আমার স্মরণে থাকা সবচাইতে পুরোনো ঘটনাখানি লিখিতে বসিয়াছি। হুবহু অনেক কিছুই মনে নাই। তাই কিছুটা কল্পনার আশ্রয় লইতে হইয়াছে। তখন আমার বয়স পাঁচ কী ছয়!
একদা আমাদের বাড়িতে জনৈক মামা বেড়াইতে আসিলেন। কিছুকাল হইল, তাহার বড় কন্যার বিবাহ সম্পন্ন হইয়াছে। শ্বশুর বাড়িতে বিবাহ পরবর্তী দাওয়াত। তিনি আমাদিগকে দাওয়াত করিতেই আসিয়াছেন।
নির্দিষ্ট দিবসে দাওয়াতে যাওয়ার জন্য আব্বা প্রস্তুত হইলেন। কী এক ঝামেলার কারণে আম্মা যাইতে পারিতেছিলেন না। কথা ছিল, আমিও আব্বার সঙ্গে যাইব, আম্মাও প্রথমে সম্মতি দিয়াছিলেন। কিন্তু যথাসময়ে তিনি অজানা এক কারণে বাঁকিয়া উঠিলেন, যদ্যাপি আব্বা আমাকে সঙ্গে লইতে চাহিতেছিলেন।
আব্বা একেলাই চলিয়া গেলেন। আমি মনঃক্ষুণ্ণ হইলাম। রাস্তায় দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছিলাম; তাহাতেও আম্মার মন গলিল না- তিনি আপন মনে আঙ্গিনা লেপিতেছিলেন।
কিছুক্ষণ কাঁদার পর আমার প্রচন্ড অভিমান হইল আম্মার উপর। তিনি কেন আমাকে যাইতে দিলেন না? তিনি কি আমার মনের কথা বুঝিতে পারেন নাই? কাউকে কিছু না জানাইয়াই আব্বা যে-ই পথে চলিয়া গিয়াছেন, সে-ই পথ ধরিয়া হাঁটা শুরু করিলাম।
হাঁটিতেই থাকিলাম, আর হাঁটিতেই থাকিলাম। অনেকদূর যাওয়ার পর অকস্মাৎ মনে হইল, আমি ভগ্নির শ্বশুর বাড়ির পথ ভুলিয়া গিয়াছি, যদ্যাপি কিছুদিন পূর্বে (বিবাহের সময়) তাহার শ্বশুরবাড়িতে গিয়াছিলাম। পশ্চাতে ফিরিয়া কিছুক্ষণ কী যেন ভাবিলাম। ইচ্ছা হইল, বাড়িতে ফিরিয়া আসি, কিন্তু ফিরিলাম না। আম্মা-আব্বার প্রতি অভিমান গাঢ় হইতে গাঢ়তর হইয়া উঠিল। সম্মুখপথেই অগ্রসর হইতে লাগিলাম।
আরও দশ-বারো মাইলের মতন হাঁটিয়া চলিতেছিলাম। পরিশ্রান্ত হইলে মাঝে মাঝে তরুছায়ায় বসিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম লইতেছিলাম। হঠাৎ আমার খুব ঘুম পাইল। এক কাঁঠাল গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়া ঘুমাইয়া পড়িলাম। তখন ঠিক দ্বিপ্রহর! লোক চলাচল একেবারেই কম।
আমার ঘুম ভাঙিল বিকালের দিকে। চক্ষু কচলাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। এমন সময় লক্ষ্য করিলাম, আমি দুই রাস্তার সংযোগস্থলে দাঁড়াইয়া আছি; পশ্চাতে আরও একটি রাস্তা চলিয়া গিয়াছে। আমি কোন পথ দিয়া আসিয়াছিলাম, আর কোন পথেই বা যাইব; দিশা পাইতেছিলাম না।
ডানপাশের রাস্তা ধরিয়া একটি কুকুর যাইতেছিল। ভাবিলাম, আমার বোধহয় এই পথেই যাওয়া উচিত; যদ্যাপি আমি গন্তব্যস্থলের কথা জানিতাম না! কুকুরের পিছে পিছেই হাঁটা শুরু করিলাম। হঠাৎ কী কারণে যেন আমার মনে হইল, এই পথ ধরিয়া যাইব না। প্রকৃতি বোধহয় সহায় ছিল! যদি ঐ পথ ধরিয়া চলিয়া যাইতাম, হয়তো কখনোই ফিরিয়া আসিতে পারিতাম না; আমাকে হয়তো আর খুঁজিয়াই পাওয়া যাইত না।
দুই রাস্তার সংযোগস্থলে আসিয়া বামপাশের রাস্তা ধরিয়া হাঁটা ধরিলাম। দুইপাশে আখখেত! লোক চলাচল কম হওয়ায় কেমন যেন ভয় লাগিতেছিল। মনের অভিমান ততক্ষণে কমিয়া গিয়াছে। এইবার মাথায় দুশ্চিন্তা ভর করিয়াছে। কোথায় যাইব আমি?
তখন শেষ বিকাল। লোকজনের আনাগোনা বাড়িয়া গিয়াছে। বারো-তেরো বৎসরের কয়েকজন বালক মাথায় লাকড়ি লইয়া কোথায় যেন যাইতেছিল। তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, "তোমরা কোথায় যাও?"
একজন বলিল, "আমরা মল্লিকবাড়ির হাটে যাই। লাকড়ি বেচতে। তুমি কোথায় যাও?"
হঠাৎ মনে পড়িল, আমার নানার বাড়ি তো মল্লিকবাড়ি। আমি বলিলাম, "আমিও তোমাদের সঙ্গে যাই?"
তাহারা কিছুই বলিল না। তাহাদের সঙ্গেই হাঁটা ধরিলাম।
ছেলেরা লাকড়ি বিক্রি করিতেছে। আমি তাহাদের সঙ্গেই দাঁড়াইয়া আছি। আমার জনৈক মামার বইয়ের দোকান ছিল ঐ বাজারে। হঠাৎ ভাবিলাম, চেষ্টা করিয়া দেখি দোকানটি খুঁজিয়া পাওয়া যায় কিনা!
কষ্ট করিতে হইল না- অতি সহজেই দোকানটি পাইয়া গেলাম। যেইখানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া লাকড়ি বিক্রি করা হইতেছিল, তাহার কিছু পশ্চাতেই ছিল মামার বইয়ের দোকানটি। আমাকে দেখিয়া মামা তো অবাক। জিজ্ঞাসা করিলেন, "মামা, কার সাথে এসেছ?"
আমি বলিলাম, "একাই।"
মামা আমাকে পাউরুটি আর খইয়ের নাড়ু কিনিয়া দিলেন। আমি মজা করিয়া খাইতেছিলাম। সন্ধ্যা নামিয়া গিয়াছে বহুক্ষণ পূর্বে। নানা দোকানে আসিয়াছেন। নানার সঙ্গে তাহাদের বাড়িতে চলিয়া আসিলাম।
এইদিকে আমাদের বাড়িতে তো কান্নাকাটির রোল পড়িয়া গিয়াছে। আম্মা পুত্রশোকে একাধিকবার মূর্ছা গিয়াছেন। আব্বা দাওয়াত খাইয়া আসিয়া পাগলের মতো চিল্লাপাল্লা শুরু করিলেন। কী করিবেন, না করিবেন; কিছুই বুঝিতে পারিতেছিলেন না। পুকুরে জাল ফেলা হইল, এলাকায় মাইক মারা হইল; আমার কোনো খোঁজ নাই।
এলাকার এক বড় ভাইকে লইয়া আমার খোঁজ করিতে লাগিলেন আব্বা। রাত্রি তখন একটার মতন বাজিয়া গিয়াছিল। আব্বা রাস্তা দিয়া যান, আর আশপাশের ঝোঁপঝাড়ে আমাকে হন্যে হইয়া খোঁজেন। তালগাছের ডগায় লাইট মারেন, তাহার মনে শঙ্কা, আমাকে দেও-দানব ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। গহীন শালবনে ঢুকিয়া খুঁজেন, আমাকে শিয়ালে ধরিয়া নিয়া গেল কিনা!
রাত্রি তিনটার দিকে নানার বাড়িতে চলিয়া আসিলেন আব্বা। বাড়ির লোকজন তখন গভীর ঘুমে অচেতন। কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নাই। হঠাৎ বাহিরে আব্বার কান্নাকাটি শুনিয়া নানা কপাট খুলিলেন। ততক্ষণে প্রায় সকলের ঘুম ছুটিয়া গিয়াছে । আমি নানার ঘরেই ঘুমাইয়া ছিলাম । আব্বা প্রথমে আমাকে দেখেন নাই । নানা যখন জানাইলেন, আমি তাহাদের ওইখানেই আছি; অতঃপর আব্বার কান্নাকাটি বন্ধ হইল। তিনি আমার ললাটে চুম্বন করিলেন। মনে হইল, তিনি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাইলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:১৩