somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুষ্টলোকের ধর্মকথা

০৭ ই অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্যায় - কয়েক বছর আগে:

রোজার ঈদের নামাজ পড়ে আমাদের এপার্টমেন্টের দুই তলায় এক বাসায় গিয়েছিলাম আমি আর আমার বাবা। ভদ্রলোক এক অবসরপ্রাপ্ত সচিব, তার স্ত্রী মারা গেছে, ছেলেরা আমেরিকায় আর উনি একা থাকেন। বর্তমানে একটি ইসলামী বাংকের চেয়ারম্যান ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কনসাল্টন্ট হিসেবে আছেন। লোকে বলে উনি নাকি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন লেখা পড়ায় এবং ইবাদত বন্দেগীতে।

আমাদের উনি পায়েস খেতে দিলেন, সেই সাথে জ্ঞানের আলাপ শুরু করলেন। ভাল ভাল কথাই বলছিলেন। উনি বললেন, “নাজাফে কোন এক মসজিদে কিছু খ্রিস্টানরা কি এক কাজে এসেছিল। খ্রিস্টানদের উপাসনার সময়ে তারা বাইরে যেতে চাইলে মসজিদের মুসলিমরা খ্রিস্টানদের সেই মসজিদেই তাদের উপাসনা করতে অনুরোধ করে”। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “অথচ আমাদের দেশের মসজিদে অশিক্ষিত ইমাম অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঢুকতেও দেয় না”। তাই উনি নাকি সচিব থাকাকালীন বাংলাদেশ সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন “ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমী গড়তে”। পরবর্তীতে সেটা হলেও তেমন কাজে আসে না। ইমামরা দুই মাস কোর্স করে প্রায় ১৭/১৮ হাজার টাকার মত আয় করে, কিন্তু ফিরে গিয়ে ট্রেনিংএর কোন বাস্তবায়ন করে না। এই দুঃখে তিনি অবসর নেবার পরে নিজ অর্থেই ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার চিন্তা ভাবনা করছেন। ভদ্রলোকের এহেন নেক চিন্তা ভাবনার কথা শুনে তার প্রতি খুবই প্রীত হইলাম। শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠল।

এরপর উনি শুরু করলেন ইতিহাসের কথা। আল বেরুনি নাকি বাংলাদেশে এসেছিল। এসে দেখে এই দেশে প্রতিদিন একবার নদীর পানি উঠে আর একবার নামে (জোয়ার ভাটা আর কি!)। এতে আল বেরুনী খুবই বিচলিত হইলেন কারন আলবেরুনির, ভৌগলিক কাঠামোর মানুষের আচরণের উপর প্রভাব সম্পর্কিত তত্ত্ব আছে। সেই তত্ত্ব মত আলবেরুনি নাকি তার বইতে লিখে গেছেন বাঙালিদের আচরণের ঠিক ঠিকানা নাই। এরা বিপদজনক এবং উনিও তাই ভয়ে বাংলায় এসেই দ্রুত চলে যান। আলবেরুনীর সাথের জিনিস পত্রও নাকি বাঙালিরা চুরি করে নিয়েছিল। এরপর আরো যা যা বললেন তা মূলত ছিল বাঙালিদের নিন্দা। শুনলাম মন খারাপ করলাম, কিন্তু কিছু বলার ছিল না। প্রথমত উনি কিছু রেফারেন্স সহ কথা বলছিলেন এবং ইমাম প্রশিক্ষণের কথা বলে আমার মনে নিজের একটা গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধার ইমেজ তৈরি করে ফেলেছিলেন। তবে, একটা ব্যাপার খটকা লাগছিল যে তিনি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধের স্থলে গন্ডোগোল শব্দটিই ব্যবহার করতেন। যাইহোক, তখন তো আর এত কিছু বুঝতাম না।

দ্বিতীয় পর্যায় - গত বছরের একুশে বই মেলা:

মেলায় ঘুরতে ঘুরতে, দিব্যপ্রকাশের স্টলে আলবেরুনীর ভারততত্ত্ব বইটি চোখে পড়ল। বইটার কথা আগে যদিও শুনেছিলাম কিন্তু তখন ঐ বুড়োর কথা মাথায় ভেসে উঠল। ভাবলাম আল-বেরুনীর মত বিখ্যাত ব্যক্তি আমাদের বাঙালিদের সম্পর্কে কি ধারণা করেছিলেন তা জানা দরকার। বইটা কিনে ফেললাম সাথে সাথে।

তৃতীয় পর্যায়-বাসায় ফিরে:

বইটা শেষ পর্যন্ত পড়লাম। আল-বেরুনী কখনই বাংলায় আসেননি। উনি এক প্রকার বন্দী হিসেবে গজনীর সুলতান মাহমুদের সৈন্যদের সাথে উত্তর ভারতের সিন্ধু ও পাঞ্জাবের কয়েকটা শহরে কিছু দিন ছিলেন। সেখানে হিন্দুদের সাথে তার পরিচয় হয় এবং তিনি তাদের সাথে আলোচনা করে ভারততত্ত্বর মত বই লেখেন। পুরো বইতে একবার মাত্র “বঙ্গ” শব্দটি দেখলাম তাও একটা লিস্টে।

চতুর্থ পর্যায়:

বুড়ো সম্পর্কে খোঁজ নিলাম। সরকারি চাকুরীজীবি হিসেবে একাত্তরে আমেরিয়ায় ছিল, যুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সাপোর্ট দেয় নি। দেশে আসে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, আবার চাকরিতে যোগ দেয়। সে আর কিছুই না নিম্নমানের ধর্মব্যবসায়ী। চান্স পেলেই বাঙালিদের দোষ বর্ণনা শুরু করে। বেশি চান্স দিলে হয়ত জামাত-শিবির বন্দনা শুরু করার ইচ্ছা রাখে।

উপসংহার:

লোকটা সিম্পলি গোয়েবলসীয় খেল দেখাল, আর কিছুই না । খুব ভাল মতই সে জানে, সাধারন মানুষের জ্ঞান সীমিত। মিথ্যা রেফারেন্স বা অর্ধ সত্য কথা বললে বেশির ভাগমানুষই তার সত্যতা উদ্ঘাটনে তেমন খোজ খবর নেবে না। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। বিধায় সে এই মিথ্যা প্রচার করতে কোন বাঁধা দেখে না, আর আগেই একটা ইমেজ তৈরি করে নেয়। এই ইমেজের ভিত্তিতে হয়ত অনেকেই তার সম্পর্কে ভাবে, “লোকটা জামাতি হইলেও জ্ঞানী আছে” অথবা “জামাতিগুলা খারাপ হলেও ঐ লোকটা খুব জ্ঞানী, তারে জ্ঞানের জন্য শ্রদ্ধা করি” ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ একটু লেখাপড়া করলেই এদের রূপ বেরিয়ে পড়ে।

মাঝে মাঝে এসব দুষ্টলোকদের ব্যাপারে বিভিন্ন লোকের সাথে কথা হয়। তারা বলেছেন, “ওরা দুষ্ট, যদিও ওদের মধ্যে থেকে অমুক দুষ্টটা খুব যুক্তিবাদী, জ্ঞানী, ভাল ভাল ধর্মকথা বলে ইত্যদি ইত্যাদি”। এই “ওরা”-গ্রুপের মধ্যে পড়ে জামাতী, অল্প কিছু নাস্তিকতা ধর্মে অন্ধ নাস্তিক, কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী, গুটি কয়েক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে খাওয়া লোক এবং কিছু জ্ঞান পাপী।

উপদেশ:

সাধারন ব্লগারদের জন্য নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি দুষ্ট লোকেদের ধর্মকথা থেকে সাবধান। কেউ কিছু লিখে দিলেই তা বিশ্বাস করবেন না নিজে যাচাই না করে। আর এ জন্য বসেও থাকবে না যে অন্যকেউ দুষ্টলোকের ধর্মকথা যাচাই করে দেবে। আপনার মত অন্যরাও নিজ নিজ জীবনে ব্যস্ত। ফাকতালে কিছু দুষ্ট লোক মিথ্যা ধর্মকথার প্রচার করে যায়। তাই, হয় আগে যাচাই করে নিবেন সময় পেলে, নতুবা যেন তেন লোকের লেখা (মূলত কপি-পেস্ট) পড়ে নিজের মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না। এদের সাথে যুক্তি তর্কে নামবেন না, কারন এই সব ধান্ধাবাজরা যুক্তি মানবে না এমন ব্রত নিয়েই এসেছে। অহেতুক তর্ক সৃষ্টিকরেই, এরা জনপ্রিয়তা চায়। এই দুষ্টলোকেরা তাদের ধর্মকথা নিয়ে আপনার আমার আসে পাশেই ঘুরছে। সেই দুষ্টলোকের ধর্মকথাকে বাহবা দেবার আগে কয়েকবার জ্ঞানের আলোকে চিন্তা করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৪:১০
৪৫টি মন্তব্য ৪৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×