somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশিষ্ট পণ্ডিত ও অভিধানকারক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বঙ্গীয় শব্দকোষ নামক অভিধানের রচয়িতা এবং শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং অধ্যাপক শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সঙ্কলিত বঙ্গীয় শব্দকোষ একটি বাংলা অভিধান। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিখিত বিবৃতি অনুসারে আনুমানিক ১৩১১ বঙ্গাব্দে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলা ভাষায় একটি অভিধান প্রণয়নের জন্য অনুরোধ করেন। সেই সময় তিনি কবিরই নির্দেশে ছাত্রদের পাঠার্থ সংস্কৃতপ্রবেশ গ্রন্থের রচনাকার্যে ব্যাপৃত ছিলেন। সেই কারণে পরের ব্ছর অর্থাৎ ১৩১২ বঙ্গাব্দে সংস্কৃতপ্রবেশ সমাপ্ত করে রবীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে অভিধানরচনায় আত্মনিয়োগ করেন। এই অভিধান ১৩৪১ বঙ্গাব্দে কলকাতায় প্রথম প্রকাশিত হয় ও বিশ্বকোষ প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়। গ্রন্থের সূচনালগ্নে সঙ্কলয়িতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোন অভিজ্ঞ আভিধানিকেরই সাহায্যলাভ করেননি। কোন পথপ্রদর্শক না থাকা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ স্বচেষ্টায় এবং পরিশ্রমে তিনি এই বিশাল শব্দকোষগ্রন্থ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গীয় শব্দকোষে প্রাচীন ও আধুনিক সংস্কৃতের (তদ্ভব দেশজ বৈদেশিক প্রভৃতি) প্রচুর শব্দ আছে। এই বিশাল কোষগ্রন্থে যে শব্দসম্ভার ও অর্থবৈচিত্র্য আছেছে তা কেবল বর্তমান বাঙলা সাহিত্যের চর্চা সুগম হবে এমন নয়, ভবিষ্যৎ সাহিত্যও সমৃদ্ধিলাভ করবে।নোবেলজয়ী কবি এবং শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একান্ত শুভানুধ্যায়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার এই সম্পদ প্রসঙ্গে লিখেছেন, " শান্তিনিকেতন-শিক্ষাভবনের সংস্কৃত অধ্যাপক শ্রীযুক্ত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুদীর্ঘকাল বাংলা অভিধান সঙ্কলন কার্য্যে নিযুক্ত আছেন। তাঁহার এই বহুবর্ষব্যাপী অক্লান্ত চিন্তা ও চেষ্টা আজ সম্পূর্ণতা লাভ করিয়া সর্ব্বসাধারণের নিকট উপস্থিত হইল। তাঁহার এই অধ্যবসায় যে সার্থক হইয়াছে, আমার বিশ্বাস সকলেই তাহার সমর্থন করিবেন"। তার এই মহতী কাজের জন্য ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বভারতী তাঁকে 'দেশিকোত্তম' উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫৯ সালের আজকের দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। বঙ্গীয় শব্দকোষের রচয়িতা, বিশিষ্ট পণ্ডিত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।


শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত ও অভিধান প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৬৭ সালের ২৩ জুন চব্বিশ পরগনা জেলার রামনারায়ণপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল বসিরহাটের জামাইকাটিতে। তাঁর বাবা নিবারণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্থানীয় এক জমিদারের কাচারিতে চাকরি করতেন। চার বৎসর বয়সে তিনি তাঁর পৈতৃক গ্রাম জামাইকাটিতে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর বিভিন্ন স্কুলে পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি মেট্রোপলিটান কলেজে ভর্তি হন। বিএ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও শেষ করতে পারেননি। আর্থিক অসুবিধার কারণে তিনি বিএ তৃতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়ার পর লেখাপড়া ছেড়ে দেন। এরপর কিছুদিন তিনি গ্রামে ফিরে যান এবং সেখানে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি নাড়াজোলের কুমার দেবেন্দ্রল্ল খানের গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। কলকাতা টাউন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে তিনি প্রধান পণ্ডিতরূপে যোগদান করেন। যদুনাথ চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের পরিচালিত মহর্ষি এস্টেটের সদর কাছাড়িতে খাজাঞ্চি ছিলেন। তাঁর মামাতো ভাই ছিলেন হরিচরণ। যদুনাথের অনুরোধে, পতিসর জমিদারির কাছারিতে সুপারেন্টেন্ড হিসাবে, বাংলা ১৩০৯ (১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ) অব্দের শ্রাবণ মাসে হরিচরণকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি পরিদর্শনে এসে তাঁর সাথে পরিচিত হন। রবীন্দ্রনাথ এঁর জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হন। পরে তিনি পত্রযোগে তাঁকে শান্তিনিকেতনে আসতে বলেন। শান্তিনিকেতনে তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমে সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। শিক্ষকতায় নিষ্ঠা এবং বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতার কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অভিধান রচনায় অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর অভিপ্রায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি কোষগ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেন। এরই ফসল বিখ্যাত বঙ্গীয় শব্দকোষ। অধ্যাপনা করার সময়ই ১৩১২ বঙ্গাব্দে (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ) রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে তিনি 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' তৈরিতে হাত দেন। ১৩১৮ বঙ্গাব্দে (১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ) আর্থিক সমস্যার জন্য শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে তিনি কলকাতায় যান। এই সময়ে অভিধান তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মহারাজ নন্দী অভিধানের জন্য হরিচরণের জন্য মাসিক পঞ্চাশ টাকা ধার্য করেন। এই সূত্রে তিনি এই অভিধানের কাজ পুনরায় শুরু করেন। ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১১ই মাঘ অভিধানের কাজ শেষ হয়। কিন্তু এই বিশাল গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষমতা সেস সময়ে বিশ্বভারতীর ছিল না। পরে এর মুদ্রণকাজ শুরু হয় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ থেকে। এই গ্রন্থটি ১০৫ খণ্ডে বিভক্ত করে মুদ্রিত হয়েছিল। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৪০ বঙ্গাব্দে। ১৩৫২ বঙ্গাব্দে এর মুদ্রণ কাজ শেষ হয়। চল্লিশ বছর অসাধারণ ধৈর্য, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম করে ১৯৪৫ সালে বিরাট এই অভিধান সংকলন ও সম্পাদনার কাজ শেষ করেন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বভারতী এই গ্রন্থটিকে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশ করে। এই খণ্ডগুলো নিঃশেষিত হওয়ার পর, দীর্ঘদিন এর মুদ্রণকাজ বন্ধ ছিল। বর্তমানে এই গ্রন্থটি দুই খণ্ডে পাওয়া যায়। প্রকাশক, সাহিত্য অকাদেমি, কলকাতা।


বাংলা অভিধানের গুরুত্ব বিবেচনায় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান দুটিই সর্বাপেক্ষা পরিচিত। তবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান শব্দার্থের গভীর ও ব্যাপকতর অর্থ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে অধিকতর উপযোগী। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষার শব্দ ছাড়াও এ অভিধানে ইংরেজি, পর্তুগিজ, হিন্দি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষার শব্দ রয়েছে। তিনি শব্দার্থ স্পষ্ট করতে বাংলা সাহিত্য থেকে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতির সাহায্য নিয়েছেন; আবার একটি শব্দের পূর্ণ পরিচিতির জন্য সংস্কৃত থেকেও আবশ্যকীয় উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। হরিচরণের অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে ম্যাথু আর্নল্ডের ‘শোরাব রোস্তম’, ‘বলিষ্ঠ বিশ্বামিত্রা’, ‘কবিকথা মঞ্জুষা’ ইত্যাদি বই অমিত্রাক্ষর ছন্দে অনুবাদ। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে আছে ‘সংস্কৃত প্রবেশ’, ‘পালি প্রবেশ’, ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’, ‘কবির কথা’, ‘রবীন্দ্রনাথের কথা’ ইত্যাদি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, ১৯৫৪ সালে শিশিরকুমার স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দেশিকোত্তম (ডিলিট) উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ জানুয়ারিতে মৃত্যবরণ করেন পণ্ডিত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তার ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। অভিধানকারক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সম্পাদনাঃ নূর মোহাম্মদ নূরু
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৫৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×