অফিসের কাজে নওগাঁ যাচ্ছি। শরতের এক উজ্জল রোদের দুপুরে আমাদের গাড়ি উত্তরবঙ্গের প্রশস্ত রাস্তা ধরে শাঁ শাঁ করে ছুটে চলেছে। গাড়িতে আমাদের বিভাগীয় কর্মকর্তা ছাড়াও কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী রয়েছেন। আমি বাদে সবাই মোটামুটি ফেসবুকে ব্যস্ত। এখনকার দিনে এটাই দুরস্ত। কাছের জনের খোঁজ না নিয়ে দূরের জনের খোঁজ নাও।
হঠাৎ একজনের ফেসবুক টাইমলাইনে একটা আপডেট আসলো। উনি উচ্চস্বরে পড়তে শুরু করলেন- A good boss in a bad institution is better than a bad boss in a good institution!!!
কথাটা আপেক্ষিকভাবে সত্য। কিন্তু তারচেয়েও বড় সত্য হলো- A leader is better than all kinds of bosses. কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমাদের দেশের প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক বা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানে সবাই কেবলই ‘বস’ হতে চায়, লিডার নয়। এর মধ্যে যদি কেউ লিডার হতে চায়ও, কর্মপরিবেশের চক্রে পড়ে একদা সেও সেই বসই হয়ে পড়ে। এই বসিং যে শুধুমাত্র মালিকপক্ষের বিষয় তা নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব রিক্রুটরাও এক পর্যায়ে বস হয়ে বসে আর এই বসিংয়ের ফাঁদে পড়ে অধস্তন কর্মীরা চরমভাবে নিরুৎসাহিত হতে থাকে।
একজন বস ও লিডারের মধ্যকার পার্থক্য ইন্টানেটে পাওয়া এই ছবি সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করে
আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ হচ্ছি। তো মধ্যম আয়ের দেশতো শুধু কাগজে কলমে হলে হবে না, বাস্তবে তার প্রয়োগ থাকতে হবে, চিন্তা ভাবনা, ব্যবহার, পরিবেশেও সে পরিবর্তন শুরু করতে হবে। এই শুরুটা হতে হবে যাঁরা এই মধ্যম আয়ের প্রবক্তা, তাঁদের মাধ্যমেই। ওই মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জের দরিদ্র কৃষক রজব আলীর কাছে মধ্যম আয়ের কোন তাৎপর্য নেই।
কিন্তু যাঁদের কাছে এর তাৎপর্য ব্যাপক, তাঁদের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিন্তাভাবনা, কর্মপরিবেশ খুবই অরুচিকর, নিম্নমানের। ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে এই মুহুর্তে বিশ্বের সেরা এমপ্লয়ার হলো গুগল। সেখানকার কর্মপরিবেশ অসাধারণ। কর্মীরা যেনো কোনভাবেই বোরড ফিল না করেন, তার জন্য রয়েছে নানা আয়োজন। তো সদ্যই মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার নিয়ামক অর্জন করা একটা দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো এক সুন্দর সকালে গুগল এর সমপর্যায়ের হয়ে যাবে, তা চিন্তা করাটা অবান্তর কিন্তু নিদেন পক্ষে আমাদের পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে তুলনার অবকাশ থেকে যায়।
এখানে যেমন ভারতের টাটা স্টিলেরউদাহরণ দেয়া যেতে পারে। টাটা স্টিল ১৯ শতকের শুরুতে নিজস্ব প্লান্ট নির্মাণ ও কর্মীদের আবাসনের জন্য যাবতীয় নাগরিক সুবিধাসহ একটা সিটি প্রতিষ্ঠা করে, যেটা জামসেদনগর/টাটানগর বা স্টিল সিটি নামে পরিচিত। এই টাটানগর সম্পূর্ণভাবে টাটা স্টিলের নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। ভারত সরকার ১৯৮০ এবং ২০০৫ সালে এই সিটিতে টাটার প্রশাসনের অবসান ঘটিয়ে মিউনিসিপালিটির অধীনে আনার প্রচেষ্টা চালায় এবং দুইবারই টাটা স্টিলের কর্মীদের তুমুল প্রতিবাদের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ ক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি ছিল মিউনিসিপালিটির অধীনে গেলে তাদের বর্তমান সুবিধাদি কমে যাবে।
একটা প্রোগ্রামে শিল্পপতি সুফী মিজানুর রহমান এর বক্তব্য শুনেছিলাম, তিনি জাপানে তাঁর টয়োটা প্লান্ট ভিজিটের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বললেন- কারখানার যতজন কর্মীর সাথে তিনি কথা বলেছেন, সবাই নিজের নাম ‘টয়োটা’ বলে উল্লেখ করেছে।
টাটা এবং টয়োটার এই দু’টি ঘটনায় বোঝা যায় যে এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মীবৃন্দ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রতি কি পরিমাণ আন্তরিক এবং বিশ্বস্ত। এর কারণটাও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। নিশ্চিতভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব কর্মীদের জন্যে এমন কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করেছে যে তাঁরা প্রতিষ্ঠানকে কখনই নিজের থেকে আলাদা ভাবতে পারেনি।
প্রায় দু’শ বছরের ব্রিটিশ দাসত্ব আমাদের মনোজগতে যে স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব রেখে গেছে, তা অভ্যন্তরীণ মতামতকে উপেক্ষা করার প্রবণতা উস্কে দেয়। অথচ সাংবাদিকতায় একটা অতি পুরোনো আপ্তবাক্য হচ্ছে 'Vox Populi, Vox Dei.' ল্যাটিন এই প্রবাদের অর্থ দাড়ায় 'The Voice of the people is the voice of God.
আজকের আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি যে গণতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে গণতন্ত্রও দাড়িয়ে আছে মূলত এই ল্যাটিন প্রবাদের উপরেই। ১৮৬৩ তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বিখ্যাত গেটিসবার্গ ভাষণে যে গণতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেছিলেন 'Government of the people, by the people, for the people' বলে। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাঁর এই বক্তব্যে জনগণ বলতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ জনগণকেই বুঝিয়েছিলেন।
মোটাদাগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একেকটি প্রতিষ্ঠানও রাষ্ট্রের মতই। রাষ্ট্রকে কল্যাণকামী-আধুনিক হতে গেলে যেমন নিজের জনগণকে কমফোর্ট জোন দিতে হবে, ঠিক তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি কর্মীদের জন্য একই ধরণের কমফোর্ট জোন দিতে পারে, তবেই প্রতিষ্ঠানগুলো কল্যাণমুখী হবে, মধ্যম আয়ের দেশের সুফল সবার কাছে তখনই পৌঁছুতে পারবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১৮ ভোর ৬:৩৫