মৃত্যু কি? জীব বিজ্ঞানের জ্ঞান দিয়ে এককোষী জীবের মৃত্যুর একটা সংজ্ঞা জেনেছিলাম। এককোষী জীবের মৃত্যু হল তার প্রজনন বিনষ্ট ক্ষমতা একেবারেই হয়ে যাওয়া (যদিও দ্বিমত রয়েছে)। কিন্তু, বহুকোষী জীবের মৃত্যুর জৈবরাসায়নিক সংজ্ঞা আমি এখনও জানি না। নিজে নিজে একটা দাড় করাতে চেষ্টা করেছিলাম। আমার মতে, বহুকোষী জীবের শ্বসন ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ফলে তার মস্তিস্ক সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় হয়ে পড়াই তার মৃত্যু। সত্যিই, যে বিজ্ঞান শিখেছিলাম, তা আমাকে দিয়েছিল বেগ কিন্তু কেঁড়ে নিয়েছিল আবেগ। কোন দুঃখের কিছু শুনলেই বলতাম, “সব কিছুই আপেক্ষিক, কোন কিছুই পরম নয়, দুনিয়াতে আরও কত খারাপ ঘটনা ঘটে!”। আজ কেন জানি না সন্দেহ হয়, আদৌ বিজ্ঞান জীবনে কিছু শিখতে পেরেছি কিনা। এমনই ছিলাম আমি। কারও মৃত্যুর খবর আমাকে বিচলিত করত না। আমার বাবা আমার এ চরিত্রটাকে খুবই অপছন্দ করে। অবস্থা এমন হয়ে পড়েছিল যে, আমাকে কারো মৃত্যু খবর দেবার সময়, বাবা চোখে একটা বিরক্তি ফুটে উঠত। বাবা এও ভাবত হয়ত, যে তার মৃত্যুতেও আমি বিচলিত হব না।
একটা রাত, মাত্র একটা রাত, আমার জীবন দর্শনকে একেবারেই বদলে দিল। সে সন্ধ্যায় প্রায় ৬.০০টার সময় বন্ধুদের সাথে বের হয়েছিলাম ঈদের মার্কেটিং করতে। মনে খুব আনন্দ নিয়ে আমরা প্রথমে গেলাম, এলিফেন্ট রোডের বাটা সিগনালের কাছে বাটাতে। এক বন্ধু একটা জুতা পছন্দ করল। সে ঠিক করতে পারছিল না জুতা কিনবে নাকি আগে কাটাবনের Nick এ দেখা ব্লেজার কিনবে। আমি বললাম, “চল আগে আমারে দেখা, তারপর সাজেশন দিব”। ওর পিঠে থাপড়ে হাটা শুরু করলাম কাটাবনের দিকে। পেট্রোল পাম্পের বাম পাশের গলির গিয়ে থেমে গেলাম। কেমন যেন অজানা একটা আকর্ষণ অনুভব করলাম, মন বলল কে যেন ডাকছে, সেই গলির ভেতর থেকে। আর আগে অনেক গিয়েছি সেখানে নানা কাজে। তবে, যখন দাদির সাথে দেখা করবার উদ্দেশ্য নিয়ে গেছি, শুধু তখনই ভিতরে ঢুকেছি। অন্যসময় কখনোই যাওয়া হয় নি, এমনকি দাদি অসুস্থ থাকার সময়ও না। কিন্তু, সেদিন কেন জানি না, আমি বন্ধুদের বললাম, “ তোরা যা আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। দাদিকে একটু দেখে আসি, গতকাল শরীরটা খুব খারাপ দেখলাম”। ওরা Nickএর ভেতর চলে গেল, আর আমি গেলাম দাদির কাছে। কিন্তু গিয়ে দেখি দরজা তালা বদ্ধ। ভাড়াটিয়া মহিলা উঁকি দিল তার ঘর থেকে। দাদি কোথায় প্রশ্ন করায়, উত্তর দিল শরীর খারাপ করায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পাশের ঘর থেকে বড় চাচী, মাথা বের করে একই উত্তর দিল। কিন্তু, কেউই জানেনা কোন হাসপাতাল। চাচাকে ফোন দিলাম, চাচা বলল সেন্ট্রাল হাসপাতালে দাদি। সাথে সাথে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, রিক্সা নিলাম সেন্ট্রাল হাসপাতালের জন্যে। গিয়ে এমার্জেন্সিতে দেখি, দাদিকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার বলছে আইসিইউতে রাখতে হবে। কিন্তু, কোরবানীর ঈদে আইসিইউতে ডাক্তার সংকট। তাই সেন্ট্রালে রাখা যাবে না। হঠাৎ, দেখি বাবা হাজির। বাবা চলে গেল, বারডেম ও পিজিতে আইসিইউএর খোজে। কিন্তু, পেল না। সব বুক হয়ে আছে। অবশেষে সেন্ট্রালের ওরাই ঠিক করে দিল, ধানমন্ডিতে স্যালভেশন সেন্টার। সাথে সাথে সেন্ট্রালের ওরাই এমবুলেন্স ভাড়া করে দিল, দাদিকে নিয়ে গেলাম সেখানে।
দাদি খুব জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছিল, তার অস্থিরতা খুব বুঝতে পারছিলাম। আগের দিন আমাকে প্রথমে চিনতে পারেনি। সেদিন আমাকে বাবার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। কিন্তু, সেই রাতে তার মুখে ছিল তার বড় ছেলে নাম, যে তার মৃত্যুর সময়ও উপস্থিত ছিল না। এমনকি মৃত্যুর ২৪ ঘন্টা পার হবার আগে সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারার প্রশ্নে মেতে উঠে। মায়ের হৃদয় সত্যিই শাস্তি দিতে জানে না। এমবুলেন্সে তার হাত আমি ধরে রেখেছিলাম, ঠিক বিগত ২৪ বছরে যেরকম ধরেছি ঠিক সেরকমই লাগছিল। স্যালভেশন সেন্টারে দাদিকে ওরা সাথে সাথে আইসিইউতে ঢুকিয়ে নিল। রাত তখন প্রায় ১০.০০ টা। এরপর দাদিকে আর ছোয়া হয়ে উঠেনি। সাথে সাথেই সেখানে এক ভদ্রলোকের মৃত্যু ঘটে। সে মোটরসাইকেলে একসিডেন্ট করেছিল, ঢাকা মাওয়া সড়কে। তার স্বজনদের আহাজারীতে হাসপাতালের পরিবেশ অন্যরকম হয়ে উঠে।
আমরা অপেক্ষা করছিলাম বাইরে, আমি, আমার বাবা, আর ছোট চাচা। চাচা নিজেকে শান্তনা দিয়ে কথা বলে যাচ্ছিল অনবরত। আর আমার বাবা চুপ করে বসেছিল, বাবা এমনই। এর আগের দিনই বাবা, আমাকে বলেছিল দাদি হয়ত আর বাঁচবে না। ডাক্তার আমাকে একটা ব্লাড স্যাম্পল ধরিয়ে দিয়ে বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইবনে সীনা হাসপাতাল থেকে টেস্ট করিয়ে আনতে। টেস্ট করালাম, সেখান থেকে। ওখানের ডাক্তার বলল, “তাড়াতাড়ি যান, অবস্থা খুবই খারাপ”। মুখে উচ্চারণ না করেও, বলেদিল “সময় নেই আর”। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে অবস্থাটা বুঝিয়ে দিতে। সে বলল, দাদির মারাত্বক electrolyte imbalance ঘটেছে। রিপোর্ট ওরা ফোনে স্যালভেশন সেন্টারকে জানিয়ে দিল। রিপোর্ট নিয়ে স্যালভেশন সেন্টারে পৌছলাম প্রায় রাত ১২.০০ টার দিকে। ওরা বিশাল ঔষুধের লিস্ট ধরিয়ে দিল, সাথে সাথে দুই ব্যাগ ভর্তি ঔষুধ কিনে দিলাম, রাত তখন ২.০০টা। সেই সাথে বলল, দাদির শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য বিশেষ যন্ত্র লাগাতে হবে (নামটা মনে আসছে না)। সেটার জন্য প্রতি দিন ১১,০০০ টাকা দিতে হবে। আমি বললাম, “যা কিছু লাগে করেন, আমাদের সব কিছুতেই সম্মতি আছে”। ডাক্তারের মত এমন ইতর প্রানী আমি জীবনে আর দেখি নি। এই অর্থখেকো জীবদের নিয়ে এখন আর কথা বাড়াব না।
ডাক্তার আমাকে ডেকে নিল, প্রায় ২.৩০ এর দিকে। আমাকে জানাল, দাদির ব্লাডে অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল খুবই ফ্লাকচুয়েট করছে। কখনও ৯৯ তো একটু পরেই ২০। তার মতে, এ অবস্থা থেকে কেউ কখন ফিরে আসে না। আমি দাদিকে দেখলাম কাচের এপার হতে। রাত ১০.০০ টায় যখন তাকে নিয়ে আসা হয়, তার মধ্যে অস্থিরতার প্রকাশ ছিল, কিন্তু হাসপাতালে আনার পর রাত ২.৩০ তে দাদি একদম নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন। বুঝতে পারছিলাম, দাদি বেচে আছেন। আগে সিনেমাতে দেখতাম, রোগীর পাশে ছোট্ট একটা টিভির মত যন্ত্রে কত গুলো দাগ চলে যায়। দাগ গুলো যখন সরল রেখা হয়ে পড়ে, তার মানে শেষ। আর একটু পর পর যখন, দাগ দেখা যায় তার মানে অবস্থা খারাপ। দাদির অবস্থা সেরকমই ছিল। ডাক্তার আমাকে ডেকে ইতরের মত বলল, “মনে হয় আর বেশিক্ষণ টিকবে না”। ছেলেমেয়ে অপহরণের পর, পিতামাতার অপহরণকারীর কাছে যে অবস্থা হয়, আমাদের অবস্থা তখন সেরকম। ডাক্তার কিডনাপারের মত আচরণ সব সহ্য করতে হচ্ছিল। আমার বাবার সাথেও সে একই রকম কথা বলছিল। লোকাল বাসের কন্ট্রকটরের মত বাবাকে সম্বোধন করছিল, “মুরুব্বি” বলে। তার কথায় আমার বাবার হঠাৎ কাপুনি ধরে বুকে ব্যাথা ধরে গেল। খুব কঠিন মূহুর্তেও আমি নিজেকে শক্ত রাখতে সক্ষম। কিন্তু, বাবাকে ঐ অবস্থায় দেখে চোখে পানি আটকে রাখতে পারলাম না।
আমার বাবার এক পরিচিত ডাক্তার আছে। তার প্রতি বাবার ভক্তি অসীম। বাবা ডাক্তার সাহেবকে ফোন করে যায়। আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শোনে!! ডাক্তার সাহেব তার ফোনে একটা গান সেট করেছে, “এসো হে বৈশাখ এস এস”। কেউ ফোন করলেই, টু টু শব্দের স্থলে এই গান বাজে। চিন্তা করুন, গভীর রাতে আপনি আপনার মৃত্যপ্রায় মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তারকে ফোন করছেন, আর কানে বেজে উঠছে কোন গান। আপনি প্রতিবার ফোন করে, শুনে যাচ্ছেন সে গান... ... ... ...
(পরবর্তি পোস্টের জন্য ক্লিক করুন )
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





