শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক কিংবদন্তি। কিন্তু স্বাধীনতার পর কেমন ছিল তাঁর শাসনামল?
তাঁর শাসনামল নিয়ে সবচেয়ে বেশি লুকোচুরি খেলে তাঁর ই দল; আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ভাষ্য অনুযায়ী সেটা যেন কোন স্বর্ণযুগ এর বহিঃপ্রকাশ।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের খুব ক্ষুদ্র অংশ ই জানে সেই দিনগুলর কথা, তাদের ই জন্য আমার এই প্রয়াস, বয়সে আমিও তরুণ, তাই জানার আগ্রহ অবারিত। এই পর্বে আলোচনা করবো আওয়ামী লীগের ১৯৭০ এর অবিভক্ত পাকিস্তানের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বে দেয়া নির্বাচনী ওয়াদা এবং স্বাধীনতা পরবর্তী শাসনামলে কৃষি খাতের অবস্থা নিয়ে। সেই সাথে উল্লেখ করবো প্রকৃত অর্থেই কি ধরনের সমাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল।
৭০ এর নির্বাচনী প্রসঙ্গঃ
৭০ এর ১২ নভেম্বরে প্রলয়ংকরী সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের পটভূমিতে মাওলানা ভাসানীসহ অধিকাংশ দল নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিব ১২ লাখ মানুষের প্রাণহানির চেয়েও নির্বাচনে অনুষ্ঠানকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানও, রহস্যজনক কারণে, সেটাই অনুসরণ করেছিলেন।
নির্বাচনে শেখ মুজিব ৬ দফা ও সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ১১ দফা ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে আরো কয়েকটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দেশবাসীকে। এগুলো হচ্ছেঃ
১) ২০ টাকা মণ চাল ও ১০টাকা মণ গমের দাম নির্ধারণ করে পল্লী এলাকায় রেশন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা হবে,
২) বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা করা হবে,
৩) সাইক্লোনের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসিত করা হবে,
৪) যমুনার উপ সেতু নির্মাণ করা হবে প্রভৃতি।
এই নির্বাচনী ওয়াদার পরিণতি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তার একটিও কি ওয়াদা পূরণ করেছে?? ২০টাকার মণের চালের বদলে চালের দাম তারা ৪২০ টাকায় উন্নীত করেছেন। দুর্ভিক্ষে ৬ লাখ আদম সন্তান ‘বেওয়ারিশ লাশ’ খেতাবে ভূষিত হয়েছে। আর ক্ষমতাসীন নেতাদের আত্মীয় স্বজন ট্রাকে, লঞ্ছে, জাহাজে চাল পাচার করে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছে। বন্যানিয়ন্ত্রনের স্থায়ী ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আওয়ামী সরকার ভারতকে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সম্মতি দিয়েছে – যার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমির আবহ পাচ্ছে। সাইক্লোনের ক্ষতিগ্রস্তরা কে কি পেয়েছে তাও কারো অজানা নয়। হাজার হাজার কোটি টাকার রিলিফের কোন হদিস মেলেনি। যমুনা সেতু শুধু বক্তৃতায় ছিল; বাস্তবে নয় !
কেমন ছিল কৃষি আর শিল্প ব্যবস্থা
মুখে সমাজতন্ত্র আর কাজে লুটপাটঃ
আওয়ামী লীগ সরকার সমাজতন্ত্রের শ্লোগানে প্রতারণার এই কৌশলটি ই গ্রহণ করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৮৫ ভাগই ছিল পাকিস্তানী মালিকদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি। এগুলোকে রাষ্ট্রের মালিকানায় নিয়ে আসা ছাড়া সেই মূহুর্তে কোন বিকল্প ছিল না। কিন্তু স্বাভাবিক এই পদক্ষেপটির ওপর সমাজতন্ত্রের শ্লোগান চাপানোর চাতুরী নিতে গিয়ে মুজিব বাংঙ্গালী মালিকদের শিল্পকারখানাকেও জাতীয়করণ করেছিলেন। শেষের কার্যক্রমটি ছিল বাচালতা আর মুর্খতার এক চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত,। কেননা দেশপ্রেমিক জাতীয় পুজির নিয়ন্ত্রিত বিকাশ ব্যতীত যে সমাজতন্ত্রের লক্ষাভিমুখে এগিয়ে যাওয়া যায় না-এই সর্বনিম্ন জ্ঞানটুকু বোধহয় আওয়ামী সরকারের ছিল না। এর ফলে একদিকে তারা শিল্প মাত্রই জাতীয়করণের পদক্ষেপ নিয়ে জাতীয় পুঁজির বিকাশের পথকে রুদ্ধ করেছিলেন, অন্যদিকে আবার ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত পুজি বিনিয়োগের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করে জাতীয় শিল্পকে উৎসাহিত করার হাস্যকর এবং অর্থবহ চাতুরীর আশ্রয়ও নিয়েছিলেন।
পদক্ষেপটি হাস্যকর ছিল এজন্য যে, ৩ লাখ টাকায় তখন উল্লেখযোগ্য কোন শিল্প প্রতিষ্ঠা সম্ভব ই হতো না এবং সেজন্যই ছিল তা ছিল অত্যন্ত অর্থবহ। কেননা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আওয়ামীলীগের অনেক নিম্ন পর্যায়ের কর্মীও বিভিন্ন অসদুপায়ে লুটেরা পুঁজির মাইল্ক হয়েছিল। এদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্যেই আসলে ৩ লাখ টাকার সিলিং নির্ধারবের প্রয়োজন পরেছিল। ঠিক একই কারণে প্রচুর বাগাড়ম্বর সত্বেও ’৭২ সালেই সিলিং এর সর্বোচ্চ সীমা ৩০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয় আর ’৭৪ সালে এর পরিমাণ করা হয় ৩ কোটী টাকা। আসলে ঐ সময়কালের মধ্যেই লুটেরা পুঁজি অস্বাভাবিকভাবে দ্রুতলয়ে স্ফীত হয়ে পড়ে। ৩ লাখ টাকার সিলিংকেও তাই বারবার পরিবর্তন করতে হয়।
জাতীয়করণের নামে অনুসৃত এই প্রতারণামূলক এবং ক্ষতিকর নীতির ফলে প্রথম থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে শুরু করে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছিল মূলতঃ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা; তাদের অবাধ লুন্ঠন, যথেচ্ছ দুর্নীতি এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন অবহেলা স্বল্পকালের মধ্যে দেশে সর্বনাশের কারণ ঘটিয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানের মুখোমুখি হতে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে মেশিন এবং যন্ত্রাংশ চুরির কারণে কারখানাকে বন্ধও ঘোষণা করা হয়। এককথায়, স্থবিরতা এবং সর্বনাশ গ্রাস করে ফেলে সমগ্র অর্থনীতিকে। শিল্পের বিকাশও রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে সিপিবির মূল্যায়ন উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, এই দলটি বর্তমানের মত অতীতেও আওয়ামীলীগের কট্টর সমর্থক এবং অনুসারী ছিল। সিপিবির তৃতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক রিপোর্ট,১৯৮০ তে উল্লেখ করা হয়,
“মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ব্যক্তির ধন ও জৌলুস অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং তাহারা ক্রমেই ফাঁপিয়া ঊঠিতেছে। পাকিস্তান আমলে সৃষ্ট বাঙ্গালী ধনিক শ্রেণির বিকাশ বিঘ্নিত হয়নাই। সেই সঙ্গে দুর্নীতি ও নানারূপ লুটপাটের মাধ্যমে (আওয়ামী লীগ আমলে) দেশে নব্য ধনিক শ্রেণী গজাইয়া উঠে। রাষ্ট্রীয় অর্থ সম্পদ ব্যবহার করিয়া শিল্প ও ব্যবসায়ে ব্যক্তিগত খাত বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমগ্র জাতি ও দেশবাসীর স্বার্থের বিনিময়ে এইভাবে মুষ্টিমেয় লোক অভাবনীয় দ্রুতগতিতে ধনী হইয়া উঠে এবং পুঁজিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।”
জোতদারের স্বার্থেঃ
আওয়ামীলীগ সরকারের ভূমি নীতি ও ছিল দেশবাসীর কাছে অত্যাচারের খড়গের ন্যায়। প্রতিশ্রুতি পূরণের নামে সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তা বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা কৃষকদের অবস্থায় কোন পরিবর্তন আসতে পারেনি। কারণ মুজিব আমলে ভূমিহীন এবং (এক একরের কম জমির মালিক) গরীব কৃষকের সংখ্যা ছিল কৃষিকাজের সংগে সম্পর্কিত জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। এদের শেষ সম্বল ছিল একটুখানি ভিটেবাড়ী। কিন্তু সরকার ভিটেবাড়ির খাজনা মওকুফ করেনি। আর এই নীতিটির মাধ্যমে লাভবানদের শ্রেণী ও সংখ্যাও সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।
সরকারের খাস ও উদ্বৃত্ত জমির পরিবর্তনই কেবল প্রকৃত কৃষকদের অবস্থা পরিবর্তন করতে পারত। এক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ সরকার ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করেছিলেন ১০০ বিঘা। এর উপরের জমি রাষ্ট্রায়ত্ত করে ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মাঝে বিতরণের কথা থাকলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে যে কেউ ইচ্ছা করলে হাজার হাজার বিঘার মালিকানাকে বহাল রাখতে পারতো এবং বাস্তবে হয়েছিলো ও তাই। এমন একটি প্রমাণ দেখানো যাবে না যেখানে প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে কোন জমি বিতরণ করা হয়েছিল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে গণবিরোধী হিসেবে প্রত্যাখ্যাত মুসলিম সরকারও ১৯৫০ সালে সর্বোচ্চ জমির পরিমাণ করেছিল ১০০ বিঘাই। অথচ অত বিশাল পরিমাণ জমির মালিকের সংখ্যা ছিল নগণ্য। আর এরা পেয়ে বসেছিল অবাধ শোষণের অধিকার। এর ফলে তারা বর্গা প্রথার মাধ্যমে ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের উপর সামন্ত শোষণকে অব্যাহত রাখার সুযোগ পেয়েছিল। গরীব ও ভূমিহীন তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকদের মঙ্গল বিধানের সামান্য চিন্তা থাকলেও সরকার অমন একটি শোষণমূলক ভূমি নীতিকে পরিকল্পনায় আনত না এবং বর্গা প্রথাকে উচ্ছেদ কিংবা নিয়ন্ত্রণের বাস্তব পদক্ষেপ নিতো।
শেখ মুজিব নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের এহেন লোপাটতন্ত্র, জোতদারি মনোভাবের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন মওলানা ভাসানী। ৭২ সালের ২৯ শে এপ্রিল শিবপুরে আয়োজিত দুদিন ব্যাপী পূর্বাঞ্চলীয় কৃষক সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষনে তিনি বলেন,
“ সমাজতন্ত্র দেশের সংখ্যাগরিষ্ট কৃষক শ্রমিকদের মুক্তির একমাত্র পথ। শোষক শ্রেণীকে নির্মুল করে সমাজতন্ত্র কায়েম না করা গেলে বাংলাদেশের কৃষকদের মুক্তি আসবে না। ............ স্বাধীনতার পর লুটপাট সমিতি জনগণের উপর নির্যাতন করছে। রাতারাতি গাড়ি বাড়ির মালিক হয়েছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করে জনজীবনে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হবে।”
--- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- ---
আজ এ পর্যন্ত ই, পরবর্তী পর্বগুলোতে আলোকপাত করবোঃ
=> কেমন ছিল মানুষের আয় এবং দ্রব্যমূল্যের 'লাগামহীন ঘোড়া'
=> খাদ্য সংকট, ৭৪ এর ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ এবং বৈদেশিক সাহায্যের কড়চা
=> রাজনৈতিক হত্যাকান্ড এবং রক্ষীবাহিনী
=> বাকশাল, সংবাদপত্রের উপর আঘাত
=>মওলানা ভাসানীর সরকারবিরোধী আন্দোলন
আর সেই সাথে থাকতে পারে উইকিলিক্সের ফাঁস করা কিছু গোপন নথিপত্রের অনুবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৩:৫৬