ্গে ভিম ভেন্ডারস্ কেন ‘ইমোশন পিকচার’ কথাটি ব্যবহার করেছেন, রাজীব মহাজন সেই প্রশ্নটি করেছেন। তার জানার জন্য বলি ভিম ভেন্ডারস্ ‘মোশন পিকচার’ আর ‘ইমোশন পিকচার’ কথাদুটিকে কাছাকাছি অর্থের হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। ১৯৭৬ সালে জ্যান ডসনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে নিজের চলচ্চিত্রে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া এবং বিভিন্ন যানবাহন নিয়মিত দেখানোর পাশাপাশি মূল চরিত্রগুলির একধরনের নিশ্চলতা দেখানোর প্রসঙ্গে ভিম ভেন্ডারস্ বলেছিলেন তিনি গতি আর আবেগের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সংযোগটি সবসময়ই পছন্দ করেন এবং কখনো তিনি এমনটাও ভাবেন যে তার ছবিতে ইমোশন বা আবেগ মূলত তৈরি হয় ছবিতে গতি বা মোশন দেখাবার মধ্য দিয়ে। কাজেই ভিম ভেন্ডারস্-এর এই বক্তব্য অনুযায়ী মোশন আর ইমোশন কাছাকাছি শব্দ, তিনি দুটি বিষয়ের ঘনিষ্ঠতা নির্দেশ করছেন। কিন্তু ফারুকী বলেই দিয়েছেন যে তার ছবি ‘আর্ট ফিল্ম’ নয়, তা ‘হার্ট ফিল্ম’। আমরা আর্ট ফিল্ম কী তা জানি, আর ফারুকীর ‘হার্ট ফিল্ম’ আর্ট ফিল্ম থেকে কতোটা ভিন্ন তা তার এই নতুন ছবি নিয়ে আমার করা রিভিউতেই আমি আলোচনা করেছি। ভিম ভেন্ডারস্-এর লেখা একটি বইয়ের নামও ‘ইমোশন পিকচার্স: রিফ্লেকশনস্ অন দ্য সিনেমা’। এই বইতেও ভেন্ডারস্ শব্দদুটিকে কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার করেছেন।

রাজীব মহাজন লিখেছেন ফারুকীর এই চলচ্চিত্রটি নাকী ‘একা মেয়ের সমস্যা ও সংকটবিষয়ক’ কোন কাজ নয়। অথচ এই ছবি দেশে মুক্তি পাবার আগে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই ছবির কাহিনী সম্পর্কে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে যে এই ছবিতে আমাদের সমাজে একজন অবিবাহিত নারীর সমস্যাকেই দেখানো হয়েছে। এমনকী রাজীব মহাজন যে উৎসাহ নিয়ে রটারডাম চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবির অংশ নেয়ার কথা বললেন, সেই রটারডাম উৎসবের ওয়েবসাইটে এবং ‘ভ্যারাইটি’ ম্যাগাজিনের রিভিউতেও তো এই ছবির কাহিনী বর্ণনায় লেখা হয়েছে এই ছবি কীভা্বে একজন একা নারীর সমস্যাকে তুলে ধরছে সেই কথা। রাজীব মহাজন কী তার পছন্দের এই ছবি সম্পর্কে সেই বর্ণনাগুলি পড়েননি? আর একজন অবিবাহিত নারীর বাড়ি ভাড়া পাওয়ার সমস্যা আর বাজে স্বভাবের পুরুষের একা নারীর প্রতি বাজে আচরণ তো অবশ্যই সহজে অনুমান করা যায় এমনই বিষয়; আমাদের সমাজে তো অবিবাহিত পুরুষদেরও বাড়ি ভাড়া পেতে সমস্যা হয়। আর সমাজে একা নারীর কী কী জটিলতর সমস্যা দেখানো যেতো তা একজন সচেতন চলচ্চিত্রকারকে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে নিজেকেই বুঝে নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে; এই ব্যাপারে অন্য কারো তো তাকে বলে দেয়ার দায়বদ্ধতা নেই।

রাজীব মহাজন ফারুকীর এই ছবির স্থূল হাস্যরসের সমালোচনাও পছন্দ করেননি। সিরিয়াস ছবিকে গম্ভীর হতে হবে এমন কোন কথা নেই, কিন্তু চলচ্চিত্রে হিউমার-এর নামে স্থূলতা দেখানো হলে তা কেবল ছবির মানকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাজীব মহাজন কী সত্যজিৎ রায় এর ‘হীরক রাজার দেশে’, আকিরা কুরোশাওয়ার ‘সেভেন সামুরাই’ বা চার্লি চ্যাপলিন, ঋত্বিক ঘটক, আলফ্রেড হিচকক কিংবা মার্কিনী ইন্ডি পরিচালক জিম জারমুশ-এর বিভিন্ন ছবি দেখেছেন? তাহলে তিনি বুঝবেন হিউমার এর মধ্য দিয়েও কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছবি তৈরি হতে পারে, এবং সেই হিউমার দীর্ঘসময় ধরে কনডম কেনার দৃশ্য দেখানোর মতো স্থূল হাস্যরসের কোন দৃশ্য নয়, যেমন স্থূল দৃশ্য আমরা দেখেছি ফারুকীর এই ছবিতে।

রাজীব মহাজন উল্লেখ করেছেন যে এই ছবিটি দেশের বাইরে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু সেই সব উৎসবে অংশ নিয়ে ছবিটি এখন পর্যন্ত কোন পুরষ্কার অর্জন করেছে সে কথা শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। এই ধরনের উৎসবে বিভিন্ন দেশের অনেক ছবিই অংশ নেয়, কিন্তু সেই সব ছবিই যে সুনির্মিত এবং সমালোচনার উর্দ্ধে এমন মনে করার কিন্তু কোন কারণ নেই। তিনি আরো বলেছেন যে ‘ভ্যারাইটি’ ম্যাগাজিন নাকী ছবির সিনেমাটোগ্রাফির প্রশংসায় এক প্যারা বরাদ্দ করেছে। কিন্তু আসলে সেখানে এই ছবির ক্যামেরার কাজের প্রশংসা করে লেখা হয়েছে কেবল একটি বাক্য, একাধিক বাক্য নয়। আর সেই রিভিউতে যে এই ছবির সমালোচনাও করা হয়েছে তা কী রাজীব মহাজনের চোখে পড়েনি? আমার রিভিউতেও আমি এই ছবির একটি ভাল সিকোয়েন্সের প্রশংসা করেছি; ভাল সিকোয়েন্স ছবিতে আরো থাকলে তার প্রশংসাও নিশ্চয়ই করা হতো। আর বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা যুক্তি দিয়ে চলচ্চিত্রের সমালোচনা করেই থাকেন। তার জন্য এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে তারা সেই ছবিকে গালি দিচ্ছেন। আমার লেখা রাজীব মহাজন এর বক্তব্য মতো ‘যুক্তিহীন ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ফিরিস্তি’ হয়নি; আমার লেখায় আমি কেন এই ছবির বিভিন্ন দিককে দুর্বল মনে করেছি তা যুক্তি দিয়েই উপস্থাপন করেছি। কিন্তু সেই যুক্তি যে রাজীব মহাজন-এর বোধগম্য হয়নি তা তার লেখার একের পর এক ভুল মন্তব্য দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এবং তার লেখাতেই যে যুক্তির জোর নেই তাও স্পষ্ট কারণ তিনি আমার রিভিউটিতে এই ছবির সমালোচনা থাকার কারণে খুবই আপত্তিকর ভাবে মন্তব্য করেছেন যে আমি গালি দেয়ার উদ্দেশ্যে ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম। এই মন্তব্য এবং সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য দেয়া তার এই লেখায় ছবির পরিচালককে ‘ফারুকী ভাই’ হিসেবে সম্বোধন করার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয় যে তার এই লেখাতে যুক্তি কোনভাবেই গুরুত্ব পায়নি, বরং এই ছবির পরিচালকের প্রতি তার ব্যক্তিগত পছন্দ এবং এই ছবির যুক্তিনির্ভর সমালোচনার প্রতি ক্ষোভ আর অসহিষ্ণুতাই তার এই প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আর পুরো লেখাটিতে একের পর এক ভুল তথ্য চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তার ধারণার ব্যাপক ঘাটতিকেই পাঠকদের কাছে স্পষ্ট করে তুলেছে। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ভালভাবে না জেনে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি করতে গেলে যে সেই লেখা এমনই ভুলে ভরা হবে তা এই লেখকের অনুধাবন করা উচিৎ ছিল।

নাদির জুনাইদ: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।












১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×