somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক রায় বাহাদুর জলধর সেনের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা

১৩ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কালের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া বঙ্গদেশের অন্যতম কর্ম প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব রায় বাহাদুর জলধর সেন। তিনি একাধারে কৃতী ভ্রমণ কাহিনী, রম্যরচনা, উপন্যাস লেখক এবং সাংবাদিক। তিনি বাংলায় প্রকাশিত উন্নতমানের সাহিত্য পত্রিকা ‘মাসিক ভারতবর্ষের’ সম্পাদক। মাসিক ভারতবর্ষ পত্রিকাটির কথা এখন হয়তো অনেকাই জানেন না। কিন্তু একসময় এটি ছিল খুবই জনপ্রিয় পত্রিকা। জলধর সেন দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল এবং অনেক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়েছিলেন। তার প্রতিভার প্রশংসা করেছেন দেশের অনেক কৃতী ব্যক্তি। কর্ম প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার জলধর সেনকে রায় বাহাদুর উপাধি প্রদান করে। ১৬০ সালের আজকের দিনে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে জন্মগ্রহণ করেন রায় বাহাদূর জলধর সেন। আজ তার ৭১৫৬তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে রায় বাহাদুর জলধর সেনকে স্মরণ করছি ফুলেল শুভ্চ্ছায়।


জলধর সেন ১৮৬০ সালের ১৩ মার্চ কুষ্টিয়া জেলার (তত্কালীন বৃহত্তর নদীয়া জেলা) কুমারখালী গ্রামে (বর্তমানে কুমারখালী শহর) এক এক সম্ভ্রান্ত ও সংস্কৃতিবান হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জয়ধর সেন। তার স্কুল শিক্ষা জীবন অতিবাহিত হয় কুমারখালীতেই। ১৮৭৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত কুমারখালী হাইস্কুল থেকে এন্ট্রাস (বর্তমান সময়ের মাধ্যমিক সমমান) পরীক্ষায় পাস করেন। এন্ট্রাস পরীক্ষা পাস করার পর তিনি উচ্চতর শিক্ষা লাভ করার জন্য চলে আসেন কলকাতা শহরে। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জেনারেল এসেব্লী ইনস্টিটিউশনে তিনি ফার্স্ট আর্টস বা এফএ ক্লাসে (বর্তমান কালের উচ্চ মাধ্যমিক সমমান) ভর্তি হন। কিন্তু নানা কারণে তিনি এফএ পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর না এগোলেও তিনি ঘরে বসে প্রচুর লেখাপড়া করেছিলেন।


জলধর সেনের কর্মজীবন শুরু হয় একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে। ১৮৮৩ সালে তিনি গোয়ালন্দ হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক নিযুক্ত হন। স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় তার সহধর্মিণী, কন্যা ও মাতার মৃত্যু হয়। এই তিনটি মৃত্যুতে তিনি খুব দুঃখ পান। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। মানসিক প্রশান্তি লাভের জন্য তিনি হিমালয় চলে যান। হিমালয় থেকে ফিরে এসে আবার শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু গোয়ালন্দ হাইস্কুলে নয়, অন্য প্রতিষ্ঠানে। ১৮৯১ সালে তিনি মহিষাদল রাজ স্কুলের শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৮৯৪ সালে তিনি আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৮৯৯ সালে শিক্ষকতার চাকরি ইস্তফা দিয়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে শুরু হয় তার অন্য পেশা। তিনি শুরু করলেন সাংবাদিকতা। তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হয় সাপ্তাহিক ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায়। এই পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে তিনি কাজ করতেন। সাপ্তাহিকে ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি যোগদান করেন সাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’ পত্রিকায়। ‘হিতবাদী’ নামক পত্রিকায় তিনি যোগদান করেন সম্পাদক হিসেবে। এই পত্রিকায় তিনি কাজ করেন ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অবনিবনার কারণে ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় তার কাজ করা সম্ভব হয়নি। তিনি এই পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিছু সময় পর টাঙ্গাইলের সন্তোষের (তখন টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত ছিল) জমিদার বাড়ির গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। কিছু সময় পর তাকে নিযুক্ত করা হয় জমিদার বাড়ির দেওয়ান। ১৯০৯ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি সন্তোষের জমিদার বাড়ির দেওয়ান হিসেবে কাজ করেন। তার কর্মদক্ষতা সবারই প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। জমিদার বাড়ির চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১১ সালে তার সম্পাদনায় ‘সুলভ সমাচার’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিছু সময় পর তিনি যোগদান করেন ‘মাসিক ভারতবর্ষ’ নামক বিখ্যাত পত্রিকায়। তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ‘মাসিক ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় তিনি কাজ করেন একটানা ছাব্বিশ বছর। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই পত্রিকায় কাজ করেন। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে অনেক লেখক সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেক খ্যাতনামা সাহিত্যসেবী ‘মাসিক ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় লিখেছেন। এই পত্রিকাটি সাড়া বাংলায় জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। ‘মাসিক ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সময়কে জলধর সেনের চাকরি জীবনের স্বর্ণ অধ্যায় বলা যায়।


(কাঙাল হরিনাথ ওরফে হরিনাথ মজুমদার)
জলধর সেন শুধু পত্রিকা সম্পাদনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি নিজে লেখালেখিও করতেন। তিনি আজীবন সাহিত্য সাধনা করে গেছেন এবং নিজেকে একজন সাহিত্যিক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সাহিত্য শিক্ষাগুরু ছিলেন কাঙাল হরিনাথ ওরফে হরিনাথ মজুমদার। কাঙাল হরিনাথের জন্মও কুমারখালীতে। মূলত কাঙাল হরিনাথের অনুপ্রেরণাতেই তিনি সাহিত্য সাধনা শুরু করেন। সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি বিভাগে তার সহজ পদচারণা ছিল। তার সর্বমোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বিয়াল্লিশটি। জলধর সেন বেশ কিছুদিনের জন্য হিমালয় ভ্রমণে গিয়েছিলেন এর উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয় সে যুগের অসমান্য জনপ্রিয় ভ্রমণকাহিনী হিমালয়। এ ছাড়াও ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানের ভ্রমণ নিয়ে রচিত তার অপর বইয়ের নাম প্রবাসচিত্র। এই বইটি সহজ ও চিত্তাকর্ষক ভাষায় রচিত হয়েছে। তাঁর রচিত গল্পের বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নৈবেদ্য, কাঙ্গালের ঠাকুর, বড় মানুষ প্রভৃতি । তাঁর রচিত উপন্যাস হল দুঃখিনী, অভাগী, (তিন খণ্ডে রচিত) উৎস প্রভৃতি । কাঙাল হরিনাথ (দুই খণ্ডে সমাপ্ত) তার রচিত জীবনী গ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হরিনাথ গ্রন্থাবলী, ও প্রমথনাথের কাব্য গ্রন্থাবলী । অপরাজেয় কথাশিল্পী শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম জীবনের লেখায় জলধর সেনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। জলধর সেনের কোনো কোনো লেখায় পতিতাদের প্রতি সহূদয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। এটা তার মহানুভবতার পরিচয় বহন করে। বিধবা বিবাহের প্রতি তার সমর্থন সহূদয়তার পরিচয়।


১৯২৯ সালে কর্ম প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার জলধর সেনকে রায় বাহাদুর উপাধি প্রদান করে। তিনি দুইবার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের’ সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরি মিলনায়তনে বঙ্গবাসীর পক্ষ থেকে জলধর সেনকে বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন বাংলার অপরাজেয় কথাশিল্পী সাহিত্য সম্রাট শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কোনো রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি বড় কথা নয়, দেশের সংস্কৃতিমনা মানুষের কাছ থেকে তিনি বিপুল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন তার তুলনা হয় না। এখানেই তিনি অনন্য।


লেখক, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক জলধর সেন ১৯৩৯ সালের ১৫ মার্চ ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুৃকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। জলধর সেনের ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক হিসেবে তার দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আজ ঔপন্যাসিক রায় বাহাদুর জলধর সেনের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে রায় বাহাদুর জলধর সেনকে স্মরণ করছি ফুলেল শুভ্চ্ছায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:০৭
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×