somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জিন্নাহ ও নেহেরুঃ মেয়ে জামাই নিয়ে দুজনেই অসুখী ছিলেন

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জিন্নাহর মেয়ে দিনার জন্ম হয়েছিল ব্রিটেনে, তিনি সেখানকার স্কুলে যেতেন। এই দুই বালিকা জানতেন না, আধুনিক ধ্যান-ধারণা সবই চমৎকার, সেগুলো নিয়ে খৈ ফোটানো যায়, কিন্তু বিছানায় নেয়া যায় না। উভয় বালিকাই ওই সীমারেখাটা অতিক্রম করে ভিন্নধর্মের পুরুষের প্রেমে মজেছিলেন।
ইন্দিরা কিন্তু ওই সময়ে ছিলেন খুবই পরিচিত তরুণী। অনেকেই তাকে বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। নেহরুরা ছিলেন উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ। তবে কট্টর নয়। কিন্তু তাই বলে নিম্নবর্ণের কারো সাথে কিংবা অন্য কোনো ধর্মের তরুণের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু কথায় বলে প্রেম কোনো বিধিনিষেধই মানে না।
ইন্দিরার স্বামী ফিরোজ জাহাঙ্গীর গান্ধী (Ghandy, Gandhi নয়। পরে বানান বদল করে করেছিলেন। হয়ে গেলেন Gandhi। ইন্দিরা এবং তার বংশধররা এই পদবিই ব্যবহার করেন)। ছিলেন ভারতের পারসি সম্প্রদায়ের সদস্য। ১৯৩০ সালে হরতালের পিকেটিং করার সময় নেহরুর স্ত্রী কমলা এবং মেয়ে ইন্দিরার সাথে পরিচয় ঘটে ফিরোজের। এর পর থেকে নেহরু পরিবারের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। ওই সময়টাতে নেহরু প্রায়ই কারাগারে থাকতেন। ইন্দিরার বয়স যখন মাত্র ১৬, তখন ফিরোজ বিয়ের প্রথম প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইন্দিরা ও কমলা উভয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। অজুহাত হিসেবে দেখানো হয়, ইন্দিরার বয়স কম। তবে কমলা নেহরু যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার পর ফিরোজ তাঁর সেবায় নিয়োজিত রাখেন। চিকিৎসার জন্য ইউরোপ নিয়ে যান। কমলার মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডে বাস করার সময় ইন্দিরা ও ফিরোজ ঘনিষ্ঠ হন। ১৯৪২ সালে তারা হিন্দু ধর্মমতে বিয়ে করেন।
জওয়াহেরলাল এই বিয়েতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। তিনি বিয়েটি বাতিল করার জন্য মহাত্মা গান্ধীর শরণাপন্নও হয়েছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। তাঁদের বিয়েটাও সুখের হয়নি। স্বাধীন ভারতে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে। ইন্দিরা তাঁর বাবার সরকারি বাসভবন তিন মূর্তি হাউজে ওঠেন, সেখানে তিনি বাবার পারসোনাল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন। ফিরোজ সাংবাদিকতা করতেন, একাধিকবার এমপি হয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওই সময় তিনি ছিলেন স্রেফ একজন এমপি, ইন্দিরাও নিজ নামে খ্যাতিমান ছিলেন না।
তবে তাদের উভয়ের জীবন নানা কেচ্ছা-কাহিনীতে ভরপুর। ইন্দিরা গান্ধীর জীবনীকার ক্যারিনি ফ্রাঙ্ক বলেছেন, ইন্দিরার অনেকগুলো অ্যাফেয়ার্স ছিল। শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নের সময় তিনি জার্মান নাগরিক ফ্রাঙ্ক ওবেরডর্ফ নামের এক ফরাসি শিক্ষকের প্রেমে পড়েছিলেন। পরে নেহরুর সচিব এম ও মাথাইয়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল বলে অনেকে দাবি করেছে। এমনকি ফিরোজ গান্ধীর সাথে বিয়ের পরও এই সম্পর্ক টিকে ছিল। এমনকি ইন্দিরার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর তিনি অন্য এক নারীর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেছিলেন। তবে তাদের কাহিনী খুব বেশি প্রচার হয়নি, যেমনটা হয়েছে জিন্নাহর মেয়ের কাহিনী।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ফিরোজ অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নেহরুর জন্য অনেকবারই বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি ন্যাশনাল হেরার্ল্ড নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাটি স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারত সরকারের জন্য নানা সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। স্বাধীনতার পর থেকে অনেক শিল্পপতি সরকারের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিচ্ছিলেন। ফিরোজ এগুলো তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এতে করে একবার অর্থমন্ত্রীকে পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়েছিল। ফলে মেয়ে-জামাইয়ের প্রতি আরেক দফা অসন্তুষ্ট হন নেহরু। এ দিকে নানা কারণে ফিরোজের সাথে দাম্পত্য জীবন অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিল না নেহরুর জন্য। একপর্যায়ে বাবার একাকীত্ব অবসানের কথা বলে ইন্দিরা তাঁর স্বামীর সংসার ত্যাগ করে বাবার কাছে চলে যান।
দিনা জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৯ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্টের মাঝামাঝি, রাতে। দুনিয়ায় তাঁর আগমন হয়েছিল নাটকীয়ভাবে। তাঁর মা-বাবা লন্ডনের একটি থিয়েটারে মুভি উপভোগ করার সময় তিনি আগমনবার্তা ঘোষণা করেছিলেন।
স্ট্যানলি ওলপার্টের ‘জিন্নাহ অব পাকিস্তান’-এ ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে : ‘বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ওই দিনটির ঠিক ২৮ বছর পর জিন্নাহর আরেকটি সন্তান তথা পাকিস্তানের জন্ম হয়।’
দিনাকে ১৯৩৬ সালে যখন নেভিল ওয়াদিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর। নেভিল এক পারসি পরিবারে (তাঁর বাবা জরস্ত্রীয় হলেও মা ছিলেন খ্রিষ্টান) জন্মে ছিলেন। তাঁর বাবা স্যার নেস ওয়াদিয়া ছিলেন ভারতবর্ষের বিখ্যাত বস্ত্রশিল্পপতি। নেভিল জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের লিভারপুলে, ক্যামব্রিজের মালভার্ন ও ট্রিনিটি কলেজে পড়াশোনা করেন। ওই সময়ে জিন্নাহর সহকারী মোহাম্মদ আলী করিম চাগলা তার আত্মজীবনী ‘রোজেজ ইন ডিসেম্বর’-এ লিখেছেন : ‘দিনাকে জিন্নাহ জিজ্ঞাসা করলেন ‘ভারতবর্ষে লাখ লাখ মুসলমান আছে, আর তুমি কি না কেবল তার জন্য অপেক্ষা করছিলে?’ দিনার জবাব ছিল, ‘ভারতবর্ষে লাখ লাখ মুসলিম মেয়ে ছিল, তুমি কেন তাহলে আমার মাকে বিয়ে করেছিলে?’
প্রেম যে কী জিনিস তা জিন্নাহর অজ্ঞাত কিছু ছিল না। রট্টি ও জিন্নাহর প্রেমকাহিনী জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো রাজি হায়দায়ের ‘রট্টি জিন্নাহ : দ্য স্টোরি টোল্ড অ্যান্ড আনটোল্ড’ বইটি পড়া। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার ২০ বছর পর জিন্নাহ ১৬ বছর বয়সী রট্টির (দিনার হবু মা) প্রেমে পড়েছিলেন। রট্টি ছিলেন জরস্ত্রীয় ধর্মাবলম্বী পরিবারের সন্তান। তারা কোর্ট ম্যারেজের আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময়ের আইনে বলা ছিল, কোর্টে বিয়ে করতে হলে ধর্ম বিসর্জন দিতে হতো। হায়দার ব্যাখ্যা করেছেন, এটা করা হলে জিন্নাহকে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মুসলিম আসন থেকে পদত্যাগ করতে হতো। রট্টি ইসলাম গ্রহণ করে জিন্নাহকে বিয়ে করে এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন।
তবে জিন্নাহ-রট্টির বিয়েটা কিন্তু খুব সহজে হয়নি। বলিউড-টালিউড-ঢালিউড সব সিনেমাকেই হার মানাবে ওই কাহিনী। রট্টির বাবা স্যার দিনশা পেতিত ছিলেন টেক্সটাইল ম্যাগনেট, ব্যারিস্টার জিন্নাহর মক্কেল। তাঁর একমাত্র সন্তান ভিন্ন ধর্মের জিন্নাহকে বিয়ে করতে চাইছে, এটা মেনে নেয়া তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তিনি তাঁদের সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করে দিলেন। স্যার দিনশা আদালতে গিয়ে তাঁর নাবালক মেয়ের সাথে জিন্নাহর দেখা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এলেন। তাঁরা দুই বছর অপেক্ষা করলেন। রট্টি আইনগতভাবে প্রাপ্তবয়স্কা হলে তিনি জিন্নাহকে বিয়ে করে বাবার বাড়ি ছেড়ে গেলেন।
এটা ছিল প্রেমের প্রথম দিককার বিষয়। হায়দারের মতে, জিন্নাহ (তিনি তাঁকে ‘জে’ নামে অভিহিত করেছেন) যখন শ্বাসরোধী অফিসে শ্বাসরোধী মানুষদের সাথে শ্বাসরোধী বিষয় নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত থাকতেন, তখন বোম্বের ফুল রট্টি ধৈর্য ধরে আইন-আদালতের দ্বন্দ্বমুখর কক্ষগুলোতে বিচরণ করতেন। তিনি জিন্নাহর সাথে বিভিন্ন সভাতেও যেতেন। এমনকি নাগপুরে কংগ্রেস অধিবেশনেও যোগ দিয়েছিলেন, ঔপনিবেশিক শত্রু ব্রিটেনের মোকাবেলায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতি জোরালোভাবে বক্তব্য রেখেছেন। রট্টিতে অভিভূত ছিলেন জিন্নাহ। হায়দার গভর্নর হাউজে তাঁদের এক ডিনারের চমৎকার ঘটনা তুলে ধরেছেন।
কাহিনীটি এমন : মিসেস জিন্নাহ লো-কাট ড্রেস পরেছেন। তাঁরা যখন ডাইনিং টেবিলে বসেছিলেন, তখন লেডি উইলিংডন, মেরি ফ্রিম্যান-টমাস তার এডিসিকে বললেন একটা তোয়ালে এনে মিসেস জিন্নাহকে ঢেকে দিতে, যাতে তাঁর ঠাণ্ডা না লাগে। জিন্নাহ টেবিল থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মিসেস জিন্নাহর যদি ঠাণ্ডা লাগে, তিনি সেটা জানাবেন এবং নিজে থেকেই তোয়ালে আনতে বলবেন।’ তিনি সাথে সাথে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে এলেন, আর কখনো তিনি গভর্নর হাউজে যাননি। তবে তাঁদের জীবনটা এভাবে চলেনি। বিয়ের প্রথম প্রথম জিন্নাহর জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে রট্টির খুব অসুবিধা হয়নি। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষে ফিরে এলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তাঁর রাজনৈতিক কৌশল ছিল জিন্নাহর সাংবিধানিক নিয়মনীতি মেনে চলা থেকে ভিন্ন।
বিয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে জিন্নাহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। এতে করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে জিন্নাহর ভূমিকা সাময়িকভাবে কমে যায়। তিনি ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেন, হোম রুল লিগ থেকে সরে যান, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসও ছেড়ে দেন। মনে হচ্ছিল, জিন্নাহর ক্যারিয়ার দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। ১৯২০ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে রট্টি ছিলেন জিন্নাহর পাশেই। জিন্নাহ দেখলেন, গান্ধী আন্দোলনটি হাইজ্যাক করছেন। ওই ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন যশোবন্ত সিং তাঁর জিন্নাহ : ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ইন্ডিপেন্ডেন্স বইতে। গান্ধী নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে পূর্ণ স্বরাজ ধরনের গোলমেলে দাবিসহ রাজপথে নিয়ে গেলেন।
গান্ধীকে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘আপনার পথ ভুল পথ : আমার পথটাই (নিয়মতান্ত্রিক পথ) সঠিক পথ।’
কংগ্রেসের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন জিন্নাহ। মুসলিম লিগের সদস্যপদ ছাড়া আর কোনো জনগণ-সংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল না। জাতীয় পর্যায় থেকে সরে গিয়ে জিন্নাহ এখন দাঁড়ানোর জন্য অনেক ছোট প্লাটফর্মে চলে গেলেন।
ভারতবর্ষে অসহযোগিতা ও আইন অমান্য আন্দোলন চলার সময় দিনার বয়স ছিল মাত্র এক বছর। গান্ধীর কৌশলের সাথে দ্বিমত পোষণ করে তাঁর বাবা জিন্নাহ পেছনে সরে গেলেন। পরিবারটি ইউরোপ সফরে বের হলো, তাঁরা অভিজাতদের সাথে মিশত।
গান্ধী ১৯২২ সালে কারাগারে গেলেন। এ প্রেক্ষাপটে রট্টি আর দিনা দেখলেন, তাদের অবহেলা করে জিন্নাহ ১৯২৩ সালের নভেম্বরে সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির নির্বাচনে অংশ নিলেন। এমনকি জিন্নাহ জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও জিন্নাহ আইন পরিষদে মুসলমানদের জন্য পর্যাপ্ত আসন সংরক্ষণ করার জন্য লড়াই করতে লাগলেন।
হায়দার জানিয়েছেন, রট্টি এবং ৯ বছরের দিনা এখন জিন্নাহর জীবনে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছিল না। রট্টির পক্ষে এমনটা মেনে নেয়া কঠিন ছিল। তিনি ১৯২৮ সালে বাড়ি থেকে তাজমহল হোটেলে সরে গেলেন। জিন্নাহ ব্যর্থ বিয়েতে তাঁর ভূমিকা মেনে নিলেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা আমারই ভুল : আমাদের মধ্যে কিছুটা উপলব্ধি সৃষ্টি হওয়া উচিত।’
জিন্নাহ ১৯২৮ সালে যখন বোম্বে ছাড়লেন, তখন মিসেস জিন্নাহ তাঁর মা-বাবার সাথে ইউরোপ পাড়ি দিয়েছেন। তখন জিন্নাহর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ছিল অনেকটাই অন্ধকারে। ব্যক্তিজীবনেও জিন্নাহ তখন ভয়াবহ রকমের নিঃসঙ্গ।
তিনি তখন ইংল্যান্ড যাত্রা করলেন। তাঁর জাহাজ যখন ইংল্যান্ডে ভিড়ল, তখন রট্টি আর দিনা অবস্থান করছিলেন প্যারিসে। সেখানেই রট্টি ভয়াবহ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে তাকে দেখতে প্যারিসে ছুটে যান জিন্নাহ। ওই সময় তাঁদের মধ্যে সমঝোতা হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু হয়নি। তাঁরা আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
এ দিকে জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবন আরো কঠিন হয়ে পড়েছে। গান্ধীর দ্রুত উত্থানে জিন্নাহ কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকেন। ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহরু (জওয়াহেরলাল নেহরুর বাবা) কলকাতায় নেহরু রিপোর্ট পেশ করেন। জিন্নাহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতাকে অগ্রাহ্য করার বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু তাঁর কথা শোনার গরজ কেউ অনুভব করেনি। তিনি নিজেই সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। বিদায়বেলা জামশেদ নওসেরওয়ানজিকে বলেছিলেন, ‘জামশেদ, এটা হলো আলাদা হওয়ার পথ।’
জিন্নাহ, পাকিস্তান অ্যান্ড ইসলামিক আইডেন্টিটি গ্রন্থে আকবর আহমদ বলেছেন, দিনা যদিও বারবার বলেছেন, তার মা রট্টি মারা গেছেন মলাশয় প্রদাহ বা এ ধরনের জটিল কোনো রোগে, তবে এটা নিশ্চিত মৃত্যুটি ঘটেছিল হজম-সংক্রান্ত রোগে। রোগটির কারণে রট্টিকে অসহ্য ব্যথা সহ্য করতে হচ্ছিল। একপর্যায়ে ওভারডোজে তাঁর মৃত্যু হতে চলেছিল। অনেকে এমনও বলে থাকেন, তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন।
জিন্নাহ যখন তাঁর রাজনীতি, আইনপেশার মারাত্মক জটিল অবস্থা মোকাবেলা করছিলেন, রট্টি তখন ভাঙা হৃদয়ে তাজমহল হোটেলে শুয়ে ছিলেন। মায়ের শেষ দিনগুলোতে দিনা তার পাশেই ছিলেন। দুই মাস পর মাত্র ২৯ বছর বয়সে রট্টি মারা যান।
দাফন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ উপস্থিত ছিলেন। তবে তাঁকে কবরে শুইয়ে দেয়ার সময়ও জিন্নাহ তাঁর রাজনৈতিক দুশ্চিন্তা নিয়ে কথা বলছিলেন। তবে কবরে একমুঠো মাটি দেয়ার সময় তিনি স্ত্রীর বেদনায় সত্যিই ভেঙে পড়েন। সবশেষ হয়ে যাওয়াটাই তাকে আঘাত করে। তাঁর হতাশ মনে যখন নতুন একটি দেশের ধারণার জন্ম দিচ্ছিল, তখন তাঁর ভালোবাসা অন্য জগতে বাস করার জন্য তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আর তাঁর প্রেমিকা উভয়ই তাঁকে পরাস্ত করে ফেলেছিল। ১০ বছরের দিনা দেখলেন, তাঁর বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
আকবর আহমদ লিখেছেন, ‘রট্টির মৃত্যু জিন্নাহকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। এটা ছিল তাঁর জন্য একটা যবনিকাপাত।’
জিন্নাহ তখন রাজনীতি ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি দিলেন। সাথে ছিলেন মাহীন দিনা এবং জিন্নাহর বোন ফাতিমা।
আট বছর পর তাঁর ১৯৩১ সালের যাত্রা সম্পর্কে আলিগড়ের ছাত্রদের জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘আমি তখন চরম অসহায় অবস্থা অনুভব করেছিলাম।’
তাঁরা হ্যাম্পস্টিডের একটি সুরম্য অভিজাত বাড়িতে ওঠেন। ‘দিনা সকালে বিছানার প্রান্তে বসা বাবার জন্য মর্নিং টি নিয়ে যেতেন। সকালের নাশতা হতো ৯টায়। শোফার জিন্নাহকে কিংস বেঞ্চ ওয়াকে তাঁর চেম্বারে নিয়ে যেত। শনি ও রোববার তাঁরা হাঁটাহাঁটি করতেন। দিনা তাঁর বাবাকে ভালোবাসতেন।
ভারতবর্ষে আবার রাজনীতি করার জন্য ১৯৩৩ সালে জিন্নাহ ফিরে আসেন। ইংল্যান্ডের বাড়িটি বিক্রি করে দেয়া হয়। দিনা চলে যান তাঁর মায়ের স্বজনদের সাথে বাস করার জন্য। জিন্নাহ ব্যস্ত হয়ে পড়েন রাজনীতিতে। সৃষ্টি হলো নতুন ইতিহাস।
মায়ের স্বজনদের সাথে বাস করার সময়ই নেভিলের সাথে দিনার পরিচয় হয়। নেভিল ছিলেন তাঁর চেয়ে আট বছরের বড়। জিন্নাহর অমতেই বিয়েটা হয়ে যায়। জিন্নাহ বিয়েটা গ্রহণ করতে পারেননি।
তাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে হয়। দিনা তাঁর মায়ের মতোই সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই তাঁরা আলাদা হয়ে যান, যদিও আনুষ্ঠানিক বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেনি।
১৯৪৭ সালে জিন্নাহ পাকিস্তান নামের নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। জিন্নাহর এই কৃতিত্বে দিনা খুশি হয়ে তাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। কিন্তু জিন্নাহর জীবিতকালে নতুন রাষ্ট্রে যাননি। অবশ্য বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে পাকিস্তান গিয়েছিলেন।
তবে ১৯৪৭ সালের ৭ আগস্ট নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রে যাওয়ার আগের রাতে জিন্নাহ তাঁর মেয়ে ও নাতি-নাতনীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁর স্ত্রী রট্টির কবরও জেয়ারত করেছিলেন।
দিনার ছেলে নুসলি ওয়াদিয়া খ্রিষ্টান হয়েছিলেন। পরে জরস্ত্রীয় ধর্মে ফিরে যান। তিন বোম্বের ধনী পারসি সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবেই জীবনযাপন করেন।

সংযোজনঃ

ইসলাম গ্রহণের আগে ইরানের পারসিকরা আগুনকে দেবতা-জ্ঞানে উপাসনা করত। ইসলাম-পূর্ব কালের অগ্নি-উপাসক ইরানীদের অধুনা-প্রায় বিলুপ্ত ধর্মের নাম ছিল জরাথুস্ট্রীয় ধর্ম। তাদের ধর্ম গ্রন্থের নাম ছিল জেন্দা-বেস্তা। সমগ্র ইরান বা পারস্য এবং পারসিক জাতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে অগ্নি-উপাসক সম্প্রদায়টি পালিয়ে ভারতে চলে আসে। বোম্বাই নগরীতে তাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ এখনও রয়েছে। নেহেরু-কন্যা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ ছিলেন এমনই একজন অগ্নি-উপাসক পারসিক।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:২৩
২৯টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×