somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নীরা আর অদিতির গল্প, তাদেরকে ভালোবাসা

২০ শে জুন, ২০১০ দুপুর ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৯৫ সালের কথা। সারাদেশে আওয়ামীলীগের মুহুর্মুহু হরতাল আর প্রতিবাদ চলছে।শেখ হাসিনা একের পর এক জনসমাবেশে খালেদা জিয়ার গুষ্টি উদ্ধার কাজে লিপ্ত। ওই সময়, ঠিক সেক্ষণেই আমি পাবনা শহর থেকে উঠে আসলাম রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা তখনো এতটা ব্যস্ত নগরী হয়ে উঠেনি। এখনকার মত এত্তগুলো শপিং মল, যানজট আর তিক্ততাও তখন রাজধানীকে গ্রাস করতে পারেনি। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে আমি তখন স্বপ্নের ফানুস উড়াচ্ছি।আমাকে বড় হতে হবে, অনেক বড়।

ঢাকাতে আমার সেজখালা থাকেন। খালু খুলনার মংলা পোর্টে তখন বন্দর কর্মকর্তা। বাবা একদিন ঢাকায় আমাকে নিয়ে এসে খালুর সামনে এনে বললেন, “ভাইসাব, ছেলে এবার ৯২১ মার্ক নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। একটুর জন্য স্ট্যান্ড করতে পারেনাই। আপনি কি আমার ছেলের দায়িত্ব নিয়ে তাকে একটু বিশ্ববিদ্যালয়টা পার করে দিবেন?”

আমার খালু খুবই রাশভারী মানুষ।উনি কান চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “পারবোনা।”

আমার আব্বা বললেন “আলহামদুলিল্লাহ। অর্ক তুমি এখন থেকে খালুকে বাবার মত শ্রদ্ধা করে তার পাশে পাশে ঘুরবা আর পড়াশোনা করবা।”
খালু বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মনযোগ দিয়া পড়বা।নাহলে কান টেনে ছিড়ে ফেলবো।”

এরপর আমাকে জ্বী বলার সুযোগ না দিয়ে আমার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি মহা চালু মানুষ দুলাভাই। প্রতিমাসে খাবার খরচ পড়ার খরচ ৩ তারিখের মধ্যে পাঠায় দিবেন। নাহলে ৩ তারিখেই মাঝরাতে ছেলেকে আজগর পরিবহনে উঠায় পাবনা ফেরত পাঠায় দিবো।”

এখানে উল্লেখ্য আমার খালু কখনো একটি টাকাও নেয়নি বাবার থেকে। যখনই আমার বাবা কিছু দিতে চাইতেন খালু আমাকে হুংকার দিয়ে ডেকে বলতেন, বাক্স পেটরা ভর্তি করে বাবার সাথে বিদায় হও। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলতেন, "দুলাভাই, আমি যখন আপনার বাড়িতে বছরের পর বছর আপনার শ্যালিকা নিয়ে পড়ে ছিলাম তখন যা খরচ গেছে একটু কষ্ট করে জানায় দিয়েন। এখন ছেলে নিয়ে বাপ ব্যাটা বিদায়।" খালু আমার জন্য যা করেছেন তা একজন বাবার থেকে কোন অংশে কম নয়। আর আমার খালাও আমার মায়ের থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না।

এভাবেই শুরু হলো ঢাকা শহরে থাকা। খালু মাসের দু একদিন ঢাকায় এসে থাকেন, বাকী সময় মংলায়। খালাই মূলত আমাকে দেখে শুনে রাখেন, আর আমার প্রায় সমবয়সী(বছর দেড়েক ছোট) খালাতো বোন নীরা আমাকে ত্যাক্ত বিরক্ত করেই চলে। ভাত খেতে বসলে বলে, “অর্ক তুমি এত খাও কি করে বলোতো?"”।

আমি নিজেও কিন্তু খুব একটা দুধে ধোওয়া ছিলামনা। ওকে কতভাবে যে খেপাতাম, জ্বালাতাম তা মনে পড়লে এখনো অনেক হাসি পায়। পাঠকের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমার আজকের এই গল্পে নীরার ভূমিকা খুব সামান্য নয়। তাকে নিয়ে আবার পরে লিখছি।এখন যেই মেয়েটিকে নিয়ে লিখবো, সে আমার থেকে বছর দুয়েক বড় ছিলো শিক্ষাক্ষেত্রে(বয়সে এক দুমাসের হয়তো ছোটবড়,আমার পড়াশোনা একটু দেরীতে শুরু হয়েছিলো)।কিন্তু সেই আমার প্রথম ভালোবাসা, এবং জীবন দিয়ে ভালোবাসা।

মেয়েটির নাম অদিতি, এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সে আমার প্রথম হাউসটিউটর। তাকে ঠিক করে দিয়েছিলো আমার খালা।অদিতি থাকতো আমার খালার বাসার পাশের ফ্লাটে। খালার সঙ্গে অদিতির আম্মার দহরম মহরম অবস্থা।ওই সূত্রেই ওকে আমার জন্য শিক্ষিকা হিসেবে ঠিক করা।তাছাড়া ছাত্রী হিসেবে ওর তখন আমাদের ফ্লাটে বেশ সুনাম। অদিতি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যয়নরত। আমি যেন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো একটি বিভাগে ভর্তি হতে পারি এটা নিশ্চিত করাই ছিলো তার দায়িত্ব।

প্রথম যেদিন অদিতি পড়াতে আসে, আমি ওর দিকে একটিবারও তাকাতে পারিনি। শুধু জ্বী ম্যাডাম বলেই শেষ। কিন্তু আমি ওর গায়ের সেন্টের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম প্রবল ভাবে। যতক্ষণ সে আমার পাশে বসে ছিলো, প্রতিটি সময় আমি অনুভব করছিলাম বিশেষ কেউ আমার পাশে বসে আছে। এভাবে ঘন্টাখানেক চলার পর ও বললো, “আচ্ছা আজকে আমি যাচ্ছি। কিন্তু যাওয়ার আগে তোমাকে কিছু কথা বলে যাবো"”।

এবার আমি প্রথমবারের মত ওর দিকে তাকালাম এবং আতেলটাইপ, ইংরেজীতে যাকে বলে উইর্ড লুক দিলাম। অদিতি আমাকে হতভম্ব করে বললো, “দেখো ছোট্ট ছেলে, আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়। তাই আমাকে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি জানি, আমি দেখতে বেশি ভালো। কিন্তু সেটা তোমার দেখার দরকার নেই। তুমি মফস্বল থেকে এসেছো বলে এতোটা আনস্মার্ট হয়ে থাকবে এটা ঠিক নয়। আমার কাছে যখন পড়তে আসবে তখন স্মার্ট হয়ে পড়বে এবং আমার দিকে তাকিয়ে পড়বে।আমি হলাম তোমার খালার লেভেল এর মানুষ। ঠিক আছে?”
আমি বুকে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে বললাম, “জ্বী”।

এরপর থেকে আমি পড়াশোনা করা বাদ দিয়ে দিলাম। কি হবে পড়াশোনা করে! যে অপমান আর গঞ্জনার জ্বালা আমাকে অদিতি দিয়ে গেলো তার ভার সহ্য করা অসম্ভব ছিলো। ও যখন আমাকে পড়াতে আসতো তখন সে মাঝে মাঝে পিচ্চি বলে সম্বোধন করতো। এমন একটা রুপসী মেয়ে আমাকে এভাবে অপমান করছে আমি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। কিছু বলতেও তো নাহি পারি!

এভাবে দু সপ্তাহ কেটে গেলে আমি একদিন অদিতির জন্য বসে আছি পড়ার ঘরে।একটু পরেই ও এসে গম্ভীর হয়ে চেয়ারে বসলো। আমি ওর দিকে তাকাতেই আমার গলা শুষ্ক হয়ে গেলো। বুকে শুকিয়ে কাঠ হয়েছে যেন। ওর সারা চোখে পানি, মনে হয় যেন একটু আগে কান্না করে এসেছে। আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না আমার কেন এতো খারাপ লাগছে! আমি জানিনা আমার কি হয়েছিলো, আমি কি করে যেন ওর হাত শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে?"”।

অদিতি ঝাপটা দিয়ে ওর হাত সরিয়ে নিয়ে বললো, “পিচকি তোমার সাহস তো কম না! আমাকে কি তুমি তোমার প্রেমিকা মনে করো নাকি?তোমাকে থাপ্পর দিয়ে বেক্কেল দাত ফালায় দিবো।যাও ত্রিকোণমিতি বই নিয়ে এসো।”

আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হৃদয়ে স্ট্রোক খেলাম, আবার থাবড়া খাইনাই এইজন্য আকাশের দিকে মুখ তুলে করুণাময়ের দরবারে শুকরিয়াও জানালাম।অদিতি সেদিন যাওয়ার আগে আমাকে বললো, “চোখ উঠছে বুঝলে।বেশিক্ষণ আজকে তোমাকে পড়া দেখাতে পারলামনা।”

এভাবে দু-তিন মাস পার হওয়ার পর আমি দেবদাস হয়ে গেলাম এবং দাড়ি রাখা শুরু করলাম। অদিতি আমার দিকে কোন ভ্রুক্ষেপও করেনা। আমার খালা খালু ও নীরা আমার এহেন অবস্থা থেকে বলতে লাগলেন "অর্কর উন্নতি হয়েছে। পড়াশোনার চাপে হুজুর হয়ে যাচ্ছে।”আমি বহু কষ্টে কান্না থামিয়ে সব কিছু মেনে নিয়ে চলছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিলাম। অবস্থান বেশ ভালো ছিলো(না পড়ে কিভাবে এত ভালো হলো জানিনা!)। প্রথম ৫ টি বিষয়ের মধ্যে একটি পেয়ে গেলাম।অদিতি যে বিভাগে পড়ে তার থেকেও ভালো বিভাগে চান্স পাওয়ায় সে মনে হয় বেশ অবাক হলো। কারণ আমি খুবই কেয়ারলেস ভাবে তার কাছে পড়াশোনা করেছিলাম। এরপর থেকে তার সাথে একটু ভাব মারা শুরু করলাম।

ওর সাথে আমার মাঝে সাঝে দেখা হতো মধুর ক্যান্টিন অথবা অপরাজেয় বাংলার পাশে। কখনো কার্জন হলের ঘাসে ঢাকা মাঠে হেটে যেতে যেতে পাশের রাস্তায় হয়তো দেখতাম ও হেটে যাচ্ছে।আমি জানতে পারলাম, বেশ অনেকদিন ধরে তারই বিভাগের এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে সে প্রণয় সম্পর্কে আবদ্ধ।যেদিন খবরটা পেলাম সেদিন আমি সারাদিন কিছুই খাইনি। একমাস ভার্সিটিতে ক্লাস করতে যাইনি।বিশাল বড় চুল আর রবিবাবুর মত দাড়ি(জটপাকানো) নিয়ে আমি ক্লাসে আসতাম। সবাই ভাবতো, আমি বুঝি কবি হয়ে গেলাম। কিন্তু কেউ এটা জানতোনা, মনের ব্যথা আর চুলদাড়ির দৈর্ঘ্য একে অপরের সমানুপাতিক।

এভাবেই কেটে গেলো কিছুদিন। একদিন মেডিকেলের রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি অদিতি হেটে যাচ্ছে এবং তার মুখ দেখেই বোঝা যায় অত্যন্ত বিষণ্ণ। এর মধে তার কাছে আমার অবস্থান কিছুটা উন্নত হয়েছে। এখন সে আমার অর্ক বলে ডাকে, পিচ্চি বলে নয়। আমি ওর দিকে কাষ্ঠহাসি দিয়ে তাকিয়ে বললাম, “কেমন আছো অদিতি?”। পাঠক আপনাদের আগেই জানিয়ে রাখি ওকে আমি জীবনেও আপু জাতীয় কোন সম্বোধন করিনি। এই কারণে সে অনেক হম্বিতম্বি প্রথমে করলেও পরে আর কিছু বলেনি।

আমাকে দেখে ও একটু ভদ্রতার হাসি দেয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু পরে আবার বিষণ্ন হয়ে বললো, “জানিনা কেমন আছি!”

আমি ওকে নিয়ে মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে চা আর পুরীর অর্ডার দিলাম। সময়টা তখন গোধূলীবেলা। অদিতির চোখে পানি(চোখ ওঠার পর কেতর মার্কা পানি নহে), আমার দেবদাস অবস্থা। আমার মনে হয় দুজনেরই সেদিন দুজনকে বেশ আপন লাগছিলো। আমাকে অবাক করে দিয়ে ও সেদিন আমার হাত ধরে বললো, “তুমি কি আমার থেকে ছ্যাকা খেয়ে এমন চুল দাড়ি বানিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো।”

আমি স্পষ্টভাবে বললাম, “হ্যা”।

ও আমার দিকে অস্বাভাবিক একটা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে অপ্সরার মত হাসি দিলো। আমি পাগল হয়ে যাবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। বিশ্বাস করুন, নিজেকে আমি থাবড়া দিয়ে টেস্ট করেও দেখেছিলাম স্বপ্ন দেখছি কিনা!

সেদিন থেকে আমাদের প্রেম শুরু। হ্যা, একবছর ৫ মাস ৬ দিন(আমি দিন তারিখ ভালো মত গুণে রাখি) পর আমার বুকের ব্যাথা লাঘব হলো। আমি আপনাদের আমার প্রেম কাহিনীর কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি।

আমি প্রতিদিন ভোরবেলা শেভ করে বাসার পাশের গলিতে ফিটফাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম অদিতির অপেক্ষায়। ওর ক্লাস আমার আগে হোক অথবা পরে সবসময় আমি ওর জন্য অপেক্ষা করতাম। ও এলে আমি ওর সাথে রিকসা চেপে হুড উঠিয়ে মনে মনে শীষ বাজাতে বাজাতে ভার্সিটিতে যেতাম।সমস্যা একটাই ছিলো, আমি আবার ওর কাছে পিচ্চি উপাধিতে ভূষিত হতাম। সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিলো যখন আমি আর ও মোখলেছ মামার চটপটি খেতাম আর ওর চুল আমি নাড়াচাড়া করতাম। আমি ওর সাথে দুমাস ছিলাম, এবং এই দুমাসে কখনো ওকে স্পর্শ করিনি। শুধু ওর চুলগুলো একটু ছুঁয়ে দিতাম। ও আমার হাত মাঝে মাঝে জোর করে ধরে থাকতো।

কিন্তু কষ্ট পেতাম তখন যখন মনে হতো, ও কখনো আমার দিকে তাকায় না কেন? আমি দেখতে খারাপ ছিলাম না হয়তো। মাত্র দেড় বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি ২-৩ টি মেয়ের আগ্রহের মানুষে উপনীত হয়েছিলাম। অনেক নতুন জুনিয়র মেয়ে আমার কাছে আসতো পড়া(?!)বুঝতে। অবশ্য আমি কাউকে পাত্তা দিয়েছি বলে মনে পড়েনা। যেদিন থেকে আমি অদিতিকে দেখেছি সেদিন থেকে ওই আমার কাছে সর্বময় ছিলো।

মাস দুয়েক এভাবে রোমান্টিক আবহে কেটে যাওয়ার পর, একদিন হঠাৎ ও আমার কাছে এসে বললো, “কাল রাতে ফয়সাল ফোন করে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। অর্ক তোমার কি মনে হয় আমার ওকে ক্ষমা করা উচিত? তুমি আবার এটা ভেবোনা আমি ওর কাছে ব্যাক করবো।”

আমি ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “তুমি ওর কাছে ফিরে যাও।”

আমি দেখেছিলাম অদিতি আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে ছিলো। কিন্তু আমি জানি ও মনে মনে খুশি হয়েছিলো। আমি ওর দিকে তাকিয়েই বুঝেছিলাম ও কি চায়। যদি নিজের ভালোবাসার মানুষের মনের কথা না বুঝতে পারি তাহলে কিসের প্রেমিক হলাম?

এরপর আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ জীবনটা আমি কাটাতে লাগলাম। বাসায় আমার খালা খালু, বাহিরে বন্ধুরা সবাই করুণা করে আমার দিকে তাকাতো।আমি বদলে গিয়েছিলাম। আমি অনেক বদলে গিয়েছিলাম। আমি কারো সাথে কথা বলিনি বেশ অনেকদিন। আমি বোকা ছিলাম, কারন ভাবতাম ভালোবাসাই জীবনের সবকিছু। এই পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ আধবেলা খেয়ে বেঁচে থাকে, বাঁচার তাগিদে মানুষ তার গায়ের পোড়া মাংশ আরো ঝলসিয়ে খেয়ে বেড়ায় আর আমি হৃদয়ের পোড়া গন্ধ ঢাকতে ব্যস্ত, অতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি তখন নগরী ঢাকার এক জরাজীর্ণ কালো পাথর যাকে লাথি মারলে সে অনেক দূরে চলে যায়, কিন্তু তবুও মরে পড়ে থাকে। হ্যা, আমি একজন মৃত মানুষের মত নিঃশ্বাস নিতাম এই কার্বন ডাই অক্সাইডের শহরে।

এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সেদিনের আগ পর্যন্ত যেদিন আমি অদিতি আর ফয়সালকে চারুকলার পাশের মাঠের এক গাছপালার ছায়ার অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেললাম। অদিতি আমাকে দেখতে পেয়েছিলো কি? আমি জানিনা! আমি অতিদ্রুত সেখান থেকে হেঁটে আসলাম। একটা রিক্সা নিলাম এবং অসংবিত অবস্থায় বাসায় ফিরে আসলাম। তারপর কি হয়েছিলো জানিনা। আমি বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

জ্ঞান যখন হালকা ফিরে আসে তখন অনেক রাত। খালা কাঁদতে কাঁদতে বললো, “বাবা তোর কি হয়েছে?তুই দিন দিন এমন শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন?তোর মনে কি কেউ কষ্ট দিয়েছে রে?”। আমি নীরবে চোখের পানি ফেলি, মোমবাতির আলোয় সেই চোখের পানি জ্বলজ্বল করে উঠেছিলো কিনা কে জানে, আমি যে আঁধার কালোতেই ভবিষ্যত হারিয়ে ফেলেছি এটা ভালোই বুঝতে পারছি। শুধু একজন সব বুঝতে পেরেছিলো, ওটা ছিলো নীরা। ও সব জানতো, যদিও আমি ওকে কখনোই কিছু বলিনি। তবুও মেয়েটি সব বুঝেছিলো।নীরার গল্পের এখানেই শুরু।

৯৭ এর শেষভাগ। হাসিনা সরকার, বিএনপির হম্বতিম্বি, মুহুর্মুহু হরতালের আহবান সবকিছু ছাপিয়ে তখন ভালোবাসার আঘাত আমার কাছে আরো বড় ছিল।আমি ভার্সিটি যাইনা দুমাস হতে চলছে। এই পুরো সময়টা নীরা আমার পাশে থাকতো। ও তখন ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায়। ও আমাকে একটু পরপর বলতো, “কিছু খাবে?খাওনা কেন কিছু?"”। আমি ওর দিকে তাকিয়ে শুধুই একটা সুন্দর হাসি দিতাম।

আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, নীরাকে আমি কখনো চাইনি। কোনদিন না। কিন্তু ও আমাকে এত চায় কি করে? মেয়েটা সারাদিন আমার খাটের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে থাকে আর একটু পরপর কাঁদে।

আমি ওকে কিছু দিতে পারিনা। কিচ্ছু না! এটা ও ভালোভাবেই জানে, তবুও কি করে ও আমাকে এভাবে চায়?এতটা চায়?

এরপর একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে অদিতি খালার বাসায় এসে হাজির হয়। আমি তখন নীরার সাথে বসে ওকে ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে চলছি। এসময় অদিতি আমার রুমে এসে আমার পাশে বসে বললো, “তোমার একি হাল! এমন কেন করছো অর্ক?”

নীরাকে আমি চোখের ইশারায় চলে যেতে বললাম। এরপর অদিতির দিকে তাকিয়ে ঝকমকে হাসি দিয়ে বললাম, “কেমন আছো অদিতি?”
অদিতি আমার দিকে বেশ দুঃখী হয়ে তাকিয়ে রইলো। আমি ওর এমন চাহনী সহ্য করতে পারছিলাম না। ও মৃদুকন্ঠে বললো, “তুমি যেতে বলছো, আমি তো নিজে থেকে কিছু বলি নাই। ”

আমি জানালার পাশে যেয়ে আকাশ দেখতে দেখতে বললাম, “তোমার থেকে আমি মিথ্যা আশা করিনা অদিতি।যাকে চাও তার কাছেই যেতে বলেছি।এখন আমার কাছ থেকে চলে যাও। আর এসোনা”।"

অদিতি বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে চলে গেলো। ভুল দেখলাম কিনা জানিনা, কিন্তু তার চোখে পানি ছিলো। লজ্জার আর দুঃখের।বিশ্বাস করুন, ওর কান্না আমার ভালো লাগেনাই। আমি নিজের কাছে লজ্জিত হয়ে পড়ি।

আমি টানা দুদিন এরপর না খেয়ে ছিলাম। আমার বাসা থেকে বাবা মা এসে পড়ে, খালা খালু আমাকে অনেক বকাঝকা করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আমি শুধু একটু পানি আর দুটি কলা ছাড়া আর কিছুই খাইনি দুদিন ধরে।

একদিন গভীর রাতে আমার প্রচন্ড জ্বর। আমি মনে প্রাণে অদিতিকে চাচ্ছিলাম, আবার তার চুলগুলো একটু ছুঁয়ে দেখতে। তার পাশে বসে অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে।কিন্তু ও নেই, ও কোথাও নেই। আমি হাত বাড়িয়ে ওকে যখন ছুঁতে গেলাম তখন অস্বাভাবিক মমতায় কে যেন আমার মাথায় হাত রেখে কাঁদছিলো।নীরার চোখের পানি আমার কপাল ভিজিয়ে দিলো। ও আমার হাত যেভাবে শক্ত করে ধরে রেখেছিলো সেভাবে কেউ কখনো আমাকে ধরেনি। ও ওর মাথাটা কাত করে আমার কানের কাছে এসে বলছিলো, “তোমার জন্য জীবন দেবো অর্ক, একটু ভালো হয়ে যাওনা।”ওর সারা দেহ তখন থরথর করে কাঁপছিলো। আমি ওর হাত ধরে শুধু বলেছিলাম, “লাগবেনা”।"

আজ ১২ বছর হলো নীরার হাত একবারের জন্যও ছাড়িনি। আসলে মেয়েটি ছাড়তে দেয়নি, যে ভালোবাসার দাবীতে সেদিন ও আমার হাত ধরে ছিলো সেই দাবী অগ্রাহ্য করার মত ক্ষমতা কারো আছে বলে বোধ করিনা। আমার খালা খালু যেদিন আমার সাথে ওর সম্পর্কের কথা জানলেন সেদিন আমি অনেক লজ্জা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে তারা অনেক ভালোবাসতেন।

নীরা স্ট্যান্ড মার্ক নিয়ে পাশ করে আমার বিভাগেই ভর্তি হলো। আমি পাশ করার পর ওর সাথে জোর করে আমার পরিবার বিয়ে করিয়ে দেয়। আমাদের ছোট্ট একটি মেয়ে আছে। মেয়ের নাম আমি পাঠককে বলবোনা। কারণ আমি ওই নাম নিয়ে অত্যন্ত মনোকষ্টে আছি এবং ছিলাম। আমার মেয়ের নাম আমি রাখবো, সে জায়গায় নাম রাখলো তার মা। আমি মেনে নেইনাই, নিবোওনা।

আর অদিতি, ওর কথা অনেকদিন জানতাম না। মাঝে মধ্যে রাস্তায় দেখা হয়েছে। এরপর ওই এলাকা ছেড়ে অনেকদিন হলো চলে এসেছি। ২০০৮ এর শেষের দিকে বোধ করি একবার দেখা হয়েছিলো। আমি তখন নীরা আর আমার কন্যামাকে নিয়ে ধানমন্ডির শর্মা প্যালেস এ ফিশ শর্মা খাচ্ছি। ও পিছন থেকে এসে হাসিহাসি মুখে বললো, “কেমন আছো অর্ক?”
আমি হাসিমুখে বলেছিলাম, “ভালো আছি, সংসারী আছি। তুমি?”

ও সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললো, “জানি না তো!”


সেদিন রাতে নীরাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে হারানোর ভয় পেয়েছিলে আজকে?”
ও রিনিঝিনি কন্ঠে হাসতে হাসতে বললো, “যে আমার তাকে নিয়ে ভয় পাবো কেন? আমার না হলে সেইরাতে আমি তোমার হাত না ধরে উত্তম মাধ্যম দিয়ে অদিতির কাছে পাঠিয়ে দিতাম”।"
আমি গভীর আবেগে ভাবি, বাহ! ও যে আমার মত করেই ভাবে!

********************************************************************

যারা কষ্ট করে এই রোমান্টিক লিখাটি পড়েছেন, তাদেরকে আমার সমবেদনা জানাই।আমি লেখক নই আগেও বলেছি।আজও এই লিখাটি অফিস ফাঁকি দিয়ে লিখেছি। আমার মনে হয় এখনকার সময়ে এমন লুতুপুতু আবেগী গল্প একেবারেই মূল্যহীন। তাও কেন যে এমন কিছু লিখলাম জানিনা! হয়তো একথা ভেবে যে, এই কাষ্ঠ সময়ে আমার এই তুচ্ছ লিখা যদি ভুল করেও কাউকে একটু আবেগ ধরিয়ে দিতে পারে!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১০ সকাল ১০:৫৩
৪১টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×