মা আমি আসছি। ছয়টার বাসে উঠবো, চিটাগাং পৌঁছুতে রাত দুইটা কি তিনটা বাজবে। মা, তুমি কিন্তু ঘুমিয়ে যেও, আমার অপেক্ষায় আবার রাত জেগে বসে থেকো না। রাত জাগলে তোমার শরীর খারাপ করবে যে।
ঢাকা থেকে ফোন করে কথাগুলো রিফাত চিটাগাং তার মাকে বলছে। রিফাত জানে সে তার মাকে যতই রাত জেগে তার অপেক্ষায় বসে থাকতে না করুক, মা তার অপেক্ষায় ঠিকই বারান্দার ইজি চেয়ারটায় বসে থাকবেন। যত রাতই হোক রিফাত না আসা পর্যন্ত ঘুমাবেন না।
মিসেস রুবির স্বামী ফয়সাল সাহেব চিটাগাং এর বাসিন্দা। সরকারি চাকুরী করতেন, এখন রিটায়ার্ড করেছেন। এক ছেলে, এক মেয়ে, গত বছর এক এডভোকেটের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
ছেলে রিফাত পড়াশুনা শেষ করে ঢাকায় গ্রামীণফোন অফিসে ভালো একটা চাকুরী করছে ।
মা বাবা বিয়ের জন্য খুব করে বলছেন কিন্ত রিফাত রাজী হচ্ছে না, আরও একটু সময় চাইছে।
মা নাছোড়বান্দা, একা তার সময় কাটে না। রিফাতকে বিয়ে করিয়ে ঘরে বউ আনবেন। বউয়ের সাথে গল্প করবেন, আড্ডা দিবেন, টিভি সিরিয়াল নিয়ে ডিসকাস করবেন।
যেমন, 'দেব' কে কি 'সোনাকশি ' বিয়ে করবে? 'গোপির' খাবারে যে তার 'জা' বিষ মিশিয়ে দিল, এখন কি গোপি বাঁঁচবে? রাখির স্বামি যে তার অফিসের 'পিএস' এর সাথে পরকীয়া করছে, এটা কি 'রাখি' জানতে পারবে? মিসেস রুবি এসব নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করতে পারেন না। ফয়সাল সাহেব খেলা, খবর আর টক শো দেখেন। মিসেস রুবি দেখেন বিভিন্ন চ্যানেল এর নাটকের সিরিয়াল। দু'জন দু'জগতের....!
খুব সুন্দরী ও ভাল একটা পাত্রীর নাকি খোঁজ পেয়েছেন, রিফাতকে দেখানোর জন্য দু'দিনের ছুটি নিয়ে আসতে বলেছেন।
মা বললে যেতেই হবে, কোন অজুহাত চলবে না। নয়ত মা নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিবেন।
রিফাত তার নানুর মুখে শুনেছে, ছোট বেলা থেকেই তার মা নাকি খুব জিদ্দি। যখন যা বলবেন, না হলেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য 'হাংগার স্ট্রাইক' শুরু।
মায়ের হাংগার স্ট্রাইককে রিফাত খুব ভয় পায়। মা খাবার না খেলে হার্ট আর প্রেশারের ঔষধ খাওয়া হয় না, এতে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে যায়।
রিফাত মাকে খুব ভালবাসে, মা ও রিফাত বলতে অজ্ঞান।
মিসেস রুবি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করছেন। ফয়সাল সাহেব বার বার এসে বলছেন, "রুবি এখন রাত এগারটা বাজে ঘুমিয়ে যাও, রিফাত আসতে রাত দুইটা থেকে তিনটা বাজবে।"
মিসেস রুবি বলেন, "তুমি ঘুমাতে যাও, আমি আসছি।"
ফয়সাল সাহেব জানেন, যতক্ষণ রিফাত না আসবে তার স্ত্রী ঘুমাবে না। রিফাত আসার আগে প্রতিবার এমনই হয়....!
মিসেস রুবি ইজি চেয়ারে শুয়ে ছেলের অপেক্ষা করছেন। কল্পনার চোখে ছেলেকে বর সাজে দেখছেন। কিছুদিন আগে মিসেস রুবির ভাইয়ের ছেলের বিয়েতে, রিফাত বরের শেরওয়ানী পাগড়ী পরে ছবি তুলেছিল। সেদিন রিফাতকে বরের সাজে কি সুন্দর যে লাগছিলো! মায়ের চোখে এখনো ওই সুন্দর দৃশ্য লেগে আছে.....
কাল ছেলেকে নিয়ে পাত্রী দেখতে যাবেন, সাথে একটা আংটি নিয়ে যাবেন। রিফাত মেয়েকে পছন্দ করলে একবারে আংটি পরিয়ে বিয়ের তারিখ পাকা করে আসবেন।
ঢাকা থেকে বার বার আসাটা ছেলের কষ্ট হয়ে যায়।
মিসেস রুবি ছেলের বিয়ের কল্পনায় এত মগ্ন যে মোবাইলের রিং বাজছে টেরই পাচ্ছেন না।
অনেকক্ষণ পর মোবাইলের রিং টের পেয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখেন রিফাতের ফোন।
মা ফোন ধরে বললেন, "বাবা তোমার বাস কতদূর এলো?"
"আপনি কি আন্টি বলছেন?" ওপাশ থেকে অপরিচিত কন্ঠ ভেসে এলো।
রিফাতের মা বললেন, "তুমি কি বাবা রিফাতের বন্ধু, ও তো বলেনি কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসছে।"
না আন্টি, আমি আপনার ছেলেকে চিনি না তবে আমরা একই বাসে ছিলাম।
ওপাশের কথাগুলো শুনে মিসেস রুবির হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেলো, তিনি পাথর হয়ে বসে রইলেন....!
রিফাতের সিটের পাশের জানালাটা ভাঙা ছিলো, এক বৃদ্ধ লোকের সিট ছিল জানালার পাশে। বৃদ্ধ লোকটা খুব করে কাশছিল, রিফাত উনার সাথে নিজের সীট টা বদল করেছিল।
বলেছিল, "কাকা ভাঙা জানালা দিয়ে আপনার ঠান্ডা লাগছে, আপনি আমার সিটে বসুন। আমি আপনার জানালার পাশের সীটটায় বসছি।"
কিছুদূর যাওয়ার পর বাসটা ব্রেকফেল করে একটা গাছের সাথে ধাক্কা লাগে, তেমন কোন ক্ষয় ক্ষতি হয় নি। কিন্ত রিফাত ভাঙা জানালা দিয়ে ছিটকে বাইরে পড়ে আরেকটা গাছের সাথে ধাক্কা লেগে.......!
রিফাত ঐ বৃদ্ধলোকটার সাথে সিট বদল করেনি, সে যেন তার মৃত্যুকে বদল করেছে।
মায়ের দেখা ছেলেকে বিয়ে করানোর স্বপ্ন, বাসের জানালার কাঁচের মতই যেন ভেঙে টুকরো হয়ে গেলো......
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৮ দুপুর ২:২৯