somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেড়াল অথবা আত্মহত্যার গল্প-২

২০ শে আগস্ট, ২০১০ সকাল ১০:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১ম পর্বের লিংক গোল্লাছুটপর্বে প্রায় প্রতিবার একচুলের জন্য বেঁচে যায় বেড়ালটা; কিন্তু আশপাশের প্রায় সবগুলো রুমের দরজা বন্ধ থাকায় এবং ডাইনিং টেবিল ব্যতীত অন্য কোন বিশেষ আড়াল না থাকায় সে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারে না। ইতোমধ্যে বেড়ালের কমজোরি ফুসফুস হাঁফিয়ে উঠেছে, ধীরে ধীরে গতি শ্লথ হয়ে আসছে। পক্ষান্তরে ইলিয়াস আরো বেশি ক্ষীপ্র, আরো বেশি নিশানা-কেন্দ্রীক; শত্রুর পতন অবশ্যম্ভাবী। বেড়ালটা আত্মরক্ষার কোন পথ না পেয়ে অবশেষে মরিয়া, সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করে ছাদের উদ্দেশে; পেছনে ইলিয়াস, হাতে বাগিয়ে ধরা হকিস্টিক।
পরক্ষণেই দুপক্ষকে সিঁড়িঘরের খোলা দরজা পেরিয়ে ছাদে চলে যেতে দেখা যায়। জিঘাংসার ঘোরে মত্ত ইলিয়াসের একবারও মনে হয় না, এই এত রাতে সিঁড়ির দরজা খোলা কেন। কার্নিশহীন খোলা ছাদ, হু হু করছে জোসনা, এলোমেলো বাতাস; জোসনার ঢেউয়ে সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে গিয়ে বেড়ালটা বসে ছাদের শেষ সীমানায়; সীমান্ত, জীবন এবং মৃত্যুর। বসেছে সে এদিকে ফিরে, সামনে ক্রমাগ্রসরমান ঘাতক, পেছনে ঝুলছে শূন্যতা...
এখন দুইপক্ষ মুখোমুখি, মৃত্যু ছাড়া বেড়ালের সামনে আর কোন পথ নেই; ইলিয়াসের হকিস্টিক ধরা হাত মাথার উপর থেকে নিচের দিকে নামতে নামতে মাঝ-পথে থেমে যায়। কিছুক্ষণ সে তার কৌতুক ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে বেড়ালের ঘৃণাদগ্ধিত জ্বলজ্বলে চোখের দিকে; তারপর বেড়ালকে লক্ষ্য করে কেমন এক পরাবাস্তব কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘তোর সামনে এখন দুটো পথ, একটা হত্যার অন্যটা আত্মহত্যার। কোনটা নিবি?’
বেড়াল দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সরোষে জবাব দেয়, ‘মি-ও-য়া-ও-ও-’; কণ্ঠ তার মৃত্যুভয়-ক্লান্তি-দ্বেষ-ক্রোধে আধিভৌতিক
ইলিয়াস চাপা অথচ তীক্ষèকণ্ঠে হুংকার ছাড়ে, কোন পথ নিবি ব্লাডি বাস্টার্ড? আনছার মি...’। তার হকিস্টিক নিচের দিকে নামতে থাকে; ততক্ষণে বেড়ালটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়; দ্বিতীয় পথটাই উত্তম মনে হয় তার কাছে; সাই করে ঘোরে; শূন্যে লাফ দেয়। একটা ডিগবাজি খেয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন একটা শ্বাপদ-শরীর; নামতে নামতে এক পর্যায়ে হাইভোল্টেজ ইলেক্ট্রিক তারে পেঁচিয়ে যায় শরীরখানা; আর সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যার দৃশ্যটা একটা ভিন্নতর মাত্রা পেয়ে যায়; “দুম” করে কয়েকটা অগ্নি-স্ফুলিঙ্গের ধারা ছিটকে পড়ে নিচের সড়কে, তদসঙ্গে বেড়াল; “থপ” করে একটা আওয়াজ হয়।
ইলিয়াস মনে মনে বলে, আহ! কী চমৎকার আত্মহত্যা... ডাইং ইজ অ্যান আর্ট লাইক এভরিথিংএল্স। পেছনে হাসির শব্দ; কে হাসে এত রাতে খোলা ছাদে, হু হু করা জোসনায়? কোনও নারী? নারীকণ্ঠের হাসিই তো! নারী নাকি নারীর প্রেতাত্মা? নাকি পরী? জোসনায় নেমে এসেছে...
সিঁড়িঘরের অন্ধকার ছায়া থেকে এক পলকে চন্দ্রালোকে বেরিয়ে আসে গুলবাহার। ওদের কাজের মেয়েটা; কিন্তু ওর তো এখন কিচেনে দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর কথা; কাজের মেয়ের এত রাতে ছাদে কী? এসব কী হচ্ছে? ইলিয়াসের মাথার ভেতর ফ্লাইং সসারের মত উড়ে আসে একটা প্রশ্ন, এই চারদিকের মানুষগুলো এমন কি পশুকুল ক্রমাগত উদ্ধত হয়ে উঠছে- এর ফলাফল কী শুভ হবে?
গুল হাসতে হাসতে বলে, ‘ভাইজান, বিলাইডারে মারে ফালাইলেন?’
‘জ্বি। কিন্তু তুই এভাবে হাসছিস ক্যান?’
‘আপনে ঐডারে এমন করে মারলেন যেন আদমের বাচ্চা...’
‘আদমের বাচ্চার চেয়েও ওটা ভয়ংকর। আর আমি মারিনি তো, নিজেই আত্মহত্যা করেছে।’
এবার হে হে করে হেসে গুল বলে, ‘আত্মহত্যা? বিলাই আবার আত্মহত্যা করে না কি? ভাইজান আপনার কী মাথামুথা খারাপ হইসে?’
ইলিয়াস আবাক হয়ে লক্ষ্য করে, এই মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে তার কথা বলতে ভাল লাগছে; রক্তের মধ্যে ক্রোধের রাসায়নিকসমূহ থিতিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ...
গুল ফের বলে, ‘কাজটা আপনি ঠিক করলেন না। আপা বিলাইডারে বড় ভালোবাসতো!’
‘বাসতে পারে। বেড়ালটা ওর বন্ধু ছিল, আমার শত্রু। শত্রুকে বধ করাটাই হচ্ছে নিয়ম।’
‘এইডা আপনি কী কন! সব শত্রুরে আপনি মেরে সাফ করতি পারবেন? কেউ পারে। এট্টা কথা আছে, ঠগ বাছতে গা উজাড়। তয় তো দুনিয়াডাই উজার হয়ে যাবে।’
বাহ্, মেয়েটি তো চমৎকার কথা বলে। প্রায় ২ বছর ধরে আছে এ বাড়িতে গুলবাহার, ইলিয়াস কখনও ভাল করে লক্ষ্য করে নি; কেন? হয়তো লক্ষ্য করার প্রয়োজন পড়ে নি অথবা হয়তো সঙ্গত মনে হয় নি তার। তবে মায়ের কাছে শুনেছে, স্বামীর অতাচারে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে গুল। আচ্ছা ওর স্বামী ওকে কী ধরনের অত্যাচার করত? শারীরিকভাবে না কি মানসিকভাবে? না কি দুভাবেই? আচ্ছা গুলের স্বামীর কী গুল ছাড়াও এক বা একাধিক নারীর সাথে শারীরিক সংশ্রব ছিল? যদি তা থাকে, তবে সেটাই ছিল গুলের উপর ভাইটাল অত্যাচার- দুর্বিষহ এক মানসিক আগ্রাসন- এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই ইলিয়াসের।
‘তুই এত রাতে না ঘুমিয়ে ছাদে কী করছিস?’
‘ঘুম আসে না, ভাইজান...’
‘ক্যান?’
আপনি ও তো রাতে ঘুমান না, ক্যান?’
মেয়েটির কণ্ঠস্বর ক্রমাগত ধারালো হয়ে উঠছে; চাঁদের আলোতে মেয়েটা ছুরির ফলার মত চকচক করছে।
‘আমি ঘুমাই না কে বলল তোকে?’
কেউ বলে নাই, আমি জানি। আমার তো রাইতে ঘুম আসে না, তাই আমি টের পাই এ বাড়িতে কে ঘুমায় আর কে ঘুমায় না।’ ইলিয়াস ভেতরে ভেতরে টের পায়, এই চাঁদের আলো শুষে নিয়ে জ্বলজ্বল করা মেয়েটাকে তার বেশ লাগছে; শেলী’র “সোল সিস্টার” কিংবা জীবনানন্দ’র “হৃদয়ের বোন” এর মত লাগছে; আর শরীরের ভিটায় কী যেন নড়াচড়া করছে দুষ্টু ইঁদুরের মত। খুব খারাপ সিম্পটম; পালাতে হবে; চিরকাল যেমন পালিয়েছে; কিন্তু পালানোর আগে মেয়েটাকে আর একটু নাড়তে ইচ্ছে করে ওর।
‘তুই আর কী টের পাসরে গুল?’
‘অনেক কিছু।’
‘অনেক কিছু কী?’
‘সংসারডা মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি ধ্বংস হবে, আমি টের পাই।’ ইলিয়াস এবার সিঁড়ির দিকে পা চালিয়ে দেয়; পালানোটা এখন অনিবার্য। কিন্তু পেছন থেকে কামজ কণ্ঠে ডাক দেয় গুলবাহার, ‘ভাইজান কী চলে যান?’
‘হ্যা।’ একটু বেশিই জোর দিয়ে বলে ইলিয়াস; গতি তার ঈষৎ শ্লথ হয়ে আসে।

চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১০ সকাল ১১:৪১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×