somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তালাকপ্রাপ্ত স্বামীর কষ্টের চিঠি

২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

ক্ষতিরন্নেসা,
প্রিয়তমা বলে সম্বোধন করা আজ আর আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। তাই তোমার নাম ক্ষতিরন্নেসা লিখেই আজকের চিঠি লেখা শুরু করতে হলো। কারণ দু’বছর পূর্বেই তোমার আমার মাঝে সে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। তোমার কাছে আমার চিঠি লেখা উচিৎ নয়, তবু মনের জ্বালা মিটানোর জন্য দু’টি কথা লিখছি। যদি এ চিঠি তোমার হাতে পৌঁঁছে, তবে তুমি পড়বে কিনা জানিনা, তবে আমি আমার মনের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা কিছুটা লাঘব করার জন্য এ কাজটি করছি।

অনেক ভালবেসে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। বাবা-মায়ের এ বিয়েতে মত ছিল না। তাদের অজান্তেই বিয়ে করে ফেলি। বাবা বিয়ের কথা জানতে পেরে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। তোমার বাবার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। দু’বছর পর বাবা মারা গেল। কিছুদনি পর আমাদের ঘরে একটি ছেলে সন্তান জন্ম নিল। মা নাতীর মুখ দেখে খুব খুশি হয়ে অতীত ভুলে গেলেন। নাতীর মায়ায় মা আমাদেরকে নিজের বাড়ি নিয়ে এলেন। কিন্তু আমার বাড়ি ফিরে আসা ভাইয়েরা বাধা না দিলেও তোমাকে তারা সহ্য করতে পারল না। একসময় এসব নিয়ে ভাইয়েদের সাথে আমার মনোমালিন্য শুরু হলো। জমিজমা ভাগ করে তারা পৃথক সংসার করল। আমিও পিতার সম্পত্তির তিন বিঘা জমি ভাগ পেয়ে সংসার আলাদা করে ফেললাম।

তুমি মায়ের সাথে প্রায়ই দুর্ব্যবহার করতে। তা সত্বেও নাতীর মায়ায় পরে মা আমাদের কাছেই থেকে গেল। শুধু আমার ছেলেটির কারণে তোমার শত অত্যাচার মা সহ্য করতে লাগল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আরেকটি পুত্র সন্তান আমাদের ঘরে এলো। কিছুদিন পর মা মারা গেল। মারা যাওয়ার কিছুদিন পূর্বেই মা তার নামের সমস্ত সম্পত্তি আমার দুই ছেলের নামে লিখে দিয়ে গেল।

বিয়ের সময় তুমি ক্লাস সিক্সের ছাত্রী ছিলে। লেখা পড়ায় মনোযোগী ছিলে না বলে সিক্স পাস করা তোমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। যুদ্ধের পরে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার একটা সুযোগ এলো। তোমার নামে ফরম ফিলাপ করে তোমার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। কিন্তু পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর লেখা তো দুরের কথা প্রশ্ন বোঝারও ক্ষমতা তোমার ছিল না। যুদ্ধোত্তর দেশে পরীক্ষার হলে কোন প্রকার কড়াকড়ি না থাকায় তোমার খাতায় আমি প্রশ্নের উত্তর নিজ হাতে লিখে দিলাম। তাতে তুমি ২য় বিভাগে পাশ করেছিলে।

দু’বছর পর পরিবার পরিকল্পনায় চাকরির সুযোগ এলো। কিন্তু ইন্টারভিউয়ে তুমি কিছুই উত্তর দিতে পারলে না। কারণ তোমার লেখাপড়ার দৌড় কতটুকু তাতো আমি জানি। তাই ভাগে পাওয়া পৈতৃক সম্পত্তি তিন বিঘা বিক্রি করে ঘুষ দিয়ে তোমার ইন্টারভিউয়ে পাশ করার ব্যবস্থা করি। তুমি পাশ করে চাকরী পেলে। বাকী জমিটুকুও বিক্রি করে তোমার একবছরের ট্রেনিংয়ের খরচ বাবদ দিয়ে দিলাম। কারণ, আশা ছিল ট্রেনিং শেষে চাকরীতে জয়েন করে বেতন পাওয়ার পর আমাদের আর কোন কষ্ট থাকবে না। তোমার বেতনে দু’টি সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে পারবো। এই আশায় বাপ-দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি শেষ করে তোমার চাকরীর ব্যবস্থা করেছিলাম।

একবছর পর ট্রেনিং শেষ হলো। তুমি আমাকে খবর দিলে প্রথম বেতনের টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি খুশি হয়ে শহরে চলে গেলাম। তুমি প্রথম বেতনের টাকায় বাজার করে খুব ভাল ভাল রান্না করে খাওয়ালে। তোমার হাসিমাখা আদরে পৃথিবীটা যেন স্বর্গের মত মনে হলো। তোমার প্রত্যেকটা কথাই আমার কাছে অমৃত মনে হতে লাগল। আমি আমার অতীতের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। পুরো পৃথিবীটাই আমার কাছে স্বর্গ মনে হলো। আমি স্বর্গ সুখের হাওয়ায় ভাসতে লাগলাম।

আসার সময় আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে দিলে। আমি খুশি হয়ে টাকাগুলো না গুনেই পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। বিদায়ের সময় তুমি নিজ হাতে আমার পাঞ্জাবীর পকেটে একটি হলুদ খাম ঢুকিয়ে দিয়ে বললে, ‘এটা কিন্তু রাস্তায় খুলবে না, তোমার জন্য একটা চমক দিয়ে দিলাম’। মাথায় হাত দিয়ে কসম করিয়ে বললে, বাড়ি না যাওয়া পর্যন্ত যেন হলুদ খামটি না খুলি। আমি তখন তোমার ভালবাসায় মুগ্ধ, তাই তোমার সব কথা বিশ্বাস করে হাসি মুখে বিদায় নিলাম। তোমার দিব্যি অনুযায়ী হলুদ খামটি রাস্তায় ছুঁয়েও দেখলাম না।

বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হলো। শোয়ার সময় ঘরে আলো জ্বালিয়ে তোমার চমক হলুদ খাম খুলে চমকে উঠলাম। সত্যিই চমক বটে! নীল কাগজে সরকারী ফরমে তোমার দস্তখতকৃত একখান তালাক নামা। চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরে দেখি আমার ভাইয়েরা আমার মাথায় পানি ঢালছে।

পরদিন ঘটনাটি পুরো গ্রাম ছড়িয়ে গেল। আমি লজ্জায় ঘর থেকে বের হতে পারলাম না। আমার নামছিল আহম্মদ আলী সবাই ডাকতে লাগল আহম্মক আলী। সাত গ্রামের লোক এখন এই নামেই চেনে। পরে ছেলে দু’টাকেও তুমি তোমার বাপের বাড়ি রেখে দিলে। দু’মাস পরে খবর পেলাম ট্রেনিং চলা অবস্থায় তুমি তোমার অফিসারের সাথে প্রেমে মত্ত হয়েছিলে। চাকরিতে জয়েন করার পর সেটা বাস্তবায়ন করেছো। আমি নিঃশ্ব হলেও তুমি অনেক সুখী হয়েছো। অফিসার স্বামীর সাথে ঘুরে বেড়াতে তোমার গর্বে বুক ফুলে যায়। বেকার স্বামীর পরিচয় আর দিতে হয় না।

কত যে নিঃস্ব আমি সেটা তোমাকে বললে লাভ হবে কিনা জানিনা। তোমার কারণে পৈতৃক জমি হারালাম, তোমাকে হারালাম, দাদার দেয়া নিজের নামটা হারালাম, সন্তানগুলোও হারালাম। নিজের সন্তানদের সামনে গিয়ে সন্তান বলে ডাকতে পারি না। বুক জুড়ে হাহাকার। আমার মত এমন নিঃস্ব পৃথিবীতে আর কেউ আছে কিনা জানিনা। সন্তান দু’টির মুখ দেখতে বড় ইচ্ছে করে। কিন্তু দেখব কি করে? পিতা হিসাবে তাদের হাতে তো কিছু দেয়া দরকার? কিন্তু দেয়ার মতো আমার তো কোন সামর্থ নেই! খালি হাতে কি ওই কচি মুখগুলার কাছে যাওয়া যায়? কি যে কষ্ট আমার! হাসলেও মানুষ আমাকে আহাম্মক বলে কাঁদলেও আহাম্মক বলে। মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আত্মহত্যা করলেও মানুষ আমাকে আহাম্মক বলবে। সুখের মুখ দেখতে গিয়ে কত কঠিন, কত কষ্টের জীবন যে অতিবহিত করছি তা কাউকে বুঝাতে পারছি না।

যাক এসব কথা আর কিছু লিখে তোমার সময় নষ্ট করতে চাই না। তুমি ভাল থাকো সুখে থাকো।

ইতি
তোমার প্রাক্তন স্বামী
আহম্মক আলী
অতীতের আহম্মদ আলী
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:২২
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×