পূর্বের সারসংক্ষেপ: কানাডিয়ান স্কুলের কাউন্সিলরের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করা হলো ফোনে। আমি নানা ধরণের প্রিপারেশন নিলাম এবং বাবা মার সাথে স্কুলে গেলাম।
পূর্বের পর্বগুলোর লিংক:
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (১) - প্রথমবার প্রবাসে প্রবেশের অনুভূতি!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (২) - জীবনের গল্প শুরু হলো এইতো!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৩) - সুখে থাকতে কিলায় ভূতে! (কুইজ বিজেতা ঘোষিত)!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৪) - বাংলাদেশ ভার্সেস কানাডার দোকানপাট, এবং বেচাকেনার কালচার! (কুইজ সলভড)!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৫) - কেমন ছিল কানাডিয়ান স্কুলে ভর্তি হবার প্রস্তুতি পর্ব?!
পূর্বের সিরিজের লিংক: কানাডার স্কুলে একদিন এবং কানাডার স্কুলে একেকটি দিন
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বাবা মা কে নিয়ে স্কুলের মেইনগেটের সামনে দাড়িয়ে আছি। হার্টবিট যেন ড্রাম বাজাচ্ছে জোরে জোরে! কাঁপা হাতে মেইন ডোরটা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ঢুকে এদিক ওদিক তাকাতেই ডানে একটা সাইনবোর্ড দেখলাম, "মেইন অফিস!" সেদিকে যেতে যেতে পথে দেখলাম বেশ কিছু হোয়াইট মেয়ে এবং একটি ব্ল্যাক মেয়ে গল্প করতে করতে আসছে। ব্ল্যাক মেয়েটি বিশেষভাবে নজর কাড়ছে। কেননা সে ভীষনই ফ্যাশেনবল; কোকড়া কালারড চুল, হেভী মেকআপ, হাতে অনেকগুলো ব্রেসলেট! লেস দিয়ে ডিজাইন করা স্টাইলিশ শর্টস্কার্ট পরে আছে! মেয়েটি এবং তার সঙ্গী সাথীদের পোশাক আশাক, ভাবসাব দেখে আমার মনে হলো না এটা কোন বিদ্যালয়! মনে হলো হলিউড মুভির সেটে চলে এসেছি! মেয়েটি নায়িকা, এখনই ডাইরেক্টর তাকে নির্দেশ দেবে সিন শুরু করার জন্যে!
ওদের দেখে আমার টেনশন মুহূর্তেই বহুগুণে বেড়ে গেল। যে স্কুলে মেয়েরা এমন পোশাক পরে, সেখানে আমি কিভাবে!? মায়েরও দেখি চোখমুখ শুকিয়ে গেছে, এখানে নিজের মেয়েকে কিভাবে ছাড়বে সে ভাবনায়!
মা আমাকে আস্তে আস্তে বলল, "কোনদিকে তাকাবি না, মিটিং এ কি কি বলবি সেটা ভাব শুধু!"
আমিও ভাবলাম ঠিকই, এখন আশেপাশের বিষয় নিয়ে টেনশন করা যাবেনা। আগে ভর্তি তো হই, পরে এদের মধ্যে কিভাবে সার্ভাইভ করব সেটা ভাবা যাবে।
মেইন অফিসে গিয়ে রিশিপসনিস্টের সাথে বাবা কথা বলল। আমাদের এপয়েন্টমেন্ট আছে জানালে তিনি কম্পিউটারে চেক করে অপেক্ষা করতে বললেন।
রিশিপসনিস্টের ডেস্কের সামনে সোফা ছিল। আমি আর বাবা মা সেখানে বসে অপেক্ষা করছিলাম। কিছুক্ষনেই বুঝতে পেরেছি স্কুলের সিলিং, ফ্লোর, পরিবেশ, মানুষ কোনকিছুই দেশের স্কুলের মতো না। অপরিচিত, অচেনা পরিবেশে টেনশন বেড়ে যাচ্ছে, নিজের হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি খুব ক্লিয়ারলি। নিজেকে সামলানোর জন্যে মনোযোগ অন্যদিকে নিতে হবে। তাই আমি পুরো অফিসটাতে চোখ বোলাতে লাগলাম।
ছিমছাম পরিপাটি অফিস। টাইলস দেওয়া ঘিয়ে মসৃণ, ঝা তকতকে ফ্লোরে নিজের চেহারাটি ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছি! সোফার দুপাশে আর্টিফিশিয়াল গাছ দেওয়া। সোফার সামনে একটি ছোট কাঁচের টেবিলে ছোট্ট ফুলদানি রাখা। অফিসটির একদম মাঝখানে রিশিপনিস্টের লম্বা ডেস্ক। ডেস্কের ওপরে ফোন, কম্পিউটার, একটা কাঁচের জারে অনেকগুলো আর্টিফিশিয়াল ফুল। ডেস্কের ডান এবং বাম পাশে দুটো গলি। বাম পাশে অনেকগুলো ছোট ছোট রুম অবস্থিত। রুমগুলোর দরজার ওপরে আঁটা নেম প্লেট দেখে বুঝলাম একটি প্রিন্সিপালের, একটি ভাইস প্রিন্সিপালের, একটি কাউন্সিলরের। পাশে আরো রুম আছে, আমার চোখ অতোদূর যেতে পারছেনা। রুমটির ডান পাশে একটি সরু গলি, সেখানে বিশাল একটি প্রিন্টার রাখা!
অফিসটির মানুষজনের যে নি:শ্বাস ফেলার সময় নেই তা ভালোই বোঝা যায়। রিশিপসনিস্ট লাস্ট পাঁচ মিনিটে পঁচিশটি ফোন এটেন্ড করে ফেলেছেন! অনেকেই হন্তদন্ত হয়ে প্রিন্টিং রুমে যাচ্ছেন, প্রিন্টকৃত পেপার নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন এমনভাবে যেন ট্রেইন মিস হয়ে যাবে এখনি! রিশিপসনিস্টের ডেস্কের সামনে স্কুলের বেশকিছু ছাত্রছাত্রী ভীর করেছে। নিজের নিজের সমস্যা বলছে।
রিশিপসনিস্ট নিজের মতো উত্তর দেবার চেষ্টা করছেন, কখনো কখনো প্রিন্ট নিতে আসা টিচারদেরকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করছেন। ভীষনই শান্ত ছিমছাম ডেকোরেশনের অফিসটি আসলে পুরো স্কুলের সকল সমস্যা মাথায় নিয়ে দাড়িয়ে থাকে!
এসব দেখতে দেখতে একজন শার্ট প্যান্ট পরিহিতা হোয়াইট, চিকন চাকন ফেস কাটিং এর নারী আমাদের সামনে এসে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম বলার পরে, তিনি জানালেন তার সাথেই আমাদের এপয়েন্টমেন্ট!
তিনি কি ভীষন মিষ্টি, অমায়িক একটা হাসি যে দিচ্ছেন প্রতিটি কথায়! আমার অনেকখানি চিন্তা শুধুমাত্র তার হাসিতে কমে গেল! তার গলার স্বরটা এত নরম যে স্পর্শ করার মতো কিছু হলে তুলার মতো মনে হতো! তখনো পর্যন্ত আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ইমপ্রেসিভ ব্যক্তিত্ব তিনি!
তিনি আমাদেরকে, "ফলো মি!" বলে একটা রুমে নিয়ে গেলেন।
সেই রুমটি ছোটখাটো বোর্ড রুমের মতো। মাঝখানে ডিজাইন করা লম্বা টেবিল, এবং চারপাশ দিয়ে লম্বা সব রোলিং চেয়ার। আমাদেরকে বসতে বলে নিজে বসলেন। তার হাতে পেন, ফাইল। আমি মনে মনে ভাবছি প্রশ্নপত্র ওরমধ্যেই আছে নিশ্চই! একেবারেই অফিস ইন্টারভিউয়ের মতো সেটিং! হে আল্লাহ! আমাকে সাহায্য করো!
উনি আমাকে আবারো নামটি জিজ্ঞেস করলেন, ঠিকমতো বলছেন কিনা জানতে চাইলেন। আমি একটু হেসে ইয়েস বললাম। তারপরে আমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলা শুরু করলেন। কানাডায় কতদিন হলো আছি, কেমন লাগছে কানাডা, আমরা কেন এলাম কানাডায় ইত্যাদি ইত্যাদি। ওনার কথার কিছু কিছু জিনিস বুঝতে না পারলেও খেয়াল করে শুনে আমি মোটামুটি ধরতে পারছিলাম। হয়ত কমন সব প্রশ্ন করছিলেন বলে বা ওনার আস্তে আস্তে নরম স্বরে কথা বলার ভঙ্গিমায়!
বাবা সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, আমি আর মা চুপচাপ বসে আছি। এসব ভদ্রতাপূর্ণ কথা শেষ করে, তিনি বললেন যে, "আপনারা ভর্তির জন্যেই এসেছেন বোধ করি?" বাবা তখন সাথে সাথে হ্যাঁ বলল।
উনি বললেন, "এক্সিলেন্ট! আমরা ওকে স্টুডেন্ট হিসেবে পেয়ে খুশি হবো!"
আমি অবাক! বলে কি! পরীক্ষা হলো না কিছুনা, কেমনে কি? কিছু ভুল বুঝেছি নিশ্চই!
বাবা তাড়াতাড়ি করে মায়ের কাছ থেকে আমার দেশের স্কুলের সার্টিফিকেট ওনার হাতে দিলেন। উনি সেগুলোতে আলতো করে চোখ বোলালেন। যেন ওনার দরকারই নেই, আমরা কষ্ট করে এনেছি বলে দেখলেন ব্যাস!
তারপরে নিজের ফাইল থেকে একটা কাগজ বের করলেন, আমি ভয় পেয়ে গেলাম। টেস্ট! মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছি।
খেয়াল করে দেখি, ব্ল্যাংক পেপার! সেই পেপার নিয়ে উনি আটটি সাবজেক্টের নাম লিখলেন। আমি মনে মনে ভাবছি এইসব বিষয়ে পরীক্ষা নেবে!?
উনি বললেন, আমাদের বছরে দুটো সেমিস্টারে চারটি করে সাবজেক্ট নিতে হয়। আমার মনে হয় প্রথম সেমিস্টারে এই চারটি সাবজেক্ট ওর জন্যে ভালো হবে। সাবজেক্টগুলো হচ্ছে: সমাজবিজ্ঞান যাতে প্রচুর ইংলিশ থাকে, আরেকটি ইংলিশ, জিম ক্লাস এবং ম্যাথ। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ডু ইউ লাইক দিস প্ল্যান?"
আমি একটু নার্ভাসভাবে বললাম, হ্যাঁ!
বাবা আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, "ম্যাম, ওর জন্যে এখনি সোশাল স্টাডিসটা কঠিন হয়ে যাবে। এখন সাইন্স রিলেটেড কিছু হলে ভালো হতো। দেশের পড়ার সাথে মিল পেত। ইংলিশ একটু ইমপ্রুভ করলে পরের সেমিস্টারে নিতে পারে সোশাল স্টাডিস!"
তিনি তখন একটু চিন্তা করে বললেন, "আমার মনে হয় ওর জন্যে এটাই ভালো হবে। ইংলিশ শেখাটা তো জরুরি। ইংলিশের পাশাপাশি সোশাল স্টাডিসেও ইংলিশ চর্চা করতে করতে ও সহজে ধরে ফেলতে পারবে ভাষাটি! একটু স্ট্র্যাগল করতে হলেও, যতো তাড়াতাড়ি ও শিখতে পারবে সামনে ততোই ভালো করবে! তারপরেও আপনারা চাইলে আমি সোশাল স্টাডিসের বদলে সাইন্স দিতে পারি, সমস্যা নেই।"
বাবা কি করবে বুঝতে পারছেনা, মা বাবাকে কি যেন ইশারা করল। বাবা সাথে সাথে বলল, "ইউ নো বেটার! আমাদের সমস্যা নেই!"
উনি তখন আন্তরিকভাবে হাসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ইউ আর নাও এ পার্ট অফ আওয়ার ফ্যামিলি! ওয়েলকাম টু আওয়ার স্কুল!
আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা। এত সহজে আমি ভর্তি হয়ে গেলাম! স্কুলের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে গত করাতে নানা স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন দেখেছি। বাস্তব অভিজ্ঞতাটি আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নটার চেয়েও সুন্দরভাবে এগোচ্ছে! এত ওয়েলকামিং মানুষ যে স্কুলে আছে, সেখানে আমি পড়তে পারব! বিশ্বাসই হয়না!
মা ইংলিশে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, এজন্যে বাইরে গেলে চুপচাপ বসে থাকে। তবুও সেদিন ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংলিশে একটা কথা জিজ্ঞেস করল কাউন্সিলরকে। আমার পরনে থাকা সালোয়ার কামিজটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল আমি অমন পোশাক পরে ক্লাস করতে আসতে পারব কিনা?
কাউন্সলির হেসে কোন ব্যাপারই না এমন ভাবে হাত নেরে বললেন, "এবসোলুটলি! নো প্রবলেম! আমাদের স্কুল একটি ইন্ট্যারন্যাশনাল স্কুল! এখানে কোন ইউনিফর্ম নেই। প্রায় তিরিশটিরও বেশি দেশের ছাত্রছাত্রী এখানে পড়ে। প্রতিটি স্টুডেন্টেরই নিজস্ব কালচারে চলার স্বাধীনতা আছে। ওর কোন অসুবিধাই হবেনা।"
মা এবং আমি তখন এমনভাবে হাসলাম যেন আমাদের মাথার ওপর থেকে একটা আস্ত পাহাড় নেমে এসেছে! যেদিন থেকে কানাডায় আসব জেনেছি, সেদিন থেকে পোশাকের ব্যাপারে খুবই ভয় ছিল। আমার ছোটমনের ভয়কে কানাডিয়ান মহিলা বিশাল মনে তাড়িয়ে দিলেন!
তারপরে উনি আমার দিকে তাকিয়ে, প্রাণবন্ত হাসি দিয়ে, ফট করে চেয়ার থেকে উঠে বললেন, "হেই লেটস গো! তোমাকে পুরো স্কুলটি ঘুরিয়ে নিয়ে আসি! জরুরি কিছু মানুষের সাথে পরিচয় করাই!"
তারপরে বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আপনারাও জয়েন করতে চান!?"
আমার বাবা বলে ফেলল, "না, ঠিক আছে, আপনি ওকে নিয়ে যান, আমরা এখানে ওয়েট করি?"
উনি বললেন, "নো প্রবলেম!"
তারপরে আমাকে ফলো করতে বলে সামনে হাঁটা শুরু করলেন। আমার মা তখন পারলে আমার বাবাকে গিলে খায়। মায়ের চোখ বলছে, একা একা ওকে কেন ছাড়তে গেলে? আমিও বাবার দিকে তাকিয়ে একই লুক দিলাম। বাবা হুট করে বলা কথাটার রেজাল্ট বুঝতে পেরে নিজেও থতমত খেয়ে গেল। বিদেশী মানুষটার সামনে যদি তারা পাশে থাকত তবে আমি সাহস পেতাম। এতক্ষন তো বাবাই আমার হয়ে সব কথা বলছিল, আমি ইয়েস নো ছাড়া তেমন কিছু বলিনি। উফফ! এক চিন্তা যেতে না যেতেই আরেক চিন্তার মধ্যে পরলাম। জীবনে প্রথম এক বিদেশীর সামনে একদম একা হয়ে গেলাম! এখন কিভাবে সামলাবো? কাউন্সিলর তো বকবক করেই যায়! একটার পর একটা প্রশ্ন করবে। বুঝে উত্তর দিতে পারব তো? কেমনই বা হবে আমার স্কুলটি; এর অলিগলি, ক্লাসরুম, ক্যাফেটেরিয়া!? কার কার সাথে পরিচয় হবে আজ?
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আজকে এখানে শেষ। পরের পর্বে আপনাদেরকে বিদেশ বিভুঁইয়ে আমার সবচেয়ে আপন জায়গা হয়ে ওঠা স্কুলটি ঘুরে ঘুরে দেখাব!
পাঠকের জন্যে কুইজ: এত সহজে ওনারা কেন আমাকে স্কুলে ভর্তি নিয়ে নিলেন? যিনি সবচেয়ে গুছিয়ে সঠিক উত্তরটি দিতে পারবেন তিনিই জয়ী হবেন।
কৌতুহলী পাঠক, ৩০ এবং ৩১ নাম্বার মন্তব্য চেক করে নেবেন কুইজের উত্তর জানতে হলে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৮ সকাল ৯:৩১