ভারতীয় সিনেমায় একটি যুগের অবসান হল। বলিউডের কিংবদন্তি পরিচালক যশ চোপড়া প্রয়াত হলেন। রোববার মুম্বাইয়ের লীলাবতি হাসপাতালে ৮০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বলিউডে রোমান্টিক সিনেমার রূপকার এই চিত্রপরিচালক। সম্প্রতি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হন যশ চোপড়া, সেরেও উঠছিলেন। কিন্তু এ দিন দুপুরে হঠাৎই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। আর সন্ধ্যার সময়ই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনায় একই সঙ্গে সফল, এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোণা যাবে। এমনই একজন ছিলেন যশ চোপড়া। ১৯৫৯ সাল থেকে একাধারে চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনা করে বলিউডে তিনি রাজেন্দ্র কুমার থেকে অমিতাভ বচ্চন কিংবা শাহরুখ খানের মতো অসংখ্য তারকাই তৈরি করেননি, বরং নিজেকেও তিনি তারকার আসনেই বসিয়েছেন। দীর্ঘ ৫৬ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে যশ চোপড়া ছবি প্রযোজনা করেছেন ৫৩টি, পরিচালনা করেছেন ২২টি এবং ৩টি ছবির সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। যশ চোপড়ার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের প্রায় সবগুলো ছবিই পেয়েছে দর্শকপ্রিয়তা। ব্যবসা সফল ছবির তালিকা করলেও তাতে সিংহভাগই আসবে তার ছবির নাম। আগামী মাসের দিওয়ালীতে (১৪ নভেম্বর) যশ চোপড়া পরিচালিত সর্বশেষ ছবি ‘যাব তাক হ্যায় জান’ মুক্তি পাবার কথা রয়েছে। শাহরুখ খান অভিনীত এই ছবিটিকে এরই মধ্যে চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বছরের সেরা ব্যবসা সফল ছবি হিসেবে আগেই মন্তব্য করেছেন। সেজন্য বলা যায়, মৃত্যুর আগেও যশ চোপড়া যেমন ভারতীয় চলচ্চিত্রে নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন, তেমনি মৃত্যুর পরও তিনি তার দৌন্ডর্ড প্রতাপ বজায় রাখবেন। কারণ, তার ছবিগুলো তো দর্শকদের কাছে এখনও সমান জনপ্রিয়।
বলিউডকে বিশ্ব চেনে চলচ্চিত্রের গান, রোমান্স আর ডায়লগের জন্য। আর এই তিনটিই ছিল যশ চোপড়ার চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য। তাঁর চলচ্চিত্র তৈরির ধরণ তাঁকে আলাদা জায়গা করে দিয়েছে। যশ চোপড়া পরিচালিত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘বীর-জারা’ (২০০৪), ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ (১৯৯৭), ‘লামহে’ (১৯৯১), ‘চাঁদনী’ (১৯৮৯), ‘সিলসিলা’ (১৯৮১), ‘ত্রিশুল’ (১৯৭৮), ‘কাভি কাভি’ (১৯৭৬), ‘জসিলা’ (১৯৭৩), ‘ইত্তেফাক’ (১৯৬৯), ‘ওয়াক্ত’ (১৯৬৫) প্রভৃতি।
১৯৩২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ভারতের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন যশ চোপড়া। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ‘ধুল কা ফুল’। এর আগেই তিনটি ছবিতে তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৬ সালে যশ চোপড়া নিজের নামে যশরাজ ফিল্মস নামের ছবি প্রযোজনা সংস্থা খোলেন। সেই যশরাজ ফিল্মস এখন বলিউডের সেরা প্রযোজনা সংস্থা।
চলচ্চিত্র নির্মাণের বিচারে ভারতে প্রথম ও বিশ্বে ২৭তম অবস্থানে রয়েছে যশরাজ ফিল্মস। বানিজ্যিক দিক থেকে সবচেয়ে সফলও এটি। এই প্রযোজনা সংস্থা থেকেই কেবল গত ১২ বছরে তার প্রযোজিত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো- ‘এক থা টাইগার’ (২০১২), ‘লেডিস ভার্সেস রিকি ভাই’ (২০১১), ‘মেরি ব্রাদার কি দুলহান’ (২০১১), ‘মুঝছে ফ্রেন্ডশিপ কারোাগি’ (২০১১), ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ (২০১০), ‘পেয়ার ইমপসিবল’ (২০১০), ‘দিল বোলে হারিপ্পা’ (২০০৯), ‘নিউইয়র্ক’ (২০০৯), ‘রাব নে বানা দি জোড়ি’ (২০০৮), ‘বাচনা এ হাসিনো’ (২০০৮), ‘থোরা পেয়ার থোরা ম্যাজিক’ (২০০৮), ‘তাহসান’ (২০০৮), ‘আজা নাচলে’ (২০০৭), ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ (২০০৭), ‘ঝুম বারা বার ঝুম’ (২০০৭), ‘ধুম-২’ (২০০৬), ‘ফানা’ (২০০৬), ‘সালাম নমস্তে’ (২০০৫), ‘বান্টি অর বাবলী’ (২০০৫), ‘ধুম’ (২০০৪), ‘হাম তুম’ (২০০৪), ‘সাথিয়া’ (২০০২), ‘মুঝে দোস্তি কারোগি’ (২০০২) প্রভৃতি।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন পদ্মভূষণ খেতাবপ্রাপ্ত এই গুণী নির্মাতা। এ ছাড়া পুসান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে এশিয়ার সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতার পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার, আইফা, দাদা সাহেব ফালকে, কিশোর কুমার পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন যশ চোপড়া। এ ছাড়া ফ্রান্সের সেরা বেসামরিক পুরস্কার ‘লিজিয়ন অব অনার’এ ভূষিত হয়েছেন যশ চোপড়া। প্রথম ভারতীয় হিসেবে বাফটার আজীবন সদস্যপদ লাভ করেন তিনি।
যশ চোপড়ার মৃত্যুতে গোটা বলিউড শোকাহত। অমিতাভ বচ্চন থেকে শাহরুখ খান- সবাই তাঁদের শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। টুইটার আর ফেসবুকেও যশ চোপড়ার মৃত্যৃতে শোকের ছায়া। বলিউডে যশ চোপড়ার অবস্থানটি কেমন ছিলো তা বোঝা যায় শাহরুখ খানের এই কথাতেই- ‘বাকিদের ছবি তৈরি হয় ক্যামেরা, সাউন্ড, লাইট আর ক্যাসেট দিয়ে আর যশের ছবিগুলো হয় হৃদয় দিয়ে। তাই কখনো কখনো তার ছবি দেখতে দিল তো পাগল হোতা হ্যায়।’
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ২:০৯