somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিবর্ণ দুপুর

২৭ শে মার্চ, ২০০৮ রাত ১০:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি বসে ছিলাম পার্কের মধ্যে৷ অনেক দিন পর রমনা পার্কে এলাম৷ পার্কটা ইদানিং অনেক সুন্দর আর গোছালো হয়েছে৷ এই শহরে সব জিনিষ দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যায়, ব্যতিক্রম এই পার্কটা৷ এই একটা জিনিস অন্য সবকিছুকে কলা দেখিয়ে দিনে দিনে উন্নতি করে যাচ্ছে৷ ঢাকায় প্রথম আসার পর পার্কটাকে যেমন দেখেছিলাম তার চেয়ে এটা এখন অনেক গোছানো আর পরিচ্ছন্ন৷

পার্কের মাঝামাঝি একটা নির্জন জায়গায় একটা বেন্চে আমি বসেছিলাম৷ বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছিলাম৷ হঠাৎ শুনলাম আমার পাশ থেকে কেউ বলল, “আমি একটু আপনার পাশে বসি?”

আমি মুখ ফিরিয়ে তাকালাম৷ আমার বেন্চের ডানদিকে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে৷ ভদ্রলোকের বয়স পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হবে৷ পার্কের মধ্যে বসার জন্য এত ফাঁকা বেন্চ থাকতে আমার পাশে তিনি কেন বসতে চাইছেন? আমি একটু বিরক্ত হলাম৷ ঢাকা শহরে ধান্দাবাজের অভাব নেই৷ ইনিও সেরকম কোন ধান্দাবাজ কিনা কে জানে? কিন্তু ভদ্রলোককে দেখে সেরকম মনে হলো না৷ নিতান্ত পরিপাটি ভালো মানুষ বলেই মনে হলো৷

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম৷ এই মধ্যদুপুরে পার্কটা প্রায় ফাঁকা৷ যদিও বৈশাখের প্রথম দিনে এই পার্কটাতেই পা ফেলার জায়গা থাকেনা, কিন্তু আজকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অল্প কিছু মানুষ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না৷

ভদ্রলোক কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকলেন৷ তারপর উসখুস করে বললেন, “আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?”

তা আমি একটু হচ্ছিলাম বইকি৷ আমি এসেছিলাম চুপচাপ একা একা কিছুক্ষন বসে আকাশ পাতাল ভাবার জন্য৷ কিন্তু আমি সেকথা বললাম না, তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম, যার অর্থ যেকোন কিছু হতে পারে ৷
“একটা গল্প শুনবেন?” ভদ্রলোক বললেন৷

এবার আমি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম৷ গল্প শুনতে আমার সব সময়ই ভালো লাগে, যদি সেটা রাজনীতি বিষয়ক গল্প না হয়৷ কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি ছাড়া অন্য কোন গল্প জানে না৷ দেখা যাক ইনি কি বলেন৷
মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ বলেন৷”
“আপনি কি বিয়ে করেছেন?” উনি জানতে চাইলেন ৷
“না৷” আমি জানালাম ৷
“আমি বিয়ে করেছিলাম আপনার চেয়েও কম বয়সে৷” ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন৷ “এ্যারেন্জড ম্যারেজ ছিলো৷ প্রেম করে বিয়ে আমাদের কপালে নেই বুঝলেন না৷ আমি অতি সাধারণ মানুষ, চেহারাও এমন কিছু আহামরী না দেখতেই পাচ্ছেন৷ কোন মেয়ে আর আমার সাথে প্রেম করবে বলেন?”

একথার উত্তরে কি বলা যায় বুঝলাম না, তাই চুপ করে রইলাম৷ উনি বলতে থাকলেন, “এ্যারেন্জড ম্যারেজ হলেও, আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবেসেছিলাম প্রচন্ড৷ আমার জীবনে সে ছিলো প্রথম নারী৷ কি যে বিস্ময়! প্রচন্ড ভালোলাগায় আমি ভেসে গেলাম৷ দিনগুলি যাচ্ছিলো যেন স্বপ্নের মত৷ আহ, কি মধুর ছিলো সেই দিনগুলো!”

আমি নড়েচড়ে বসলাম৷ গল্প কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না৷ ভদ্রলোক অতীত কালে কথা বলছেন কেন?

উনি আবার শুরু করলেন, “বিয়ের পর কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও আমাদের কোন ছেলে মেয়ে হচ্ছিলো না৷ আমার অবশ্য তাতে খারাপ লাগছিলো না, কিন্তু আমার স্ত্রী একটা বাচ্চার জন্য অস্থীর হয়ে উঠছিলো৷ হবেইতো, সারাদিন আমি বাইরে বাইরে থাকি, আর সে বাসায় একলা থাকে৷ তার সময় কাঁটে কিভাবে বলেন? আমরা অনেক ডাক্তার দেখালাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না৷ অথচ আমাদের কারো কোন সমস্যাও ছিলো না৷”

ভদ্রলোক চুপ করলেন৷ একটু থেমে আবার শুরু করলেন, “তারপর, আজকে থেকে পাঁচ বছর আগে, আমাদের একটা মেয়ে হলো৷ কি যে সুন্দর হয়েছিলো সে! কি যে ফুটফুটে সুন্দর! আমি ভাবতাম, আমার স্ত্রীকে যতটা ভালোবাসি তা আর কাউকে বাসতে পারব না৷ কিন্তু সেই পিচ্চিটা সব অন্যরকম করে দিলো৷ যখন বাইরে যেতাম, খালি পাগলের মত ভাবতাম কখন বাসায় গিয়ে ওকে কোলে নিব৷ একটু একটু করে সে বড় হতে লাগলো৷ গুট গুট করে হামাগুড়ি, আমার দিকে দু'হাত বাড়িয়ে একটা দাঁত বের করে ফিক করে হাসা, আমার মনে হত পৃথিবীতে এর চেয়ে সুখ আর কিছু নাই৷ আমার চেয়ে সুখি আর কেউ নাই৷”

ভদ্রলোক আবার চুপ করলেন৷ সামনের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন৷ আমি বুঝতে পারছিলাম না ঘটনা কি হয়েছে৷ যতদূর মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের মেয়েটি এখন আর বেঁচে নেই৷ আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো৷ এরকম একটা গল্প আমি শুনতে চাইনি৷

“সেদিনটা ছিলো পয়লা বৈশাখ, এক বছর আগে৷” ভদ্রলোক আবার শুরু করলেন৷ “আমি আমার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এই পার্কে আসলাম৷ কি ভীড়! কিন্তু সে ভীড়ও যে কি ভালো লাগছিলো৷ আমি আর আমার স্ত্রী মেয়ের হাত ধরে হেঁটে বেড়ালাম৷ আমার মেয়েটা, ওর নাম ছিলো নিশিতা, ওর বয়স তখন চার বছর, কি খুশি পার্কে এসে! খালি আমাদের হাত ছাড়িয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিলো, আর আমি দৌড়াচ্ছিলাম ওর পিছন পিছন৷ ঘুরতে ঘুরতে আমরা শিশু পার্কের সামনে গেলাম৷ ওখানে অনেক বেলুনের দোকান৷ নিশিতা আমাকে বলল, 'বাবা আমাকে বেলুন কিনে দাওনা'৷ আমি বেলুন কিনে মেয়ের হাতে দিলাম৷ তারপর আমরা গেলাম শিশু পার্কের মিশুকটার পিছনের দোকানে চটপটি খেতে৷ জানেনইতো কি ভীড় থাকে ঐদিন ওখানে৷ ভীড় ঠেলে দুইটা চটপটি নিয়ে একটা আমি নিলাম, একটা নিশিতার আম্মাকে দিলাম৷ চটপটি খেতে খেতে হঠাৎ মনে হলো নিশিতার কোন কথা শুনছি না অনেক্ষন৷ তাড়াতাড়ি পাশে তাকালাম, কিন্তু নিশিতাকে দেখতে পেলাম না৷ আমার হাত থেকে চটপটির প্লেট পরে গেলো৷”

উনি আবার চুপ করলেন৷ কি হয়েছিলো আমি আন্দাজ করতে পারছি৷ মাথা নিচু করে বসে রইলাম৷ একটু পর ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, “অনেক খুঁজেছি৷ অনেক৷ আমি সম্ভব অসম্ভব সব ভাবে চেষ্টা করেছি৷ তাকে আর খুঁজে পাইনি৷ আমার মাথাটা, বুঝলেন না, কেমন জানি পাগলের মত হয়ে গেলো৷ আমার সব আওলায় গেলো৷ আমার খালি মনে হয়, মনে হয়,... আমার মেয়েটাকে দিয়ে কেউ হয়তো বাসায় থালা বাটি মাজাচ্ছে৷ সেই সকালে উঠতে হয় আমার মেয়েটার, সারাদিন মুখবুঁজে পরের বাসার কাজ করে যায়.... অথবা, অথবা...”

ভদ্রলোক দু'হাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে লাগলেন৷ যখন মুখ তুললেন, আমি সে মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না৷ নিজের ভেঁজা চোখ আড়াল করার জন্য আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম৷ ভদ্রলোক ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে লাগলেন, “আমার মেয়েটাকে হয়তো, হয়তো... হাত পা ভেঙে... লুলা করে... হাহ হাহ হাহ আল্লা... আল্লা... ইয়া আল্লা... আমার ছোট্ট মেয়েটা... আমার ছোট্ট মেয়েটা... বোধহয় কোথাও ভিক্ষা করছে... ইয়া আল্লা... ইয়া আল্লা...”

ভদ্রলোক হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন৷ আমি চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ এক শান্ত নীরব দুপুর চুপ করে বয়ে যাচ্ছে৷ অনেক দূরে একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে হাসা হাসি করছে৷ মাথার উপরে কয়েকটা কাক তারস্বরে চিৎকার করছে৷ আমার পাশে এক ভদ্রলোক পৃথিবীর সব হাহাকার নিয়ে হুহু করে কাঁদছেন৷ কি বলব? কি বলব আমি তাকে? আমি কি তাকে বলব যে এরকম নাও হতে পারে? হয়তো কোন যথার্থ ভদ্রলোক তার মেয়েকে খুঁজে পেয়েছেন, নিশিতা হয়তো ভালো আছে, সুখে আছে৷ এই স্বান্তনাটুকু কি আমি তাকে দিব?
১৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×