somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ মিথিলা কাহিনী ২ - মিথিলার ভালোবাসা

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পর পর তিন বার মিথিলা ৯ রোল কল করল, কোন রেসপন্স নেই দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভালো করে সারা ক্লাসে খুঁজল। নাহ, সুমন আজকেও আসেনি। এই নিয়ে টানা পাঁচ দিন ধরে সুমন ক্লাসে আসছে না। এটা কিছু হলো? এভাবে কি পড়াশুনা করানো যায়! হেড মিস্ট্রেস ম্যাডাম কে জানাতে হবে। এইভাবে ক্রমাগত স্কুল ফাঁকি দিলে তো চলবে না, সুমনের গার্ডিয়ানদের ডেকেও কথা বলতে হবে….

কয়েকদিন পরে মিথিলা কমন রুমে বসে ক্লাস টেস্টের খাতা দেখছে। এমন সময় পিয়ন এসে জানাল যে একজন ভদ্রলোক গেস্ট রুমে ওর সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন। কে জানতে চাইলে বলল যে, উনি সুমনের বাবা। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখল, খবর পাঠানোর প্রায় পাঁচ দিন পরে আসল দেখা করতে। একটু বিরক্তই হলো মিথিলা, গার্ডিয়ানরাই যদি এরকম করে, বাচ্চারা তো ক্লাস ফাঁকি দেবেই! ক্লাস টেস্টের খাতা গুলি গুছিয়ে ওর লকারে রেখে মিথিলা গেস্ট রুমে এসে দেখে মধ্য বয়স্ক একজন ভদ্রলোক ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন……..

এক
বেশ কিছুদিন পরে স্কুল থেকে ফিরে মিথিলা দেখে ওর ভাই আর ভাবী ওর বাসায় ওরই অপেক্ষায় বসে আছে। ড্রেস চেঞ্জ করে আসতেই ভাইয়া সরাসরি বলল যে, সুমনের বাবা, মাসুদুর রহমান সাহেব মিথিলার সাথে ওনার বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। ভদ্রলোক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, আগের স্ত্রী মারা গেছেন প্রায় দেড় বছর হলো, ছোট দুইটা বাচ্চা, খুবই ভালো ফ্যামিলি। ভাই আর ভাবী দুইজনই ওকে এই বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হবার জন্য চাপ দিল আর মাসুদ সাহেবের একটা সিভি ওর হাতে ধরিয়ে দিল। মিথিলা একেবারেই হতবাক হয়ে গেল এই বিয়ের প্রস্তাবে! মাসুদ সাহেবের সাথে ওর পরিচয় আছে, মাঝে মাঝেই ওর সাথে দেখা করেন সুমনের লেখাপড়ার খোঁজখবর নেবার জন্য। উনি যে মিথিলাকে পছন্দ করেন এটা ও কখনোই বুঝতে পারে নি? ওকে একবারও না জিজ্ঞেস করে কিভাবে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল? মাসুদ সাহেবের সাথে আগে সামনা সামনি কথা বলতে হবে কেন উনি বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন………..

দুই
ছুটির দিন শুক্রবার মাসুদ সাহেব সকাল বেলা মিথিলার মোবাইলে কল দিলেন। ফোন নাম্বারটা দেখেই মিথিলা চিনতে পারল, সিভিতে এই নাম্বারটাই দেয়া ছিল। কিছুটা অস্বস্তি আর তার চেয়ে বেশি লজ্জা নিয়ে ও ফোনটা রিসিভ করল। সালাম পর্ব শেষ হতেই মাসুদ সাহেব নিজেই কথা শুরু করলেন।
-মিথিলা, আপনার সাথে সরাসরি এই বিষয়ে কথা বলতে আমার খুব লজ্জা লাগছে! আমি এই জন্যই আপনার ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। উনি বললেন, আপনি আমার সাথে কথা বলতে চান, সে কারনেই আপনাকে আমি কল করেছি। আমি আজকে বিকাল বেলা আপনার সাথে কথা বলার জন্য দেখা করতে চাচ্ছি, যদি আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে একটু সময় দিতেন?

মাসুদ সাহেবের কথা এবং এপ্রোচ দেখে মিথিলা মনে মনে খুব খুশি হলো। যথেষ্ট ভদ্রোচিত ব্যবহার। মিথিলা খুব ভয় পাচ্ছিল যে, উনি কি মিথিলাকে করুনা বা এই ধরনের কিছু করছেন কিনা? সেটা না দেখে মিথিলার ভালো লাগল। আজকে বিকাল বেলা ও ফ্রি আছে এবং দেখা করতে পারবে এটা জানিয়ে দিল।

বিকাল ছয়টার সময় মাসুদ সাহেব মিথিলাকে ওর বাসার সামনে থেকে পিক করে নিজেই গাড়ী ড্রাইভ করে কাছাকাছি একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাচ্ছেন। সারা রাস্তা মাসুদ সাহেব বেশ চুপচাপ আছেন দেখে মিথিলার মনে হলো উনি মনের ভিতরে কথা গুলি গুছিয়ে নিচ্ছেন। ওর ভাইয়া আজকে ফোন করে ওকে জানিয়েছে যে, মাসুদ সাহেব কে ওদের ফ্যামিলির বেশ পছন্দ হয়েছে। ওকে মাসুদ সাহেবের সাথে সব কিছু জানিয়ে আলাপ করতে বললেন। মিথিলার কেমন জানি লাগছে, ঠিক বুঝতে পারছে না, আসলে ওর কি করা উচিত? এই দেড় বছরে সাগরের কাছ থেকে চলে আসার পর, ও এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী হতে পেরেছে, হুট করে আবার কারো কাছে মুখাপেক্ষী হতে ওর ইচ্ছে করছে না। নতুন করে কোন ছেলেকে আবার বিশ্বাস করা ওর জন্য অনেক কঠিন ব্যাপার! ওর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া হৃদয় আবার কি ও জোড়া লাগাতে পারবে? এর আগেও বেশ কিছু বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল, ও সরাসরি না বলে দিয়েছে। এই বার কেন যেন সরাসরি না করতে পারছে না। ভদ্রলোক যথেষ্ট সোবার, ব্যবহার ভালো, দেখতেও বেশ হ্যান্ডসাম। ওর বন্ধ্যাত্ব জনিত সমস্যার কথা জানানোর পর কি বলে এটাই আসল? তখনই আসল আচরন বুঝা যাবে…….

রেস্টুরেন্টে নিরিবিলি একটা টেবিলে মিথিলা কে নিয়ে মাসুদ সাহেব এসে বসলেন। মিথিলা মাথা নীচু করে বসে রইল। মাসুদ সাহেব একটু সময় নিয়ে কথা শুরু করলেনঃ
-মিথিলা, আপনার মনের অবস্থা কিছুটা আমি অনুভব করতে পারছি। একটা কথা প্রথমেই আপনাকে বলতে চাই, সেটা হলো, আমি নিজে পছন্দ করেই আপনাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি, এটার সাথে আপনার আগের বা বর্তমান অবস্থার কোনই সম্পর্ক নেই।
মিথিলা বেশ অবাক হয়ে মাথা উচু করে মাসুদ সাহেবের দিকে তাকাল। উনি কি ভাবে বুঝলেন?
-আমি সব কিছু বেশ ভালো ভাবে খোঁজখবর নিয়েই প্রস্তাব দিয়েছি। এমন কি, আপনার শারীরিক সমস্যার কথাও আমি জানি। আমি কোন ছোট বাচ্চা না যে হুট করে পাগলামি করছি!
-আপনি কেন এত মেয়ে থাকতে আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন? আপনার বাচ্চাদের দেখাশুনা করার জন্য?
-মিথিলা, আপনি মনে হয় ভূল বুঝেছেন! আমি আপনাকে বিয়ে করে স্ত্রী হিসেবে আমার সংসারে আনতে চাইছি, বাচ্চাদের গর্ভনেস হিসেবে নয়! এই নিয়ে আপনার সাথে আমার ঠিক নয় বার দেখা হলো। প্রথমবার আপনার সাথে স্কুলের গেস্ট রুমে দেখা হবার সময়ই আপনাকে আমার খুবই ভালো লাগে। ভালো লাগা এমন এক জিনিস যা একবার শুরু হলে তার সব কিছুই আস্তে আস্তে ভালো লাগতে থাকে। তখন আপনার ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। এর পরের বার দেশে এসেই আপনার ব্যাপারে আমি সব রকম খোঁজ খবর নিয়েছি। এই সাত মাস আমি শুধু নিজের সাথেই বোঝাপড়া করেছি আপনাকে নিয়ে। আপনি হয়ত খেয়াল করেন নি, দেশে ফিরলেই আমি মাঝে মাঝেই সুমনের ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার অজুহাতে আপনার সাথে দেখা করতে যেতাম আর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করতাম আপনাকে বুঝার জন্য। কমপ্লিটলি স্যাটিসফাইড না হওয়া আমি অপেক্ষা করেছি। যখন উপলব্ধি করেছি যে, আমি সত্যই আপনাকে যথেষ্ঠ পছন্দ করি এবং বিয়ের পর উপযুক্ত সম্মান দিতে পারব, তখনই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। আমার বয়স এখন ৩৯। এই বয়সে এসে নিশ্চয়ই আপনাকে আমি অ্যাফিয়ার করার প্রস্তাব দিতে পারি না? আপনিই বলুন, আমি কি কোন ভূল করেছি?

মিথিলার মনে হঠাৎ করেই সব কিছু জলের মতো পরিষ্কার হতে লাগল। এই জন্যই উনি এত ঘন ঘন ওর সাথে দেখা করতে চাইতেন? ওর মনে হয়েছিল ভদ্রলোক বাচ্চার লেখাপড়ার ব্যাপারে বেশী সিরিয়াস। মা নেই যেহেতু, বাবা একটু বেশী টেক কেয়ার করে। মাঝে মাঝে ওর বিরক্তই লাগত, ইচ্ছে করে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে যেত ক্লাস আছে এই অজুহাত দেখিয়ে। অনেক সময় গেস্ট রুমে অনেকক্ষন বসিয়ে রেখে পরে দেখা করত। ছিঃ ছিঃ, কি করেছে ও! ভূলেও এটা কখনোই জানতে দেয়া যাবে না। ও যেত ক্লাস টিচার হিসেবে সুমনের লেখাপড়ার প্রোগ্রেস নিয়ে কথা বলার জন্য আর উনি কিনা দিব্যি ওকে প্রেমিকা ভেবে গল্প করতেন! কি ভয়ংকর কান্ড? ভাগ্য ভালো স্কুলে কেউ টের পায় নি? টের পেলে এই স্কুলের চাকরীটা করাটা খুব কঠিন হয়ে যেত? কি পাগল মানুষ! নিজের ছেলের টিচার কে কেউ প্রেমিকা ভাবতে পারে? তাও আবার একদিন দুইদিন না, সাত মাস ধরে উনি এই কান্ড করে বেড়িয়েছেন! লজ্জায় মিথিলার মাথা কাটা যাচ্ছে। ওর বয়স অল্প বা ভার্সিটির স্টুডেন্ট টাইপের কিছু হলেও একটা কথা ছিল? তখন ও দেখতে সুন্দর ছিল, অনেক ছেলেরা ওকে পছন্দ করত, প্রোপজালও পেত অনেক। অনেক বেলা কেটে গেছে, ওর বয়সও বেড়ে গেছে, এখন কি ওর এসব মানায়? ওর মাথায় সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কি কি যেন বলবে মনে করে এসেছিল, ভদ্রলোকের এই কান্ড কারখানা শুনে সব ভূলে গেল মিথিলা! ধ্যাত, এটা কিছু হলো! এক মুহুর্তের জন্যও এই ধরনের কিছু হতে পারে মিথিলা চিন্তাও করে নি? কি বলবে ও এখন? মাসুদ সাহেব তো চাতক পাখীর মতো ওর উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছে! আচ্ছা ওর অসুখের কথা, কি জানেন উনি?
-আমার শারীরিক সমস্যা কতটা ভয়াবহ আপনি জানেন?
-মিথিলা, প্রোফেশন বা স্বভাব যেটাই বলেন না কেন, আমি যথেষ্ট মেথডিক্যাল পারসন। কোন কিছু না জেনে আমি কিছুই বলি না। আপনার অসুখের ব্যাপারে যে সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন, সেই সাগর সাহেবের সাথেই আমি দেখা করেছি। ওনার সাথে তো আমার এমনিতেই দেখা করতে হতো। আমি খোঁজ নিয়েছি, আপনাদের এখনো ফরমাল ডিভোর্স হয় নি। আপনার চেন্নাইতে চিকিৎসার ফাইনাল রিপোর্ট এর একটা কপি আমি কালেক্ট করেছি। আমার একজন ক্লোজ ফ্রেন্ড ডাক্তার, ফার্টিলিটি নিয়েই কাজ করে ঢাকায়, ও সেটা দেখে বলেছে ইউরোপ আর আমেরিকায় এখন এটার ট্রিটমেন্ট স্টার্ট হয়েছে, অল্প কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও পেয়েছে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি; সাগর সাহেব যেখানে থেমে গিয়েছিলেন, আমি সেখানে থামব না। আমি যথেষ্ট ফিনান্সিয়ালি রিচ পারসন। ইনসাল্লাহ, আমি আপনার জন্য আমার চেস্টার কোন ত্রুটিই রাখব না। বাকিটা মহান আল্লাহ পাকের ইচ্ছা!

মিথিলা হতভম্ব হয়ে মাসুদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। যা এতক্ষণ শুনল তারপর ওর আর কিই বা বলার আছে? এই ভদ্রলোক ওর মধ্যে কি দেখেছে যে এতটা ফিদা হয়েছে? মিথিলার মাথা এখন পুরোপুরি কাজ করছে না, এটা কি করে সম্ভব? এতো সিনেমার কাহিনী মনে হচ্ছে? বা তাকেও হার মানায়? আর একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ওর জানার বাকি আছে!
-আমি কি জানতে পারি আমাকে কেন আপনার এত পছন্দ হয়েছে? আমি আসলে খুবই কনফিউজড! আমি তো কোন বিশ্ব সুন্দরী নই যে, এত এত স্যাক্রিফাইস করে আমাকেই আপনার বিয়ে করতে হবে?

মিথিলার প্রশ্ন শুনে মাসুদ সাহেব দাঁত বের করে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। হাসির ধরন দেখে মিথিলা আরোও সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেল? ঘটনা কি?
-মিথিলা, সব মানুষের জীবনেই কোন না কোন অপূর্ণতা থাকে, এই পৃথিবীতে কেউ পরিপূর্ণ নয়! অপূর্ণতা থাকে না শুধু বড় বড় সাধক আর মহা পুরুষদের। আপনি এর কোনটাই নন!
-আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি, এর জন্য অপেক্ষা করছি!
-বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না!
-বিশ্বাস করব কি করব না, সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আমি জানতে চাই, এটা আমার জানতেই হবে?
-মিথিলা, আপনার কি মনে আছে? প্রথম বার যখন আমি আপনাকে দেখি, তখন চমকে উঠেছিলাম।

মিথিলা ঠিক মনে করতে পারল না, এসব বিষয় ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। অহরহ স্টুডেন্টের গার্জিয়ানদের সাথে দেখা করতে হত। আলাদা করে কাউকে মনে রাখার কোন দরকার ওর কাছে মনে হয়নি। তবে এই ফিদা কাহিনী ও আগে জানতে পারলে সেটা অন্য ব্যাপার হতো।
-এই ছবিটা দেখুন, আমি জানতাম আপনি এই প্রশ্ন করবেনই। সেজন্যই এটা নিয়ে এসেছি। শুধু অপেক্ষা করছিলাম কখন জিজ্ঞেস করবেন? খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন, আপনার জায়গায় আমি থাকলেও করতাম!

ছবিটা হাতে নিয়ে মিথিলা ভালো করে দেখে খুবই অবাক হয়ে গেল। একেবারেই ওর মতো দেখতে, ড্রেসটার জন্য পার্থক্যটা ধরতে পারল, এই টাইপের ড্রেস ও কখনই পড়েনি। মনে হচ্ছে বেশ আগের ছবি। মেয়েটা কে? সুমনের মা নাকি? তাহলেই সর্বনাশ, কোনভাবেই বিয়েতে রাজী হওয়া যাবে না, সারা জীবন আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুকতে হবে!
-এটা আমার মায়ের ছবি। প্রথম বার আপনাকে দেখে আমি হতভম্ব হয়ে চমকে উঠেছিলাম। এটা কিভাবে সম্ভব? এই জন্যই আমি আপনার বাবা মা ফ্যামিলি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম আর আপনি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। কথা শর্ট করে চলে গিয়েছিলেন।

ছবিটা কার জানার পর মিথিলা যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়ে গেল। ও এই সমস্যাটার কথা জানে। ওর ক্লোজ একটা বান্ধবী, নাবিলা সাইকোলজির স্টুডেন্ট ছিল। নাবিলা মাঝে মাঝে এইসব অদ্ভুত সাইকোলজিক্যাল টার্ম নিয়ে গল্প করত। বিষদ ব্যাখ্যাটা ওর মনে নেই তবে এই সাইকোলজি টার্মটা ও জানে, সিগমন্ড ফ্রয়েড এটাকে বলেছেন “ওডিপাস কমপ্লেক্স”। কিন্তু ও তো জানতো বড় হলে ছেলেদের এই সমস্যা এমনতেই চলে যায়? আচ্ছা, উনি তো একমাত্র সন্তান, সম্ভবত মায়ের সাথে খুব বেশী ক্লোজ ছিল আর এখন খুব বেশী একাকিত্বে ভুগছেন। এই দুটাই মেজর ফ্যাক্টর। কিন্তু উনি কি এটা জানেন? মুখে বিরাট একটা প্রশ্ন নিয়ে মিথিলা মাসুদ সাহেবের দিকে তাকাতেই উনি হেসে ফেললেন।
-মিথিলা, আপনি আমাকে আবারো মুগ্ধ করলেন! আমার ধারনা ছিল এই ব্যাপারটা আপনি জানেন না। আমাদের দেশে এটা প্রচলিত নয়, সবাই এটা জানেও না। হ্যাঁ, আপনি বিড়বিড় করে যেটা বলেছেন, এটা সেই “ওডিপাস কমপ্লেক্স”। শুরুটা সেভাবেই হয়েছিল। আপনাকে প্রথম বার দেখার পর আমি সাথে সাথেই অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে চলে যাই। মা আমার ছিল জীবনের সব কিছু, একমাত্র সন্তান হবার কারনে মা আমাকে চোখের আড়াল করতেনই না। অনেক দিন পরে মা'র মতো কাউকে দেখতে পেয়ে আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। সেই বার হাতে সময় ছিল না, পরের দিনই আমাকে জাহাজের সাথে বিদেশে চলে যেতে হয়। দেশে আসার পরেই আমি বড় ছুটি নিয়ে আপনার সব কিছু খুঁজে বের করি, অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, টাকা পয়সা বা সময় যা লাগে লাগুক, আমি পিছপা হইনি। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি আপনার প্রায় সব কিছুই জানি, এমনকি কোন কিন্ডারগার্টেনে পড়াশুনা করেছেন সেটাও জানি! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্কুলের গেস্ট রুমে এসে আপনার জন্য অপেক্ষা করতাম, সময় কোন ব্যাপারই ছিল না। ঠিক আড়াই মাস পরে আমার ডাক্তার ফ্রেন্ড এটা প্রথম ধরতে পারে। সমস্যাটা নিয়ে আমি অনেক স্টাডি করেছি, বিদেশে সাইক্রিয়াট্রিক ট্রিটমেন্টের জন্য অনেক গুলি সেশনও করেছি, এটা থেকে আমি এখন মুক্ত। তত দিনে যা সর্বনাশ হবার তা হয়ে গেছে, কোন কিছু বুঝার আগেই আমি আপনার গভীরতম প্রেমে পড়ে গেছি। ভালোবাসা বাসির জন্য অনন্তকালের প্রয়োজন নেই, একটি মুহূর্তই যথেষ্ঠ! এই জীবনে মনে হয় সেই ভালোবাসা থেকে আর কোনদিনও বের হতে পারব না। সত্যি কথা বলতে কি, বের হবার কোন ইচ্ছাও আমার নেই! সত্যই আপনি যথেষ্ট এ্যাট্রাক্টিভ গার্ল। আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। কি যে ভালো লাগে আপনার কথা শুনতে! মনে হয় সারাক্ষণ শুধু আপনার কথা শুনি আর শুনি! বাচ্চা হওয়া নিয়ে যে সমস্যা, এটা নিয়ে আমার তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই। দেখুন, আমার দুইটা বাচ্চা অলরেডী আছে, এই দুটাকে পালতেই আমার নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে! জাহাজে লাইফ খুব লোনলি। ঘরে ফিরে এসে হাসি খুশি ভাবে লাইফটা কাটাতে চাই। আপনার কোন কিছুর অভাবই আমি রাখব না, ঘরে ফেরার পর শুধু আমাকে সময় দিবেন, প্লিজ আমার সাথে কথা বলবেন।

অবিশ্বাস্য বিস্ময় চোখে নিয়ে মিথিলা মাসুদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল! একদিনে ও যা শুনেছে এটা হজম করতে মিথিলার অনেক অনেক দিন সময় লাগবে।
-মিথিলা, আমি অনেক হিসাব নিকাশ করে দেখেছি, আমার প্রস্তাব আপনার না করার কোন যৌক্তিক কারনই নেই। সুতরাং যেন তেন একটা চিন্তা করে আমাকে না বলে দিলেন আর আমি হাল ছেড়ে দিয়ে চলে দেব, এটা কোনদিনও ভাববেন না। এই বিয়ে নিয়ে আমি কোন কিছুতেই পিছু হটব না। প্রশ্নই উঠে না! বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী! আপনাকে বিয়ে আমি করবই করব, কেউ ঠেকাতে পারবে না!

এইরকম ডেস্পারেট একটা মানুষকে ও কি বলবে সেটা মিথিলার মাথায়ই এলো না। এই লোক কি ওকে জোড় করেই বিয়ে করবে নাকি? ওর মতামত কি সেটাও তো জানতে চাচ্ছে না। কি বড় বিপদ! ভিষন লজ্জায় মিথিলার মুখ লাল হয়ে গেল, মাথা নীচু করে ও ভাবছে কি করা যায় এখন!
-ওয়েটাররা অনেকক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে আমার ইসারার জন্য। খাবারের অর্ডার আমি আগেই দিয়ে গিয়েছিলাম। ওদের কে খাবার সার্ভ করতে বলি? আপনি কি আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?
নীচু অবস্থায়ই দুই পাশে মাথা নাড়ল মিথিলা। ওর নিজের মাথাই এখন কাজ করছে না, কাকে কি জিজ্ঞেস করবে?

খাবার সার্ভ করার পর সেগুলি দেখে মিথিলা অবাক হয়ে গেল। চাইনিজ খাবার ও পছন্দ করে আর উনি ঠিক ঠিক যে ডিস গুলি ও খুবই পছন্দ সেগুলিই অর্ডার দিয়েছেন। একগাদা খাবারে টেবিলটা ভরে গেল। মিথিলা এত খাবার দেখে বিরক্ত হয়ে বললঃ
-এত খাবার অর্ডার দিয়েছেন কেন? কে খাবে এতগুলি? মানুষ তো মাত্র আমরা দুইজন!
-আপনি খাবেন! আপনার পছন্দের কোনও ডিস আমি বাদ দেই নি।

এই লোকের সাথে তর্ক করে কোন লাভ নেই! শুধুই পন্ডশ্রম! মিথিলা হতাস হয়ে চেয়ার থেকে উঠে নিজেই দুইজনের প্লেটে খাবার সার্ভ করা শুরু করল, বসে থেকে কোন লাভ নেই, শুধু দেরীই হবে আর কিছু না।

ফেরার পথে মিথিলা গাড়িতে আরো একটা অদ্ভুত কথা শুনল। স্কুলের হেড মিস্ট্রেস ম্যাডাম নাকি মাসুদ সাহেবের এই পছন্দের কথা সবই জানেন। প্রথম দিন মিথিলা চলে যাবার পরই নাকি মাসুদ সাহেব সোজা উনার রুমে চলে গিয়েছিলেন। প্রায় প্রত্যেক বারই মিথিলার সাথে কথা হবার পর মাসুদ সাহেব ম্যাডামের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন। এটা ওর মাথায় কিছুতেই ঢুকল না কিভাবে এই ভদ্রলোক যেন সবাই কে ম্যানেজ করে ফেলেন!

বাসায় আসার পর ড্রেস চেঞ্জ না করেই মিথিলা চুপচাপ বেডে বসে রইল। ওর কি করা উচিত বা উচিত না কিছুই মাথায় ঢুকছে না। অনেকক্ষন চিন্তা করার পর হটাৎ করেই মনে হলো, তাইতো, নাবিলার সাথেই আলাপ করতে হবে। এই সিচুয়েশনে ঐ সব চেয়ে ভালো সাজেশন দিতে পারবে। কিছুদিন আগেই শুনেছিল ও এখন ঢাকায় চেম্বার নিয়ে ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে……

তিন
মিথিলা নাবিলা চেম্বারে যাবার আগের দিনই ফোনে প্রায় সবকিছুই নাবিলাকে জানালো। পুরো বিষয়টা নিয়ে ও মারাত্মক বিপদে পড়েছে, রাজি হবে কি হবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাই চেম্বারে যেয়ে সরাসরি আসল বিষয়ে কথা বলা শুরু করল। নাবিলা ওকে একেবারে মাসুদ সাহেবের সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে সেইদিন বাসায় ফিরে আসা পর্যন্ত সবকিছু আদ্যোপান্ত খুলে বলতে বলল, নাবিলা অবশ্য ওকে ফোনে আগেই মনে করে রাখতে বলেছিল। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে মাসুদ সাহেবের ফিদা কাহিনী শুনার পর নাবিলা মিথিলার দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে দিল। নাবিলার হাসি দেখে মিথিলার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ও আছে দুনিয়ার ঝামেলার মধ্যে আর সবাই শুধু হাসে, এটা কোন কথা হলো?
-হাসছিস কেন? গাধা কোথাকার, এটা হাসির কিছু হলো?
-তোর সমস্যা কি? তুই কেন রাজি হচ্ছিস না? তোর বর্তমানে যেই অবস্থা, এটাতো মেঘ না চাইতেই জল পাবার মতো? সমুদ্রের জীবনে যেমন জোয়ার ভাটা আছে, মানুষের জীবনেও আছে। মানুষের সাথে এই জায়গাতেই সমুদ্রের মিল। এই রকম প্রেমিক পুরুষ তুই বারবার পাবি?
-তাই বলে এই রকম একটা সাইক্রিয়াট্রিক পেশেন্ট কে আমি বিয়ে করব?
-আমি তো কোন অসুবিধা দেখছি না। তোকে “ওডিপাস কমপ্লেক্স” সম্পর্কে যা বলেছিলাম সেটা তোর ভালোই মনে আছে, সে জন্যই সাথে সাথে ধরতে পেরেছিলি। যদিও উনি বলেছেন এটা থেকে উনি মুক্ত কিন্তু আমার মনে হয় কিছুটা এখনো রয়ে গেছে তবে উনি যেহেতু ব্যাপারটা জানেন এবং ট্রিটমেন্ট নিয়েছেন, এটা তোর কোন সমস্যা করবে না। তুই কিন্তু ওনার আসল সমস্যাটার কিছুই ধরতে পারিস নি। মাসুদ সাহেবের উদ্ধত আর বেপরোয়া প্রেম দেখে তুই যে ভয় পেয়েছিস, সেটা ভয়ের কিছু না। তোকে আমি এটাও বলেছিলাম, সম্ভবত ভূলে গেছিস। আমরা এটাকে বলি “সিংগেল চাইল্ড সিনড্রোম”। আমি ফোনেই তোর কথা শুনে কিছুটা বুঝেছিলাম। উনি একটু বেশী রিয়াক্ট করেছেন, মনে হয় একাকিত্বটা সহ্য করতে পারছেন না। আমি তোর জন্য এদের বিহেবিরিয়াল প্যার্টানের একটা নোট রেডি করেছিলাম, যাওয়ার সময় নিয়ে যাস।
-শোন, খুব মনোযোগ দিয়ে শোন, ““সিংগেল চাইল্ড সিনড্রোম” এর ছেলেরা প্রেম, ভালোবাসা বা বিয়ের জন্য খুবই ভালো, যদি এরা নিজেরা কাউকে প্রস্তাব দেয় বা পছন্দ করে….
-এরা সহজে কাউকে পছন্দ করে না। পছন্দ না হলে এদের পায়ে সারা জীবন মাথা কুটলেও হৃদয়ে এক ফোটা জায়গা দেবে না। কিন্তু কাউকে যদি এরা নিজেরা পছন্দ করে, তার জন্য এরা হাসি মুখে হেঁটে হিমালয় পর্বতেও উঠে যেতে পারবে। নিজের ভালোবাসার জন্য এরা পারে না এমন কিছুই নেই! এরা নিজের ভালোবাসার মানুষের প্রতি চরম বিশ্বস্ত! ভালোবাসার মানুষ আর নিজের পরিবার এদের কাছে পৃথিবীর সব কিছুর চাইতেও বেশী আপন! এরা সারাজীবন হৃদয়ের ভালোবাসার চাদর দিয়ে মনের মানুষকে ঢেকে রাখে, ফুলের টোকাও গায়ে লাগতে দেয় না। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে এর অনবদ্য। প্রতিনিয়ত ইনোভেটিভ কিছু করে এরা প্রেয়সীকে মুগ্ধ করে রাখে।

-আমি একটা জিনিস শুধুই বুঝলাম না, তুই কেন এখনো মাসুদ সাহেবের প্রেমে পড়িস নি? মনে হয় মাসুদ সাহেব ধরেই নিয়েছেন তুই এমনিতেই রাজি হয়ে যাবি, তাই তোকে ইমপ্রেস করার কোন চেস্টা করেন নি। এরা ভালোবাসার মানুষকে ইমপ্রেস করতে দারুন পটু। তুই যেহেতু উনাকে এখনো ঠিক পছন্দ করতে পারিস নি, তাহলে একটা কাজ কর, উনি তো তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন, উনাকে একটু বিরহের পুকুরে চুবিয়ে নিয়ে আয়! কিছুদিন দেখা করবি না, নিজে ফোন করবি না, উনি ফোন করলে শুধু yes no very good টাইপের উত্তর দিবি। এরা দুর্দান্ত বুদ্ধিমান হয়, সাথে সাথেই বুঝে ফেলবে তুই এখনো উনাকে পছন্দ করতে পারিস নি। উনি কোন না কোন এ্যাকশনে অবশ্যই যাবেন, আমার ধারনা এমন কিছু একটা করে বসবেন যে, তুই সাথে সাথেই উনার প্রেমে পড়ে যাবি। আমার কাছেও আর তোকে আসতে হবে না।
-তোর কথা যদি ঠিক না হয়? তখন তোকে আমি কি করব, বল?
-আমি নিশ্চিত। গত আট বছর ধরে এই রকম একটার সাথেই সংসার করছি আর আমার সাবজেক্টই এটা, আমার চেয়ে ভালো আর কে জানবে, বল? আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না। তবে আমার কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তোকে আমি মাসুদ সাহেবের সাথে তোর বিয়ের অনুষ্ঠানেই পিঠের মধ্যে গুনে গুনে তিনটা কিল দেব, মনে রাখিস…….


চার
প্রায় পঁচিশ দিন পরে, একদিন বিকেল বেলা স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকে মিথিলা বেশ অবাক হলো। বেশ বড় সাইজের একটা প্যাকেট ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা। বাসায় যে মেয়েটা সোমাকে দেখাশুনা করে তাকে ডেকে জানতে পারল কিছুক্ষণ আগে এই পার্সেল টা মিথিলার নামে ডেলিভারি দিয়ে গেছে। কি আছে ভিতরে দেখার জন্য প্যাকেটের উপরের কাভার খুলতেই মিথিলা স্তব্ধ হয়ে গেল। ও নিজেই ভূলে গিয়েছিল! আজকে ওর বার্থডে আর সেটা উইশ করেই এই বিশাল বড় বার্থডে কেকটা তৈরী করে পাঠানো হয়েছে। কেকের উপরে ওর প্রিয় সবুজ রং দিয়ে ওর নাম এবং দিন তারিখ লেখা। কেকের উপরে সাজান মোমবাতি গুলি গুনে দেখে ঠিক ঠিক ৩০ টাই আছে, কোন ভূল করেনি। মিথিলা সাথে সাথেই বুঝল কেকটা কে পাঠিয়েছে! অনেক, অনেক দিন পরে ওর বার্থডে তে কেক কেনা হলো। সাগরের সাথে বিয়ের পর সম্ভবত প্রথম দুই বছর কেক কেনা হয়েছিল। তারপর মনে হয় এত দিন পরে এটা! কি যে খুশি লাগছে মিথিলার! চোখে জল আসার উপক্রম! প্যাকেটের চারপাশে ভালো করে মিথিলা খুঁজল কোন চিঠি বা উইশ কার্ড টাইপের কিছু আছে নাকি?
প্যাকেটের পাশে একটা খাম পেল। খামটা খুলে মিথিলা দেখে ওর জন্য গোটা গোটা বাংলা বর্ণে হাতে লেখা একটা চিঠি…..

মিথিলা,
শুভ জন্মদিন! আপনার জীবনের এই আনন্দঘন দিনটা ইচ্ছে ছিল সবাই মিলে হইচই করে কাটাব। সেজন্য এই কেকটার অর্ডার দিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল নিজেই নিয়ে আসব। হটাৎ করে কেন জানি মনে হল, আপনি আমাকে কিছুটা এ্যাভয়েড করতে চাচ্ছেন! তাই পার্সেল করে পাঠিয়ে দিলাম। আপনার জন্মদিনের উপহার হিসেবে এইবার সিংগাপুর থেকে ফেরার সময় একটা দারুন গিফট নিয়ে এসেছিলাম। ইচ্ছে ছিল নিজের হাতেই আপনাকে পড়িয়ে দেব! গিফটটা আমার কাছেই আছে। ইনসাল্লাহ, খুব শিঘ্রই এটা আমি আপনাকে পড়িয়ে দিতে পারব! আপনার মনের বদ্ধ দুয়ার খুব তাড়াতাড়িই খুলে যাবে সেই প্রত্যাশায়……
মাসুদ

# আমার খুব প্রিয় একটা গানের কিছু লিরিক্স দিলাম। কেন দিয়েছি পড়লেই বুঝবেন!
ঝড়ের দিনে খুলেছে যে পথ
আমি জানি জানি তার বেদনা
নতুন আলোর জোয়ার এলে
আমি চাই তারে দিতে আশা
তুমি কি চাওনা সোনালী দিনে
সোনালী সুখেরই সারা
কাঁটার আঘাত ভুলে তুমি
এসো এই ফুলেরই কাছে।

হাজার ফুলে ছেয়েছে যে পথ
আমি চিনি চিনি সে ঠিকানা
তোমার মনের নীরব ভাষা
সেতো আমার আছে জানা
আমি তো চাইনা তোমার এ দ্বিধা
ভেঙ্গে দাও কাঁচেরই বাধা
সীমার বাঁধন ছিঁড়ে তুমি
ধরা দাও আমারই কাছে।

যেখানে সীমান্ত তোমার
সেখানে বসন্ত আমার
ভালোবাসা হৃদয়ে নিয়ে
আমি বারে বার আসি ফিরে
ডাকি তোমায় কাছে।

@ শিল্পীঃ কুমার বিশ্বজিত, সুরকারঃ লাকী আখন্দ,গীতিকার: কাওসার আহমেদ চৌধুরী।

চিঠিটা হাতে নিয়ে মিথিলা খোলা বারান্দায় এসে দাড়াল। উন্মুক্ত নীল আকাশে রক্তিম সুর্যাস্তের আভাস দেখা যাচ্ছে আর ওর জীবনে নতুন সুর্যোদয় অনুভব করছে মিথিলা। ওর এই ভেঙে যাওয়া ছোট্ট বুকে এত ভালোবাসা রাখার জায়গা কি আছে? হাত ঘড়িতে দেখল এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। ও মনে মনে একটা হিসেব করে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসল।

সব কিছু রান্না শেষ করে মিথিলা যখন রান্নাঘর থেকে বের হলো তখন বাজে পোনে সাতটা। ওর জীবনের সবচেয়ে সেরা রান্না করেছে আজকে আর সেজন্যই সময়টা একটু বেশীই লাগল। হাতে আর আছে মাত্র ৪৫ মিনিট। গরমে ঘেমে নেয়ে একেবারে যা তা অবস্থা! আলমিরা খুলে ভালো একটা ড্রেস বের করে বাথরুমে গেল গোছল করতে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে যখন মিথিলা বসল হাতে আর মাত্র ২০ মিনিট। আজকে অনেক, অনেক দিন পড়ে ও মনের মতো করে সাজবে, যা সময় লাগবে লাগুক! এতটা দিন ধরে অপেক্ষায় ছিল আর ওর ঘরে এসে আর কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে পারবে না ওর জন্য? আজকের এই সাজুগুজু তো ওর প্রেমিক পুরুষের জন্যই……………

পাঁচ
বাসর ঘরে বসে মিথিলার খুব লজ্জা লাগছিল। এক মেয়ের জীবনে কয় বার বাসর হয়? কি শরমের ব্যাপার! ছিঃ ছিঃ! তাকিয়ে দেখে পুরো বিছানাটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। সম্ভবত ডেকরেটরের কাজ! ঘরের ফার্নিচার গুলি খুব দামী। মাসুদ মনে হচ্ছে সৌখিন মানুষ। বেড রুমটাও বেশ বড়। মিথিলা চারপাশে যখন তাকিয়ে দেখছিল হটাৎ দরজা খুলে সুমন ঢুকে পড়ল, ওর পিছনে পিছনে দুই জন হাউজ মেইড। সুমন দৌড়ে মিথিলার পাশে এসে বসে পড়ল। হাউজ মেইড দুইজন সুমন কে নিয়ে যাবার চেস্টা করতেই সুমন বেশ জোড়ে দুই হাত দিয়ে মিথিলাকে জড়িয়ে ধরল। মিথিলা সুমনের দিকে তাকিয়েই বুঝল ও কিছুতেই যাবে না। মিথিলা হাউজ মেইডদের মানা করে দিয়ে বললঃ
-আপনারা চলে যান। সুমন আমার কাছে থাক। ওর আব্বু আসলে আমি বুঝিয়ে বলব।

মিথিলার জন্য চরম বিস্ময় অপেক্ষা করছিল যখন মাসুদ ওর তিন বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে বাসর ঘরে এসে ঢুকল। মেয়েকে ভাইয়ের পাশে বসিয়ে দিয়ে মাসুদ হাসতে হাসতে বললঃ
-দায়িত্ব যখন নিচ্ছেন, তখন দুটারই নেন। দুই ভাই বোন মিলে আমার লাইফ পুরো ভাজা ভাজা করে ফেলেছে! কিছুটা হলেও তো শান্তি পাব! আরো আগে আপনি আসলে, আরো আগেই শান্তি পেতাম!
মাসুদের কথার ধরন দেখে মিথিলা হেসে ফেলল। মাসুদের পা সালাম করার জন্য বেড থেকে নামার চেস্টা করতেই মাসুদ ওকে ধরে আবার বেডে বসিয়ে দিল।
-লাগবে না। আমি এমনিতেই অনেক খুশি হয়েছি। কবুল বলার পর থেকে আপনার জন্য অনেক বার শুকরিয়া করেছি।
মাসুদ দুই ভাই বোন কে মিথিলার দুই পাশে বসিয়ে দিয়ে মিথিলার সামনে বেডে এসে বসল। বাচ্চা দুইটাকে দুই পাশে দেখে মিথিলা চুপ হয়ে গেল। মাথা নীচু করে বসে আছে দেখে মাসুদ মিথিলার ডান হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বললঃ
-শুধু শুধু মন খারাপ করছেন কেন? এই রুমে ঢুকার আগেই আমি সোমার খোঁজ নিয়েছি। সোমা এখন আপনার ভাইয়ের বাসায় আছে। একটু আগে আপনার ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। কালকে আপনার ভাইয়ের বাসায় আমাদের দাওয়াত, এমনিতেই যেতে হবে। ফেরার সময় আমরা দুই জন মিলে এক সাথেই সোমাকে এই বাসায় নিয়ে আসব।
-আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। শুকরিয়া করে শেষ করা যাবে না। এই দুইটা বাচ্চাকে যদি খাওয়াতে পড়াতে পারি, আরেকটা কে কেন পারবো না? আমি আপনাকে কথা দিয়েছি না, বলুন?
অসম্ভব কৃতজ্ঞতায় মিথিলার মনটা ভরে উঠল। এই মানুষটা এত ভালো কেন? কেন মাসুদের সাথে ওর আগে পরিচয় হয় নি? কেন এই ভালো মানুষটা ওর কাছ থেকে এতদিন এত দূরে দূরে ছিল? আগে পরিচয় হলে হয়ত ওর জীবনটাই অন্যরকম হতে পারত!

হঠাৎ করেই মাসুদের জন্য মিথিলার বুকের ভিতর গভীর অনুরাগের একটা ঝড় বয়ে গেল। আবেগের তীব্রতায় মিথিলা মুখ তুলে দেখে মাসুদ এক বুক ভরা মায়া চোখে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সেই মায়া ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে মিথিলা ওর পিছনে ফেলে আসা জীবনের সব পাওয়া না পাওয়া আর বেদনা বিধূর দিন গুলির কথা ভূলে গেল। টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া হৃদয়টা আবারো জোড়া দিতে শুরু করল। এটাই মনে হয় সেই ভালোবাসা, যা অনেক দিন আগে ও হারিয়ে ফেলেছিল! মিথিলার ডান হাত অনেকক্ষন ধরেই মাসুদের দুই হাতের মধ্যে ছিল, এবার মিথিলা ওর বাম হাতটাও মাসুদের দুই হাতের মধ্যে রাখলো। অনেক দিন পর ভালোবাসার স্পর্শে মিথিলার দুই চোখই আদ্র হয়ে আসছে! ভিজে যাওয়া চোখ ওর মুছতে ইচ্ছে করছে না! ভিজে যাওয়া চোখেই মিথিলা মাসুদের দিকে তাকিয়ে রইল। মাসুদের দুই হাতের স্পর্শে মিথিলা অনুভব করল ভালোবাসায় ঘেরা নিরাপত্তা, যার জন্য প্রতিটা মেয়েই সারা জীবন তৃষিত হয়ে থাকে…………

পূনশ্চঃ
এর আগের পর্ব পড়ে আসুন এখান থেকে গল্প - আমি মিথিলা, একজন বন্ধ্যা মেয়ে বলছি! শবনম আর শুভর প্রেম কাহিনীর জন্য অনেক অনুরোধ এসেছে, লিখতেও শুরু করেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো মিথিলা কি দোষ করল? ভালোবাসা পাবার অধিকার তো মিথিলারই সবচেয়ে বেশী! তাইনা……….

সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, নভেম্বর ২০১৮

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:২১
৩৪টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×