বর্তমানের তথাকথিত পার্লার বা মেকওভার সেলুন নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুনে। দেখতে সাধারন মেয়েটিও বৌ এর সাজে নজরকাড়া রাজকন্যা। গুরুত্ব না দেয়া পরিচিত মেয়েটাকেই বিয়েতে বৌয়ের সাজে দেখে অনেক ‘এলিজেবল ব্যাচেলর’ এর মাকেই গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখেছি। সে যাই হোক, রাজকন্যার বেশে বিয়ে পরে রানী হয়ে শ্বশুরালয়ে পৌঁছেই বদলে যায় নারীর ভূমিকা। তখন তিনি স্ত্রী, পুত্রবধু, ভাবী, ভাই বৌ, চাচী, মামী। তাকে হতে হয় দেবী দূর্গার মত দশভুজা। এই দশভুজা কেবল কর্মে, কতৃত্বে নন।
মেয়েদের কনফিডেন্স বরাবর-ই বেশি। একজন নারীকে বিয়ে করে বাড়ী আনতে ১০০ বরযাত্রী যায়। মেয়েটা কিন্তু একাই আসে। তারপর থেকে শুরু হয় তাকে গড়ে নেয়ার প্রশিক্ষন। কেননা এতোদিন সে যেটা শিখেছে সেটা কুশিক্ষা। সুশিক্ষিত করার মহান ব্রত নিয়ে অপেক্ষা করছিল নারীর আপন শ্বশুরালয়। একজন নিবেদন প্রাণ পুরুষ পুরো পরিবার নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা শুরু করে বদলের আয়োজন।শ্বাশু্রবাড়ির লোকজন বৌয়ের রান্না মুখে তুলতে পারেননা, তাই তাকে সেরা রাধুনী বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শ্বাশুড়ী। বাড়ির বৌকে আরো পরিশ্রমী হতে হবে এমন আদেশ আসে ননাশ দের কাছ থেকে। ননদ বলে, আর উদার হতে শেখো ভাবি। জ্যা’রা বলেন মেনে নাও ভাই। মেনে নেয়া-ই শান্তি। জ্যা এর পলিটিকাল হাসি, “শুধু আমার সাথে হবে কেন! তুমিও কিছু ভোগ করো”।
এতো গেলো ভূমিকা। এবার বলি বিস্তারিত, রাজপূত্র দিনের পর দিন, বছরের পর বছর হলে, হোস্টেলে, মেসে বুয়ার হাতের রান্না খান কিন্তু বিয়ের পর রাধতে হবে সেই বৌ কেই। কেন? সোনার চুড়ি হাতে পরিয়ে ঘরে এনেছেন, তাই! দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা যাবে না। তাই শ্বাশুড়ির উষ্মা “তোমার মা তোমাকে কি কিছুই শেখায়নি?” যেন নারী বিয়ের আগে যে জীবন যাপন করত তা ছিল সংবিধান বিরোধী। যা শিখেছে তা অসম্পূর্ন। অনেক ক্ষেত্রে-ই সেটা হয়ে যায় কু-শিক্ষা। এই পুরো প্রক্রিয়ায় পুত্র অদৃশ্য। কারন সব আয়োজন কিংবা শিক্ষন তো সেই মহারাজের জন্য-ই। তিনি নারীর ভরনপোষনের দায়িত্ব নিয়েছেন। জি বাংলার সিরিয়ালে যেটা কে বেশ ঘটা করেই দেখানো হয়। বেশ আয়োজন করে দেখানো হয় “তোমার ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম”। তার জন্য এটুকু তো নিতান্তই সামান্য, তাই না?
স্টার প্লাস এর সান্ধ্যকালীন সিরিয়াল “সাত নিভানা সাথীয়া” দেখে অনেক শাশুড়ী সুশিক্ষিত হয়েছেন। মাঝে মাঝে কোকীলা বেহেন এর ভাব দেখে আমার সন্দেহ হয়, তিনি কি পরিবার চালান নাকি দেশ শাসন করেন! সিরিয়ালের মত সুন্দর সুনিপুনা বৌই সম্ভবত শাশুড়ীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। কেমন লক্ষ্মীমন্ত সর্বংসহা বৌ। সব বেদনা মুখ বুঝে সহ্য করে! সিরিয়াল দেখে মনে হবে, মেয়েদের জীবনের ধ্যান জ্ঞান হবে একটা “ভাল বিয়ে”। বিয়ে হলেই মেয়েটি রাতারাতি ক্ষমতার কেন্দ্রে। সেখানে নারীর যে উপস্থাপন তাতে, আদিম অকৃত্তিম পরিবার প্রথাকেই মনে হবে সবথেকে জটিল প্রতিষ্ঠান।
বিয়ে নামক প্রচলিত প্রথাতে নারী হক-ই মোহর নিয়ে নারীর মতামত নেয়া হয় না।দেনমোহর নিয়ে দরকষাকষি কিন্তু পুরুষ-ই করে। নারীর মূল্য নিরুপনে পুরুষের দরদ রীতিমত চোখে পড়ার মতো। রবীদ্রনাথের স্ত্রীর পত্র থেকে-ই বলি “তোমরা আমার বুদ্ধিকে মেনে নিতে পারোনি”। তাই শাররীক ভাবে তোমরা নারীর মূল্য নির্ধারনে ব্যস্ত। ঘর থেকে শুরু হয় নারীর বঞ্চনার ইতিহাস। মেয়ে তাই ভাইয়ের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে। কেবলই কন্যা সন্তান! তাই বাবার সম্পত্তির দুই আনা পাবে নিকট আত্মীয়। যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় ‘আবছা’ সম্পত্তি। কাজের মজুরী্তে নারী বরাবর-ই পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পেয়েছেন। পুরুষ দিনমজুর ৩০০টাকা পেলে নারী পান ২০০-২২০ টাকা। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘নারী’ মানেই ঝামেলা। কিছুদিন পরেই ম্যাটার্নিটি লিভ দিতে হয়। কর্মী সুন্দরী নারী হলে নাকি অফিসের কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়। সমান শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার পরও নারী নিয়োগের ক্ষেত্রে পান বঞ্চনা। কারণ বাসায় যাবার তাড়া থাকে, কোনো ভাবেই ‘ওভারটাইম’ করতে চান না। কাজের মজুরি থেকে ঘরের সম্পত্তি কোথাও ন্যায্য হিস্যা মেলেনি। কি ভাবছেন দায় নারীর। মোটেই না, মানিয়ে নেয়াকে যারা মেনে নেয়া ভাবেন তাদের চিন্তার দৈন্যতা, নারীকে মুকুট হীন সম্রাজ্ঞী করে তোলে।
ক্রুসেড লড়তে যাওয়ার সময় নাইটরা বউদের “চেস্টিটি” বেল্ট পরিয়ে তালাচাবি লাগিয়ে দিয়ে যেত। অন্য নাইটদের হাত থেকে বউ কে সুরক্ষিত রাখার জন্য। ভাবেন একবার। পুরুষ কে বীর হতে হয়, কেননা “বীর ভোগ্য বসুন্ধরা”। যিনি ক্ষমতাবান তাকে প্রতি মূহুর্তের সাথে লড়াই করতে হয়। টিকে থাকার লড়াই। পেশি শক্তির লড়াই থেকে ক্ষমতার লড়াই সব-ই এক ধরনের ফাইজলামি। সারাক্ষন নিজেদের নির্মিত এবং চর্চিত নিয়মের অনুশাসন। যেন “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে, নইলে মোদের রাজার সনে মিলবো কি শর্তে”। যুগে যুগে পুরুষ যতটা ক্ষমতাধর হয়েছেন- নারীরা হয়েছেন ঠিক ততটাই ক্ষমাশীল ।ছেলের চালিকা শক্তি তাদের “স্ট্রেস” আর মেয়েদের “ ইনার স্ট্রেনথ”।পুরুষ চায় নারীর সময়, শরীর আর অখন্ড মনোযোগ। কিন্তু নারী কি চান, ভেবেছেন কখনো? পুরুষের স্ট্রেস হলো, তাকে প্রতিনিয়ত প্রথম হতে হবে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে হবে। জিততে হবে, জয়-ই শেষ কথা। ইতিহাসরমন) কখনো বিজিতদের মনে রাখেনা। কিন্তু কেন? সব ক্ষেত্রে কেন পুরুষ কে প্রথম হতে বাধ্য করা হচ্ছে। ক্ষমতার লড়াই তে হারলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে। তার মানে সংসারে পুরুষ ( রমন) বেগুন হলেও কোনো ক্ষতি নাই। কি কি রমনীয় গুনে সংসার সুখের হয়? - রান্না করা, পরিবেশন করা, গুছিয়ে কথা বলতে পারবে, গুছিয়ে থাকতে পারবে। নারীর ডিকশনারি তে ‘না’ শব্দ টা থাকবেনা। বিয়ের পর পর-ই বছরের মধ্যে বাচ্চা নিলে সমালোচনা। সংসার গুছিয়ে তারপরও তো বাচ্চা নিতে পারতো। কারো কাছে তো পরামর্শ নিতে পারতো। বিশাল লেখাপড়া জানা তো, নিজের বুঝই তো বড় বুঝ! আর যদি কোন কারনে দেরি করে বাচ্চা নিলে, কেন বাচ্চা হচ্ছে না। কেন? শুরু হয়, সংসারে কি মন আছে? আগে ক্যারিয়ার পরে বাচ্চা। বেশি বয়সে বাচ্চা নিলে হাজার টা কম্লিকেশন হয়, যখন সমস্যায় পড়বে তখন বুঝবে।
পুরুষতন্ত্র টাকে অনেক বেশি টিকিয়ে রেখেছেন নারী। বৌ মানে একজন সাবঅর্ডিনেটস। সিদ্ধান্ত নিবে পরিবার, পালন করবে বৌ। শাশুড়ি প্রথমে বৌকে রান্নার দায়িত্ব দিবেন কিন্তু সেখানেও ‘কিচেন পলিটিক্স’। রান্না নিয়ে কটুক্তি দিয়ে শুরু, অপরাধী করে চলমান রাখে। বৌ তো! তাকে তো প্রশংসা করা যাবে না। প্রশংসা তুলে রাখতে হবে অন্যদের জন্য। নারী প্রথম হলেই যত মুশকিল। ভালো বর খুঁজে পাওয়া যায় না। নারীর পেশাও তো সমাজ এবং পরিবারই ঠিক করে দিবেন। এমনটাই তো নিয়ম। এক ছাত্রী একবার বলছিলেন, “ ম্যাডাম সমাজের চোখে তো এমন টাই স্বাভাবিক”। আমি জানতে চাইলাম, সমাজের চোখটা আসলে কোথায়? আমি কখনো দেখিনি, আপনি কি সেটা খুঁজে পেয়েছেন।
উল্লেখিত কোনো কিছুই আসলে রূপকথা নয়। সবাই যেন কেমন করে সামাজিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে যায়। তারপর? সমাজকে বদলে দেয়ার স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:০৪