somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উপমহাদেশের বরেণ্য বাঙালি চিত্রকর পটুয়া যামিনী রায়ের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


উপমহাদেশের বরেণ্য চিত্রকর যামিনী রায়। বাঙালির শিল্পকলা চর্চার অর্থাৎ লোকশিল্পকলার পদ্ধতির শিল্পরসিক ও প্রচারক এবং এই ধারার সম্ভবত শ্রেষ্ঠ শিল্পী যামিনী রায়। নিজেকে পটুয়া পরিচয় দিতেই যিনি বেশি পছন্দ করতেন। প্রখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী যামিনী রায় কালিঘাটের "পট" শিল্পকে বিশ্বনন্দিত করে তোলেন। যামিনী রায় তাঁর শিল্পসাধনার প্রথম পর্যায়ে ইউরোপীয় টেকনিক প্রথমে আয়ত্ত করেছিলেন, তারপর খুঁজতে শুরু করেছিলেন তার নিজস্ব ছবি আঁকার রীতি কী রকম হবে। অচিরেই তিনি অনুধাবন করেন যে আঁকাআঁকির ব্যাপারে পশ্চিমা ধারার পরিবর্তে নিজস্ব সংস্কৃতিই হবে উত্তম অনুপ্রেরণা। তা হলো, বঙ্গদেশের গ্রামাঞ্চালের লোকশিল্পের পথ ও পদ্ধতি। খুঁজে পেয়েও ছিলেন তিনি। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্যে এ জন্যই তিনি লোক এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বেছে নিয়েছিলেন। যামিনী রায় শিল্পী হিসেবে তথাকথিত বেঙ্গল স্কুল ঘরানা থেকে দূরে গিয়ে একটি নিজস্ব ঘরানা এ দেশীয় চিত্রকলার ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে গেছেন, যেমন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, অব্যশই যার কাজের গভীরতা আরো তাৎপর্যপূর্ণ।তার খুব বিখ্যাত ছবি ‘প্রসাধন’, ‘কৃষ্ণ ও বলরাম’, ‘কৃষ্ণলীলা’, ‘সাঁওতালী নাচ’ ইত্যাদি। শিল্পরসিক যামিনী রায় ১৯৭২ সালের আজকের দিনে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুরায় মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। বরেণ্য চিত্রকর যামিনী রােয়ের মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

যামিনী রায় ১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুরা জেলার বেলিয়াতোর গ্রামে এক ক্ষুদে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম রামতরণ রায়। শৈশব-কৈশোর গ্রামেই কেটেছিল যামিনী রায়ের। বাঁকুড়া মাটির মূর্তি গড়ার কাজে চিরকালই বিখ্যাত জায়গা হিসেবে গণ্য হতো। শিল্পী হওয়ার স্বভাবজাত প্রেরণা ছিল মনের মধ্যে, ফলে নিজের গ্রামাঞ্চলের মূর্তিশিল্পীদের মূর্তি তৈরি করা অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে দেখতেন, বুঝতে চেষ্টা করতেন। ১৯০৩ সালে ১৬ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। সময়টা তখন এমন ছিল যখন ভারতীয় শিল্পীরা ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ইউরোপের অনুকরণ ছেড়ে স্বদেশের শিল্পকলার ঐতিহ্য বুঝতে চেষ্টা করছেন, প্রাচ্য রীতিতে ছবি আঁকছেন। এখানে তিনি যা শিখেছিলেন তা ছিল গতানুগতিক। ১৯০৮ সালে ফাইন আর্টে তিনি ডিপ্লোমা গ্রহণ করেন।

কালিঘাটের পটচিত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন যামিনীরায়। বাংলার এই শিল্পচর্চার ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রাচীন পটের গায়ে আঁকা ছবি, পাটাচিত্র, আল্পনার ঢং, মাটির তৈরি হরেক রকমের খেলনা, পুতুল-ঘোড়া, মানুষ ইত্যাদি সব কিছু থেকেই তিনি তার নিজের স্টাইল তৈরি করে নিয়েছিলেন। তাঁর আঁকা ছবি দেখামাত্রই চেনা যায়, যেমন চেনা যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা নন্দলাল বসুর ছবি দেখলে। প্রত্যেকেরই শিল্প রচনার বিষয় ভারতীয়, অথচ আঁকবার ধরন একেবারে আলাদা। ফোক আর্ট বা লোকশিল্প থেকেই যামিনী রায় তার নিজস্ব অঙ্কনশৈলী আবিষ্কার করেছিলেন। তত দিনে তার বয়স প্রায় ৩৫ বছর। ধীরে ধীরে তিনি ইমপ্রেসনিস্ট ল্যান্ডস্কেপ ধারা থেকে সরে আসেন। সাঁওতালদের সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে তিনি নিজস্ব ধারার পরীক্ষা চালান। শিল্পকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে সমাজের সর্বত্র রূপ দিতে চেয়েছিলেন তিনি; যাতে ভারতীয় চিত্রকলার আলাদা বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। তিনিই প্রথম ভারতীয়, যিনি পোর্ট্রেট শিল্পী হিসেবে সাফল্য পেয়েছেন। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে প্রথমজীবনে পাশ্চাত্যরীতি অনুসরন করলেও, ১৯২১ সাল থেকে সেই রীতি পরিহার করে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে চিত্রাঙ্কনের ধারা পরিবর্তন করেন। এসময় তিনি লোকজ মোটিফ ব্যবহার শুরু করেন। পরবর্তীতে লোকশিল্পের ভাব ঐশ্বর্যকে তাঁর শিল্প প্রতিভার দ্বারা এক উচ্চ পর্যায়ে স্থাপন করেন।

‘গণেশ জননী’ ছবিটি যামিনী রায়ের অতি পরিচিত চিত্রশৈলীরই একটি উদাহরণ। শিল্পী রাধাকৃষ্ণ, মা ও শিশু, নারী কিংবা নৃত্যরতা নারী, কৃষ্ণ ও গোপিনী, যিশুখ্রিস্ট এই সব ধর্মীয় বিষয় ও কাহিনি কিংবা লোকাচার ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বিষয় নিয়ে ছবি এঁকেছেন। পটুয়াদের মতো তিনি মেটে রঙে ছবি আঁকতেন। সর্বাঙ্গীণ ভাবে দেশজ রীতিনীতিকে তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। পটুয়াদের মতো একই বিষয়বস্তুকে তিনি বহু বার নানা ভাবে-ভঙ্গিতে, রঙে এঁকেছেন। ‘গণেশ জননী’ও তিনি অনেক বার এঁকেছেন। পটুয়াদের আঁকা ছবির মতো হলেও তাঁর ছবিতে শিক্ষিত আধুনিক চিত্রীর সুপটু রেখা, সুনির্বাচিত বস্তু, মুখাকৃতি ও চোখের আকার দেখতে পাই। তা ছাড়া অলংকরণে, জমিতে মূর্তি ও আকারের সংস্থাপনে বিশেষ স্থিরতা, পরীক্ষানিরীক্ষামূলক রূপারোপ এবং সতর্কতা এ সব কিছু চোখে পড়ার মতো। পটুয়াদের মতো আঁকা দ্বিমাত্রিক ছবিতে চিত্রিত ছবিগুলির মধ্যে মানবিক শারীরিক অনুভব কখনওই স্পষ্ট হয়ে দেখা দেবে না। বরং এখানে রং, রেখা, জমি (স্পেস) এবং তাতে আকারের সংস্থাপন ও তাদের মধ্যেকার টানাপোড়েনই আমাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। গণেশ জননী এখানে প্রায় নিমিত্তমাত্র। আসলে এটি একটি ছবি, অবশ্যই বিষয়বস্তুভিত্তিক এবং অর্থবাহক। যামিনী রায় শিল্পী হিসেবে তথাকথিত বেঙ্গল স্কুল ঘরানা থেকে দূরে গিয়ে একটি নিজস্ব ঘরানা এ দেশীয় চিত্রকলার ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে গেছেন, যেমন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, অব্যশই যাঁর কাজের গভীরতা আরও তাৎপর্যপূর্ণ।

চিত্রকর হিসেবে যামিনী রায় বিত্ত ও যশ দুটোই দেরিতে পেয়েছিলেন। নির্দিষ্ট বিখ্যাত কিছু কলারসিক ছাড়া তার ছবি প্রথম দিকে কেউ পছন্দ করতেন না। পরে অবশ্য ভারতবিখ্যাত তো বটেই, বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। বহু আমন্ত্রণ সত্ত্বেও কখনো বিদেশে যাননি। নিজের আঁকা ছবি এবং দেশের শিল্পকলা বিষয়ে শিল্পীর অহঙ্কার ছিল তার; বলতেনথ 'আমরা গরিব দেশের মানুষ, এত পয়সা খরচ করে ওদের দেশে যাব কেন? ওদের অনেক পয়সা, ওরা এসে আমাদেরটা দেখে যাক।' তার খুব বিখ্যাত ছবি 'প্রসাধন', 'কৃষ্ণ ও বলরাম', 'কৃষ্ণলীলা', 'সাওতালী নাচ' ইত্যাদি। ১৯২৯ সালে শিল্পী মুকুলদে’র সহায়তায় তিনি প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী করেন কলকাতায়। এ সময় তিনি শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা প্রভাবিত হন। ত্রিশের দশকের শেষার্ধ্বে যামিনী রায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণে ভারতীয় চিত্রকলাকে বিশ্ব দরবারে সম্মান জনক আসনে নিয়ে যান। ‘সাঁওতাল মা ও দুই ছেলে’ ‘চাষীর মুখ পুজারিনী মেয়ে’ যীশুখৃষ্ট ‘কনে ও তার দুই সঙ্গী’, ‘ক্রন্দসী মাছের সাথে দুই বেড়াল’ প্রভৃতি তার বিখ্যাত শিল্পকর্ম। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এবং আলবার্ট মিউজিয়ামে তার চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে।

শিল্পকর্মের স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৫৪ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৫৬ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট ডিগ্রি লাভ করেন যামিনী রায়। ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন চিত্রকর যামিনী রায়। আজ তাঁর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যু দিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:৩৯
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×