somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কম খরচে আবার ভারত পর্ব-৬ ( আধিক্য কালকা থেকে সিমলা টয় ট্রেন-১)

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
অন্য পর্বগুলো




কালকা স্টেশনে ট্রেন পৌছালো সকাল আটটার দিকে। ট্রেন থেকে নেমেই আমি দৌড় দিলাম। আমার এই ট্যুরের মূল উদ্দেশ্যটা ছিলো কালকা থেকে সিমলা যাবার টয়ট্রেনটা ঘিরে। এমনিতেই ট্রেনের প্রতি আমার একধরনের দুর্বলতা আছে। আমি চেয়েছিলাম ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠা ছোট ছোট বগির এই খেলনা ট্রেনটি উপভোগ করতে।



ব্রডগেজ ট্রেন থেকে নেমে কিছুটা হেটে ন্যারো গেজের এই স্টেশনটাতে যেতে হয়। কিছুদূর দৌড়ে যাবার পর সন্দেহ হতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার পিছনে সেতু আর নিয়ন নেই। তারা তখন ট্রেন থেকে নেমে ফটোসেশনে ব্যাস্ত। থাকুক তারা তাদের মতো! এগিয়ে গেলাম আমি সামনের দিকে। ন্যারো গেজের স্টেশনে পৌছে দেখি বেশ কয়েকটি টয় ট্রেন দাড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একটি কালকা মেইল ট্রেনটির সাথে সংযুক্ত। অর্থাৎ কালকা মেল ট্রেনটি পৌছালে এই টয় ট্রেনটি সিমলার উদ্দ্যেশে ছেড়ে যাবে। যেহেতু এই সংযুক্ত টয় ট্রেনটির সবগুলি আসন চেয়ার, এজন্য আমি এই ট্রেনটির টিকিট কাটিনি। কারণ আমি বেঞ্চওয়ালা কোন সিটে যেতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগলাম।

এর আগে আমি দার্জিলিঙের টয় ট্রেনে চড়েছি। দার্জিলিঙের টয় ট্রেন ছিল নীল রঙের। কিন্তু সিমলা যাবার টয় ট্রেনগুলি হলুদ আর লালে মেশানো। ১১০ বছরেরও বেশি পুরানো এই রেলপথে কালকা থেকে সিমলা পর্যন্ত পাহাড়ি ৯৬ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৫ঘন্টা। মাত্র ২ফুট ৬ইঞ্চি চওড়া রাস্তায় চলাচলকারি ট্রেনগুলিও খুব ছোটছোট। এই ৯৬ কিঃমিঃ যাত্রাকালে টয়ট্রেন ৮৬৪টি ব্রীজ আর ১০২টি সুড়ঙ্গ পাড়ি দেয়। ব্রীজগুলি খুব সুন্দর সুন্দর ঢেউ খেলানো খিলান দিয়ে তৈরি। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে এর যাত্রাপথ। তার বর্ণনা একটু পরে দিচ্ছি।



স্টেশনে দাঁড়ানো অবস্থায় ‘রেল মটর’ টয় ট্রেনটি দেখলাম। ট্রাকের মতো দেখতে একবগির ছোট্ট একটি ট্রেন এটি। এই ট্রেনে মোট সিটের সংখ্যা ১৪টি। খুব ইচ্ছা ছিল এই টয় ট্রেনটিতে চড়ার। কিন্তু এটার টিকিট নাকি অনেকদিন আগে কাটতে হয়। ‘রেল মটর’ ট্রেনে চেপেই নাকি ব্রিটিশ আমলে বড়লাট আর ছোটলাট ভারতের তৎকালীন গ্রীষ্মকালিন রাজধানী সিমলাতে যাতায়াত করতো। ইন্দিরা গান্ধীও নাকি বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে এই ট্রেনে চড়েছে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য ছোট্ট এই ট্রেনটিতে বড়বড় জানালা রয়েছে। এমনকি এই ট্রেনের ছাদটিও কাঁচের তৈরি।



আমি ঘুরে ঘুরে ট্রেনগুলি দেখছি এমন সময় সেতু আর নিয়ন হাপাতে হাপাতে সেখানে এলো। তারা খোঁজ খবর নিয়ে এসেছে যে কোথা থেকে টয়ট্রেনের টিকিট কাটতে হবে। আর টিকিট কাটার জন্য আমকেই যেতে হবে। কারন সেখানে কালকা মেইলের যাত্রীদের টিকিট চেক হচ্ছে। সেতু আর নিয়ন যেহেতু দিল্লী থেকে কালকা পর্যন্ত বিনা টিকিটের যাত্রী সেহেতু ওখানে গেলে তাদের খবর আছে। অগত্যা আমিই গেলাম টিকিট কাটতে। অসংরক্ষিত বগির টিকিট জনপ্রতি ৫০রুপি করে।



টিকিট কেটে নির্দিষ্ট বগি খুঁজে বের করে দেখি বগি পুরো ফুল হয়ে আছে। নিয়ন তারই মধ্যে একটা বসার জায়গা খুঁজে পেল। আমি কোনরকমে আমার ব্যাগটা রাখতে পারলাম। তারপর আমি আর সেতু নামলাম আশপাশ ঘুরে দেখার জন্য। সেতু নাকি মোবাইলে টাকা রিচার্জ করবে। ট্রেন থেকে নেমে সে সোজা হাঁটা শুরু করলো। আমি যতোই বলছি যে এদিক দিয়ে বের হওয়া যায়না, সে আমার কথা না শুনে সেইদিকে গিয়ে ট্রেনের গুদাম ঘরে উপস্থিত হলো। পায়ে কালি মেখে সেখান থেকে বের হবার পর তার আবার প্রসাব পেয়ে গেল।স্টেশনের টয়লেটে যাবার সময় তার আবার একজনের সাথে আলাপ হয়ে গেল। টয়লেটে না গিয়ে সে ততোক্ষণে লোকটির সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে।

লোকটা একজন ভারতীয় বাঙালি আর্মি। ছুটিতে বাড়িতে যাবার জন্য কালকা স্টেশনে এসেছে ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে। সেতুর সাথে তার বিরাট খাতির হয়ে গেল। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব দেখছি। আর্মি লোকটা আমাদের বোঝাচ্ছে যে কেন টয় ট্রেনে সিমলা যাওয়া উচিৎ নয়। বাসে করে গেলে ভাড়া একটু বেশি পড়বে কিন্তু খুব দ্রুত পৌছে যাওয়া যাবে। খামাখা আস্তে আস্তে ট্রেনে যেতে হবে কেন? ট্রেনে যেতে কমপক্ষে ৬ঘন্টা লাগবে। আর বাসে বা জীপ গাড়িতে গেলে খুব আরামে যাওয়া যাবে, আরো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার লাদাখে যাওয়ার খুব ইচ্ছা, কিভাবে সেখানে যাওয়া যায় জিগ্যেস করাতে সে বললো প্লেন ছাড়া নাকি সেখানে যাবার কোন উপায় নেই। তারপর সে আমাকে বোঝাতে লাগলো কিভাবে প্লেনে যাওয়া যায়। তারপর মানালি কিভাবে যাওয়া যায় তাই বোঝাতে লাগলো। সে যদিও মানালি তো দূরে থাক সে সিমলাতেও কখনো যায়নি তবুও এই এলাকাগুলো সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান। কারণ সে একজন আর্মি।

সেতু দেখি আর্মি ব্যাটার পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে আমার উপর ঝাড়ি দেয়া শুরু করলো। কেন আমরা বাসে না গিয়ে টয় ট্রেনে যাচ্ছি? তো আমি তখন তাকে বোঝালাম যে, আসলেই বাসে যাওয়া বেশি লাভজনক।সেতুরা যেন টয় ট্রেনের টিকিট ফেরত দিয়ে বাসে করে আগে আগে সিমলা চলে যায়। আমি টয়ট্রেনে করেই ধীরে ধীরেই সিমলা যাবো। কারন সেটাতে চড়ার জন্যই আমি কলকাতা থেকে কালকা পর্যন্ত ৩৮ ঘন্টা জার্নি করে এসেছি। আমাদের দুজনের এসব কথার মধ্যেই আর্মি ব্যাটা শুনলো যে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তার চেহারা একেবারে বদলে গেল। সে ভেবেছিল আমরা বুঝি কলকাতা থেকে এসেছি। কিন্তু বাংলাদেশী শুনে কেমন যেন রুক্ষ আর কঠোরভাবে দুয়েকটি কথা বলে মালপত্র উঠিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে চলে গেল, যেন আমরা খুব অচ্ছুৎ কোন প্রাণী। শালা বাঞ্চোত ইন্ডিয়ান আর্মি! আর্মি ব্যাটার হঠাৎ এরুপ আচরণে সেতু কিছুটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। সে তখন আমার পিছু পিছু টয়ট্রেনে গিয়ে উঠলো। তারপর নিয়নের সিটে গিয়ে একটু জায়গা বের করে গাদাগাদি করে বসলো। আর আমি গিয়ে দাড়ালাম ট্রেনের দরজায়।



নটার দিকে ট্রেনটা ছেড়ে দিলো। আর তক্ষুণি ঘন সবুজ জঙ্গলে হারিয়ে গেল এটি। একে বেঁকে পাহাড়ি পথ দিয়ে ঘুরে ঘুরে ট্রেনটি উঠছে। দুপাশের দৃশ্য এতো মনোরম যে বলার মতো না। প্রথম দিকে দুধারে কিছু ছোট ছোট পাহাড়ি বাড়ি ঘর ছিল। কিন্তু কিছুদূর পর সেগুলো উধাও হয়ে গেল। কখনো একপাশে উচু পাহাড় আর অন্যপাশে গভীর খাদ। আবার কখনো ছোট ছোট ঝরণা। আবার কখনো গিরিখাদের মধ্য দিয়ে ট্রেনটি খুব আস্তে ছুটে চলেছে। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটি এতো উপরে উঠে এলো যে নিচের বাড়িঘর আর গাড়িগুলোকে খেলনার মতো দেখাচ্ছে। আমি আবার ট্রেনের দরজার পাদানিতে বসতে গেলাম। ট্রেনের গার্ড বিকট শব্দে হুইসেল বাজিয়ে সকল যাত্রীকে সচকিত করে আমাকে সেখান থেকে উঠিয়ে দিলো। যাই হোক, ট্রেন রাস্তাটি সাপের মতো পেচিয়ে পেচিয়ে উঠছে। ফেলে আসা পথটিকে পায়ের নিচে দেখতে পাচ্ছি। আমার এখনো পর্যন্ত চড়া সবচেয়ে আকর্ষণীয় রেলপথ এটি। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে দার্জিলিঙের টয় ট্রেন পথটি এর কাছে কিছুই না। আমি পুরোপুরি মুগ্ধ।




কিছুক্ষণ পর থেকে সুড়ঙ্গগুলি শুরু হলো। ট্রেন যখন অন্ধকার সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে তখন ট্রেনের মধ্যে লাইট জ্বলে ওঠে। আসলে লাইট সবসময়ই জ্বলে, কিন্তু অন্ধকার সুড়ঙ্গে না ঢুকলে তার অস্তিত্ব প্রকাশ পায় না। তবে যখনই ট্রেন কোন সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে তখন সব যাত্রী আনন্দে একসাথে চিৎকার শুরু করে দেয়। তাদের এই আনন্দধ্বনি দেড় থেকে দু মিনিট ধরে চলে। কারণ একেকটি সুড়ঙ্গ পার হতে সেরকম সময়ই লাগে।


পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১৯
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×