ভ্রাতৃত্ব-বোধ বিবেকবোধ মমত্ববোধ-হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে নিত্য-সমাজপতিদের নোংরা প্রভুত্বের লড়াইয়ে!-মনুষ্যত্বহীন হয়ে একভাই আরেক ভাইকে-করে দিচ্ছে দা'য়ের কোপে ক্ষতবিক্ষত!
সমাজপতিদের প্রভুত্বের লড়াইয়ে বলি হচ্ছে পরিবার সমাজ দেশ। মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ভ্রাতৃত্ব-বোধ। বিবেকবান লোকের অভাব প্রতিটি সমাজে বেড়েই চলেছে। এখন আর মানুষের মনে মানুষকে দেখে মমতার জন্ম হয় না। আজকের প্রতিটি সমাজে সামাজিকতা বলতে সমাজপতির শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার মনুষ্যত্বহীন অপচেষ্টা। পরশ্রীকাতরতা প্রতিটি মানুষের বৈশিষ্ট্যে যোগ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন ব্যাপকভাবে। মানুষসুলভ চিন্তাজগত হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের মন থেকে। মানুষের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। এখন মানুষের মনে পশুত্ব করছে স্থায়ী বসবাস! তাই বুঝি আজকের এমন ঘটনাদি ঘটেই চলেছে....
সুমনের দিনটি আজ ভালোই শুরু হয়েছিল। সুমন শিক্ষিত মানুষ। প্রত্যন্ত হাওড় অঞ্চলে সুমনের বাড়ি। গ্রামের চারিদিক ভাসা পানি। একগ্রাম থেকে অন্য গ্রাম যাতায়াত ব্যবস্থা নৌকা ডিঙি। আয় রোজগার বলতে হয়তো হাওড়ে রোদবৃষ্টি ঝড়ো প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মাছ আহরণ, নয় তো নৌকা চালিয়ে যাত্রী পারাপার। সুমন লেখাপড়া কিছু করেছিল। চাকরিবাকরি কোনটা তার কপালে না জুটলেও সুমন নিরাশ নন কখনওই। বাপের অঢেল সম্পত্তি চার ভাই ভাগ করে নিয়েছে বাবা মারা যাবার পর। বেচাকেনা করে যেটুকু আছে তা থেকে ধান চাষবাস করে সংসারচলা হয়ে যায় তার। সে রোজ নৌকা চালায়। বউ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করেন। ছেলে মেয়ে নিয়ে ভালোই চলছে তার সংসার।
দূরের খ্যাপ নিয়ে গিয়েছিল গতরাতে। সকাল সকাল বাড়িতে পৌঁছেন সুমন। বাড়িতে পৌঁছে ছোটমেয়ের কাছে ভাত চান। মেয়ে বলে আব্বু তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো, আমি খাবার রেড়ি করছি। সুমন হাত ধুয়ে এসে ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ পর টয়লেটে যাওয়া জন্য বদনা হাতে টয়লেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। টয়লেটের কাছাকাছি যেতেই পিছন থেকে মাথায় দা'য়ের বারি মারে তারই বড়ভাই সমির। সুমন মাথা ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সমির তাতেও ক্ষান্ত নন, দা দিয়ে কোপ দেয় ডান পায়ে। হাটুর নিচের মাংস কেটে আলাদা হয়ে যায়, রক্তে ভিজে উঠে মাটি। তাতেও সমিরের রাগ কমে না, বুকের উপর দা-এর গোড়ালি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। সুমন মাটিতে জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে আঘাত হজম করছে। মেয়ের চিল্লাচিল্লি শুনে আসেপাশের লোকজন জড়ো হয়ে যায়। সমির হাতের দা নিয়ে ধীরেধীরে আড়ালে চলে যায়। কোথায় গেছে কেউ জানেনা। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে সুমন। আশেপাশের লোকজন ধরাধরি করি একটা নৌকার ব্যবস্থা করে আহত সুমনকে থানা উপজেলা হাসপাতালে পাঠায়। ডাক্তারবাবুরা আশঙ্কাজনক দেখে সেখান থেকে দ্রুত ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সুমন এখন ময়মনসিংহ হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
সারা গ্রাম ছিছিছি করে ঘৃণা ছড়াচ্ছে বড়ভাই সমিরে প্রতি। খবর গেছে থানায়। থানার বড়বাবু একজন দারোগা দুইজন সিপাই পাঠিয়ে দিয়েছে ঘটনার তদন্ত করার জন্য। দুপুর-প্রায়, ভীষণ রোদ্দুর, গরমে দিশেহারা জনমন। ছাউনিহীন নৌকাযোগে দারোগা বাবু আসলেন সুমনের বাড়িতে। বাড়িতে কেউ নেই, নীরব। দারোগা বাবু ডেকেও কাউকে বের করতে পারছেন না। সুমনের মেয়েটা দাঁড়ানো ছিল উঠনে, পুলিশ দেখে দাদির কাছে ছুটে গেল। সুমনের মা তার নাতিকে বলছে বলে দে বাড়িতে কেউ নেই। দারোগা শুনে রেগে সুমনের মা'কে দোষী করে বলছেন, কেমন মা আপনি নিজের ছেলেদের শাসন করতে পারেননা? বারবার ঘটনার জন্য মা'য়ের দায়িত্বহীনতা বলে যাচ্ছেন দেখে আমি একটু বিরক্ত হয়েই প্রতিবাদ করলাম। বললাম, আপনি শুধুশুধু বৃদ্ধা মহিলাকে দোষারোপ করছেন। বর্তমানে কয়জন ছেলেমেয়ে বাবা-মা'য়ের কথামতো চলে! বাবা'র চোখ রাঙানোই ভয় করেনা আর স্বামী হারা বৃদ্ধা মায়ের কথা কিভাবে শুনবে! আমার কথায় দারোগা বাবু একটু বিরক্ত বোধ করলেও তখনকার মতো মা'কে দোষারোপ বন্ধ করলেন।
ঘটনার সাক্ষী কেউ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক বুঝিয়েও দারোগা বাবু কোন লোককে রাজি করাতে পারলেন না সাক্ষী হতে। পরে দু'একজন মুরুব্বী আসলেন। তারাও কিছু জানেননা বলছেন। তারমধ্য একজন লোক ঘটনার বৃত্তান্ত বর্ণনামতে বলে গেলেন। তারপর সুমনের মা ও মেয়ের কাছে শুনে আরও লোকজন বললো, আজ ঘটনাটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটে গেছে। সুমনের আজ কোন দোষ নেই। সুমনের মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ে। তার বিবরণ (উপরে উল্লেখিত)-থেকে বুঝি-
সকালে ঘুম থেকে ওঠে বাশি হাড়িপাতিল ধুইতে যান টিউবয়েলে। সেখানে কিছুক্ষণ পর সমিরে মেয়েও যায় এবং সুমনের মেয়ের আগেই ধুইতে চায়। তাতেই দুইজনের ঝগড়া বাঁধে। কথা কাটাকাটি শেষে সব ঠিকঠাকই ছিল। সুমনের স্ত্রী স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে রান্না শেষে। সুমন বাড়ি আসার পর ভাত খেয়ে টয়লেটে যাওয়ার সময় সমির অতর্কিত হামলা করে এবং দা দিয়ে কোপায় সুমনকে। সুমনের মা কিছু না বলার কারণ জানতে চাইলে কেঁদে কেঁদে বললেন সেরকমই। তিনি বললেন, বাবা! ছেলেদের বাবা গত হওয়ার পর আমার খবর নেয়ারই কেউ নাই। আমার কথার কোন দাম নাই ছেলেদের কাছে। দুই ছেলে শহরেই থাকে। দুই ছেলে বাড়িতে। বাড়ির পাশে মেয়েটির বিয়ে হয়েছে বলেই মেয়েটা আমাকে দেখভাল করছে। দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে আছি।
দারোগা বাবু কিছুদিন আগেও একবার এই বাড়িতে এসেছিলেন দুই ভাইয়ের কলহের জের ধরে। দারোগা বাবু দুঃখ প্রকাশ করে সাক্ষীদের কাছে যা জানার পরে চলে গেলেন।
সেবার সেই কলহ সামাজিক দরবার করে মিমাংসা হলেও দ্বন্দ্ব শেষ হয়নি দু ভাইয়ের। দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিলই মনে মনে। একভাই আরেক ভাইয়ের প্রতি হিংসা জিইয়ে রেখেছিল। তার জের ধরেই আজকের এই মর্মান্তিক ঘটনা। যে লোক প্রথম দেখেছিল তার কথায় বুঝা যায় সে না চিল্লানি দিলে আজ হয়তো ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের মৃত্যই হতো। যদিও এখনও জখম আশঙ্কাজনক।
ঘটনার রেষারেষি যা বুঝলাম তা হলো গত চেয়ারম্যান নির্বাচন ঘিরে সূত্রপাত। বড়ভাই সমির এক প্রার্থীর সমর্থক অার ছোটভাই সুমন আরেক প্রার্থীর সমর্থক ছিলেন। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের শুরু সেখান থেকেই। সুমনের প্রার্থী চেয়ারম্যান জয়ী হওয়ায় বড়ভাই সমিরের প্রতিহিংসা বেড়ে যায়। সুমনের বউ চাকরি করেন, সুমনও বসে নেই, তাই সংসার ভালো চলে। বড়ভাই দেখে দেখে হিংসায় পুড়ে। সেই হিংসা ক্ষোভ থেকেই এর আগেও তুচ্ছ ঘটনার কেন্দ্র করে তাদের দুই ভাইয়ের ঝগড়া বাঁধে। কিন্তু সমাজের দুই প্রভাবশালীত্ব টিকিয়ে রাখতে তাদের দ্বন্দ্বের শেষ করতে কেউই হয়তো আগ্রহী দেখাননি। যদি সামাজিক ভাবে চাপ সৃষ্টি করতেন তাহলে হয়তো আজকের এই বিবেকহীনতা দেখতে হতোই না আমাদের।
মানুষের প্রতিহিংসা আর পরশ্রীকাতরতা কাজে লাগিয়ে সমাজপতিরা সমাজে শ্রেষ্ঠত্বের খেলায় মেতে রয়েছেন এভাবেই। কোন কোন পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাদের নোংরা প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে। মানুষ সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন সমাজপতিদের এমন প্রভাববিস্তার দেখে দেখে।
বাবা-মা বৃদ্ধ হলে পরিবার থেকে সম্মান হারিয়ে(যদিও অনেক পরিবারে সম্মানিত হয়েই আছেন অনেক বাবা-মা।) অসহায় হয়ে পড়ছেন। ছেলে ছেলে-বউয়ের দয়ায় বোকা বনে পড়ে থাকেন। মনের কষ্ট আর আফসোস নিয়ে সমাজের দিকে আশার চোখে চেয়ে থাকেন। সমাজ নিরুত্তর, নির্বাক। সমাজের যেন কিছুই করার নেই আর....!!
(ঘটনার বিবরণ আজকের। আমি কাল্পনিক নাম ব্যবহার করেছি। আমার কাছে ঘটনাটি খুবই খারাপ লাগায় লিখে রাখলাম মাত্র।)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৭ রাত ৮:০৩