টিভিতে লাইভ অনুষ্ঠানে নজরুলের গান শুনছিলাম। এমন সময় স্ক্রলে ভেসে উঠলো একটি লাইন, লাল কালিতে: 'সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রিক দেবীর আদলে তৈরি মূর্তি সরানোর কাজ চলছে'। চমক লাগলো না, কারণ এটা অনুমিতই ছিলো। চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে এটিএন নিউজে গিয়ে দেখি লাইভ দেখাচ্ছে মূর্তি সরানোর কাজ।
.
সুপ্রিম কোর্টের মূল ফটকের লোহার শিকের ভেতরের ফাঁকটুকু দিয়ে ক্যামেরার লেন্স তুলে এনেছে ভেতরের দৃশ্য। কালো টিশার্ট পড়া একজন বয়স্ক লোক, মাথায় এলোমেলো চুল, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। টিভিতে বলছে আনুমানিক তিনি ভাস্কর্যটির ভাস্কর মৃণাল হক। তাঁকে ব্যাক্তিগতভাবে চিনি বিধায় আমি নিশ্চিত ছিলাম তিনিই মৃণালদা। মোবাইলে কথা বলছেন, আর দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। একটু পর সিগারেটে শেষ টান দিয়ে তিনি মোবাইলটা বাম হাত দিয়ে প্যান্টের বা পকেটে রেখে টিভি ক্যামেরার দিকে হেঁটে এলেন।
.
এই মৃণাল হককে চেনা যাচ্ছিলো না। কোনো এক রাতে আনুমানিক ১১টার দিকে আগের অফিস থেকে ফেরার পথে হোটেল শেরাটনের সামনে 'রাজসিক' এর সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করতে দেখেছিলাম তাঁকে। সেদিন তিনি ছিলেন প্রাণচঞ্চল, হাসিমুখে কথা বলেছিলেন। আজ তাঁর চোখে জল, গা জড়িয়ে নেমে আসছে ঘাম। টিশার্টের বোতামগুলো খোলা। জানতে চাওয়া হলো, তিনি এতো রাতে এখানে কেন? কর্তৃপক্ষ কই? তিনি জানালেন, যাতে ভাস্কর্যটি অন্য কেউ সরিয়ে ফেলতে গিয়ে ভেঙে না ফেলে তাই তিনিই ছুঁটে এসেছেন। পরবর্তী প্রশ্ন, সরাতে হচ্ছে কেন দাদা? সরাসরি জবাব না দিয়ে নানামুখী চাপের কথা বললেন তিনি, যেহেতু তিনিই তৈরি করেছেন, তাই তাঁর ওপরই নাকি চাপটা বেশি। ভাস্কর্যটির পোশাক দেখিয়ে বললেন, এটা তো শাড়ি-ব্লাউজ পড়া বাঙালি মেয়ে, ন্যায়বিচারের প্রতীক, গ্রিক আমেরিকান মূর্তি হবে কেন? এরপর নির্দেশ আসবে অপরাজেয় বাংলা সরাও, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরাও, রাজু ভাস্কর্য সরাও..'
.
কথার এক পর্যায়ে লালন ভাস্কর্যে কোটি টাকার ওপর লস খাওয়ার কথা বলে ভাস্কর মৃণাল হক বললেন, আমেরিকায় খুব ভালো ছিলাম আমি। গোটা নিউ ইয়র্ক সিটির সৌন্দর্য বৃদ্ধির দায়িত্ব ছিলো আমার ওপর। দেশে ফিরে কী পেলাম? সবাই যে বলে দেশপ্রেম দেশপ্রেম, আমি তো এসে দেশপ্রেম দেখিয়েছি। অন্যরা আমার কাজের সমালোচনা করে, তারা কেন এসে করে না?
.
ভাস্কর্যটি কোথায় সরানো হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'অ্যানেস্কের সামনে হতে পারে'। এরপর 'সব কথা বলতে চাচ্ছি না, আপনারা আমায় ক্ষমা করেন' বলে ভাস্কর্য সরানোর কাজ তদারকের কাজে আবার ফিরে গেলেন ভাস্কর মৃণাল হক। বুকে কান্না চেপে যেন নিজ হাতে সন্তানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করছেন এক পিতা।
.
জয় বাংলা। জয় হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৭ ভোর ৪:২০