somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঐতিহাসিক ৬ দফা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ

০৭ ই জুন, ২০১২ রাত ১২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৬৬ সালের ৭ই জুন এই দিনে আজকের বাংলাদেশে ঘটে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। যার ফলে প্রকাশ ঘটে এক বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ। আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগেকার এইদিনে রাজপথের তপ্ত বালুকাময় পথ যাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল তেজগাঁওয়ের শ্রমিক শহীদ মনু মিয়া সহ স্বাধীনতার ঊষালগ্নের এই দিনে ঐতিহাসিক ৬ দফার আন্দোলনে যারা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, যারা বিভিন্নভাবে নেতৃত্বে দিয়েছেন ও অংশ গ্রহন করেছেন, তাদের সকলের ঐতিহাসিক ভুমিকার কথা স্মরন করেই আজকের এই লেখা।

৬ দফা রচনার ভিত্তিঃ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও এই অঞ্চল তখন থেকেই পরাধীন ছিল। এই অঞ্চল থেকেও যারা কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হয়েছিলেন, তাদের কেউ ছিলেন জাতিগতভাবেই বাঙালি বিদ্বেষী, আবার কেউ ছিল ন্যায্য হিস্যা আদায়ে অক্ষম বা বঞ্চিত। এভাবে ক্রমেই বাঙালির বঞ্চনার পাল্লা ভারি হতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খোলে যায় পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধীতার দোয়ার। ব্যালটের মধ্য দিয়ে চুয়ান্নতে আঞ্চলিক ক্ষমতার গদিতে বসলেও জনগনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পশ্চিমারা খেলে যায় তাদের গোপন খেলা। বিভিন্ন ঘটনা পরিক্রমায় পতন ঘটে জনগনের রায়ের, উদয় হয় সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের। আইয়ুবের শাসনকালেই পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম এই দুটি অঞ্চলের মধ্যে একনাগাড়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সেই সাথে রাষ্ট্রীয় বিষয়ে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতি পরিপূর্ণ অবহেলা এবং এতদঅঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সামঞ্জস্য ক্ষুন্ন করার বারংবার অপপ্রয়াসে পূর্ব পাকিস্তানীদের মন গভীর হতাশায় ভারাক্রান্ত হয়। ষাটের দশকের শুরু থেকেই পূর্ব অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের মাঝেই এই হতাশার প্রতিক্রিয়া ছিল স্বতস্ফূর্ত। এই অসন্তোষের বিষয়টিই শেখ মুজিব বুঝতে পেরে সরকারের নিকট সুনির্দিষ্টভাবে কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপনের লক্ষ্যে প্রয়াসী হন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে তাসখন্দ চুক্তিকে(১০ জানুয়ারী ‘৬৬) কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে আইয়ুবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মনোভাব তখন ছিল তুঙ্গে। সেজন্য আইয়ুব তখন সারাদেশে সভা সমাবেশ করে বেড়াচ্ছিলেন। প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পরকের আশায় পূর্ব পাকিস্তানীরা তাসখন্দ চুক্তিকে স্বাগতই জানিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় জানুয়ারিতে আইয়ুব খান বাংলাদেশে এলে সকল নেতাদের বিশেষত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন, ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া, হামিদুল হক চৌধুরী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। শেখ মুজিব অন্যান্য নেতাদেরকে আইয়ুবের কাছে পেশ করার জন্য একটি অভিন্ন দাবিনামা তৈরির অনুরোধ জানালেও তারা আপত্তি করে। কিন্তু ইতিমধ্যে শেখ মুজিব তার ইনার সার্কেলের সহযগিতায় একটি দাবিনামা প্রস্তুত করেন এবং অন্যান্য নেতাদেরকে আইয়ুবের নিকট উপস্থাপনের চেস্টা করলেও অসফল হন। যে কারনে শেখ মুজিবের অসহযোগিতায় আইয়ুবের সঙ্গে এইসব বাঙালি নেতাদের আপোষমুলক বৈঠক ব্যর্থ হয়। ষাটের দশকের শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের বাইরেও শেখ মুজিবের একটি ইনার সার্কেল ছিল। সেই ইনার সার্কেলের সদস্য ছিল সিএসপি কর্মকর্তা আহমদ ফজলুর রহমান ও রুহুল কুদ্দুস এবং তাজউদ্দিন আহমদ। মুলত ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমুলক আচরনের সুত্রপাত ঘটায়। প্রথমত ভাষাগত বৈষম্য। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা সত্তর ভাগ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আয় হলেও উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়া হতো মাত্র তিরিশ ভাগ। পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন করার জন্য যে বৈদেশিক ঋণ নেয়া হতো সেটাও শোধ হতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে আয় করা টাকায়। আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর সেই বৈষম্যের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পেতে পূর্ব পাকিস্তানে দেখা দেয় চরম অনিশ্চয়তা। পাকিস্তানের প্রথম খসড়া পরিকল্পনার ঘাটতি নিরুপনে ড এ সাদেক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক এইসব অর্থনৈতিক বিষয়ে গবেষনা করেন। সেইসব গবেষনার ফলাফলে উল্লিখিত ও নির্দেশিত কথাগুলোই পূর্ব পাকিস্তানের কোনো কোনো গনপরিষদ ও জাতীয় পরিষদ সদস্য ১৯৫৬ সালেই গনপরিষদে তুলে ধরেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনেও এই বিষয়গুলো উপস্থাপিত ও বিশদ আলোচনা হয়েছিল। কাগমারী সম্মেলনেও স্বায়ত্বশাসন প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানী আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের ভাষনেও একই রকম তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন শিক্ষক ড রেহমান সোবহান ষাটের দশকের গোড়া থেকেই বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত দেখিয়ে বিভিন্ন লেখায় এইসব বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন। ১৯৬১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের সিএসপি কর্মকর্তা রুহুল কুদ্দুসও তার বাস্তবলব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিমা পাঞ্জাবী শাসকদের শোষনের পুরো তথ্য ও পরিসংখ্যানসহ একটি নিবন্ধ লিখে শেখ মুজিবকে দিলে তিনি সেটার বাংলা অনুবাদ ‘বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে ইত্তেফাকে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিব গনপরিষদ ও জনসভায় এই বিষয়গুলিই বিভিন্ন সময়ে তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরেই শেখ মুজিবের নির্দেশে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের পরিচালক(ফাইনান্স) হিসেবে কর্মরত রুহুল কুদ্দুসসহ ইনার সার্কেলের অন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষন অবসানের লক্ষ্যে স্বায়ত্বশাসন ভিত্তিক একটি দলিল তৈরি করেন। শেখ মুজিবের ইনার সার্কেলের চুড়ান্ত বিশ্লেষন এবং উপরোক্ত বিষয়গুলোর সরল অনুসরনে রাজনৈতিকরুপে বাঙালির প্রানের দাবি ছয়দফা প্রনয়ন করা হয়েছে বলে স্বিদ্ধান্তে পৌছা যায়। প্রথমে সাতটি পয়েন্ট থাকলেও পরে সপ্তম পয়েন্টটি বাদ দেয়া হয়। যেখানে ছিল ‘প্রাদেশিক গভর্নরকে নির্বাচিত হতে হবে’। সেসময়ের ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেডের(জনতা ব্যাংক)কর্মকর্তা খায়রুল কবিরের অফিস থেকে টাইপ করান।

প্রকাশ্যে ৬ দফাঃ পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে আইয়ুবের নিকট পেশ করতে না পেরে শেখ মুজিব অপেক্ষা করেন এই দাবিগুলোকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার জন্যে। এরপরেই আসে সেই ঐতিহাসিক লাহোর বৈঠকের বিষয়টি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরে তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে আইয়ুবের গদি যখন নড়বড়ে তখনই পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী নেতারা পরিস্থিতি আলোচনা এবং আইয়ুবের কাছ থেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় ও একটি জাতীয় সরকার গঠনের দাবিতে প্রধানত পশ্চিমের বিরোধীদলীয় নেতাদের উদ্যেগে সকল বিরোধীদলের একটি নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনফারেন্স ডাকা হয় ১৯৬৬ এর ফেব্রুয়ারির ৫ ও ৬ তারিখে লাহোরে। পশ্চিমারা উপলব্ধি করলেন, এই প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানকেও সম্পৃক্ত করতে পারলে আইয়ুবের উপর অধিক চাপ দেয়া সম্ভব হবে। পাঞ্জাবীদের অনুরোধে ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মধ্যস্থতায় শেখ মুজিব সেই বৈঠকে যোগ দিতে সম্মত হন। এক্ষেত্রে মানিক মিয়া বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবকে রাজি করালেও কোন দাবি পেশ করতে অনুৎসাহিত করেন। যেকারনে ৬ দফা ঘোষনার পরেও অনেকদিন ইত্তেফাক ৬ দফাকে সমর্থন দেয়নি। এদিকে লাহোরের বৈঠকে যোগদানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরেই শেখ মুজিব তার অনুগত ছাত্রলীগকে দেয়া গোপন নিরদেশে মোতাবেক ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি এক বর্ধিত সভায় একই ধরনের দাবিদাওয়া সম্বলিত একটি প্রস্তাব পাস করে। ছাত্রলীগের এই সভায়ই ‘পাকিস্থানের আঞ্চলিক বৈষম্য’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ পাঠ ও আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠে আঞ্চলিক বৈষম্যগুলি মৃদু দর কষাকষি করে দূর করা যাবেনা, এ জন্য পূর্ব পাকিস্তানীদের দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই নিবন্ধটি পুস্তকাকারেও প্রকাশিত হয় এবং ছাত্রলীগ সভাপতি মাযহারুল হক বাকী ও সাধারন সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক মুখবন্ধে লিখেন ‘ বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য গ্রহনযোগ্য নয়’। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোন নেতাই তখনো ছয়দফা বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে ৫ই ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব খ্যাত লাহোর শহরেই আসে শেখ মুজিবের সেই বহুল কাংখিত দিন। এদিনই নেজামী ইসলাম দলের প্রধান চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে আওয়ামীলীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতাদের মিটিং হয়। এখানেই শেখ মুজিব সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয়ে অসহায়ত্বের চিত্র তুলে ধরে স্বায়ত্বশাসনের দাবি সম্বলিত ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন এবং বিষয়টিকে আলোচ্যসুচীতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানান। কিন্তু সেখানে উপস্থিত পূর্ব পাকিস্তানী অন্যান্য দলের নেতারাসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সবাই এটিকে গ্রহন করতে এমনকি শুনতেও অনীহা প্রকাশ করলে সঙ্গে থাকা ঢাকার পাইয়নিয়ার প্রেস থেকে ছাপা স্বল্প সংখ্যক লিফলেট মিটিং স্থলেই বিলি করেন। সবার বিরোধীতায় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বৈঠক থেকে ওয়াক আউট করে, সম্মেলনের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের কাছে উত্থাপিত প্রস্তাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এটাকে কেন্দ্র করে লাহোর সম্মেলনও তার গুরুত্ব হারায় এবং বলা যায় বাতিলই হয়ে যায়। এই প্রস্তাবটিই পরে বাঙালির মুক্তির সনদ খ্যাত ঐতিহাসিক ৬দফা দাবী হিসেবে মুল্যায়িত হয়। সম্মেলন তার গুরুত্ব হারানোয় অন্যান্য দলগুলো তীব্র ভাষায় শেখ মুজিবসহ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে বিষোধগার করেন। তারা ছয়দফার মধ্যে আইয়ুব খানের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে বলেন, শেখ মুজিব সরকার পক্ষ থেকে প্ররোচিত হয়ে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। যদিও নুরুল আমিনসহ পূর্ব পাকিস্তানী অন্যদলের কেউ কেউ হয়ত জানতো যে, শেখ মুজিব আরও আগেই স্বয়ং আইয়ুবের নিকটই একটি প্রস্তাব পেশ করার উদ্যেগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তারাও বিরোধীতা করতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে একাট্টা হয়। এমনকি সম্মেলনে যোগদানকারী সকল বিরোধী দল এটাও কুৎসা করে যে, লাহোর পৌছেই শেখ মুজিব আইয়ুবের দুতের সঙ্গে বৈঠক করেন ও আওয়ামী লীগের নেতাদের আসা যাওয়ার খরচ সরকারই বহন করেছে। এখান থেকেই বিভক্তি সুস্পষ্ট হয় উদীয়মান বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্বকারী নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে নীতির প্রশ্নে আপোষকামী অন্যান্য বাঙালি নেতাদের। যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের বাস্তব দাবির মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা জাতিগতভাবেই শোষক, কাজেই তাদের বিরোধীতা করাটা খুবই স্বাভাবিক ছিল।
১১ ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে বিমানবন্দর থেকেই সোজা ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধধার বৈঠক করে গোপন নিরদেশ দেন ছয়দফার পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালাতে। ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখেই প্রথম চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ এবং তারপরের দিন ১৪ তারিখে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে পত্রিকায় প্রকাশ্যে বিব্রিতি প্রদান করলে ছয় দফা মানুষের দ্রিস্টি আকর্ষন করে। ১৭ ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগ অফিসে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রস্তাবিত ছয়দফার বিষয়বস্তুর উপর বিশদ ব্যাখ্যা দেন শেখ মুজিব। ২১ ফেব্রুয়ারী ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং এ শেখ মুজিব পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে তার প্রস্তাবগুলির বাস্তবতা মুল্যায়নের আহবান জানান। এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ছয়দফা নিয়ে রাজনৈতিক দর কষাকষির কোনো অবকাশ নেই এবং এটি কোনো রাজনৈতিক ভোজভাজিও নয়। ছয়দফা পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত। যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের বৈধতা এখনো রয়েছে। কেননা, ১৯৪৬ সালের মুসলীম লীগের ব্যবস্থাপকদের দিল্লীর সম্মেলনে ঐ প্রস্তাবে পরিবর্তন আনা হলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল মুল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই। এই মিটিং এ ৬ দফার সামগ্রিক প্রস্তাবনা তুমুল বিতর্কের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন লাভ করে এবং ৬ দফা আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসুচী হিসেবে গৃহীত হয়। এই সভা থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, তাজউদ্দিন আহমদ, হাফেজ হাবিবুর রহমান ও এ কে মুজিবুর রহমানকে ছয়দফা পুস্তিকা আকারে প্রকাশের জন্য একটি উপ-কমিটিও গঠন করা হয়। এর পর থেকেই প্রচার সম্পাদক আব্দুল মোমিনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের তরুন কর্মীরা পুস্তিকা, লিফলেট ও পোস্টার প্রকাশ করে সারাদেশে বিতরন করতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ ৬ দফা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহন করার পরে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা থেকেই ছয়দফার আনুষ্ঠানিক প্রথম প্রচার শুরু হয়।
জন্মের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের মুখপত্র বলে বিবেচিত ইত্তেফাক পত্রিকাও প্রথমে ছয়দফাকে সমর্থন দেয়নি। একমাত্র আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘আওয়াজ’ নামক সান্ধ্যকালীন পত্রিকাটিই প্রস্তাবটি প্রথম প্রকাশ করে। কিন্তু পরে জনমত ছয়দফার পক্ষে আসলে ইত্তেফাকও সমর্থন দেয়। আইয়ুব খান শুরু থেকেই ছয়দফাকে পাকিস্তান ভাঙ্গনের আন্দোলন বলে কঠোর দমনের হুমকি প্রদান করেন। অপরদিকে কেন্দ্রীয় তথ্য সচিব আলতাফ গওহর তার প্রভু আইয়ুবকে তাসখন্দ চুক্তির দায় থেকে মুক্তি দিতে সুকৌশলে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের মনোভাব পূর্ব পাকিস্থানের উপর বিক্ষিপ্ত করে তোলার অভিপ্রায়ে এবং পূর্ব পাকিস্তানীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী এই মনোভাব গড়ে তুলতে ছয়দফার ব্যাপক সমালোচনা প্রচারের ব্যবস্থা করেন। যার ফলশ্রুতিতে পশ্চিমে ছয়দফা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অংশ হলেও পূর্ব পাকিস্তানে সেটাই জনগন তাদের মুক্তির সোপান হিসেবে গ্রহন করে। আইয়ুবের বিদেশ মন্ত্রী ভুট্টো দুরভিসন্ধিমুলক চিন্তা থেকে আইয়ুব বিরোধী রাজনীতিতে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমান দিতে শেখ মুজিবের সঙ্গে ছয়দফার প্রশ্নে প্রকাশ্যে বাহাসে অবতীর্ণ হওয়ার ঘোষনা দিলে শেখ মুজিবও সেই প্রস্তাব গ্রহন করেন। কিন্তু ভুট্টো দিনক্ষন চুড়ান্ত করে ঢাকায় এসেও বাহাসে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস না পেয়ে পালিয়ে যায়।
এদিকে আওয়ামী লীগের ভিতরেও ভাঙ্গন দেখা দিতে থাকে। যারা ২১ তারিখের মিটিং এ বিরোধীতা করেছিল তারা আরো বেশি বিরোধীতায় লিপ্ত হলে ১৩ মার্চ দলের ওয়ার্কিং কমিটির জরুরী মিটিং আহবান করা হয়। সেই মিটিং এ দলের ভিতরে প্রবল সমালোচনা ও মতবিরোধের নিরসন এবং স্বিদ্ধান্ত গ্রহনের লক্ষ্যে ১৮ ও ১৯ মার্চে ইডেন হোটেলে দলের বিশেষ কাউন্সিল আহবান করা হয়। কিন্তু এই ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকেই মতবিরোধের এক পর্যায়ে সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ তার অনুসারীদের নিয়ে বৈঠক ত্যাগ করেন। কাউন্সিলেও তিনি অনুপস্থিত থাকায় সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভাপতিত্ব করেন। ১৯ তারিখের কাউন্সিলেই ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদকে সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক নির্বাচন করে। সেই কাউন্সিলই ঢাকা মহানগর সভাপতি বাহাউদ্দিন চৌধুরীর প্রস্তাব ও ঢাকা জেলা সভাপতি শামসুল হকের সমর্থনের মধ্য দিয়ে ছয়দফার ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের খসড়া অনুমোদন করে এবং ছয়দফা সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়। ১৯ মার্চ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আওয়ামী লীগ ছয়দফা বিষয়ে বর্ণনা করে বলে, উল্লিখিত ছয়দফা ভিত্তিক দলীয় কর্মসুচী পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার এবং এই প্রদেশের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার পুনরুজ্জীবনের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক, বাস্তব ও সুপারিশযোগ্য কর্মসুচী। প্রচারিত লিখিত পুস্তিকায় বলা হয়, এই দাবীগুলোর অন্যতম আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন মুলত রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম নেওয়ারও আগের। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানিয়ে আসছে। এবং শেখ মুজিব বলেন, ছয়দফা দাবী জনগনের বিপুল সাড়া লাভ করেছে কারন, এই বিষয়গুলি নতুন কোনো আবিষ্কার নয় বরং প্রকৃতপক্ষে জনগনেরই দীর্ঘকালের দাবি, আর তাদের নেতাদের অঙ্গীকারও বটে। যা কয়েক দশক ধরে পুরনের অপেক্ষায় রয়েছে। ২০ মার্চ নতুন কমিটির উদ্যেগে প্রথম জনসভা পল্টন ময়দানে হয়। ২৩ মার্চ মানিকগঞ্জে এভাবে শেখ মুজিব উল্কার মতো দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে চলেন ছয়দফার প্রচারে এবং এভাবে ৩৫দিনে ৩২টি জনসভায় ছয়দফার পক্ষে বক্তৃতা করেন। এর মধ্যেই শেখ মুজিব কয়েকবার গ্রেফতার হন আবার জামিন পান। এহেন ঘটনা পরিক্রমায় ৮ই মে নারায়নগঞ্জে জনসভা শেষেই শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিন আহমদসহ দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকেই গ্রেফতার করা হয়।
সরকারী নিপীড়ন যত বাড়তে থাকে আন্দোলন ও গনমানুষের সমর্থন ততই আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের পক্ষে বাড়তে থাকে। আবার অন্যান্য দলগুলোও তাদের সংগঠন শক্তিশালী করা ও সরকারের চরমভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীতার দারুন রাজনৈতিক সুযোগ কাজে লাগাতে উঠেপড়ে লাগে। সেজন্যই ছয়দফা ঘোষনার পর থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতি সরকার যতই আক্রমনী ভাষা ব্যবহার ও রূঢ় আচরন করছে জনগন ৬ দফা ও আওয়ামী লীগকে ততই তাদের উদ্ধারদাতা হিসেবে গ্রহন করেছে। অপরাপর দলগুলোও যত বেশি সমালোচনা ও বিরোধীতা করেছে তারা ততই জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ছয়দফা ঘোষনার অব্যবহিত পর থেকেই শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ বাঙালি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উঠতি ব্যবসায়ী, ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারন বুদ্ধিজীবি সকলের অকুণ্ঠ সমর্থন অর্জন করতে শুরু করে। এসময় আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আশা আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেও দারুনভাবে সক্ষম হয়। সেসময় পূর্ব পাকিস্থানের সবকয়টি দলই স্বায়ত্বশাসনকে তাদের অন্যতম দাবি হিসেবে স্থান দিলেও ৬দফা ঘোষনা হওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অত্যান্ত কার্যকর ও অর্থবহ হিসেবে স্বায়ত্বশাসন দাবির সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়। ছয়দফা বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোকে অনুপ্রানিত এবং সংঘবদ্ধ হতে গুরুত্বপুরন ভুমিকা পালন করে এবং স্বল্প সময়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুল চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। এই কর্মসুচী ছিল বাঙালিদের সুচিন্তিত বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ এবং দেশের যেকোন রাজনৈতিক দলের যেকোন রাজনৈতিক কর্মসুচীর চাইতে বেশি বলিষ্ঠ ও অকপট কর্মসুচী।
ছয় দফায় উল্লিখিত প্রস্তাবগুলো মুলত ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে উত্থাপিত আগেকার দাবীগুলোর উপরে ভিত্তি করেই প্রনীত, তবে নিঃসন্দেহে শেখ মুজিবের উত্থাপিত প্রস্তাবটি ছিল বিস্তৃত ও বাস্তব কাঠামোসম্পন্ন। এমন এক সময়ে ছয়দফা কর্মসুচী ঘোষনা করা হয়েছিল, যখন বাঙালিরা ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারিত্বের গনতান্ত্রিক অধিকার থেকে প্রায় আট বছর যাবত বঞ্চিত ও শোষনের মাত্রা তীব্রভাবে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ছয়দফা দাবীনামা ছিল বাস্তবিকপক্ষেই পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের লালিত ন্যায্য আচরন প্রাপ্তির যৌক্তিক দাবীকে আর্থ-রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের সুনির্দিষ্ট দাবীতে রুপান্তরের অনুঘটক মাত্র। একারনেই ছয়দফা পাকিস্তানী রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে আর সেই সাথে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এক নবপর্যায়েরও সুচনা ঘটে।

৬ দফার সমালোচনাঃ অপরদিকে দেখা যায়, ছয়দফা ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গে সরকারী প্রচারযন্ত্র শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের সম্মানহানিতে নেমে পড়ে এবং এটিকে রাষ্ট্রের শত্রুতা বলে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৬৬ এর মার্চ মাসে ঢাকায় কনভেনশন মুসলীম লীগের জনসভায় আইয়ুব খান বলেন, যারা ছয়দফার কথা বলবে সেসব বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে ‘অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ’ করা হবে বলে হুশিয়ারী উচ্চারন করেন। এই ছয়দফা বিচ্ছিন্নবাদী তৎপরতা এবং এটি পাকিস্তানকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। কেবল সরকার বা সরকারী প্রচার মাধ্যমই নয় পাকিস্তানের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই ছয় দফার সমালোচনায় উঠেপড়ে লাগে। চারদিকে বিতর্ক এবং রাজনৈতিক যুক্তির ঝড় বয়ে যায়। কাউন্সিল মুসলিম লীগ ছয়দফাকে ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলে, পাকিস্তানের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের ভিত্তি কোনোভাবেই ছয়দফা হতে পারেনা, কারন এটি কনফেডারেশন নয় বরং ফেডারেশন গঠনের দাবী। জামায়াতে ইসলামী বলে ‘পাকিস্তানকে বিভক্ত করে ভারতীয় আগ্রাসনের শিকারে পরিনত করে সমগ্র পাকিস্তানের অস্তিত্ত্বের উপর হুমকি হিসেবে ছয়দফা প্রনয়ন করা হয়েছে’। এবং এটি নিশ্চিতভাবেই বিচ্ছিন্নতার লক্ষ্যে পরিচালিত একটি আন্দোলন। নেজামে ইসলামী ছয়দফাকে প্রত্যাখ্যান করে বলে, শেখ মুজিব একক ও একনায়কীয় কায়দায় এই স্বিদ্ধান্ত নিয়েছে। মওলানা ভাসানীর ন্যাপ যুক্তি দেখায়, এতে ভুখা নাঙ্গা মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কোন নির্দেশনা নেই এবং এতে সাম্রাজ্যবাদী দালালদের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার কোনো দাবিই নেই। ন্যাপের অনেকেই এটিকে সিআইএ’এর আয়োজিত ও মস্তিষ্ক প্রসুত পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করে। এই মর্মে ন্যাপ জুনের ৪ ও ৫ তারিখে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ১৪ দফা ভিত্তিক একটি কর্মসুচীও গ্রহন করে এবং সেখানে স্বায়ত্বশাসনের দাবীর উল্লেখ করা হয়। সমালোচনায় পশ্চিম পাকিস্তানের দলগুলো ছিল বেশি সোচ্চার এবং ধর্মভিত্তিক দলগুলো মনে করতো ছয়দফা বাস্তবায়িত হলে উপমহাদেশে ইসলাম বিপন্ন হবে। পূর্ব পাকিস্তানের দলগুলোর সমালোচনা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় মৃদু এবং ন্যাপের পশ্চাৎপসরনের বিষয়টি ছিল খুবই আকর্ষণীয়, বিশেষ করে আইয়ুবের চীনা নীতির কারনে ন্যাপ তখন আইয়ুবকে সমর্থন করতো।
সমালোচনাকালে ডানপন্থী দলগুলো ছয়দফাকে ‘ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে’ ধবংসকারী কমিউনিস্ট ভারতের আয়োজিত এবং বামপন্থীরা সাম্রাজ্যবাদীদের প্রেরনার ফল হিসেবে অভিহিত করে। মোদ্দাকথা, পাকিস্তানে ক্রিয়াশীল প্রায় সকল দলই সমালোচনা ও বিরোধীতা করে। কেউ সরাসরি, কেউ ঘুরিয়ে। যারা অখন্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখতো তারা খুজে পায় ভারতের গন্ধ। ন্যাপের চীনাপন্থী কমিউনিস্টরাও খুজে পায় ভারতের গন্ধ এবং আইয়ুব খান চীনের বন্ধু তাই তাকে ডিস্টার্ব করা যাবেনা। সেজন্য ছয়দফার বিরুদ্ধে ভোতা যুক্তি উপস্থাপন এবং পূর্ব পাকিস্তানের একক নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের উত্থানকে মেনে নিতে না পেরে ছয়দফার অনুরুপ ১৪ দফার প্রস্তাব প্রকাশ করে। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির গোপন কর্মীরা নীরব থাকলেও ন্যাপে বাস করা মস্কোপন্থীরা ছয়দফার ভিতরে সিআইএ’এর গন্ধ খুজে পায় কাল্পনিকভাবে। ধর্মভিত্তিক দলগুলোও ভারতের অদৃশ্য ইন্ধন খুজে পেয়ে ইসলাম গেলো ইসলাম গেলো ধ্বনি তোলে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব পাকিস্তানকে লুটপাট করতে পারবেনা এই আশংকায় যেকোনভাবেই বিরোধীতা করে।

৬ দফা দাবীতে কর্মসুচী ও চুড়ান্ত পরিনতিঃ ছয়দফার প্রচারকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্থানের বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবকে বাধা প্রদান এবং ১৯৬৫ এর পাক-ভারত যুদ্ধের সময় প্রবর্তিত নিবর্তনমুলক আইনের আওতায় দেশরক্ষা আইনের ৩২নং অনুচ্ছেদবলে ৮মে রাতে চুড়ান্তভাবে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের প্রথমসারির অধিকাংশ নেতাসহ সারাদেশের কয়েকহাজার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। নারায়নগঞ্জের সভা শেষে নেতাদের গ্রেফতার করা হলে জামিনের অনেক চেষ্টার পরেও দ্রুত মুক্তি না পাওয়ায় গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম নেতারা ৩০ মে ৩২নম্বরের শেখ মুজিবের বাড়িতে ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকেন। সেই সভাতেই সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। এই সভা থেকেই সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী গ্রেফতার, অত্যাচার এবং শেখ মুজিবসহ অন্য নেতাদের মুক্তির দাবিতে ৭ জুন হরতাল আহবান করা হয়। গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম নেতারা হরতালের প্রস্তুতি নেন ব্যপকভাবে। সেসময়েও রুহুল কুদ্দুস ৪ হাজার টাকা দিয়ে আর্থিকভাবে সহায়তা করেন। তখনকার দিনে সেই হরতালে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ ব্যপক সমর্থন দেন। ছাত্রলীগ আগে থেকেই প্রধানত আওয়ামী লীগের মধ্যকার বিরোধীতা সত্বেও ৬ দফার পক্ষে সারাদেশে সভা সমাবেশ করতে থাকে। সেজন্য ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান অনেক নেতাই গ্রেফতার হন। এইসবের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের পক্ষে আহুত ৭ জুন সারা পূর্ব পাকিস্থানে হরতালে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে কর্মসুচী সফল করতে ব্যপক প্রস্তুতি নেয় ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ। কর্মসুচীর ধারাবাহিকতায় আহুত হরতালের দিনেই তেজগাওয়ের শ্রমিক মনু মিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিতে ৪১ জন নিহত হয় এবং ১০০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। হয়। সেই থেকে ৭ জুন ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস।

৬ দফার এদিক সেদিকঃ সরকার যতই মুখে বলুক ছয় দফা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ষড়যন্ত্র, সত্যিকারে কিন্তু তারাও ভীত হয়ে পড়ে। সেজন্যই ৭ জুনের সফল হরতালের কয়েকদিনের মধ্যেই আইয়ুব তনয় গওহর আইয়ুব ও সাংবাদিক জেড এ সুলেরী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকা আসেন ছয়দফার বিষয়ে আপোষরফার জন্য। জেলখানায়ই যোগাযোগ করেন খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে। খন্দকার মোশতাক আহমদ একটি খসড়া দিয়ে এই ব্যপারে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে মতামত নেওয়ার জন্য। শেখ মুজিব খসড়াটি দেখে পড়ে বলেন, ‘এ ধরনের আপোষ করলে পুরব পাকিস্থানের স্বাধীনতা দুরের কথা ছয় দফাও আদায় হবে না’। ২২ জুন মিজানুর রহমান চৌধুরী গ্রেফতার হলে প্রথমে মোল্লা জালাল উদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক করা হয় কিন্তু সে সহ ৩৭ জন কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হলে কৌশলগত কারনে মহিলা সম্পাদক আমেনা বেগম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্তঃ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ছয়দফার প্রবল সমালোচনা ছিল। দলের পশ্চিম পাকিস্থানী নেতারা ছিলেন চরমভাবে ছয়দফা বিরোধী। এবং এই বিরোধীতা এতই প্রকট ছিল যাতে দলের মধ্যেই ভাঙ্গন শুরু হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্থানী আওয়ামী লীগের সকল নেতা এবং পূর্ব পাকিস্থানের ৮দফা পন্থী আব্দুস সালাম খানের মতো অনেকেই দল থেকে বেরিয়ে ৬ দফা পরিত্যাগ করে ১৯৬৭ সালের মে মাসে নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট পাকিস্থান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট(পিডিএম) গঠন করে। উপরন্তু তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এনডিএফ এর কতিপয় সাবেক আওয়ামী লীগার। ১৯৬৭ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ৬ দফা পন্থী ও ৮ দফা পন্থীতে পরিনত হয়। কিন্তু ৮ দফা পন্থীদের জনগন গ্রহন করেনি। এইবার মুলত ৪র্থ বারের মতো আওয়ামী লীগ ভাঙ্গনের মুখোমুখি হয়।

সরকারের রোষানলে ইত্তেফাকঃ আওয়ামী লীগের বিরোধী অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধীতার সুযোগে সরকার সুপরিকল্পিতভাবে ছয়দফা কর্মসুচীর বিরুদ্ধে প্রচারনা চালায় এং গ্রহন করে রাজনৈতিক নিবর্তনের পথ। ছয়দফা ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গেই ইত্তেফাক সমর্থন না দিলেও প্রবল জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল 'ইত্তেফাক' পরবর্তীতে ৬ দফার পক্ষে ব্যপক প্রচারনা চালায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একমাত্র সমর্থনদানকারী পত্রিকা এবং আওয়ামীলীগের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা ১৫ জুন থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। ইত্তেফাকের প্রেস বাজেয়াপ্ত করে সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।

স্বায়ত্বশাসন দাবী থেকে স্বাধীনতা, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধুঃ শেখ মুজিবসহ অন্যদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৭ জুন সফল হরতাল পালনের পরে জেলখানায় আইয়ুবের দুত ছয়দফার সমঝোতা চেস্টা করেও ব্যর্থ হয়। ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলন ক্রমশ বাড়তেই থাকে।ক্রমশ ছয়দফা ঘোষনার পর থেকেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উপর গ্রেফতার, নির্যাতন, হুলিয়া চলতেই থাকে। ৮ মে ১৯৬৬ থেকে একটানা জেলে থাকা অবস্থায়ই সরকার এক প্রেসনোটের মাধ্যমে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা প্রকাশ করে। এর আগে থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে অনেক সরকারী ও সামরিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৮’র ১৭ জানুয়ারী শেখ মুজিব মুক্তি পেলেও জেলগেট থেকেই আবার গ্রেফতার করে তাকে কথিত আগরতলা মামলায় ফাসানো হয়। এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ছিল বহুবিধ উদ্দেশ্য- পূর্ব পাকিস্থানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন, পূর্ব পাকিস্তানের কন্ঠ স্তব্দ করে দিয়ে চিরতরে স্বাধীনতার স্বপ্নকে হত্যা করা, বাঙালিদের সামরিক বাহিনী থেকে বিতাড়ন করে পাঞ্জাবী আধিপত্য বজায় রাখা এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে স্থায়ী আস্থাহীন ও বিভেদ রচনা। এহেন মামলার উপস্থিতি ঘটিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাদের ক্ষমতা দখল ও নির্বিঘ্নতা বজায় রাখতে সামরিক শক্তিকে নির্বিবাদে দেশ শাসনের সুযোগ করে দেয়াই ছিল মুল উদ্দেশ্য। কিন্তু তারপরেও শেষ রক্ষা হয়নি লুটেরা পশ্চিমাদের। ছয় দফা আন্দোলন ইতিমধ্যে একদফায় পরিনত করেছে ছাত্র-জনতা রাজপথে তাঁদের মিলিত উচ্চারনে। ছয় দফার আড়ালে 'স্বাধীনতা'র একদফা দাবীর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমের পাঞ্জাবী নেতারা যতই রুক্ষ হতে থাকে, যতই বাঙালিকে শাসন ও শোষনের জালে বন্দী করতে ততপর হয়ে উঠে ততই বাঙালি চুড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ছয় দফা আন্দোলনের ধারাক্রমেই রচিত হয় লৌহ মানব খ্যাত আইয়ুবের বিদায়ের গনঅভ্যুত্থান। আইয়ুবের পতনের মধ্যদিয়ে বাংলার মানুষের লালিত আশা আকাংখা পুরনেরই যেন বাস্তব ভিত্তি রচিতও হয়েছিল।
তীব্র ছাত্র গন-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেন বাঙালির ত্রাতা এবং জনগনের বঙ্গবন্ধু। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে বাঙালি খুজে পায় তার বিদ্রোহী সত্ত্বাকে। যার ধারাবাহিকতায় সত্তরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালি এবার স্বায়ত্বশাসন নয় চুড়ান্ত স্বাধীনতার লড়াইয়ে নামে। লক্ষ প্রানের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বপ্নের কাংখিত স্বাধীনতা। যে আন্দোলন ১৯৬৬ তে শুরু হয়েছিল স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে সেই আন্দোলনই অবশেষে এনে দিয়েছে বাঙালির এক দফা স্বাধীনতা। সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। ছাপ্পান্ন হাজার বরগ মাইল ভুখন্ডের রাষ্ট্রটি আমাদের প্রিয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

নিচে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবিসমূহ দেওয়া হলোঃ


প্রথম দফা : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি: ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকারের বৈশিষ্ট্য হবে Federal বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় পদ্ধতির; তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ এবং সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে।প্রদেশগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার প্রতিনিধি নির্বাচন জনসংখ্যার ভিত্তিতে হবে।


দ্বিতীয় দফা : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের দায়িত্ব থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ।অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।

তৃতীয় দফা : মুদ্রা ও অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা: পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দু'টি পৃথক মুদ্রা-ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা পারস্পরিকভাবে কিংবা অবাধে উভয় অঞ্চলে বিনিময়যোগ্য।এ ক্ষেত্রে দু'অঞ্চলে স্বতন্ত্র বা পৃথক পৃথক ষ্টেট ব্যাংক থাকবে এবং মুদ্রার পরিচালনা ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। অথবা, এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একটি মুদ্রা-ব্যবস্থা চালু থাকতে পারে এই শর্তে যে, একটি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার অধীনে দুই অঞ্চলে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তাতে এমন বিধান থাকতে হবে যেন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর কিংবা মূলধন পাচার হতে না পারে।বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্থান থেকে পশ্চিম পাকিস্থানে মূলধন পাচার বন্ধ করার জন্য সংবিধানে কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে।

চতুর্থ দফা : রাজস্ব কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা: সকল প্রকার রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে।কেন্দ্রীয় তথা প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় রাজস্বের যোগান আঞ্চলিক তহবিল হতে সরবরাহ করা হবে। সংবিধানে নির্দেশিত বিধানের বলে রাজস্বের এই নির্ধারিত অংশ স্বাভাবিকভাবেই ফেডারেল তহবিলে জমা হয়ে যাবে। এহেন সাংবিধানিক বিধানে এমন নিশ্চয়তা থাকবে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্বের প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারটি এমন একটি লক্ষ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে যেন রাজস্বনীতির উপর নিয়ণ্ত্রন ক্ষমতা নিশ্চিতভাবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকে।

পঞ্চম দফা : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা: পঞ্চম দফায় বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ে নিম্নরূপ সাংবিধানিক বিধানের সুপারিশ করা হয়: (ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে। (খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলোর এখতিয়ারে থাকবে এবং অঙ্গরাজ্যের প্রয়োজন অঙ্গরাজ্য কর্তৃক ব্যবহৃত হবে। (গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মতনির্দিষ্ট হারে অঙ্গরাজ্যগুলেআ মিটাবে। (ঘ) অঙ্গরাজ্যের মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন বাধা থাকবে না। (ঙ) সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্য প্রতিনিধি দল প্রেরণের এবং স্ব স্ব স্বার্থে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।

ষষ্ঠ দফা : আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: (ক) আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা-সামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে। (খ) কেন্দ্রীয় সরকারের সকল শাখায় বা চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিট থেকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ করতে হবে। (গ) নৌ-বাহিনীর সদর দপ্তর করাচি থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করতে হবে।

সহায়ক গ্রন্থসমুহঃ
পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, কামরুদ্দিন আহমদ
আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-১৯৭১, শ্যামলী ঘোষ
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১, ড. মোহাম্মদ হাননান
বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও আহমদ ফজলুর রহমান, হাছিনা রহমান
রাজনীতির তিনকাল, মিজানুর রহমান চৌধুরী
১৫০ মোগলটুলী, বাহাউদ্দিন চৌধুরী
সংগ্রামের তিনদশক, খোকা রায়
বাংলাদেশঃ স্বায়ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতা, মওদুদ আহমদ
বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, রেহমান সোবহান
স্বায়ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতা ১৯৬৬-১৯৭১, ড কামাল হোসেন
Pakistan: Military Rule or People’s Power, এম তারিক আলী
বাংলাদেশঃ জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব, আবুল মাল আবদুল মুহিত
অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জল বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও আমি, মমিনুল হক খোকা
লেখকের রোজনামচায় চার দশকের রাজনীতি পরিক্রমা, আবদুল হক
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ১৯৪৭-১৯৭১, সম্পাদনায়ঃ এ এফ এম সালাহউদ্দিন আহমদ, মোনায়েম সরকার, ড নুরুল ইসলাম মঞ্জুর
আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আবুল মনসুর আহমদ
জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫, অলি আহাদ
স্বৈরাচারের দশ বছর, আতাউর রহমান খান
জীবন সংগ্রাম, মনি সিং
একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময়, আনোয়ারুল আলম শহীদ
স্বাধীনতার স্বপ্ন উন্মেষ ও অর্জন, আবদুল আজিজ বাগমার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি(১ম খন্ড), সম্পাদনাঃ মোনায়েম সরকার
চলমান ইতিহাস জীবনের কিছু সময় কিছু কথা, মওদুদ আহমদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, এম এ ওয়াজেদ মিয়া
মওলানা ভাসানীর জীবনী, সৈয়দ আবুল মকসুদ
আওয়ামী লীগের ইতিহাস(প্রথম খন্ড), ড. ধীরাজুর রহমান খান
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১২ রাত ৮:৪৪
৩৪টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×