১. সৈয়দ হক লিখে গেছেন, ‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়, যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালের আলখেল্লায়;’ কিন্তু নির্মম হলেও সত্য, ইতিহাসে আরও অনেক কিছুর সাথে 'একজন দলদাশ' হিসেবেও মি. হককে মূল্যায়ন করতে হবে। সামাজিক সভ্যতার কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতে হবে। বিশ্লেষিত হতে হবে, পছন্দের কাছে বুদ্ধি ও বিবেককে বিকিয়ে দেওয়ার চুলচেরা।
২. সৈয়দ হক তার ভাষায় মৌলবাদবিরোধী, প্রগতির পক্ষের লড়াকু সৈনিক ছিলেন। তিনি আর যাইহোক, ছাত্রলীগের কবি ছিলেন না। তার মৃত্যুর পর ছাত্রলীগ কর্মীরা বুঝে বা না বুঝে ফেসবুকে যা করেছে তা একজন সৃষ্টিশীল স্রষ্টাকে অপদস্থ ও উপহাস করার শামিল।
৩. আমি বারবার আশংকা করি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ব্যর্থতায় দেশ যদি কখনো কোন চরমপন্থী বা মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে চলে যায় তাহলে ভয়াবহ বিপদ নেমে আসবে। হকের মতো একজন বিদগ্ধ মানুষের মৃত্যুতে সেই চেতনাধারীদের উল্লাস আমাকে আরও উদ্বীগ্ন করে দিয়ে গেছে। বাংলার যে নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বভাব একটি গোষ্ঠী তা আজও বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না। ফলে তারা সবকিছু ধর্মীয় বা নিজস্ব চিন্তার চোখে দেখছে। তাদের এই দেখার ও বোঝার প্রবণতা আত্মঘাতি, ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক।
৪. সবকিছু ছাড়িয়ে হকের পরিচয় তিনি একজন লেখক। একজন লেখক হিসেবে তার আপাত সফলতা স্পষ্ট ও ইর্ষণীয়। একজন মানুষ হিসেবে তিনি নানাভাবে, নানাজনের কাছে চিত্রিত হতে পারেন। আমরা সেসব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতে পারি।
তবে তা করার পূর্ব শর্ত হচ্ছে, সবার আগে মি. হকের সৃষ্টিকে মূল্যায়ন করা। হক এই জনপদের জ্ঞানী মানুষদের অন্যতম এটা মানলেই বিতর্ক হতে পারে। নইলে তা শুরুতেই কু’তর্ক হিসেবেই আখ্যায়িত হবে। হকের বেলা রাষ্ট্রের যে ভূমিকা তার প্রতি সাধুবাদ রইল।
হককে নিয়ে সাহিত্য সমালোচকদের যতটা আগ্রহ ততটাই তাকে জানতে অনীহা ছিল সাধারণ মানুষের। তিনি আসলে শিক্ষিত মানুষের কবি ছিলেন, সাধারণ মানুষের কাছে তার লেখা সেভাবে পৌছায়নি। একজন ভালো লেখক হওয়ার জন্য জনপ্রিয়তা কোন মাপকাঠি না। আবার সাধারণ মানুষের গ্রহণ বর্জনেও একটা লেখার মান নির্ধারণ হয় না। শেষ কথা হচ্ছে, হকের অবস্থান নির্ধারণ করার জন্য ভবিষ্যততো পড়ে রইলই।
৫. ২০১০ সালে হকের সাথে প্রথম পরিচয় আমার। তবে কখনো ওইভাবে মেশার সুযোগ পাইনি। আর একজন প্রবীণ লেখকের জন্মদিনের দাওয়াত কার্ড পৌছে দিতে তার বাসায় গিয়েছিলাম। সেসময় দেখেছি দেশের নবীন-প্রবীণ লেখকেরা কতটা সম্মানের চোখে দেখেন হককে (এখানে আদর্শগত কারণও বিবেচনায় আসতে পারে) । তার সৃষ্টিকে স্বীকৃতি দেন। তাকে নিয়ে অল্প জানলেও হকের সৃষ্টিতে আমি মুগ্ধ শুরু থেকেই। তবে তার ব্যক্তিত্ত্ব আমার কাছে প্রশ্নবীদ্ধ। বুদ্ধিজীবীদরে ব্যক্তিসত্তার যে উজ্জ্বল ইতিহাস আমরা ইতিহাসে পাই তা তিনি নানা কারণে বিকিয়ে দিয়েছিলেন বলেই আমার মনে হয়।
৬. যে জনপদে জ্ঞানীদের সম্মান করা হয় না, সে জনপদে জ্ঞানীরা জন্মানো বন্ধ করে দেয়। অন্যদেশের ছোট কাহিনী দিয়ে শেষ করি। তুরস্কের বর্তমান সরকারের সাথে নোবেল বিজয়ী উপন্যাসিক ওরহান পামুকের বিরোধ তুঙ্গে। কিন্তু এই তুরস্কে যখন বিদেশিরা আসে তখন আরও অনেক কিছুর সাথে এটা পামুকের দেশ বলে বিদেশিদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়!
এখানে ব্যক্তি পামুককে ছাড়িয়ে যায়, পামুকের সৃষ্টি, স্রষ্টা পামুক। আমাদের দেশেও একদিন এই চর্চা বহুলভাবে চর্চিত হবে সেই আশা রইল।