১ম পর্ব
উনি যেহেতু বারবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা মুবারকের সামনে সালামের ব্যাপারটি এনেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওসিলা করে দোয়া করাকে বোল্ড করে দেখিয়েছেন,তাই এ পোস্টে হায়াতুন নবী এবং কাউকে ওসীলা করে দোয়া করাতে শরীয়তের হুকুম কি তা তুলে ধরতে চেষ্টা করব।
প্রথমে আসা যাক হায়াতুন নবী বিষয়টিতে।
হযরত আম্বিয়া কেরাম আলাইহিমুস সালাম এর কবরের জীবন হুবহু জিবীত থাকা সত্য ও হক্ব। ইমাম বাইহাকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ বিষয় বস্তুর উপর একটি সহীহ হাদিস বর্ণনা করেছেন। হাফেজ ইবনে হাজার (রহ) ফতহুল বারী ৬:৩৫২ এবং হাফেজ সাখাবী আলাকওলুল বদী'-১১৬-এ উক্ত হাদিস্কে বিশুদ্ধ সনদ বিশিষ্ট বলেছেন । এছাড়া আল্লামা সাখাবী(রহ) লিখেন যে-
আমরা ঈমান রাখি সত্ত্যায়ন করি যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে জিবীত এবং তাঁকে রিযিক দেয়া হয় এবং তাঁর শরীর মোবারক কে মাটি খায়না অর্থাৎ নষ্ট করে না। আর এর উপর উম্মতের ইজমা এবং ইত্তেফাক। (আলকওলুল বদী'- ১২৫)
মুল্লা আলী ক্বারী (রহ) তাঁর কিতাব الدرة ِالمضٔية في ِالزيارة المصطفوية তে লিখেন-" নবিজীর কবর জিয়ারাতের ফায়েদা সমূহের মাঝে সবচেয়ে বড় ফায়েদা এই যে, যখন যিয়ারাতকারী হুজুরের কবরের নিকট দুরুদ ও সালাম পাঠ করে তখন তিনি তা যথাযথভাবে তা শুনেন ও তার জবাব দেন কোন প্রকার মাধ্যম(ফেরতেশতা ) ছাড়া, তার বিপরীতে যখন কোন ব্যাক্তি দূর হতে দুরূদ ও সালাম পাঁঠ করে ,তখন ফেরেশতার মাধ্যমে তা হুজুরের নিকট পৌঁছানো হয়। ( এ আকিদার কারণ ) এজন্য যে, মজবুত সনদে এসেছে (হুজুর বলেন) যে আমার কবরের নিকট দুরূদ পড়ে আমি তা সরাসরি শুনি, আর যে দূর হতে দুরূদ পড়ে ,তা আমার নিকট পৌঁছে দেয়া হয়।"
উপরের মুল্লা আলী ক্বারী (রহ) যে হাদিস বর্ণনা করেছেন যেখানে من صلّي عند قبرئ আছে তা আবুশ শায়খ -এর সনদে সহীহ। এই হাদিসে মুহাম্মাদ বিন মারওয়ান সুদ্দী নেই। এই প্রসঙ্গেই হাফেজ ইবনে হাজার আস্কালানী (রহ) বলেন যে,بسند جيِّد পোক্তা সনদে বর্ণিত (ফতহুল বারী ৬: ৩৫২) এবং উক্ত সনদকে আল্লামা সাখাবী (রহ) وسنده جيِّد -এর সনদ মজবুত লিখেছেন। (আল কওলুল বদী-১১৬) এবং আহলে হাদিস আলেম নওয়াব সিদ্দীক খান লিখেন اسناد جيِّد -বর্ণনা সূত্র উত্তম (আদদলীলুত ত্বালেব-৮৪৪)
এবং অধিক সম্ভাব্য যে, এর উপরই শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) এই মাসয়ালার বুনিয়াদ রেখে লিখেন যে,
فاخبرانّه ىسمع اصلوة واسّلام من القرىب وانّه ىبلغ ذالك من بعد (منا سك لججع ص ٨٤)
অর্থাৎ,হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি নিকটবর্তী থেকে নিজেই দুরূদ ও সালাম শুনতে পান। আর দূর থেকে হুজুরের নিকট দুরূদ ও সালাম পৌঁছানো হয়।
ইবনুল কায়্যিম(রহ) লিখেন যে- "যদিও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারক হযরত আম্বীয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম-এর রূহের সাথে রফীকে আলায় এ রয়েছেন,কিন্তু এতদ্বসত্বেও তাঁর রূহ মোবারক তাঁর শরীর মোবারকের সাথে সম্পর্ক রয়েছে,যে কারণে তিনি সালাম দাতার উত্তর দিয়ে থাকেন ( যাদুল মা'আদ খঃ ২, পৃঃ ৪৯)
রুহুল আয়ানীর লেখক তার কিতাবের ২২ঃ৩৬ এবং আল্লামা সবকী (রহ) শিফাউস সিকাম-১৪৩ এ বর্ণনা করেন যে, এই কবরের জীবন সমস্ত আহকামের ক্ষেত্রে দুনিয়াবী জীবনের মত নয় এবং সব দুনায়াবী আহকাম তার উপর বিন্যস্ত হয় না যে, এরকম বলা- যেমন দুনায়াবী খাওয়া ও পান করার প্রয়োজন ছিল,কবরেও এরকম হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বরং তিনি বলেন যে, ঐ জীবন ইলম তথা জানা ও শ্রবন করা ইত্যাদি অর্জনের ক্ষেত্রে দুনিয়াবী জীবনের মত এবং এ সম্পর্কেই আল্লাম সুবকী (রহ) ও অন্যান্যগণ বলেন-
فلا شكّ انّ ذلك ثابت(شفاء السقام ص:١٤٣)
যারা কবরের হযরত আম্বিয়া কেরাম আলাইহিমুস সালাম-এর জিবীত থাকার মত পোষণ করেন,তাদের উদ্দেশ্যও দুনিয়াবী জীবন থেকে শুধু এতটুকু জীবন যে, কবরের পাশে সালাত ও সালামম শুনতে পান এবং শরীর মোবারকের সাথে রূহ মোবারকের গভীর(শক্ত) সম্পর্ক বিদ্যমান,তাদের উদ্দেশ্য দুনিয়ার এই ধ্বংশশীল ও নিকৃষ্ট জীবন এবং পাবন্দী ও কষ্টের কখনই নয়। কোরানুল কারিমের কিছু কিছু আয়াত দ্বারা একথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ দুনিয়া থেকে ওফাত হয়েছে,কিন্তু এরপর উন্নত ও উত্তম জীবন কবরে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে দিয়েছেন (যেমনটি নাকি তিনি স্তরভেদে শহীদ,সাধারণ মুমীন এবং কাফের ও গুনাহগারদেরকে স্থান দিয়ে থাকেন) তা সত্য ও প্রমাণিত। কোন সহীহ আকলী অথবা নকলী (যৌক্তিক কিংবা বর্ণিত) দলীল দ্বারা তার অস্বীকৃতি সাব্যস্ত নেই। এটাই আকাবেরে দেওবন্দ এর আক্বীদা। ( আল্মুহান্নিদ আলাল মুসান্নিফ-১৩)
ইমামে রব্বানী মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ) বলেন," কিন্তু আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-এর শ্রবণ সম্পর্কে কারো দ্বিমত নেই। একারণেই তাঁদেরকে আলাদা রাখা হয়েছে। এ কথা অনুমদনের জন্য দলীল এই যে, ফুকাহায়ে কেরাম কবর মোবারক যিয়ারতের সময় সালামের পর মাগফিরাতের সুপারীশের জন্য দরখাস্ত করার কথা লিখেছেন। সুতরাং এটিই অনুমোদনের জন্য যথেষ্ট (ফতুয়া রশিদিয়া-১: ৯৯)
এবার আসা যাক উসীলার ব্যাপারে।
নবী-ওলীগণের উসীলা দিয়ে দুয়া করা শরীয়তে অনিমোদিত।এর পক্ষে দিলিলগুলো দেখুন-
একটি হাদিসে আছে যে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে একজন সাহাবীকে এভাবে দু'আ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন-
اللهم اني اسألك وا توجه اليك نبي الرحمه اليك بنبيك محمد نبي الرحمة
অর্থাৎ, হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি এবং তোমার দিকে ধাবিত হই তোমার নবী মোহাম্মাদের উসিলায়,যিনি রহমতের নবী (মারিফুল কুরআন, ৩:১২৮, ইবনে মাযাহ ,১০০ পৃ)
মুজমায়ে কবীরে একট হাদিস আছে যেখানে এই দোয়াটি ওসমান ইবনে হানিফ (রহ) মসজিদে গিয়ে দুরাকাত নামাজ পড়ে একজন লোককে তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বলেছিলেন (জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব - পৃঃ১৫৭)
আরেক সহীহ হাদিসে বর্ণনা আছে, একবার উমর ফারুক(রা) দুর্ভিক্ষের সময় হযরত আব্বাস(রা) -এর উসিলা দিয়ে বৃষ্টির জন্য দোয়া করেছিলেন।( খাইরুল ফাতওয়া-১৯৭)
হযরত উমাইয়া (রা) থেকে বর্ণিত যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে ফকির ও মুহাজিরদের উসীলা দিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য দু'আ করেছেন। এছাড়া আরো অনেক হাদীস দ্বারাও উসীলা দেওয়ার কথা প্রমাণিত ।( মিশকাত শরীফ,৪৩৯ ;আবু-দাউদ শরীফ,৪৩৯, খাইরুল ফাতওয়া ১ঃ ১৯৩)
এমনিভাবে হযরত আবু বকর বিন খতীব (রহ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলতেন ,আমি ইমাম শাফেই (রহ) কে বলতে শুনেছি,তিনি বলতেন -আমি ইমাম আবু হানিফা(রহ) এর উসীলা দিয়ে বরকত অর্জন করে থাকি।আমি তার কবর যিয়ারাত করি ,তার উসীলা দিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি। তারপরেই আমার আশা পূরণ হয় ।( খাইরুল ফাতওয়া ১:১৯৪, তারীখে খতীব ১ঃ১২৩)
ইবনে আবী শায়বা সহীহ সনদে বর্ণনা করেন, ওমর (রা) -এর সময় একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এক ব্যক্তি কবর শরীফে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন-يا رسول الله استسق لامتك فانهم قد هلكوا [হে আল্লাহর রাসূল, আপনার উম্মতের জন্যে আল্লাহর কাছে পানি প্রার্থনা করুন। তারা ধ্বংশের সম্মুখীন হয়েছে।] নবী করিম (সাঃ )স্বপ্নে এই ব্যক্তির কাছে আগমন করলেন এবং বললেনঃ যাও, ওমরকে সুসংবাদ দাও যে,বৃষ্টি হবে। ( জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব- পৃঃ১৫৮)
এখন এইসব বিষয় সামনে রাখুন আর আরিফ সাহেবের পোস্টে উল্লেখিত ঘটনাগুলো সামনে রাখুন আর আপনিই নিজে চিন্তা করুন তা কতটুকু ঠিক ছিল।
তবে আমি আগের পোস্টে উল্লেখ করেছি, আওলিয়ায়া কেরামের কারামত এবং ঘটনা কখনো শরীয়তের দলিল হিসেবে গণ্য হয় না, আর ফাযায়েলের কিতাবেও তা দিলিল হিসেবে বর্ণনা করা হয়নি বরং ঘটনা হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। তাহলে কেন এত ডাক-হাহাকার আর চিৎকার।
যে ঘটনাটি নিয়ে আরিফ সাহেব এবং তার সমমনারা খুব লাফাচ্ছেন,তা নিচে দেওয়া হলো যা মাওলানা যাকারিয়া (রহ) শুধু ওয়াকেয়া কিংবা ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন শরীয়তের দলিল হিসেবে নয়-
" শায়েখ আবুল খায়ের বলেন, একবার মদীনা মোনাওয়ারায় হাজির হইয়া পাঁচ দিন পর্যন্ত আমাকে উপবাস থাকতে হয়। খাওয়ার জন্য কিছুই না পেয়ে অবশেষে আমি হুজুর এবং শায়ইখানের কবরের মধ্যে সালাম পড়িয়া আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল। আমি আজ রাতে আপনার মেহমান হবো।
এই কথা আরজ করে মিম্বর শরীফের নিকট গিয়ে আমি শুইয়া পড়লাম। স্বপ্নে দেখি, হুজুরে পাক (সাঃ) তাশরীফ এনেছেন। ডানে হযরত আবু বকর, বাম দিকে হজরত ওমর এবং সামনে হজরত আলী রাঃ। হযরত আলী রাঃ আমাকে ডেকে বলেন, এই দেখ, হুজুর সাঃ তাশরীফ এনেছেন। আমি উঠা মাত্রই মহানবী সাঃ আমাকে একটা রুটি দিলেন, আমি অর্ধেক খেয়ে ফেলি।
তারপর যখন আমার চোখ খুলিল তখন আমার হাতে বাকী অর্ধেক ছিল (রুটি অবশিষ্টাংশ)। "
মূল ঘটনাটি শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহুলভী (রহ) এর রচিত জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব নামক কিতাবের ১৬০ পৃষ্ঠাতে আছে।
এসব ঘটনা কখনোই শরীয়তের দলীল নয়,বরং এ গুলো হলো আউলিয়া কিরামের বিশেষ হাল বা অবস্থা , যা সাধারণ মানুষের জন্য কখনোই প্রযোজ্য নয় এবং এর জন্য তাদেরকে দোষী বলাও ঠিক হবে না কারণ এসব তাদের আওতাধীন নয় ,শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) এর ফতোয়াও এর সমর্থন পাওয়া যায়। কিন্তু ঘটনার মূল লেখক যা বলেছেন তা বলেই এ পর্ব শেষ করতে চাই-
এমনি ধরনের আরও অনেক কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। অধিকাংশ কাহিনী ছুফী বুযুর্গগণই বর্ণনা করেছেন। আসলে তারা এই মহান দরবারের নৈকট্য প্রাপ্ত। তাদের অন্তরে দুনিয়ার কামনা-বাসনা ও যোগ-বিলাসের প্রতি নির্লিপ্ত। ফলে আধ্যাত্মিক জগতের গল্প-কাহিনী তাদেরকে ঘিরেই। পাপাসক্ত ও ভোগবিলাসে মত্ত মানুষ এসব কাহিনীর যথার্থতা হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। (জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব-১৬০ )
(বাকি বিষইয়গুলো পরের পোস্টে তুলে ধরা হবে ইনশাল্লাহ)