somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাবোল নামের ছেলেটি

১৫ ই জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমাদের বাড়ি থেকে ঠিক তিনটে বাড়ি পরে বাস হাবোল সর্দারের । মা হারা ছেলেটি ছোট থেকেই ছিল একটু বেশি সরল । পড়াশোনা বেশি করতে পারেনি । আর করবেই বা কী করে? বইপত্র নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে কেউ কোনও কাজে বললে হাবোলের মুখে রা নেই । ব্যাগ পত্র পাশে রেখে লেগে যেতো কাজে । কাজ শেষ হতে হতে ততক্ষণে স্কুলের সময় যেত শেষ হয়ে । পাড়ার সকলেই প্রায় এহেন হাবোলকে পেয়ে একটু আধটু খাটিয়ে নিত । ফলে স্কুলের উদ্দেশ্যে বার হলেও শেষ পর্যন্ত আর স্কুলের গন্ডি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতো না ।

হাবোলদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা খারাপ নয় । ওর বাবা কাবিলচাচার পাঁচবিঘা ধানের জমি । বাহান্ন শতক ভিটেবাড়ি, দুদুটো পুকুর, কয়েকটি গাই গরুও আছে । কাবিলচাচা ওকে অনেক বুঝিয়েও ওর এই আত্মভোলা বা সরল স্বভাব থেকে কিছুতেই কিছু না করতে পেরে পড়াশোনা থেকে ছাড়িয়ে বাড়ির চাষের কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন । তবে এখানেও এক সমস্যা আছে । হাবোল মাঠে লাঙল দিচ্ছে বা কোদাল নিয়ে কাজ করছে, প্রতিবেশী মালেকচাচা দেখতে পেয়ে তাঁর জমির আল ছেঁটে দিতে বললে, যথারীতি হাবোল লেগে গেল কাজে । এদিকে ততক্ষণে দূরে নজরুল ভাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন, হাবোলকে দিয়ে তার জমিতে একটু লাঙল দিয়ে নেবেন বলে । ফলে নিজের জমির কাজও হাবোল কখনই শেষ করতে পারতো না যদিনা কাবিলচাচা এসে হাত না লাগাতেন।

হাবোল খুব খুশি হয় যখন কেউ বলে, তোর বাপ যা রেখে যাচ্ছে তাতে তোর সারাজীবন ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ দিয়ে বসে খেলেও চলে যাবে । কাজেই কাজ শেষে পারিশ্রমিক বাবদ এই কথাটি গ্রামের প্রায় সকলেই একআধবার শোনালে, একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে হাবোল লাঙলজোড়া নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিত । পথে কারোও নারকেল গাছে উঠে নারকেল পেড়ে দেওয়া বা পুকুর থেকে খাপনা জালে দুটো মাছ ধরে দেওয়ার মত আব্দারও সে হাসি মুখে মেটাতো । মাঝে মাঝে অবশ্য পাড়ার ভাবিরা তাকে পান্তাভাতও খাওয়ার কথা বললে, তখনোও সে না বলতে পারতো না ।

এহেন হাবোল সতেরো পার করে আঠারো বছরে পা দিতেই কাবিলচাচা ছেলের মতি ঠিক করতে বিয়ে দেবেন বলে স্থির করলেন । কিন্তু সেখানেও আর এক সমস্যা দেখা দিল । পূর্বেই বলেছি আর্থিক অবস্থা ও লম্বা চওড়া গড়ন অনুযায়ী শ্যামলা হাবোলকে কারোও অপছন্দ করার কথা নয় । কিন্তু যতগুলি সম্মন্ধ এগিয়েছে, ততবারই গ্রামের লেকেরা কানভাঙানি করে কাজগুলি ভেঙে দিয়েছে, এই বলে যে ছেলে আধপাগলা , সারাদিন মাঠে বসে থাকে, বাড়ির খাবার খায়না, কেউ দয়াকরে দুবেলা দুমুঠো খেতে দিলে তবে খায় । সুতরাং এমন ছেলের জন্য মেয়ের বাবারা কেনইবা এগোবেন।

কাবিলচাচা একসময় প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, এমন সময় দূর গ্রাম নিশ্চিন্তপুরের একটি পাত্রীর খোঁজ এল । নাম, রহিমা । বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই ভালো, সম্পন্ন ব্যবসায়ী । তবে এমন বাড়ির মেয়ে হয়েও রহিমার স্বভাবের জন্য তাঁরও বিয়ে নিয়ে পিতা শারাফাত চাচা বিপদে পড়েছেন । এমনিতে রুপে রহিমা কম নয় তবে অত্যধিক ঝগরাটে, যখন তখন যাকে তাকে মেরে দেয় । সারাদিন প্রায় বাড়িতে থাকেনা। অতবড় মেয়ে ধিনধিন করে এগাছ ওগাছ মাতিয়ে বেড়ায়। ওর সঙ্গে পাড়ার আরোও দুটি মেয়ে আছে। গোটা গ্রাম দাপিয়ে বেড়ায়। কেউ কিছু বললে হাতপা চালাতে বিন্দু মাত্র পিছপা হয়না । শারাফাত চাচা বেশ কয়েকবার মেয়েকে সাবধান করে উল্টে মেয়ের কাছে ধমক খেয়ে আর শাসন করেন না । কিন্তু মেয়ের বিয়েকে নিয়ে তিনিও পড়েছেন আতান্তরে ।কাজেই উনিও দূর গ্রাম মুকুন্দগড়ের সৎ পাত্র হাবোলের সন্ধান পেয়ে আর কালবিক্ষেপ না করে যোগাযোগ শুরু করলেন ।

প্রাথমিক কথাবার্তার পর উভয়পক্ষ বিয়েতে সম্মত হল । প্রতিবেশীদের নিয়ে দুপক্ষ বেশ চিন্তিত ছিল । কাজেই তেমন কোনও আচার বিচারের দিকে না গিয়ে যথাশ্রীঘ্রই একটি বিয়ের দিন স্থির হল । একমাত্র পুত্র হওয়াই কাবিল চাচা গ্রামের প্রায় সকলকে বিয়েতে নেমন্তন্ন দিলেন । যথারীতি খুব ধুমধাম করে রহিমার সঙ্গে হাবোলের বিয়ে হয়ে গেল ।

নববধূ হিসাবে রহিমা মাত্র দুদিনেই শ্বশুরের মন জয় করে নিল । সেইসঙ্গে প্রতিবেশীদেরও সকলের খুব প্রিয় হয়ে গেল । সংসারটি যেন তার কাছে কতদিনের পুরানো, এমন ভাবে সে সকলের আপন করে নিয়েছিল । কাবিল চাচা বৌমার আচরণে অত্যন্ত খুশি হলেন । তিনি রহিমাকে নাম না ধরে কেবল মা ' বলেই ডাকতে লাগলেন । সকাল সন্ধ্যা পাড়াপড়শি সহ বাড়িতে চায়ের আসর বসতে লাগলো। এরকম দুবেলা আড্ডা সহ চা -পান একা হাবোল কেন,গোটা গ্রামের কেউ কখনোও দেখেনি । আসলে হাবোলদের গ্রামের কৃষিই প্রধান পেশা হওয়ায় সকালে পান্তাভাত ছাড়া অন্যকিছু খাওয়ার চল ছিল না । একে অপরের বাড়িতেও সকালে আপ্যায়ন হত সেই পান্তাভাত দিয়ে । এরকম গ্রামে সকলে সকাল সন্ধ্যা চা পান করতে পেরে যেন আশ্চর্য জিনিস হাতে পেল এবং গোটা পাড়ায় রহিমা যেন নয়নের মনি হয়ে গেল । কাবিল চাচা মনে মনে প্রমাদ গুনলেন যাক এতদিনে ছেলেটা যদি একটু বাড়ি মুখো হয় ভেবে ।

ঠিক দুদিন পরে ছেলে-বৌমা বাপের বাড়িতে রওনা দিলো । পাড়ার সকলে দাঁড়িয়ে ওদের বিদায় জানালো । একটা চিন্তায় কাবিল চাচা অস্থির হয়ে পড়লেন। বৌমা যখন পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো , তখন ভাবলেন একবার কথাটা বলেই ফেলি । ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে চাপতে চাপতেও তিনি পিছিয়ে এলেন । রহিমা বুদ্ধিমতী মেয়ে, হঠাৎ শ্বশুর মশায়ের দুশ্চিন্তা ধরে ফেললো,
- আব্বু! আপনি কী আমাকে কিছু বলবেন?
- হ্যাঁ, মা। একটা কথা না বলে যেন শান্তি পাচ্ছিনা ।
- কি কথা আব্বু?
- আসলে, আমার হাবোল একটু সরল মনের মা। ওকে একটু বেশি চোখে চোখে রেখো। ও জন্মানোর সময়ে ওর মা ওকে রেখে চলে গেল। তার পর আজ এতগুলি বছর আমি ওকে আগলে রেখেছি। ওর সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে ওকে ঠকায়। বাবা হয়ে আমি সব বুঝি। কিন্তু একদিনের জন্যও ওকে বুঝতে দিইনি। আমি ওর সব কাজকে সর্বদা মান্যতা দিয়েছি । ওকে আমি ভালো রান্নাবান্না করে খাওয়াতে পারিনি সত্য। কিন্তু, আরোও কিছু বলতে গিয়েও আর বলতে পারলেন না । কাবিলচাচা বৌমার হাত ধরে বসে পড়ে শিশুর মত কাঁদতে লাগলেন ।

নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আবার যোগ করলেন, এই প্রথম হাবোল আমার ছেড়ে রাত কাটাবে মা । তোমার হাতে ওকে তুলে দিলাম।
- আমি আমার সাধ্যমত ওকে দেখবো আব্বু। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। সময় মত খেয়ে নেবেন। বলতে বলতে ততক্ষণে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠলো। ছেলে-বৌমা একপা দুপা করে গাড়িতে উঠে বসলো । মুহূর্তের মধ্যে ধুলো উড়িয়ে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল । ( চলবে)

উপরের ছবিটি আমার ছাত্র শ্রীমান সুজিত কুমার দাসের আঁকা। একজনের চোখের হাজারো ফোঁটা জল অন্যের সুখশয্যার কারন হয়।


সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:৫৩
২৫টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×