নেহা দূর থেকে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে শ্রীকে বলে,
-দিদি কেমন আছেন?
সাতসকালে অপ্রত্যাশিত নেহাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় শ্রীর মুডটা হঠাৎ বিগড়ে গেছে। অনেকটা নিরসভাবে জিজ্ঞেস করে,
- তুমি! এই সকালে?
- হ্যাঁ দিদি একটু দরকারে এসেছিলাম। কেমন আছেন?
- ভালো তো ছিলাম। কিন্তু কী মনে করে? কোথায় যাচ্ছ?
- দিদি অন্য কোথাও নয় আপনার কাছেই এসেছিলাম।
শ্রী শ্লেষের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে,
- আ..মা..র কাছে!! কিন্তু.. কেন? কী দরকারে বাপু?
নেহা শান্ত স্বরে বলল,
- গতকাল একটা ঔষধ ছেড়ে এসেছিলেন। আপনি চলে আসার পর বিষয়টি লক্ষ্য করি।
- ও তাই বলো।
নেহা কথা না থামিয়ে বলতে থাকে,
-কালকে রাতে আর সময় হয়ে ওঠেনি দিদি। এখন সেটাকেই দিতে এসেছি।
শ্রী মুখে কিছু না বলে, হাত বাড়িয়ে কেবল ঔষধটা নিয়ে শুকনো একটা,ধন্যবাদ দিয়ে আবারো বললো,
-যাক বাঁচা গেল।
- কেন বাঁচার প্রসঙ্গ আনছেন দিদি?
- তুমি আসলে অন্য কিছু মাথায় চলে আসে কিনা..
- আপনি অহেতুক আমাকে নিয়ে চিন্তা করছেন দিদি। আমি কিন্তু কোনোভাবেই আপনার দুশ্চিন্তার কারণ নই।
এবারেও শ্রী শ্লেষের সঙ্গে বললো,
- তা তুমি একহিসেবে ঠিকই বলেছ বাছা। তুমি আমার আপনজন কিনা.. আর আপনজনদের নিয়ে কখনো দুশ্চিন্তা করতে আছে?
নেহা আর কথা না বাড়িয়ে সরলতার সঙ্গে বলে,
- দিদি আপনার জন্যে একটা গিফট নিয়ে এসেছি, বলে কিছুটা আহ্লাদী ভাবে ব্যাগ থেকে গিফটা বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
- আরে! আমার জন্য আবার এসব গিফ্টস টিফ্ট কেন? মুখে একথা বললেও শ্রী মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকে নেহার ব্যাগের দিকে।নেহা ব্যাগের এ চেইন ও চেইন ঘেঁটে বেশ কিছুক্ষণ হাতড়িয়ে অবশেষে একটা মধুর বোতলটা বের করতেই,
শ্রী বিরক্তির সুরে বলে ওঠে,
- কী ওটা?
- দিদি মধু।
এবারে শ্রী রীতিমতো ধমক দিয়ে বললো,
- এই মেয়ে, মধু দিয়ে তুমি আমার কী বোঝাতে চাইছো? আমার মুখের ভাষা খুব তেতো তাইতো? মিষ্টত্ব আনার জন্য মধু দেওয়া তাইনা?সত্যি করে বলো দেখি এসব কার প্লান?
শ্রীর অকস্মাৎ আচরণে নেহা হতচকিত হয়ে যায়। কিছুটা ক্ষমাপ্রার্থীর মতো বলতে থাকে,
- দিব্বি করে বলছি দিদি কারো প্লান নয় আপনাকে ভালোবেসেই দিতে এসেছিলাম।
শ্রী মুখ ভেংচিয়ে বলে,
- ভা..লো..বে..সে?ওসব ভালোবাসা টালোবাসার গল্প অন্য জায়গায় শুনিও।ওসব সব বুঝি বুঝলে,বলে রাগে গজগজ করতে করতে আবারো বলে ওঠে,
-দুদিনের ছুড়ি!আর লোক পাওনি আমার কাছে এসেছো ভালোবাসার গল্প শোনাতে।আমি যেন বাচ্চা খুকি।আর মুখ খুলিওনা।কাকে কে ভালোবাসে সেসব বুঝি।
- দিদি প্লিজ শান্ত হোন।প্লিজ দিদি প্লিজ। আপনাকে বিরক্ত করার সামান্য ইচ্ছা আমার নেই। এসেছিলাম একটু খুশি করতে। পাশাপাশি কোম্পানির হয়ে প্রচার করতে। আমরা বড় দুঃখী। গরিবের মেয়ে। আপনাদের ইচ্ছা হলে দু একটা প্রোডাক্ট নিলে আমাদের পেট চলে।
- থাক বাছা থাক।আর গরিবের দোহাই দিয়ে আবেগের গল্প শুনিয়ে কেঁদুনি করে লোক জোগাড় করো না। তোমার যা রূপ তাতে রাস্তায় নামলে এমনিতেই অনেক টাকা পাবে।
- ছিঃ দিদি আপনি এসব কী বলছেন? আপনি বাড়িতে ফেলে আমাকে অপমান করছেন করুন। কিন্তু আমি খারাপ মেয়ে নই,বলে আর সামলাতে পারলো না, হউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
আমারও এতক্ষণে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।কাঁচের জানালার আড়ালে আর নিজেকে আটকে রাখা সম্ভব হলো না। বিবেকের তাড়নায় নীচে নেমে আসি। সামনাসামনি পড়তেই নেহার কান্নার বেগ যেন আরও বেড়ে যায়। আমি পড়েছি মহাবিপদে।কী করে যে ওকে সামলাব মাথায় আসছিল না। ইচ্ছা করছিল ওর আঁচল দিয়ে মুখটি মুছে দেই। কিন্তু হাত বাড়িয়েও নিজেকে সংযত করি। নেহা কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,
- আমি চাইনি কখনো কাউকে নিজের দরিদ্রতার পরিচয় দিতে বা কারোর কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা নিতে।ডিউটি আওয়ার্সের বাইরেও এইজন্য পরিশ্রম করি কাস্টমারদের কনভিন্স করে যাতে দুটো প্রোডাক্ট বিক্রি হয়। সামান্য কমিশনে অসুস্থ বাবা মায়ের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের চেষ্টা করি। কিন্তু আজকে আপনি যেভাবে পরোক্ষভাবে আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন,বলতেই আমি মাঝখানে ঢুকে পড়ি,
- থামো থামো প্লিজ থামো,বলে দুই হাত উঁচু করে দুইজনকে থামিয়ে দেই।শ্রীর পর এবার আবার নেহাকে করজোড় করে ডিউটিতে দেরি হবার কথা স্মরণ করিয়ে দেই। মেয়েটার চোখ দিয়ে তখনও পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। মুখের অবস্থা একশেষ। মূহুর্তে চোখমুখ ফুলে উঠেছে।কী নিষ্ঠুর লাগছিল সেদৃশ্য দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে।
নেহা আর কথা বাড়ালো না। বাধ্য মেয়ের মতো ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছে ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমার নিরপেক্ষতা শ্রীর পছন্দ হলো না। মুখ ঝামটা দিয়ে দড়াম করে সপাটে দরজা বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে গেল।
ওদিকে নাটকের সময় ক্রমশ এগিয়ে আসছে। প্রস্তুতি পর্বও তুঙ্গে চলেছে। ঘটনার দুদিন পরে নিতাইকাকার জরুরি তলবে ওনার বাড়িতে গিয়ে দেখি উনি অনুপস্থিত। আগে থেকেই জেনেছিলাম নাটকের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এইজন্য নিতাইকাকা সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে চান। কাজেই একটা জেনারেল মিটিংয়ের আয়োজন করতে প্রস্তুতি হিসেবে তলব করেছিলেন।কথা বলে জেনেছিলাম ইতিমধ্যে নায়িকার সঙ্গেও ওনার আলোচনা হয়ে গেছে।বেশ ভালো মানের একজন অভিনেত্রী। দেখতে দেখতে দিন এগিয়ে আসছে।আর মাসখানেকের মতো সময় হাতে আছে। নায়িকাকে এনে অন্য কোথাও নয়, নিজের বাড়িতে ওনার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।কদিনের মধ্যেই নাকি উনি চলে আসবেন। যদিও একমাস সময়টা নেহাত কম নয়। এইসময় ওনাকে রিহার্সালের পাশাপাশি আরেকটি কাজ আমাদের দিয়েছেন। কয়েকজনের সঙ্গে আমাকেও নুতন আনকোরা জায়গায় নায়িকাকে সঙ্গ দিতে হবে। খবরটি শুনে ভিতরে ভিতরে আমি বেশ শিহরিত হয়েছিলাম। সঙ্গ দিতে তো কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু গোলমাল সেই শ্রীকে নিয়ে। এমনিতেই নায়কের চরিত্রে অভিনয়।তার উপরে সকাল বিকেলে নায়িকাকে সঙ্গ দিতে ঘুরে বেড়ানো-কার মনে কী যে আছে, আবার না নুতন করে কোনো ফ্যাসাদে পড়তে হয়। যদিও সময় দেওয়ার ব্যাপারে না করতেও পারছিনা। এলাকার ছেলেদের যা হাভাতেপনানার মতো যেন কখনো মেয়ে দেখেনি।গ্রামে নুতন কাউকে দেখলে একেবারে হামলে পড়ে। কাজেই নায়িকাকে সময় দিতে পারবো না গোছের কথা একবার মুখ ফস্কে বললে প্রতিযোগিতা পড়ে যাবে। সম্ভবত নিতাইকাকা এসব কথা ভেবেই আমাকে বেশি পছন্দ করেছেন। এখন সেই প্রত্যাশার মূল্য আমাকে দিতেই হবে।ফলে ওনার সম্পর্কে আরো কিছু খুঁটিনাটি জানার আগ্রহ থাকলেও বেশি কিছু জিজ্ঞেস করা সমীচিন হবে না মনে হলো। যদিও কাকা সময়ে সবকিছু বুঝিয়ে দিবেন বলে এই পর্যন্ত আমাদের নিবৃত করে রেখেছেন। যাইহোক নাটকের আগ্রহে বা কাকার তলবে শনিবার বিকেলে ওনার বাড়িতে গিয়ে দেখি উনি অন্য কাজে তখনও বাইরে আছেন। স্ত্রী ফুলটোসি বৌদি মুখ বেজার করে আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো,
- তোমার নামে কী সব শুনছি ঠাকুরপো?
আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি।
সম্পর্কে নিতাইকাকার স্ত্রী হলেও ফুলটোসি বৌদি বয়সে অনেকটাই ছোট। প্রথমদিন কাকার সামনে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম,
- তোমাকে কী বলে ডাকবো মানে কাকিমা না বৌদি?
ঘোমটার মধ্যে থেকে সেদিন খিলখিলিয়ে হেসে উত্তর দিয়েছিল,
-ন্যাকা কোথাকার! যেন কিছুই বোঝেনা! আপাতত বৌদি বলবে।তবে একদিন বৌ বলেও ডাকতে হতে পারে। মজার ছলে হলেও ওর এমন উত্তরে ও কাকার নির্বিকার প্রতিক্রিয়া দেখে সেদিন বিস্ময়ে অবাক হয়েছিলাম। মনে মনে বেশ লজ্জায় পড়ে গেলেও ভিতরে ভিতরে রাগও হয়েছিল ওর উপরে।যতোই রূপসী হোক না কেন একজন বিবাহিত নারী নিজের স্বামীর সামনে অন্য পুরুষকে একথা বলতে পারে কেমনে। যাইহোক নিজেকে সামলে সেদিন একটা মজার পরিবেশের মধ্যে সামান্য মিষ্টি মুখ করে বিদায় নেই।সেই থেকে ফুল বৌদির সাথে হাসি ঠাট্টার পর্ব শুরু।পরে সেই সম্পর্ক আরও অনেকদূর এগিয়েছে।যতদিন গেছে অবাক হয়েছি ওর রূপ দেখে। পেঁয়াজের খোসার মতো রূপের যাদুতে মোহিত হয়েছি। মুগ্ধ হয়েছি ওর রসিকতা করার ধরন দেখেও। অস্বীকার করবো না, ফুলটুসি বৌদি আগুনে রুপের সঙ্গে মুখের সুমধুর ডাক যে কোনো পুরুষের হৃদয়ে ঝড় তুলতে বাধ্য। এমন রূপসী নারীর সাথে বেশি আড্ডা ইয়ার্কি করলে কাকা কিছু সন্দেহ করেন এই ভয়ে একটু আড়াল আবডালে থাকলেও ফুল বৌদির সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় পার হলেও টের পেতাম না। আজ এক্ষণে ফুল বৌদির এমন অভয় বাণীকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার ছিল না। কিন্তু মুখে কিছু না বলে কিছুটা ভাবুক দৃষ্টিতে ভাবতে ভাবতে বাইরে পা বাড়াতেই অমনি খপ করে আমার হাত চেপে ধরলো..
-দেখো ঠাকুরপো আমি চাই না তুমি ঐ মেয়ের সঙ্গে ফস্টি নস্টি করো।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৬