somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ মিথিলা কাহিনী ১ - একজন বন্ধ্যা মেয়ে বলছি!

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ৮:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রায় মাঝ রাত। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছি। চোখে ঘুম আসছে না। দুই হাতের আংগুল গুলি দুই কানে চেপে ধরে আছি। কান দুইটাকে কিছুতেই বন্ধ করতে পারছি না। পাশের রুম থেকে ভেসে আসা আদিম অনুভুতির তীক্ষ্ণ শীতকার গুলি আমার দুই কান দিয়ে ঢুকে মনকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে। কি অসহ্য পাশবিক কষ্ট যে আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে সহ্য করছি তার কোন সীমা নাই! আমার অব্যক্ত অনুভুতি গুলো যেন দুই চোখ দিয়ে অবিরত জল হয়ে বের হয়ে এসে বালিশটা ভিজিয়ে ফেলছে। কতদিন কতক্ষন ধরে এই জাহান্নামের মধ্যে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে আমি জানি না। গত সাতটা দিন প্রত্যেক রাতে প্রতি মুহূর্তে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করছিল। আত্মহত্যা যদি এত বড় পাপ না হতো, তাহলে আমি প্রথম দিন প্রথম মুহূর্তেই গলায় ওড়না পেঁচিয়ে এই রুমেই আত্মহত্যা করতাম। নিজের স্বামী কে আরেকটা মেয়ের সাথে এসব করতে দেখা বা শুনার চাইতে মরনও অনেক ভালো! পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে কত শত মানুষ কত না কত ভাবে মৃত্যু বরন করে অথচ আমার কেন মরন হয় না? আমি তো মরতে চাই, আমি আমার স্বেচ্ছায় মৃত্যু চাই। এই জঘন্য স্বার্থপর পৃথিবী থেকে অনেক, অনেক দূরে চলে যেতে চাই!

এক
আমি মিথিলা। সাগর আর আমার বিয়ের আজ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর হয়ে গেল। আমাদের বিয়ে পারিবারিক ভাবেই হয়েছিল যদিও প্রথমে সাগর আমাকে আমার এক কাজিনের বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখে পছন্দ করে। দুই গায়ে হলুদের দিন পিছনে পিছনে ঘুরে ও যখন বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন আমাকে সরাসরি প্রোপজ করল, আমি মাথা নীচু করে ওকে আমার বাসায় যোগাযোগ করতে বললাম। ছেলেটাকে বেশ ভালোই লেগেছিল, বাসায় যদি পছন্দ করে তাহলে তো কোন সমস্যাই থাকে না। আমার কাছ থেকে বাসার অ্যাড্রেস নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। ঢাকা ভার্সিটি থেকে ফিনান্সে মাস্টার্স করে এখন ভালো একটা ব্যাংকে জব করে। ক্যারিয়ার ভালো। বাবা আমার ইচ্ছার কথা শুনে আর না করলেন না। ঢুমঢাম করে হটাৎ বিয়ে হয়ে গেল!

বিয়ের পর প্রথম দুই বছর ভালই কাটল। সমস্যা শুরু হলো যখন দুই বছর পর বাচ্চা নেয়ার জন্য আমরা চেস্টা শুরু করলাম। চার মাস দুই জনের আপ্রান চেস্টা পরেও যখন কিছু হলো না তখন প্রথম আমরা ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিন জন ঢাকার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সবোর্চ্চ চেস্টার পরও পরবর্তি দেড় বছরে কোন লাভ হলো না। সাগর আমাকে সব কিছ খুলে বলত না। এই সব বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে উল্টা পালটা উত্তর দিয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেত। মনের মধ্যে ভয় আস্তে আস্তে প্রবেশ করছিল। সমস্যাটা কি শুধু আমার না ওর? আমাকে ও কিছুই বলতো না। আড়াই বছর পর যখন কোন কিছুই লাভ হলো না, সাগর আমাকে নিয়ে ভারতের চেন্নাইতে এক নাম করা স্পেসালাইজড ফার্টিলিটি হাসপাতালে নিয়ে গেল। এক বুক আশা নিয়ে দুই জন সেখানে গেলাম। যত রকমের টেস্ট করান যায়, সব গুলি টেস্ট আমাদের দুই জনকে করান হলো। যেদিন ফাইনাল রিপোর্ট দেবে, সাগর আমাকে না বলে চুপচাপ একাই চলে গেল। সাগর যখন ফিরে আসল ফাইনাল রিপোর্ট নিয়ে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভয় টা পেলাম। ও আমাকে কিছুই বলতে চাচ্ছিল না। ওর হাত থেকে ফাইনাল রিপোর্ট টা জোড় কেড়ে নিয়ে পড়ার পর আমি সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। সমস্যাটা আমার, ভয়াবহ সমস্যা। আমি কোনদিনও একবারের জন্য হলেও মা হতে পারব না। এর কোন চিকিৎসাও নেই। রোগের নাম লেখা ছিল “জেনেটিক ক্রোমজম ডিসঅর্ডার” যা মাত্র পৃথিবীর ৫-৮% মেয়েদের হতে পারে। আমি সেই চরম হতভাগ্য অল্প কিছু মেয়েদের একজন, যাদের জন্য কোন সুচিকিৎসা আজোও আবিষ্কার হয়নি। ভারত থেকে ফিরে এলাম এক বুক চরম হতাশা নিয়ে। সমস্ত পৃথিবী শুধুই আমার জন্য নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই না। জীবন টা বদলে গেল কিছু বুঝে উঠার আগেই………


দুই
দেশে ফেরার অল্প কিছু দিন পর থেকেই সাগর আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগল। দেরী করে বাসায় ফেরা প্রায় প্রতি দিনের রুটিন হয়ে গেল। আমার সাথে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। ও যে প্রতিনিয়ত নিজের মনের সাথে কঠিন যুদ্ধ করছে সেটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আজ আমার কিছুই করার নেই। নিজের জীবনের প্রতি ধীরে ধীরে ঘৃনা জমতে থাকল। ঠিক আমার এই চরম দুঃসময়ের মধ্যে বাবা আমাকে ফেলে একবারে চলে গেলেন। মা মারা গিয়েছিলো আগেই, পুরোপুরি এতীম হয়ে গেলাম। ওদের বাসার সবাই আস্তে আস্তে জেনে গেল, সাগরের উপর চাপ বাড়তে থাকল নতুন কিছু চিন্তা করার। শ্বাশুড়ীর চরম খারাপ ব্যবহার মুখ বুঝে সহ্য করে থাকতাম। আমি একটা অপয়া, বাযা, তার ছেলের জীবন আমি নষ্ট করে দিচ্ছি এসব বলে সারা দিন গালমন্দ করেন। পারলে প্রতিদিন সকাল বেলা উঠেই আমাকে ঘর থেকে বের করে দেন এই অবস্থা! সাগর এসব শুনেও না শুনার ভান করে থাকে। চার মাস পরে শ্বাশুড়ী এসে সরাসরি প্রস্তাব দিলেন, হয় সাগরের দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে হবে, না হয় তালাকের ব্যবস্থা করা হবে। একদিনের মধ্যে আমাকে আমার মতামত জানাতে বলা হলো। রাতে সাগর বাসায় ফিরলে কান্না করতে করতে যখন আমি এটা ওকে বললাম, সাগর চুপ করে থাকল। একটা শব্দও করল না। বুঝলাম ওর নিজেরও সায় আছে এতে। এতটা অসহায় আর নিরুপায় আমি যে, আমার বলার বা প্রতিবাদ করার কেউ পাত্তাই দিল না। এক মাস পরে আমার চোখের সামনে সাগরের বিয়ে হয়ে গেল। আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমাকে নিজের বেড রুম ছেড়ে দিয়ে অন্য ছোট একটা রুমে আশ্রয় নিতে হলো। অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলাম, জানি না বাকি জীবন টা কিভাবে কাটবে…………….


তিন
খুব মন থেকে চেস্টা করেছিলাম ওর নতুন বউ এর সাথে মানিয়ে নিতে। বাসায় কাজের মেয়ের চেয়েও আমার অবস্থা করুন। মুখ বুঝে সব কিছু সহ্য করে দিন কাটাতাম। সাগর আমার কাছে প্রায় আসতোই না। পরে জেনেছিলাম আমার শ্বাশুড়ি সাগর কে আমার রুমে যেতে মানা করে দিয়েছিল। ও এখন খুব মায়ের কথা শুনে, আমি এখন আর ওর কেউ না। প্রথম বছরেই সাগরের নতুন বউ কনসিভ করল। শ্বাশুড়ি নতুন বউ কে কোন কাজই করতে দেয় না, সব কাজই আমার করতে হয়। একা একা চুপচাপ কাজ করে যাই, কারো সাথে প্রায় কথাই হয় না। সাগর ওর নতুন বউ কে নিয়ে মহা ব্যস্ত থাকে। আমার কোন খোঁজও নেয় না। হাসপাতাল থেকে বাচ্চা টাকে বাসায় আনার পর সবাই বাসায় হইচই করে আনন্দ ফুর্তি করল, আমার কেউ খোঁজও নিল না। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে ডেকে নিয়ে বাচ্চার কাছে যেতে মানা করে দিলেন। আমি অপয়া, বাচ্চা কোলে নিলে বা আদর করলে বাচ্চার ক্ষতি পারে এই ভয় ওনার। চুপ করে শুনে আমার নিজের রুমে কান্নায় ভেঙে পরলাম। এত মানুষ মারা যায় আমি কেন বেঁচে আছি? আর এভাবে কত কষ্ট আমাকে সহ্য করতে হবে? একদিন বাচ্চাটা কান্না করছে, কাছে কেউ নেই। খুব লোভ হলো বাচ্চাটা কোলে নেবার। ছেলেটা অবিকল সাগরের মতো হয়েছে। লোভ সামলাতে পড়লাম না। নিজে তো কখনো মা হতে পারব না। অন্যের বাচ্চা কোলে নেয়া ছাড়া উপাই কি? আমার কপাল সব সময়ই খারাপ। শ্বাশুড়ি দেখে ফেললেন, যা তা ভাষায় বকাঝকা করলেন। বাচ্চার মা এসে দেখে সেটা নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটাল। ভয় পেয়ে আমি নিজের রুমে যেয়ে চুপ করে শুয়ে আছি। না জানি আজকে আমার কপালে কি আছে? সাগর বিকাল বেলা আসতেই এটা নিয়ে হইচই আবার শুরু হয়ে গেল শ্বাশুড়ির ইন্ধনে। সাগরের নতুন বউ বিয়ের পর থেকেই সুযোগ খুজছিল আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়ে চিরতরে রাস্তা পরিষ্কার করার। এবার সেই সুযোগ পেয়ে গেল। সরাসরি সাগরকে বলে দিল আমি যদি এই বাসায় থাকি তাহলে ও বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি একবারে চলে যাবে। সাগর পড়ল উভয় সংকটে। আমি আমার বেডে শুয়ে অবিরত কান্না করে যাচ্ছি। এই সময় সাগর অনেক দিন পরে আমার রুমে এল। অনেকখন চুপ করে আমার পাশে বসে থাকল। হয়ত আমাকে কি বলবে সেটা ঠিক করছে মনে মনে। আমার বর্তমান অবস্থা ওর চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।
-মিথিলা, এত অপমান সহ্য করে কতদিন এখানে তুমি টিকে থাকবে, বলো? এর চেয়ে আমি তোমাকে আলাদা বাসা ভাড়া করে দেই। এত অপমান সহ্য করার চেয়ে সেখানে অনেক ভালো থাকবে।
কান্না থামিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছি। যেই ছেলে আমাকে বিয়ের আগে একবার একপলক দেখার জন্য বাসার বাইরের গেটের সামনে বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে থাকত, আজ সেই আমাকে আলাদা করে দিতে চাচ্ছে! সময় কত দ্রুতই না সব কিছু বদলে দেয়? এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমাকে আর কত কিছু দেখে যেতে হবে? আমি সাগরকে অনেক বুঝানোর চেস্টা করলাম, আমি কখনো একা থাকিনি, একা একা ভয়ে আমি মরেই যাবো। কিন্তু কে শুনে কার কথা? ও মনে হয় ঠিক করেই এসেছে এটা।
-আমি বাসায় শান্তি তে থাকতে চাই। এত ঝামেলা নিয়ে আমি থাকতে চাই না।
আমি এখন তাহলে ওর কাছে শুধুই ঝামেলা! আর তর্ক করলাম না। কি লাভ? কিছুক্ষন আগে শুনলাম শ্বাশুড়ি সাগরকে বলছে আমাকে তালাক দিয়ে একবারে বের করে দিতে। বাসায় অনেকদিন কুকুর বেড়াল থাকলে যে রকম মায়া জন্মায় হয়ত সে কারনে এখন আমাকে তালাক দিচ্ছে না। আমি যদি বেশি জিদ করি তাহলে হয়ত শেষ পর্যন্ত এই মায়া নাও থাকতে পারে! সাগরের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। তালাকের চেয়ে এটা ভালো! অন্ততঃ কিছু একটা সম্পর্ক তো থাকলো! সেটাও বা আমার জন্য কম কিসের…………


চার
আজ নিয়ে প্রায় তিন মাস হলো। সাগর আমার এই বাসায় আসেই না। আগে এসে অন্তত প্রতি মাসে বাসা ভাড়ার টাকাটা দিয়ে যেত। এখন তাও আসে না। একলা একটা মেয়ে কিভাবে দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে বেঁচে না মরে গেছে সেটার খোঁজও নেয় না। আগে মোবাইলে ফোন দিত, কি যে ভালো লাগত ওর গলাটা শুনতে পেলে! আমি তীর্থের কাকের মতো শুধু ওর গলাটা শুনার জন্য দিন রাত অপেক্ষা করে থাকতাম। এখন তাও দেয় না। আমি ফোন দিলে দুই একটা অতি প্রয়োজনীয় কথা বলে লাইন কেটে দেয়, একবার জিজ্ঞেসও করে না আমি কেমন আছি? ও এখন খুব ব্যস্ত নতুন বউ, একমাত্র ছেলে আর নিজের সংসার নিয়ে। সবাই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে দিন কাটাচ্ছে। আমার যে কিছুই নেই! যা কিছু নিজের ছিল, ছিল বলে ভাবতাম, তাও সবাই আমার কাছ থেকে একে একে কেড়ে নিয়ে গেল! তারপরও যে কিভাবে কিভাবে দিন গুলি কেটে যাচ্ছে জানি না। প্রতি দিন সুর্যদোয় হয় আবার সুর্যাস্ত হয় নিয়ম করে, কিন্তু মাঝখানের সময় গুলি কোন দিক দিয়ে পার হয়ে যায় আমি জানি না! জানতেও চাইও না। কোন কিছুই আর ভালো লাগে না। জীবনে বেঁচে থাকার নুন্যতম আগ্রহটাও অনেক আগেই আমি হারিয়ে ফেলেছি…………..


পাঁচ
বাড়িওয়ালা আংকেল খুব ভালো মানুষ। মনুষত্ব্য শব্দ টা যে আজও কিছু মানুষ বিশ্বাস করে সেটা তাকে দেখে শিখলাম। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল। গত দুই মাসের ভাড়া এমনিতেই দিতে পারিনি। কোন রকমে এক বেলা রান্না করে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি, ভাড়ার টাকা দিব কোথা থেকে? আজও যখন উনি আমাকে ডেকে পাঠালেন, কি যে লজ্জা লাগছিল! মনে মনে চাইছিলাম ধরনী তুমি দ্বিধা হয়, তোমার চরনে আশ্র‍য় নেই। মাথা নীচু করে চাচা'র সামনে দাড়িয়ে চুপ করে রইলাম, কি বলব? চাচা আমাকে সামনে রাখা সোফায় বসতে বললে খুব লজ্জা লাগছিল বসতে। আমার চোখ মনে হয় জলে ভিজে গিয়েছিল। অনেক অনেক দিন হলো কেউ আমার সাথে এত ভালো করে কথা বলে না।
-মা, তুমি তো এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারবে না? তোমার জামাই তোমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাচ্ছে না এটা কেন বুঝতে পারছ না? তুমি একটা শিক্ষিত মেয়ে, কেন আরেক জনের উপর নির্ভর করে এইভাবে বেঁচে আছ? এটা কোন বেঁচে থাকা হলো! আল্লাহ মানুষকে দুটা হাত আর দুইটা পা দিয়েছেন। যতদিন এইগুলি ঠিক থাকবে কারো কাছে হাত পাতবে না।
-কালকে থেকে কিছু করার চেস্টা শুরু কর। মেয়েদের এখন চাকরীর অনেক সুযোগ তৈরী হয়েছে। এই ভাবে চুপচাপ ঘরে বসে থাকা চলবে না। আমিও দেখি তোমার জন্য কিছুর ব্যবস্থা করা যায় কিনা?
-আর, শোন, যতদিন টাকা পয়সা রোজগার করার ব্যবস্থা করতে না পারবে, ততদিন বাসা ভাড়া নিয়ে লজ্জা পেতে হবে না। তুমি ভাড়া নেবার আগে ছাদের এই এক রুমের বাসাটা এমনিতেই তালা মেরে রাখতাম। তুমি আমার মেয়ের মতন, আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন, শুকরিয়া করে তার শেষ করতে পারব না। যেদিন প্রথম বেতন পাবে সেদিন থেকে ভাড়া দেয়া শুরু করবে। আমি খুশি হয়ে নিজের হাতে তোমার হাত থেকে ভাড়া নিব।
বাবা মারা গেছেন প্রায় দুই বছর হলো। বড় ভাইয়ের নিজের সংসার। ভাবীর ব্যবহার ভালো না। সামান্য কারনে চরম দুরব্যবহার করেন। আমাকে একটা উটকো ঝামেলা মনে করেন। আত্ম সম্মানের ভয়ে ভাইয়ার বাসায় আশ্রয় নেই নি। ভাইয়া নিজের সীমাবদ্ধতা জানেন। লজ্জায় আমার সাথে দেখা করেন না। বাসায় লোক দিয়ে অনেক বাজার আর টাকা পয়সা পাঠিয়ে দেন। সেটার উপরই এত দিন বেঁচে আছি। বাবা মারা যাবার পর কত দিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবী তে আমার সাথে কেউ এত ভালো ব্যবহার করেনি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না! চিৎকার করে কেঁদে উঠে চাচা'র পা দুটো জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলাম আর বাবা বাবা বলে ডাকতে থাকলাম। চাচা আমাকে ইচ্ছে করেই কাদতে দিলেন, মনে হয় বুক টা হাল্কা করার জন্য। সস্নেহে শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। একটু যখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছি, চাচা খুব নরম ভাষায় বললেনঃ
-আমার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল। আল্লাহ একটা দিয়েও ছিলেন। দেড় বছরের মাথায় মাত্র একদিনের জ্বরে আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল। মা, তুমি নিজেকে শক্ত কর। এত ভেঙে পড়লে চলবে না। আমি তোমার কষ্ট গুলি বুঝি। বাবা ছাড়া এই পৃথিবী তে মেয়ের কষ্ট কেউ বুঝে না।
অসম্ভব একটা ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে আসলাম। চাচা যা বলেছেন সেটাই ঠিক। আমাকে শক্ত হতে হবে। এত সহজে জীবনের হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। ইচ্ছে করলে একটা মেয়েও যে অনেক কিছু করতে পারে সেটা প্রমান করে দিতে হবে। অনেক, অনেক দিন পরে ব্যাগ খুলে শিক্ষা জীবনের সব সার্টিফিকেট গুলি বের করলাম, ধুলা ময়লা লেগে একটু অপরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ভালো করে মুছলাম। এখন এগুলিই আমার একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন……………


ছয়
লেখাপড়াটা শেখাটা মেয়েদের জন্য খুবই জরুরী। বাবা যখন জোড় দিয়ে শুধু লেখাপড়ার কথা বলত তখন মনে হত কি হবে মেয়েদের এত লেখাপড়া দিয়ে? শেষ পর্যন্ত তো ওই রান্না ঘরের হাড়িই তো ঠেলতে হবে? কি দরকার এত কষ্ট করার? আজ বুঝতে পারলাম কেন বাবা এসব বলত। হাতের জমান টাকা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কিছু একটা শুরু করতেই হবে। ঢাকা ভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে মাস্টার ডিগ্রী নিয়ে ঘরে বসে ছিলাম শুধুই সাগর চাইত না দেখে। মেয়েদের চাকরি করা ও কোন ভাবেই পছন্দ করত না। ওর জন্য চাকরি শুরু করব করব বলেও শেষ পর্যন্ত করা হয়ে উঠল না। বাবা যখন আমার ইচ্ছে বুঝল তখন খুব করে বকা দিয়েছিল আর বলেছিল একদিন না একদিন এর ফল আমি নিজের হাতেই পাব। আজ বাবা'র কথা গুলির হাতে নাতে ফল পেলাম। জীবনে কখন কোথাও কারো কাছে কিছু নিজের জন্য চাইতে শিখিনি। না পাওয়ার কষ্ট গুলি বুকের মাঝেই পাথর চাপা দিতাম। সময় মনে হয় খুব কাছে চলে এসেছে কিছু স্বভাব বদলে ফেলার। নিজেকে বদলে ফেলার…………


সাত
প্রতি দিন সকাল বেলা করে বাড়িওয়ালারা বাসায় যেয়ে নিউজ পেপারে জব অফারিংস গুলি দেখে আসি। প্রায় সব জায়গায় অভিজ্ঞতা চায়, এটা আমি কোথায় পাব? বিয়ের পর থেকেই তো শুধু রান্না ঘরের হাড়িই ঠেলে এসেছি! রিসিপশনিস্ট বা এরকম দুই একটা জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়ে আসলাম। মামা চাচার জোড় না থাকলে হবে না। একটা জায়গায় জব পেলাম একমাস পরে কিন্তু একদিন চাকরী করার পরেই ছেড়ে দিয়ে বাসায় চলে আসলাম। যার আন্ডারে চাকরী করতে হবে সেই লোক টা ভালো না, চোখের দৃষ্টিও ভালো না। আমার বর্তমান অবস্থা শুনে আকার ইংগিতে অন্য কিছু বুঝালেন। এতটা নীচে মনে হয় নামতে পারব না। মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে অনেক সমস্যা, অনেক কিছু কাউকে বলাও যায় না। কয়েক টা এনজিও তে কথা বললাম। বাইরে বাইরে কাজ করতে হবে। সারা জীবন স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি আর বাসা ছাড়া কোথাও যাই নি। বাবা মেয়েদের অযথা বাইরে ঘুরাঘুরি করা পছন্দ করতেন না। মনও সায় দিল না। যা পারব না আর মনও চায় না সেখানে চেস্টা করে লাভ কি? দেখি না আর কয়েক দিন। দেয়াল পিঠ ঠেকে গেল না হয় ছোটো খাট কিছু একটা করা যাবে। আপাতত চেস্টাটা বন্ধ করা যাবে না। যার কেউ থাকে না আল্লাহ তার সহায়। আমার মত এরকম একজন অসহায় এতীম মেয়ের দিকে কি একবারও কি তিনি মুখ তুলে তাকাবেন না?
তিন তলার ভাবী আমার প্রায় সমবয়সি। মাঝে মাঝে আমার বাসায় এসে গল্প করে যান। সেদিন সকাল বেলা হুট করে এসে হাজির। এই সময়ে সাধারণত উনি আসেন না। দরজা খুলে দিতেই এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বেডে নিয়ে বসালেন।
-তোমার জন্য একটা সুখবর আছে। আমার মেঝ খালা ঢাকার একটা বেসরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। গতকালকে আমার বাসায় তিনি বেড়াতে এসেছিলেন। কথায় কথায় তোমার বিষয়ে বলতেই উনি বললেন যে উনার স্কুলে একটা পোস্ট সম্প্রতি ফাঁকা হয়েছে। কালকে উনি সরাসরি ইন্টারভিউ নিবেন। তোমাকে একটা ভালো সিভি আর ছবি সহ কালকেই যেতে বলেছেন। যাবার আগে আমার কাছ থেকে আড্রেস নিয়ে যাবে। আমি খালাকে খুব করে তোমার জন্য বলে দিয়েছি। বেতন খুব একটা বেশি না, তাতে কি? তোমার তো কিছু একটা শুরু করা দরকার। আমি নিউজ পেপার থেকে তোমার জন্য এই অ্যাড টা ছিড়ে নিয়ে এসেছি, এই নাও।
কথা গুলি শুনে চোখে পানি চলে আসল। গায়ে পড়ে এভাবে কারো কেউ উপকার করতে পারে বিশ্বাস হচ্ছে না! প্রাথমিক স্কুলের ক্লাস টু থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়াতে হবে। আমার জন্য যথেষ্ঠ।
-কি বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দিব তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি এখনই কাগজ পত্র গুলি রেডি করছি। বিকাল বেলা তোমার কাছ থেকে আড্রেস টা নিয়ে আসব।
ভাবী আর বসলেন না। স্কুল থেকে উনার ছোট মেয়েকে আনতে হবে, তাড়াতাড়ি চলে গেলেন……..


আট
সকাল সকাল আমি সব কাগজ পত্র সহ ঐ স্কুলে হাজির হলাম। সাত আট জনের মতো ক্যান্ডিডেট বসে আছে। আমার সিভি টা জমা দিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। একে একে সবাই কে সিরিয়াল ধরে ডাকছে। সবশেষে আমার পালা এলো। দরজা খুলে ছালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। একজন বয়স্ক মহিলা আর তার সাথে আরো দুইজন ভদ্রলোক বসে আছেন। আমাকে সামনে রাখা চেয়ারে বসতে বলে আমার সিভি টা সবাই ভালো করে পড়ল। বয়স্ক মহিলাই শুরু করলেনঃ
-আপনি সিভি তে বৈবাহিক অবস্থা জানি না লিখেছেন কেন?
আমি চুপ করে আছি দেখে আবারও একি প্রশ্ন করলেন।
এই বার চুপ থাকা টা মনে হয় ঠিক হবে না। তাই বললামঃ
-আমি আমার বৈবাহিক অবস্থা আসলে এখন কি, তা সত্যই আমি জানি না, তাই এটা লিখেছি।
-আমি আপনার ব্যাপারে হালকা কিছু শুনেছি। আপনি আপনার বর্তমান অবস্থা খুলে বলুন। আমরা বিস্তারিত জানতে চাই। লজ্জা করার কিছু নেই। সাথের দুই জনকে আমি অলরেডি আপনার ব্যাপারে কিছুটা জানিয়েছি। তারাও পুরোটা শুনতে চান। আর আপনি এই পোষ্ট এর জন্য অবশ্যই উপযুক্ত।
আমি মাথা নীচু করে আমার এই অনিশ্চিত জীবনের সব কথা লজ্জার শরম ত্যাগ করে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললাম।
সব শোনার পর, সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর একজন ভদ্রলোক আমাকে বললেনঃ
-এই চাকরীটা আপনার চেয়ে বেশী কারো দরকার হতে পারে না। আপনি ভয় পাবেন না। আমরা আপনার পাশে আছি। বেতন শুরুতে খুব বেশি দিতে পারব না, তাতে কি, আপনার তো অন্তত একটা কিছু দরকার। আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আমরা চেস্টা করে দেখি আপনার জন্য কিছু করতে পারি কিনা!
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, আমি কল্পনাও করতে পারিনি এত বড় সুযোগ আমি পাবো। সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। বেতন শুরুতে বারো হাজার দিবে আর যদি ভালো করতে পারি তাহলে ছয় মাস পর থেকে আরো বাড়িয়ে দেবে। চেয়ার থেকে উঠে ভাবীর মেঝ খালাকে পা ছুঁয়ে ছালাম করলাম। বাকিদেরও করতে চেয়েছিলাম তারা দিলেন না। আমাকে দুই একদিন অপেক্ষা করতে বললেন এপয়েনমেন্ট লেটারের জন্য। অনেক দিন পরে আমার জীবনে একটা সুখবর পেলাম। খুব খুশি খুশি মন নিয়ে ঘরে ফিরে আসলাম।
দুপুর বেলা ভাবীর মেঝ খালা আমাকে ফোন দিল।
-আসলে সামনা সামনি বলতে পারছিলাম না, তোমার যেই অবস্থা তাতে কিভাবে যে বলি, এই চাকরীর জন্য কিছু টাকা তোমাকে খরচ করতে হবে। স্কুল কমিটি জন্য পচিশ হাজার আর স্কুলের ফান্ডে পচিশ হাজার লাগবে। আমরা অনেক চেস্টা করে তোমার জন্য স্কুলের ফান্ডের পচিশ হাজার মাপ করিয়েছি, কিন্তু স্কুল কমিটির সভাপতি কোন ছাড় দিবেন না। পলিটিক্যাল লোক তো, এদের মধ্যে কোন মনুষত্ব্য বলে কিছু নেই। তুমি কি যে কোন ভাবে এই টাকাটা জোগার করতে পারবে? পারলে কালকেই টাকাটা নিয়ে আস, আমি পারলে কালকেই এপয়েনমেন্ট লেটার টা তোমার নামে ইসু করে দিব। যত দেরি হবে ততই ক্যান্ডিডেট বাড়তে থাকবে। পরে হয়ত আমার হাতে কিছু করারও থাকবে না।

আমি ফোনেই আমার রাজি হবার কথা বলে দিলাম আর বললাম আমি কালকে স্কুলে টাকা টা দিয়ে আসব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ভালো সুযোগ বারবার আসে না, যেভাবেই হোক এই টাকাটা আমাকে আজকের মধ্যে জোগার করতেই হবে………
সাগরের বাসা থেকে চলে আসার সময় আমার বিয়ের সর্নালংকার গুলি সাথে নিয়ে এসেছিলাম। এই গুলি একান্তই আমার। মাঝে মাঝে বিপদের সময় কিছু বিক্রি করেছিলাম যে দোকানে, সেখানেই মা'র দেয়া বিয়ের গলার হাড় টা নিয়ে গেলাম। নিয়ে যাবার আগে হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কাদলাম। মায়ের স্মৃতি বলতে এটাই শুধু আমার কাছে ছিল, আজ এটাও বিক্রি করে দিচ্ছি। কিছুই করার নেই, আমি এখন ডেস্পারেট হয়ে গেছি, এই চাকরী টা আমার লাগবেই, যেভাবেই হোক………

দুই দিন পরে স্কুল থেকে দুই কপি এপয়েনমেন্ট লেটার পাঠাল স্কুলের পিয়ন কে দিয়ে সরাসরি আমার বাসায়। পিয়ন কে দাড়া করিয়ে সাথে সাথেই সাইন করে অফিস কপি ফেরত পাঠালাম যেভাবে আমাকে ভাবীর মেঝ খালা বলে দিয়েছিলেন……..

নয়
প্রথম মাসের বেতনটা যখন হাতে পেলাম কি যে ভালো লাগছিল! আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম কি করব! স্কুল থেকে বের হয়েই আড়ং এ যেয়ে চাচার জন্য একটা সুন্দর পাঞ্জাবি আর পায়জামা কিনলাম। ফেরার পথে তিন তলার ভাবীর জন্য কিনলাম একটা আন স্ট্রীচ থ্রি পিছ। এরা দুইজনই আমার জন্য যা করেছে সারা জীবনেও এর শোধ হবে না। সন্ধ্যার পরে চাচার আর ভাবীর হাতে নিজেই কাপড় গুলি দিয়ে আসলাম। জমান টাকা আর বেতন মিলিয়ে হাতে ভালোই জমেছে। মা'র হাড় টা দুই ভড়ির উপরে ছিলো। স্কুলের টাকাটা দেবার পরও হাতে অনেক রয়ে গিয়েছিল। গত তিন মাসের বকেয়া সহ বাড়ি ভাড়াও দিয়ে আসলাম। অনেক লজ্জার মধ্যে ছিলাম এই কয়দিন। চাচার হাতে ভাড়ার টাকাটা যখন দিলাম উনি কেঁদে ফেললেন, উনাকে কাঁদতে দেখে আমিও কেঁদে ফেললাম। আগের বার কেঁদেছিলাম আমি কষ্টে আর এবার দুই জনই খুশিতে………………

দশ
দেখতে দেখতে আট মাস চলে গেল! প্রথম স্কুলের চাকরি টাই এখনও করছি। খুব মনোযোগ দিয়ে ক্লাসে পড়াই। ছুটি নেই না বললেই চলে। একা একা ছুটি নিয়ে কি করব! বেতন বাড়িয়ে আঠারো হাজার করে দিয়েছে। আমাকে এখন উপরের ক্লাসের কেমিস্ট্রি পড়াতে হয় আর কেমিস্ট্রি ল্যাবে প্র্যাকটিক্যালও করাতে হয়। কি যে ভালো লাগে ছেলেমেয়ে গুলি কে পড়াতে! অনেক অনেক আদর লাগে! আমি কক্ষনো বকাঝকা করি না। দুস্টামি করলে কিংবা ভুল করলে মাথায় হাত দিয়ে সুন্দর করে বুঝিয়ে দেই।
বাসার পাশেই একটা নতুন কোচিং সেন্টার খুলেছে। কেমিস্ট্রির টিচার শুনে বাসায় এসে জবের অফার দিল। স্কুলের ক্লাস শেষ হবার পর এখানে ক্লাস নিতে বলল। আপত্তি করলাম না। স্কুল থেকে ফেরার পর বাসায় তেমন কোন কাজ থাকে না। তাছাড়া টাকা পয়সা ভালোই দিবে। টাকা পয়সার মুল্য কি জীবনে এক সময় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। কালকে থেকে জয়েন করবো বলে দিলাম।


এগারো
সপ্তাহ দুই পরে একদিন স্কুলের পর কোচিং এর ক্লাস শেষ করে বাজারে গেলাম কেনা কাটার জন্য। বাজার শেষ করে বাসায় ফিরছি। বাসার একটু দূরে বড় রাস্তাটা আটকান। আমি রিকশায় বসে আছি সারা মাসের বাসার সদাই নিয়ে। এত গুলি বাজার হাতে নিয়ে হেটে যেতে পারবো না। প্রায় দশ মিনিটের মতো বসে আছি। ভীড় কমছেই না দেখে রিকশা থেকে নেমে দেখতে গেলাম কি হয়েছে। ভীড় ঠেলে সামনে যেয়ে দেখি ভয়াবহ এক্সিডেন্ট! একটা মধ্য বয়স্ক মহিলা, সম্ভবত ভিখারিনী হবে, পোষাক দেখে তাই মনে হচ্ছে, রাস্তার উপর পরে আছে। মাথা ফেটে রক্ত বের হয়ে সারা রাস্তা ছয়লাব! দেখে আমার প্রায় বমি চলে আসছিল। হটাত কান্নার শব্দ শুনে ভালো করে তাকিয়ে দেখি একটা সম্ভবত দেড় বা দুই বছরের বাচ্চা চিৎকার করে কাদছে। কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। পাশের জনকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?
-ফকিরনী টা এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বড় রাস্তা টা পার হচ্ছিল। ওই দিক থেকে একটা প্রাইভেট কার অনেক জোড়ে এদিকে আসছিল। নতুন ড্রাইভার মনে হয়, সামলাতে পারেনি, মেরে দিয়ে চলে গেছে। আহা, এতটুকু বাচ্চা টাকে একদম এতীম করে দিয়ে গেল।
কথা গুলি শুনে আমার মনের ভিতর কি হলো আমি জানি না, আমি এগিয়ে যেয়ে রাস্তায় পরে থাকা কান্নারত বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলাম। গায়ে ময়লা কাপড়, হাত পা ময়লা লেগে কালো হয়ে আছে। আমি কোলে নিলাম পর বাচ্চাটা কান্না থামিয়ে আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে! এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কে ওকে কোলে নিল বুঝতে পারছে না। জলে ভেজা চোখে কান্না থামিয়ে বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকজন আস্তে আস্তে যে যার মতো চলে যাচ্ছে। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আমি রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছি, কি করব বুঝতে পারছি না…….


বার
ঘরের দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকতেই সোমা আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। আধো আধো বুলি তে বললঃ
-মা, আমার চলকেট কই?
আমি হেসে ভেনিটি ব্যাগ খুলে ক্যাডবেরীর একটা বড় প্যাকেট খুলে ওর হাতে দিলাম। সোমা তখনই বেডে বসে ওর চলকেট খাওয়া শুরু করে দিল। আমি ভেনিটি ব্যাগটা আলমিরায় রেখে ঘরে পড়ার কাপড় নিলাম ড্রেস চেঞ্জ করার। সোমা কিছু চাইলে আমি কখনো না করি না, যা চায় কিনে দেই। আমার সব কিছু তো ওর জন্যই। বাচ্চাটার দিকে যখনই তাকাই থানার ওসি সাহেব কে মনে মনে ধন্যবাদ দেই। সেদিন উনি রাস্তায় আমার সব কিছু শুনে বাচ্চাটা আমাকে দিয়ে দিলেন। সাত দিন পর চাইল্ড কাস্টোডিয়ানের কাগজ পত্র কিভাবে যেন জোগাড় করে আমার বাসায় এসে দিয়ে গেলেন! এই সব কিছু কিছু ভাল মানুষের জন্যই পৃথিবী টা এখন এত সুন্দর লাগে, এত মায়া মায়া লাগে! শত নিরাশার মাঝেও নতুন আশার আলোর দ্বীপ জ্বেলে দিয়ে যায়। নতুন করে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে আবার ভালোবাসতে…………….

পরের পর্ব পড়ে আসুন এখান থেকে গল্প - মিথিলার ভালোবাসা

পটভুমিঃ শিখা রহমান আপুর পর পর নতুন দুইটা গল্প পড়ার পর হঠাৎ করেই মেয়েদের নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করল! আপুকে মন্তব্যের ঘরে বলেও এসেছিলাম। বরাবরের মতো এবারো অড টপিক নিয়ে লিখলাম। জানি না কেমন হয়েছে? মূল্যায়নের দায়ভার আমার পাঠকদের কাছেই ছেড়ে দিলাম।

সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ,অক্টোবর, ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:২১
৭০টি মন্তব্য ৬৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×