উপন্যাসের নাম 'অন্তরীপ'। প্রকাশকাল ২০০৯।
অন্তরীপ মানে মিলন। লেখক রোকসানা লেইস তার উপন্যাসে একদল কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের পাওয়া না পাওয়া, আশা-হতাশা, প্রেম ভালোবাসা এবং মনের গোপন রহস্য ও হাহাকার সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। এই উপন্যাসটিতে আমার কাছে মনে হয়েছে- প্রতিটা চরিত্র লেখকের পরিচিত। উপন্যাসের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো লেখক নিজের চোখে অবলোকন করেছেন।
উপন্যাসে একটি চরিত্র চন্দ্রা। হাসি খুশি প্রানবন্ত একটি মেয়ে। যে প্রেম ভালোবাসায় বিভোর হয়ে থাকতে ভালোবাসে। এবং ভালো গানও গায়। মহসিন নামের একজন তাকে টিভিতে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে অবশ্য তাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। আরেকটি চরিত্র আছে 'দিঠি' নামে। সে চন্দ্রার বিপরীর। পরিবারের ইচ্ছায় তাকে প্রতিটা কাজ করতে হয়। দিঠি আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। উপন্যাসে একজন ফোটোগ্রাফার চরিত্র আছে, নাম অর্ণব। আমাদের সমাজে অর্ণবদের অভাব নেই। আরও বেশ কিছু চরিত্র আছে- সরজিত, মহসিন পারভেজ, অর্পিতা।
'অন্তরীপ' উপন্যাসে যৌনতা আছে। উপন্যাসটি পড়লে বুঝা যায়- এই যৌনতার প্রয়োজন আছে। লেখক এইখানে খুব সুন্দরভাবে যৌনতা উপস্থাপন করেছেন। লেখক লিখেছেন- 'কত রকম ভাবে যে আমাকে আদর করল আমাকে। দেখ ও চলে গেছে কিন্তু ওর চিহ্ন রেখে গেছে আমার গায়ে। অর্পিতা ওর জামা আলগা করে গলা ঘাড় বুকের উপর অসংখ্য লাল দাগ দেখালো।' উপন্যাসের শেষের দিকে দেখা যাবে অর্পিতার জীবনটা বড্ড এলোমেলো হয়ে যায়।
কলেজে পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের বন্ধুত্ব প্রেম ভালোবাসা আর মানসিকতা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বাবা-মা যে উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের প্রতি সঠিক আচরন করে না। এবং এর জন্য অনেক বড় মূল্য দিতে হয়। 'অন্তরীপ' উপন্যাসটি প্রতিটা বাবা- মা এবং সন্তানদের পড়া উচিত। লেখক নতুন প্রজন্মদের ভুল গুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা যে ভুল গুলো করে- একমাত্র বাবা-মা'ই সে ভুল গুলো থেকে তাদের আদরের সন্তানকে বাচিয়ে দিতে পারেন- লেখকের 'অন্তরীপ' উপন্যাসে একথাই ফুটে উঠেছে।
এই উপন্যাসে কিছু দুর্বল দিক আছে। লেখক খুব তাড়াহুড়া করেছেন। এত তাড়াহুড়া দেখে মনে হয়- উপন্যাসটি লেখার সময় লেখক অস্থিরতার মধ্যে ছিলেন। যে কোনো উপন্যাসের একটি গভীর বিষয় হচ্ছে- সময়। উপন্যাসটিতে লেখক কোন সময়ের কথা বলছেন, তা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। লেখক প্রকৃতি খুব ভালোবাসেন কিন্তু তার এই উপন্যাসে প্রকৃতির খুব সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় না। এক দুই কথায় তার প্রকৃতি নিয়ে বর্ণনা শেষ করে দিয়েছেন। ব্যাপারটা বেশ দৃষ্টিকটু লেগেছে। উপন্যাসের চরিত্র, ঘটনা এবং ঘটনা প্রবাহ সব কিছু মিলিয়ে 'অন্তরীপ' খুব উপভোগ্য।
লেখক সম্পর্কে কিছু কথা বলি, ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখালেখি করছেন। তার লেখায় পাওয়া যায় প্রকৃতি এবং নরনারীর মনের গোপন কামনা বাসনা। ভ্রমন কাহিনি লিখেন, লিখেন কবিতা। দেশ, বিদেশের পত্র-পত্রিকা, ওয়েব প্রকাশনে সমান ভাবে পদচারণা। রোকসানা লেইস এর 'শ্রাবনতিথির সোনালী আলো' এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই 'আলোর যাত্রা' বই দু'টি খুব পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
রোকসানা লেইস, এস.এস.সি ১৯৭৪ ও এইচ.এস.সি ১৯৭৬, সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজ থেকে। ঢাকার বদরুন্নেসা সরকারী কলেজ থেকে স্নাতক ১৯৮১ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ১৯৮৪। নারী নয়, ‘মানুষ’ হিসেবে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলা রোকসানা লেইসের জীবন-জীবিকার শুরু প্রিন্টিং প্রেস ব্যবসায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে ঢাকায় ১৯৯৮ পর্যন্ত। রিয়েল এস্টেট এজেন্ট, টরেন্টো, কানাডা ২০০৯পর্যন্ত। বর্তমানে কানাডাতে মিডিয়া ওয়ার্কার হিসেবে কর্মরত। তার এক পুত্র ও এক কন্যা, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে পেশার পাশাপাশি উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য অধ্যয়নরত।
রোকসানা লেইস এর একটি কবিতা
বুকে নিয়ে খুঁজে অন্ধকারের পথ।
তাতান সুখ, বুকের গহীন চিরে, রক্তাক্ত ক্ষরন।
আনমনা চোখে দেখে অতীত স্বপ্ন শূন্য ভবিষ্যত।
হৃদয় পুড়ে গেলে, কারো কিছু যায় আসে না
হৃদয়ের কান্না, থেমে যাবে এক সময়, এই ধারনা।
গতানুগতিক এই, নিয়মে বাঁধা শৃঙ্খল।
ঢেড় ভালো;দেয়াল আঁকড়ে চলা সামাজিক জীবন।
পুড়ে পুড়ে ক্ষয়ে যাক, হাজারো প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয়
শুধু স্থাপনায় দৃঢ় থাক, নিয়ম জটিলতা আচরণ।
ভালোবাসা ক্ষানিকের অস্থিত্ব সমুগ্র জীবনে
সংসার আর সবার উপরে।
এই লেখকের অন্যান্য বইঃ স্বপ্ন নগরীর খোঁজে, অজানার স্রোতে, চন্দ্রিমায় নীল জল ইত্যাদি। আরও প্রায় তিনটি উপন্যাসের কাজ শেষের দিকে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:০৪