প্রকৃতিতে এখন শীতের আমেজ। বাংলাদেশের শীত মৌসুমের নিজস্ব ফুলের সংখ্যা কম হলেও বিভিন্ন দেশের ফুল চমৎকারভাবে মানিয়ে গেছে এদেশের পরিবেশে ও আবহাওয়ার সাথে। হিম হিম শীতের শিশিরভেজা এই সময়ে স্মিগ্ধ প্রকৃতিতে মাঝে সৌরভের আবেশ ছড়ায় শীতের বিচিত্র ফুল। প্রজাপ্রতি গুলো পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় মনের আনন্দে ফুলে ফুলে। তখন বাগান, আঙিনা আর ছাদ হয়ে উঠে রঙে আর রূপে বর্ণিল। শীতের ফুল নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজকে থাকছে দৃষ্টিনন্দন শীতের ফুল পরিচিতি পর্ব ৩ ।
■ মর্নিং গ্লোরি ফুল ■
■ অ্যাস্টার ফুল (Aster) ■
■ পপি ফুল (Opium poppy) ■
■ সূর্যমুখী ফুল ■
■ জারবেরা ফুল ■
সূর্যমুখী পরিবারের জনপ্রিয় ফুলটির নাম জারবেরা। আকর্ষণীয় রং ও দীর্ঘ জীবনীশক্তির জন্য জারবেরার একটি জনপ্রিয় ফুল। সামাজিক অনুষ্ঠান বিয়ে-শাদী সভা সমাবেশ গৃহসজ্জায় জারবেরার কদর অনেক বেশি। রফতানি পণ্য হিসেবে গোলাপ ও অর্কিডের তুলনায় জারবেরার চাহিদা অনেক বেশি।
জারবেরার বৈজ্ঞানিক নাম GERBERA JAMESSONII এটি ASTERACAC পরিবারভুক্ত।জার্মান প্রকৃতি বিজ্ঞানী ট্রাউগটের নাম অনুসারে ফুলটির নামকরণ জারবেরা করা হয়েছে। জারবেরা এশিয়া ও আফ্রিকার স্থানীয় জাত। বর্তমানে পৃথিবীর বহু দেশেই এর চাষ হচ্ছে, বিশেষ করে বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রিড জারবেরার চাষ শীর্ষে।
সাধারণত ফুলটি আফ্রিকান ডেইজি নামেও পরিচিত। প্রায় ৩০টি প্রজাতির জারবেরা ছড়িয়ে আছে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায়। ফুলটি পৃথিবীব্যাপী কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সূর্যমুখীর মতো দেখতে এই ফুলগাছের পাতা পালং শাকের মতো। দেশে লাল, সাদা, হলুদ, গোলাপি, কমলাসহ কয়েকটি রঙের জারবেরার চাষ হয়। সারা বছরই জারবেরা ফুল ফোটে।
যশোরের গদখালীতে অন্যান্য ফুলের সঙ্গে ২০০৮ সাল থেকে চাষ হচ্ছে জারবেরা এবং ২০০৯ সাল থেকে ইউরোপের ফুল লিলিয়াম। জারবেরা ও লিলিয়ামের চারা ফুল চাষীরা ভারত থেকে চোরাপথে নিয়ে আসতেন। বাংলাদেশে জারবেরার চাষ বাড়ছে। আগে শুধু যশোরেই এ ফুলের চাষ হতো। এখন গাজীপুর ও সাভারেও জারবেরা চাষ হচ্ছে। জারবেরা ফুলের চাহিদা ব্যাপক। জারবেরা ফুলের নান্দনিক সৌন্দর্য ফুলের জগতে এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। সাধারণত জারবেরা ফুল গাছ থেকে তোলার ৮-১৫ দিন এবং গাছে ফোটা অবস্থায় ৩০ থেকে ৪৫ দিন সতেজ থাকে। ফলে বাসা বাড়িতে এর চাহিদা অনেক।
জারবেরা ফুলের বীজ থেকে চারা হয় না। সাকার উৎপাদনের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে। মাতৃগাছ থেকে বারবার চারা উৎপাদন করলে এই ফুলের গুণগতমান ও উৎপাদন হ্রাস পায়। এক সঙ্গে অল্প সময়ে অধিক চারার জন্য এবং জীবাণুমুক্ত চারার জন্য টিস্যু কালচার আবশ্যক। একবার চারা রোপণ করলে বহু বছর ফুল পাওয়া যায়। চারা রোপণের ১ বছর পর থেকে ফুল ও স্টিক ছোট হতে থাকে। বাণিজ্যিক চাষের ক্ষেত্রে এক বছর পরপর নতুন চারা রোপণ করা ভাল। চারা রোপণের ৬০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। জারবেরা একটি বীরুৎ জাতীয় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। একটি জারবেরা চারা থেকে চার বছর একাধারে ফুল পাওয়া যায়। একটি ফুল শুধু পানিতে বেঁচে থাকে ১৫ দিন পর্যন্ত। একটি গাছ প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০টি করে ফুল দেয়। তবে প্রকারভেদে। একটি জারবেরা শেড তৈরি করতে প্রয়োজনীয় ছায়াযুক্ত ৫০ ভাগ আলো-বাতাস লাগে। চারদিকে পোকামাকড় থেকে রক্ষা ও সরাসরি রোদ থেকে দূরে রাখতে শেড তৈরি করতে হয়।
● মর্নিং গ্লোরি ফুল :
প্রভাতের রানী মর্নিং গ্লোরি হল লক্ষ্মী মেয়ে। তার নামটাও বেশ চমৎকার । অপরূপ সুন্দর ফুলটি যখন ছাদ বা ব্যালকনিতে ফুটে তখন সবার নজর কাড়ে। মর্নিং গ্লোরীর অনেক প্রজাতি রয়েছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তাই তাকে আদর করে ডাকা হয় ভোরের রানী। বাংলা নামটি যেমন সুন্দর, ইংরেজি নামটিও চমৎকার। ইংরেজিতে ফুলটির নাম মর্নিং গ্লোরি।
মর্নিং গ্লোরি নামেই পরিচিত সুন্দর এ ফুলটি। বাংলায় বেশকিছু সুন্দর নাম রয়েছে। তবে এ নামগুলোতে খুব কম মানুষই চেনে। ভোরের রানী ছাড়াও বাংলায় ফুলটিকে ভোরগরবী, প্রভাতরানী, রেললতাও বলা হয়।
মর্নিং গ্লোরির অনেক প্রজাতি রয়েছে। প্রায় এক হাজার প্রজাতির মর্নিং গ্লোরি পাওয়া যায় বিশ্বের নানা প্রান্তে। তাদের নানা রঙ, নানা রূপ। তবে বাংলাদেশে মর্নিং গ্লোরির যে প্রজাতিটি পাওয়া যায়, সেটির বৈজ্ঞানিক নাম Ipomoea Purpurea। ঢোল কলমিও মর্নিং গ্লোরিরই একটি প্রজাতি, যার বৈজ্ঞানিক নাম Ipomoea Carnea।
মর্নিং গ্লোরি মূলত মেক্সিকো ও সেন্ট্রাল আমেরিকার অধিবাসী। প্রায় সব ধরনের মর্নিং গ্লোরির বৈশিষ্ট্য একই রকম। লতানো গাছ, পানপাতা আকৃতির পাতা। তবে কিছু প্রজাতির পাতা অন্য আকৃতিরও হয়। ফুলটি হয় ফানেল আকৃতির। ৮-১৫ সেন্টিমিটার চওড়া।
ফুলের রঙে ভিন্নতা রয়েছে। নীল, উজ্জ্বল লাল, সাদা, গাঢ় বেগুনি, গোলাপিসহ নানা রঙের হয় মর্নিং গ্লোরি। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় গাঢ় বেগুনি, গোলাপি ও আকাশি নীল রঙগুলো।
সকালে ফোটে ফুলটি। আবার নেতিয়ে পড়ে দুপুরে কিংবা বিকেলে। তবে কিছু জাতের ফুল শেষরাতে বা ভোরেও ফোটে।
মর্নিং গ্লোরির চারা হয় বীজ থেকে। টবেই লাগানো সম্ভব এটি। মাটির সঙ্গে সার ব্যবহার করতে হয়। বছরের যেকোনো সময়ই এ ফুলের চারা রোপণ বা বীজ বপন করা যায়। তবে অন্য গাছের মতোই বর্ষাকাল মর্নিং গ্লোরি লাগানোর জন্য আদর্শ। চারাগুলোকে তার বা অন্যকিছু দিয়ে উপরে লতানোর বন্দোবস্ত করে দিতে হয় । বারান্দায় টবে লাগালে গ্রিলেও লতানো যায় ।
● পপি ফুল :
পপি,পারস্যে যাকে বলা হয় ভালোবাসার ফুল। উর্দুতে গুল-ই-লালাহ বা শহীদের প্রতীক। পপি গাছ এর আদি নিবাস ইউরোপ। ফুলের রং সাদা, লাল, গোলাপি, হলুদ। ফুলের পাপড়িগুলো রেশমের মতো কোমল।
আফিম বা পপি (ইংরেজি: Opium poppy) পপি গাছের (বৈজ্ঞানিক নাম: Papaver somniferum) এই নামকরণ করা হয়েছে গ্রীক পুরাণের ঘুমের দেবতা 'সোমনাস'-এর নামানুসারে। কারণ পপি ক্ষেতে বয়ে যাওয়া বাতাসও প্রাণীদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে সক্ষম!
সব পপি ফুল থেকে মাদক দ্রব্য তৈরি হয় না, পপি ফুলের আবার অনেক নিরীহ প্রজাতি রয়েছে যা বাগানে শোভা পায়। নিরীহ দর্শন এই গাছটি একটি মাদক দ্রব্যের গাছ। ফল যখন পরিপক্ব হয় তখন ব্লেড দিয়ে ফলে গায়ে গভীর করে আঁচড় দেওয়া হয়। ফলে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা পর এর ফল থেকে কষ বের হয় এবং চাষীরা তা সংগ্রহ করে এটাই হলো আফিমের কাঁচামাল। এর পর বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অন্যান্য উপজাত জৈব রাসায়নিক দ্রব্য বানানো হয়। এটি থেকে হিরোইন ছাড়াও মরফিন পাওয়া যায়, যা ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ভয়ঙ্কর সুন্দরের প্রতীক পপি; একই সঙ্গে বিখ্যাত এবং কুখ্যাত একটি গাছ। সুন্দর ফুলের পাশাপাশি এ গাছের রয়েছে নানা ঔষধি গুনাগুনও। আবার এ গাছের ফল থেকেই তৈরি হয় সর্বনাশা মাদক আফিম, হিরোইন, মরফিন…….!
● সূর্যমুখী ফুল :
সূর্যমুখী একধরণের একবর্ষী ফুলগাছ। সূর্যমুখী গাছ লম্বায় ৩ মিটার (৯.৮ ফু) হয়ে থাকে, ফুলের ব্যাস ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়। এই ফুল দেখতে কিছুটা সূর্যের মত এবং সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে বলে এর এরূপ নামকরণ।
এর বীজ হাঁস মুরগির খাদ্যরূপে ও তেলের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই বীজ যন্ত্রে মাড়াই করে তেল বের করা হয় ৷ তেলের উৎস হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সূর্যমুখীর ব্যাপক চাষ হয়। সমভুমি এলাকায় শীত ও বসন্তকালে, উঁচু লালমাটি এলাকায় বর্ষাকালে ও সমুদ্রকুলবর্তী এলাকায় শীতকালীন শস্য হিসাবে চাষ করা হয়। ১৯৭৫ সাল থেকে সূর্যমুখী একটি তেল ফসল হিসেবে বাংলাদেশে আবাদ হচ্ছে। বর্তমানে রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর জেলা, পাবনা, দিনাজপুর, গাজীপুর, টাংগাইল প্রভৃতি জেলাতে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে।
প্রতিটি ফুল সূর্যের দিকে তাকিয়ে, কোনটি যেন গ্রীবা উঁচিয়ে, কোনটি উঁকি মেরে, কোনটি ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে প্রিয়তমকে। হলুদ আর হলুদ, সূর্যমুখী রঙ দেখে মনে হয় কেউ এসে মাঠে রঙ ছিটিয়ে দিয়েছে। ভোরের নরম রোদে এক ধরনের চোখ জুড়ানো ভালোলাগা ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে।
সূর্যমুখী ফুলের বড় শত্রু টিয়া পাখি, পরিপক্ক বীজ খেয়ে একেবারে শেষ করে ফেলে। তাই, পাখির আক্রমণ থেকে ফুলকে রক্ষার জন্য সতর্ক থাকতে হয়।
সূর্যমুখীর তেল ঘিয়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা বনস্পতি তেল নামে পরিচিত। এই তেল অন্যান্য রান্নার তেল হতে ভাল এবং হৃদরোগীদের জন্য বেশ কার্যকর। এতে কোলেস্টেরলের মাত্রা অত্যন্ত কম। এছাড়া এতে ভিটামিন এ, ডি ও ই রয়েছে।
সূর্যমুখী তাপ ও আলোক সংবেদনশীল বলে এ দেশে সারা বছরই চাষ করা সম্ভব। সবধরনের মাটিতে সূর্যমুখী চাষ হয়, তবে দো–আঁশ ও বেলে দো–আঁশ
● অ্যাস্টার ফুল (Aster) :
পুষ্পিকা (যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুলের সমন্বয়ে একটি বিশেষ ধরনের পরিণত পুষ্প গঠিকত হয় তার একটি) প্রজাতির ফুলের মধ্যে Aster এক ধরনের ফুল, সাধারণত ইহার সাদা, গেলাপী অথবা বেগুনী রঙের অংশুশিরা দন্ড এবং একটি হলুদ চাকতি থাকে৷
গ্রীষ্মের শেষ থেকে শরত্ ও হেমন্তের শুরু পর্যন্ত এই ফুল ফোটে, যে সময় অন্যান্য অনেক বারোমেসে ফুল বিবর্ণ হয়ে যায়৷ এইগুলি মাটির উপরে লাগোয়া ছোট গাছ থেকে শুরু করে 6 ফুট উচ্চতা পর্যন্ত হয়৷
অ্যাস্টার ফুলের গাছ রৌদ্রোজ্বল স্থানে, আর্দ্রতায়ুক্ত এবং উত্তম জল-নিষ্কাশিত মৃত্তিকাতে হয়ে থাকে৷ Asteraceae(অ্যাস্টারেশী) প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত অ্যাস্টার ফুলগাছ ।
বিচিত্র সব দেশী- বিদেশী শীতের ফুল পরিচিতি নিয়ে ধারাবাহিক পর্ব সমূহঃ
■ ফুল পরিচিতি » দৃষ্টিনন্দন শীতের ফুল পর্ব-১
■ ফুল পরিচিতি » দৃষ্টিনন্দন শীতের ফুল পর্ব-২
■ ফুল পরিচিতি » দৃষ্টিনন্দন শীতের ফুল পর্ব-৪ (শেষ পর্ব )
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০২০ দুপুর ২:৫৬