somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গ্রিক মিথলজিঃ সৃষ্টিগল্প(পর্ব-১) -- প্রিমরডিয়াল ডেইটিজ

২৮ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১০:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গ্রিক মিথলজির বেশীর ভাগ অংশের মতই সৃষ্টির সূচনালগ্ন সম্পর্কেও অসংখ্য বিশ্বাস ও মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এসব বিশ্বাস ও মতবাদেও পরিবর্তন ঘটেছে প্রচুর। যোগ হয়েছে নতুন নতুন শাখা-প্রশাখা। সকল ধারণা একসাথে বর্ণনা করা কতটা সম্ভব আমি জানি না তবে এটা জানি যে এত সব ধারণা একসাথে জানাতে ও জানতে গেলে মাঝখানে ছোটখাট একটা গিট্টু লেগে যাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে। তাই সব শাখায় না দুলে আমরা বরং একটু মোটাসোটা শাখা দেখেই দুলি। প্রচলিত এত সব ধারণার মধ্য থেকে সবচেয়ে বেশী গৃহীত হয়েছে যে ধারণাটি সেটি হল প্রাচীন গ্রিক কবি হেসিওড রচিত “থিওগনি” মহাকাব্যকে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এ ধারণা অনুযায়ী সৃষ্টির সূচনা হয় আপনা আপনি জন্ম নেওয়া কিছু সংখ্যক স্বত্বার মাধ্যমে। পিতৃহীন এসব স্বত্বাগুলিকে বলা হয় প্রিমরডিয়াল ডেইটি(Primordial Deity) । গ্রিক মিথলজি সিরিজের এই পর্বটি সৃষ্টির সূচনালগ্ন ও বিভিন্ন প্রিমরডিয়াল ডেইটি’র উপর লিখিত। গ্রিক মিথলজির একদম গোঁড়ার দিকটার প্রতি যাদের আগ্রহ, এই পর্ব সহ আগামী কিছু পর্ব আপনাদের জন্যে।


কবি হেসিওডের বর্ণানুযায়ী, একদম শুরুতে বিশ্ব-পরিমন্ডল জুড়ে ছিল অসীম অনন্তঃ এক শূন্যতা(Emptiness)। গ্রিক মিথে এই শূন্যতাকে প্রথম দেবীস্বত্বা কল্পনা করে তার নামকরণ করা হয়েছে ক্যাওস(Chaos)। রোমান কবি ওভিড রচিত “মেটামরফোসিস” মহাকাব্যে ক্যাওস এর পরিচয় পাওয়া যায় দেবত্ব সৃষ্টিকারী প্রথমস্বত্বা হিসেবে যেখানে ক্যাওস আসলে অজস্র বস্তুতে গড়া অসীম একটি স্তূপ। ক্যাওসে এসব বস্তুসমূহ আকারহীন অবস্থায় পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল এবং পরবর্তীতে পুঞ্জিভূত এসব বস্তুই বিচ্ছিন্ন হয়ে ও আকার লাভ করে সৃষ্টি জগতের সূচনা ঘটিয়েছিল। কিন্তু হেসিওডের বর্ণনায় ক্যাওস ছিলেন বস্তু ধারনাহীন অশেষ শূন্যতা এবং এই শূন্যতা থেকেই দ্বিতীয় প্রজন্মের নানান স্বত্বার সৃষ্টি হয়েছিল। তবে বস্তুর পুঞ্জীভূতরূপই হোক অথবা অন্তঃহীন শূন্যতাই হোক, সর্বজন গৃহীত ধারণায় ক্যাওসই ছিলেন সৃষ্টিজগতে বর্তমান থাকা প্রথম অস্তিত্ব।
পরবর্তীতে ক্যাওস থেকে একে একে বেড়িয়ে আসে অথবা জন্ম নেয় তিনটি অমর স্বত্বা গাইয়া(Gaia) , টারটারাস(Tartarus) এবং এরস(Eros)। ক্যাওস সহ এই তিন স্বত্বাকে নিয়ে প্রিমরডিয়াল ডেইটি’র সংখ্যা দাঁড়ায় চার এ।


গ্রিক মিথে গাইয়াকে বলা হয় মাদার আর্থ(Mother Earth) বা “গড অফ ল্যান্ড”। আমরা আগেই জেনেছি যে, গ্রিকরা বিশ্বাস করত পৃথিবী আসলে একটি বিস্তৃত সমতল ভূমি এবং সমতল এই ভুমির চরিত্রায়ণ তারা করেছিল মাদার আর্থ বা গাইয়ার মাধ্যমে। গ্রিক শব্দ “গি(Ge)” বা “গা(Ga)”-এর অর্থ মাটি বা ভূমি। গ্রিক মতে গাইয়াই হলেন সকল সৃষ্টির আদি মাতা এবং দ্বিতীয় দৈবস্বত্বা । গাইয়ার চরিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায় গাইয়ার ছিল গর্ভধারণ করার ব্যাপারে অসম্ভব রকম ক্ষমতা। তিনি কোন পুরুষের সাহায্য ছাড়াই যেমন জন্ম দিয়েছেন অনেক আদি স্বত্বার আবার অনেক স্বত্বার জন্ম দিয়েছেন বিভিন্ন পুরুষ স্বত্বার সহচর্যে। তার গর্ভধারণ ও জন্ম দেওয়ার বৈচিত্রময় ক্ষমতার কারনেই তিনি বহু সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং নানা কারনে গর্ভধারণ করেছেন। এমনকি একটি বর্ণনামতে, দেবতাপ্রধাণ জিউস একবার তার স্বপ্নে গাইয়ার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হন এবং তাতেই গাইয়া গর্ভধারণ করে ফেলেন।


গাইয়ার পর পরই জন্ম নেন টারটারাস। এই টারটারাস হলেন পৃথিবীর বিস্তৃত সমতল ভুমির নিচে অবস্থিত এমন এক সুবিশাল গহ্বর বা স্থান যেটিকে বিভিন্ন সময়েই দেবতারা ব্যবহার করতেন কাউকে বন্দী করে শাস্তি দেওয়ার জন্যে। টারটারাস গ্রিকদের মাঝে আন্ডারওয়ার্ল্ড(Underworld) নামেই বেশী পরিচিত ছিল। টারটারাস সম্পর্কে বহু প্রচলিত ধারণাগুলি থেকে এটা স্পষ্ট যে স্থানটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ও হতাশা, গ্লানি আর কষ্টে পরিপূর্ণ। মানুষ ও দেবতাদের কৃত বিভিন্ন পাপের ফল ভোগ করার জন্যে এখানে তাদেরকে পাঠানো হত। সহজ কথায় টারটারাসই হল গ্রিক মিথ এর নরক বা হেল(Hell)। হেসিওড টারটারাসের চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে বলেন, যদি একটি তামার স্তুপকে স্বর্গ বা আকাশ থেকে ফেলে দেয়া হয় তবে সেটা নয় দিন নয় রাত পর ভুমিতে এসে পড়বে এবং একই গতিতে পড়তে থাকলে আরো নয়দিন নয় রাত পর গিয়ে পৌঁছুবে টারটারাস বা আণ্ডারওয়ার্ল্ডে।


ক্যাওস থেকে জন্ম নেয়া তৃতীয় ও সার্বিকভাবে চতুর্থ এবং ডানাযুক্ত প্রথম দৈবস্বত্বাটির নাম এরস। এরস হলেন গ্রিকদের “গড অফ সেক্সুয়াল ডিজাইয়ার অ্যান্ড অ্যাটরাকশন” । গ্রিক শব্দ এরস থেকেই ইংলিশ “Erotic” শব্দটির উৎপত্তি যার বাংলা অর্থ “প্রেমমূলক”। প্রথম দিকের কাব্য ও মিথে এরসকে প্রিমরডিয়াল দেবতা হিসেবে উল্লেখ করা হলেও পরবর্তী সময়ের সাহিত্যে তিনি দেবী আফ্রোদিতি(Aphrodite) ও দেবতা অ্যারিস(Ares) এর ছেলে হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। আবার অনেক সাহিত্যিক এরসকে অন্ধ একটি শিশুর রূপ দিয়েছেন। এরস সব সময়ই নিজের সাথে তীর ও ধনুক বহন করেন। বাছ বিচারহীন ভাবে যাকে তাকে যখন তখন তীর বিঁধিয়ে ভালোবাসার মোহে ফেলে দেন। তার এই তীরের ক্ষমতা শুধু মানুষই নয়, এমনকি দেবতা ও দেবীদের উপরও সমানভাবে কার্যকরী। রোমানদের কাছে দেবী আফ্রোদিতি পরিচিত ভেনাস(Venus) নামে এবং দেবতা এরস পরিচিত কিউপিড(Cupid) নামে।
এই তিনটি স্বত্বার পরে ক্যাওস থেকে আরো দু’টি দৈবস্বত্বার জন্ম হয় এবং এরা হলেন এরেবাস(Erebus) ও নিক্স(Nyx)। সবমিলিয়ে প্রিমরডিয়াল ডেইটির সংখ্যা হয় ছয়।


এরেবাস হলেন “দ্য ডার্কনেস অফ দি টারটারাস” বা নরকের অন্ধকার। কিছু মিথে তাকে টারটারাসের আবরণ হিসেবে আবার কোথাও কোথাও টারটারাসের একটি বিশেষ অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত মানুষের টারটারাস অভিমুখি যাত্রার প্রথমাংশে এরেবাসকে অতিক্রম করতে হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।


সৃষ্টিলগ্নের শুরুতে ক্যাওস অভ্যন্তর হতে পিতাহীন জন্ম নেওয়া শেষ দৈবস্বত্বাটি হলেন নিক্স। নিক্স ছিলেন রাত্রির প্রতিকীরূপ। দিনের বেলায় তিনি টারটারাসে বসবাস করেন এবং দিনের শেষে নিজ ডানায় ভর করে উঠে আসেন পৃথিবীতে এবং সাথে করে নিয়ে আসেন নিজ ভ্রাতা ও স্বামী গড অফ ডার্কনেস এরেবাসকে। নিক্স গভীর হওয়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে এরেবাস ছড়িয়ে পড়েন পৃথিবীব্যাপী। প্রাচীন বিভিন্ন চিত্রকলায় নিক্সকে চিত্রিত করা হয়েছে মাথার চারপাশে কুয়াশার বলয় ঘেরা কালো বর্ণের ডানাযুক্ত দেবী হিসেবে। তার তার শরীরে জড়িয়ে রাখতে রহস্যময় কালো একটি পর্দার আবরণ। চন্দ্র ও তারারা তার চলার পথের অনুসারী হত। রোমানরা তাকে ডাকেন নক্স(Nox) বলে।
এই ছয়জন প্রিমরডিয়াল ডেইটিদের মধ্যে এরস, টারটারাস ও এরেবাস এই তিনজন ছিলেন পুরুষোচিত এবং অপর তিনজন ক্যাওস,গাইয়াও নিক্স ছিলেন নারী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আমাদের গ্রিক মিথিলজির গভীরে যাত্রায় এরাই হলেন প্রাথমিক ও মৌলিক পাথেয়। এখন আমার সাথে সাথে আপনাদের ঝুলিও যখন এই পাথেয়তে পরিপূর্ণ হয়েই গেল। তো এখন একটাই প্রার্থনা করার আছে। “যাত্রা আনন্দময় হোক”।

রেফারেন্সঃ
১। দ্য গ্রিক মিথস(রবার্ট গ্রেভস),
২। দ্য এনসাইক্লোপিডিয়া অফ গ্রিক এন্ড রোমান মিথলজি (লিউক রোমান এন্ড মোনিকা রোমান),
৩। অনলাইন।

ছবি সংগ্রহঃ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১০:৩১
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×