কবি ও বৈজ্ঞানিক দুজনই সাধক, দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। এ দু’য়ের সাধনা যেমন বিভিন্ন, দৃষ্টি ও সৃষ্টিও তেমনি পৃথক। কবির দৃষ্টিতে তিনি কেবল বস্তু বা ঘটনা দেখেন না; এ সবের ভিতর দিয়ে কি যেন এক অস্পষ্ট আভাস বা ইঙ্গিত দেখতে পান। সে ইঙ্গিত অনেক সময় সাধারণ মানুষের মনের কল্পনাকেও আলোড়িত ক’রে তোলে, এবং কল্পনা উদ্বুদ্ধও করে। সে কল্পনার ছায়ায় পৃথিবীর চিত্র বেশ স্নিগ্ধ মনোহর উজ্জ্বল হ’য়ে ফুটে ওঠে। তখন পৃথিবীটা আর আমাদের নিত্য-গোচর পৃথিবী থাকে না; কল্পনার স্বর্গে পরিণত হয়। সেই স্বর্গরাজ্য কল্পনাকে আশ্রয় ক’রেই গড়ে ওঠে, কিন্তু কবির কাছে তা কিছু কম বাস্তব নয়, আর সাধারণ লোকের মনে যে আনন্দের সৃষ্টি করে, সেটাও কিছু তুচ্ছ ব্যাপার নয়। জড়পিণ্ড সংসারটা প্রাণের স্পন্দনে সচকিত হয়ে ওঠে, প্রত্যেক তুচ্ছ ঘটনা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাতে করে কবির সহানুভূতি ও আত্মীয়তার পরিধি শতগুণ বেড়ে যায়।
কবির সত্য শুধু বর্তমানের নয়, তা অতীতের সুখস্মৃতি উদ্দীপনা করে, আর ভবিষ্যতের অপ্রাপ্ত মোহনীয় যুগের আগমনী জানায়। এই আগমনী সুরের রেশ ধ’রে ধ’রে জগৎ ক্রমে ক্রমে উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়। এই ভাবে কবি যুগে যুগে জগৎকে পঙ্কিলতা হতে বাঁচিয়ে, সুমার্জিত করে নৈতিক ও মানসিক চেতনার সঞ্চার ক’রে মহাকল্যান সাধন করেছেন।
দার্শনিকও নতুন নতুন ভাবের বন্যা এনে জগৎকে ভাবের দিক দিয়ে আরও নিবিড় ক’রে দেখতে শিখাচ্ছেন। কিন্তু তিনি অনেকটা কবি-প্রকৃতির হ’লেও কবির সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এ যে তিনি কবির মত অত বিপুল ও চিত্তাকর্ষকভাবে লোককে বুঝাতে পারেন না। দার্শনিক সাধারণ লোকের মনের মানুষ বা চিন্তার মানুষ; আর কবি যেন তার ঠিক হৃদয়ের মানুষটি। তাই দার্শনিকের চেয়ে কবির বাণী আরও প্রত্যক্ষভাবে লোকের চিত্ত অধিকার করে।
ওদিকে বৈজ্ঞানিক সচরাচর দৃশ্যমান জগতের প্রত্যেক বস্তু ও ঘটনাকে বিশেষভাবে পরখ ক’রে দেখতে চান। তাঁর কাছে ইন্দ্রিয়ের অগোচর বিষয়াদি প্রাধান্য নাই। ইন্দ্রিয়াতিরিক্ত কোনো জিনিস নাই, বৈজ্ঞানিক কোনো দিন এমন কথা বলেন না; কিন্তু তার সম্ভাব্যতা স্বীকার করলেও, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে ও বিষয়ে চুপ থাকা বা উপেক্ষা করাটাকেই বেশী বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন। তিনি কাজের লোক, যা সামনে আসছে তারই রহস্য নিয়ে ব্যস্ত, মাথা খাটিয়ে রহস্য সৃষ্টি করে আর আপদ বাড়ানো শ্রেয় জ্ঞান করেন না। কিন্তু তাই বলে, নতুন রহস্য যখন সত্যি সত্যিই আসে, বৈজ্ঞানিক সে সময় কস্মিনকালেও উদাসীন থাকেন না। নতুন নতুন রহস্য নির্ণয় ক’রেই তো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ ক’রে চলেছেন। বৈজ্ঞানিক হাজার হাজার সমস্যার সমাধান করতে অপারগ, এ কথা তিনি ভাল রকমেই জানেন। এজন্য তাঁর মনে গর্বের ভাব কখনও আসে না। বৈজ্ঞানিক জানেন, তিনি কিছু করেছেন, সংসারের জ্ঞানভাণ্ডারে অনেক সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ট নন। তিনি যে অনন্ত কোটি রহস্যের উদ্দেশ পান নাই এবং যে সমস্ত উপস্থিতি রহস্যের স্বরূপ নির্ণয় ক’রতে পারেন নাই, তার জন্য অত্যন্ত বিনীত ও নম্রভাবে সাধনা ক’রে যাচ্ছেন। তিনি নিজের মনে নিজেই সঙ্কুচিত; এর পরও যদি কেউ বলেন, “অমুক সাধারণ ব্যাপারটাই যখন সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক মীমাংসা করতে পারলেন না তখন আর বিজ্ঞানের মূল্য কি?” তা হ’লে বোধ হয় অনেকখানি অন্যায় ও অবিচার করা হবে।
বৈজ্ঞানিক বস্তু বা ঘটনাকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করেন, তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে অশ্রদ্ধার সঙ্গে ফেলে দেবার জন্য নয়; তার ভিতরকার সত্যটি আবিষ্কার করে জগতের অন্যান্য সত্যের সঙ্গে তাকে শ্রেণীবদ্ধ করে যথাযথভাবেই গাঁথবার জন্যই। এর জন্য বৈজ্ঞানিকের ‘নির্দয়’ ‘পাষাণ’ প্রভৃতি অনেক আখ্যা মিলেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক যদি কখনও নিষ্ঠুরও হন, তবু সে সত্য-সুন্দরের জন্য; সে রকম নিষ্ঠুরতা তুলনা বিশ্বস্রষ্টার জাগতিক নিয়মে অনবরতই দেখতে পাচ্ছি।
কবি দেখতে চান জগৎ-ব্যপারের অতীত সৌন্দর্য, আর বৈজ্ঞানিক দেখতে চান তার অন্তর্নিহিত সত্য। কবির সৌন্দর্য যেমন সত্য, বৈজ্ঞানিকের সত্য তেমনি সুন্দর। কবির কল্পনা-তুলিকার স্পর্শে মানুষ অতীন্দ্রিয় লোকে উঠে গিয়ে আত্মভোলা হয়ে যায়, আর বৈজ্ঞানিকের পরিমাপরজ্জু তার কল্পনার-ফানুস টেনে ধরে ব’লে আবার তার স্থায়ী আত্মানুভূতি ফিরে আসে। কবি, স্থল সংসারটাকে অনেকখানি উপেক্ষা ক’রে কল্পলোকের অমৃতের লোভে আকাশে বিচরণ করেন। তাঁর সে বিচরণ নিরর্থক হয় না; তিনি সত্যি সত্যিই কিছু না কিছু অমৃত বা সুধা পান ক’রে জগৎবাসীর জন্যও কিছু নিয়ে আসেন। আবার বৈজ্ঞানিক, পৃথিবীর স্থায়ী প্রাপ্তিকে সর্বদা মুঠোর ভিতর রেখে, নিশ্চিতকে না ছেড়ে, ঐরূপ নিশ্চিত আরও সত্যসুধার সন্ধানে ফেরেন। এখানে তিনি কল্পনা-প্রিয় দার্শনিকের মত। কিন্তু এঁর কল্পনা প্রধানতঃ মস্তিষ্কের উপর নির্ভর করে না; বৈজ্ঞানিকের কল্পনা যেমন শরীরী; তার অন্তর বাহিরের সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে জড়জগতের সমস্ত উপাদান দিয়ে তিনি তাঁর কল্পসুন্দরীর মন যোগাচ্ছেন। তার ফলে তিনি সুন্দরী প্রকৃতির কাছ থেকে অতি সঙ্গোপনে যে গোপন রহস্যবাণী শুনতে পাচ্ছেন, তা’ সোনার থালায় সাজিয়ে জগজ্জনের সামনে ধরছেন।
জগ্যৎ এজন্য কবি ও বৈজ্ঞানিক দুইজনের নিকটই কৃতজ্ঞ। বৈজ্ঞানিক না থাকলে কবির কল্পনা, খেয়াল হয়ে ধোঁয়ার মত শূন্যে মিলিয়ে যেত, আর কবিচিত্ত না থাকলে, বৈজ্ঞানিকের সাধনা পৃথিবীর ধূলামাটির মধ্যে কুটে মরতো।
কবি ও বৈজ্ঞানিক
প্রবন্ধ: কাজী মোতাহার হোসেন
কৃতজ্ঞতা, কাজী মোতাহার হোসেন ফাউণ্ডেশন।
*** *** *** *** *** * *** *** *** *** ***
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে আদর করে 'মোতিহার' ব’লে ডাকতেন। ১৯২৮-এ কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লেখা কাজী নজরুল ইসলাম এর একটি চিঠিতে কবি আকুতি মাখা ঐকান্তিকতায় জিজ্ঞাসা করছিলেন-
“আমায় সবচেয়ে অবাক করে নিশুতি রাতের তারা। তুমি হয়তো অবাক হবে, আমি আকাশের প্রায় সব তারাগুলোকেই চিনি। তাদের সত্যিকারের নাম জানিনে কিন্তু তাদের প্রত্যেকের নামকরণ করেছি আমার ইচ্ছে মত। সেই কত রকম মিষ্টি মিষ্টি নাম, শুনলে তুমি হাসবে। কোন তারা কোন ঋতুতে কোন দিকে উদয় হয়, সব বলে দিতে পারি। জেলের ভিতর সলিটারি সেলে যখন বন্দি ছিলাম, তখন গরমে ঘুম হত না। সারারাত জেগে কেবল তারার উদয় অস্ত দেখতাম। তাদের গতিপথে আমার চোখের জল বুলিয়ে দিয়ে বলতাম, বন্ধু, ওগো আমার নাম না জানা বন্ধু, আমার এই চোখের জলের পিচ্ছিল পথটি ধরে তুমি চলে যাও অস্ত পাড়ের পানে। আমি শুধু চুপটি করে দেখি। হাতে থাকতো হাতকড়া, দেয়ালের সঙ্গে বাঁধা চোখের জলের রেখা আঁকাই থাকতো মুখে, বুকে। আচ্ছা বন্ধু, ক'ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়, তোমাদের বিজ্ঞানে বলতে পারে ? এখন শুধু কেবলই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে যার উত্তর নেই, মিমাংসা নেই - সেই সব জিজ্ঞাসা।”
*** *** *** *** *** * *** *** *** *** ***
আমেরিকান কবি ও দার্শনিক হেনরি ডেভিড থ্যরু; চারপাশের প্রাকৃতিক ঘটনাবলির পর্যবেক্ষণ ধারাক্রমে তার জার্নালে প্রায় প্রতিদিন রেকর্ড করে রাখতেন। এভাবেই তিনি একজন প্রকৃতিবিদ লেখক হয়ে ওঠেছিলেন। স্ব-দেশে তাকে পরিবেশ আন্দোলনের জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। থ্যরু, শেষ জীবনে এসে নয়া-বায়োলজির সাথে সম্পর্ক গড়েন। তাঁরই একটি প্রবন্ধ থেকে স্ফুরিত হয়ে পদ্য-রচনাটি―
আশংকা হয়
আমার জানা-শোনার স্বভাব
বছর থেকে বছর
ক্রমেই পৃথক ও বৈজ্ঞানিক হয়ে পড়ছে-
যেনো স্বর্গের মস্তকাবরণে মম
বু্যঢ় দৃষ্টির বিনিময়।
অণুবীক্ষণের ময়দানে
নিজেকে সঙ্কুচিত করে দেখি
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার কিছু।
না, তাতে গোটা টা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না
এমনকি তার লেশটিও নয়।
তবে গণনা করতে পারছি, তার
কতক অংশ এবং এতেই বলেছি-
আমিও জানি?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:০১