আমার বাপ একজন অসাধারন মানুষ। তার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। কিভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, কিভাবে মানুষের জন্য কিছু করতে হয়। কিভাবে মানুষকে সহযোগিতা করতে হয়। কিভাবে বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। কোনো বিপদেই আব্বা ভয় পায় না। ঘাবড়ে যায় না। মাথার উপর কোনো বিপদ এলে, আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। কিন্তু আব্বাকে বলা মাত্র আব্বা বলে চুপ করে থাক, আমি দেখছি। আমি তোর বাপ এখনও বেঁচে আছি। তোদের কোনো ভয় নেই। আসলেই আব্বা সব বিপদ আপদ থেকে এখন পর্যন্ত আগলে রেখেছে।
আব্বা ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছে দুই বছর ধরে। আমাকে রিকুয়েস্ট পাঠাইছে। আমি এখনও এড করিনি। আব্বা ম্যাসেজ দিয়েছে প্লীজ এড মি। আমি বলেছি নো, নেভার। মাকেও রিকয়েস্ট পাঠাইছে মাও এড করেনি। আব্বার উপর মার অনেক রাগ। গত তিন মাস ধরে আব্বা বাসায় আসে না। মার সাথে রাগ করেছে। তবে আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখছে নিয়মিত। দুই একদিন পরপর ফোন দেয়। জন্মের পর থেকেই দেখছি- তাদের ঝগড়া। দুইজন খুব সুন্দর করে বসে চা খাচ্ছে, ভিসিআরে সিনেমা দেখছে। একটু পর লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। আব্বা রাগ করে চলে যায়। দুই মাস তিন মাস পর আবার ফিরে আসে। আজ সারাটা দিন পার হয়ে গেছে এখনও আব্বার সাথে কথা হয়নি।
এখনও আব্বার সাথে কোথাও গেলে অথবা রাস্তায় দেখা হলে- নিজে হাত ধরে রাস্তা পার করে দেয়। রিকশা ঠিক করে দেয়। ছোট বেলায় আব্বা নিজে সেলুনে নিয়ে গিয়ে চুল কাটিয়ে আনতো। এখনও আব্বা বড় চুল দেখলে রেগে যায়। জোর করে সেলুনে নিয়ে যায়। আব্বার মনটা মায়া মমতায় ভরা। আব্বা বাসায় চোর ধরার পরও চোরকে মারেনি। বরং টাকা পয়সা আর জামা কাপড় দিয়ে, পেট ভরে ভাত খাইয়ে চোরকে বিদায় দিয়েছে। আব্বা কোনো দিন আমাকে একটা থাপ্পড়ও দেয় না। কঠিন গলায় কথা বলে নাই। একবার স্কুলে আমি এক সাবজেক্টে ফেল করি। ছোটবেলায় ইংলীশ মিডিউয়াম স্কুলে পড়তাম। শিক্ষক বললেন, ফেল করা ছাত্রকে আমি এই স্কুলে রাখব না। আব্বাকে ডেকে নিল স্কুলে। আব্বা শিক্ষককে বললেন, আমিই আমার ছেলেকে এই স্কুলে রাখব না। তারপর আমাকে দোকানে নিয়ে গিয়ে অনেক গুলো চিপস আর চকোলেট কিনে দিয়ে কোলে করে বাসায় নিয়ে এলো।
একবার আব্বা কিভাবে যেন শেখ হাসিনার সাথে একটা ছবি তুলে ফেলে। তারপর তার গর্বের শেষ নেই। সেই ছবি বাঁধাই করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিল দীর্ঘদিন। আব্বা বঙ্গবন্ধু বলতে পাগল। সে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং মৃত্যু বার্ষিকী খুব ধূমধাম করে পালন করে। মা যদি আওয়ামীলীগ নিয়ে একটূ খোঁচা দিয়ে কথা বলে, আব্বা রেগেমেগে অস্থির হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, আব্বা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে, টিভিতে সংবাদ শুনে। অকৃপণ ভাবে টাকা খরচ করে। দরিদ্য মানুষকে খুব সাহায্য সহযোগিতা করে। তারা মোট ১১ ভাই বোন। আব্বার'ই সবার বড়। তাদের ভাই বোনদের মধ্যে দেখেছি, সবাই সবার জন্য খুব মায়া মমতা। এখনও একজন আরেক ভাইয়ের জন্য না খেয়ে বসে থাকে। প্রতিমাসে একদিন তারা সব ভাই বোন মিলে গল্প করে।
আব্বা আর মা সারাটা জীবন ঝগড়া করে কাটিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এখনও মা অসুস্থ হলে আব্বা পাগলের মতো হয়ে যায়। অনেক বছর আগে- তখন আমি ছোট। হয়তো ক্লাশ সিক্স বা সেভেনে পড়ি। রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। আব্বা রাত বারোটায় বাসায় ফিরে জানতে পারলো ছোট মাছ রেধেছে বলে আমি রাগ করে ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। সেই রাতে আব্বা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে হোটেল খুঁজতে বের হলো। অনেক খোঁজাখুজির একটা বিরানির হোটেল পেলাম। তারপর বিরানি খাইয়ে আমাকে বাসায় নিয়ে এলো। এখনও আব্বা জোর করে পকেটে টাকা গুজে দেয়। আব্বা দারুন রোমান্টি মানুষ। ছোটবেলা থেকেই সে দারুন স্মার্ট। বাসার পরার লুঙ্গিটা পর্যন্ত দোকান থেকে আয়রন করে আনে।
আব্বার কথা লিখলে এক হাজার পর্ব লিখেও শেষ করতে পারবো না। আর একটা সত্য কথা বলি, আমি আব্বার কাছ থেকে সিগারেট খাওয়া শিখেছি। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তার মতো এত সুন্দর করে করে কেউ সিগারেট খেতে পারবে না। তার সিগারেট ধরার স্টাইল, ছাই ফেলার স্টাইল আমাকে মুগ্ধ করে। আব্বা যখন সিগারেট খায় আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। ইদানিং আব্বার শরীর খুব খারাপ। প্রতিদিন অনেক গুলো করে ওষুধ খেতে হয়। সপ্তাহে একদিন ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। সে খুব অসুস্থ তবু আমাদের কোনোদিন বলে না তার শরীর ভালো নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৮ রাত ৯:২১