somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি শ্বাসরুদ্ধকর বিমান ভ্রমণ - আসাদুজ্জামান সেলিম

২৩ শে মার্চ, ২০১৮ ভোর ৫:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(কৈফিয়তঃ আমি সাধারণতঃ অন্য কারো লেখা কপি করি না। এই লেখাটি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু আসাদুজ্জামান সেলিমের নিজের জীবনের। বন্ধুটি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে প্রবাসী। লেখাটি পড়ে আমার মনে হয় সবারই ভালো লাগবে।এটি তার ফেসবুকের দেয়াল থেকে সংগ্রহ করা )

পর্ব- এক

আজ সকাল থেকেই নেপালে বিমান দুর্ঘটনার সব খবর পড়ার চেষ্টা করলাম। কাল রাত থেকেই মনটা আবারও বিশেষ রকমের খারাপ হয়ে আছে। গত এক মাসেও ঘটনাটা লিখতে গিয়েও লিখতে পারিনি, এই খারাপ লাগার জন্যই।কিন্ত এই দুর্ঘটনা আবারও আমাকে ফিরিয়ে নিয়েছিল সেই ৭ই ফেব্রুয়ারীর এসকিউ ৪৪৯ ফ্লাইটে।আমরাও হয়ে পারতাম এমন একটি সংবাদের শিরোনাম, আল্লাহ্ অশেষ রহমতে বেঁচে ফিরেছিলাম সেদিন।দিনটা অন্যান্য দিনের চেয়ে বরং একটু বেশীই সুন্দর ছিল, মেঘ মুক্ত হালকা শীতের সকাল, সোনালী রোদ। সবকিছুই স্বাভাবিক ভাবেই আগাচ্ছিল, আমার পরিবারের প্রিয় মানুষ গুলোই এসেছিল এয়ারপোর্ট এ বিদায় জানাতে। আদনানের আম্মা আমাদের মানে আমার এবং আমার মেয়ের সাথে সিডনি তে যাওয়ার কথা তার সাথেও যথারীতি দেখা হয়েছিল। আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল ঢাকা এয়ারপোর্ট এর দায়িত্ব প্রাপ্ত এস পি শরীফ। দুই বন্ধু মিলে ছবিও উঠিয়েছিলাম এবং তা যথারীতি পোস্টও দিয়েছিলাম ফ্লাইয়ের আগে শেষ পোস্ট হিসেবে। আমার বন্ধুর মুখেই শুনেছিলাম ভি আই পি পাসিং( সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট)এর জন্য আমাদের প্লেন ছাড়তে এক ঘণ্টা দেরী হবে, হয়েছিলও তাই। এখানে বলে রাখা ভাল যে, ২০০৭ সন থেকে বিদেশে যাতায়াত করা আমি প্রায় প্রতি বছরই একবার বা একের অধিক বার দেশে এসেছি। সে হিসেবে আমি কমপক্ষে ৫০ বারের(অন্যান্য দেশ সহ)অধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট করেছি। প্রতি বারই যখন ঢাকা ছেড়ে যাই প্রিয় শহর টিকে বার বার প্লেন এর জানালা দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দিনটা এত পরিষ্কার ছিল যে জানালা দিয়ে আমার মেয়েকে সি এম এইচ হাসপাতালের বিল্ডিং টা পর্যন্ত দেখিয়েছিলাম কারণ তার ঠিক পিছনেই ছিল আমাদের বাসা। সুন্দর উড্ডয়নের পর প্লেন সুন্দর ভাবেই এগোচ্ছিল, যথারীতি নিদিষ্ট উচ্চতায় উঠার পর বিমানবালারা গরম রুমাল দিয়েছিল। একটু পর তাঁরা আমাদের ড্রিঙ্কস দিয়েও গিয়েছিল। সিঙ্গাপুর যেতে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশী লাগে না যার প্রায় ৫০ মিনিটস চলে গিয়েছিল, প্লেন টা তখন সাগরের উপর দিয়ে যাচ্ছিল। আমি এয়ারলাইন্সের বইয়ে ঘুম ঘুম চোখে চোখ বুলাচ্ছিলাম কোন মুভি দেখা যায় কিনা। ২৯৭ জন যাত্রী নিয়ে ৩৩০০০ ফুট উপরে থাকা বিমানটি হঠাত বিকট শব্দে বিশাল ঝাঁকুনি মেরে আমাকেসহ সব যাত্রীদের জাগিয়ে তুলে সকল মনোযোগ কেঁড়ে নিল। এতদিনের প্লেন জার্নির অভিজ্ঞতা থাকায় আমার আর বুঝতে বাকী রইল না যে এটা স্বাভাবিক কোন শব্দ/ ঘটনা নয়। আমাদের সীট ছিল সামনের দিকে, বিশাল বড় প্লেনটার পিছনের বাম দিক থেকে কিছু শোরগোল ভেসে আসছিল। তখনো টের পাইনি কি সময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
(সময় সল্পতায় লিখাটা শেষ করতে পারলাম না বলে দুঃখিত, বাকী অংশ পরের পোস্টে শেয়ার করা হবে)


পর্ব - দুই


আহা জীবন
( বিমান দুর্ঘটনার সময়ের আমার ব্যক্তিগত অনুভুতির পরের অংশটুকু)

পরে শুনেছিলাম পিছনের বাম দিকে যারা বসেছিলেন তাঁরা জানালা দিয়ে বাম দিকের ইঞ্জিনে আগুন জ্বলতে দেখেছিলেন বলেই শোরগোল টা উঠেছিল।
কিছুক্ষন পর সে শোরগোল টা থেমেও গেল কিন্ত প্লেনটি এত উপরেই অস্বাভাবিক শব্দের সাথে কাঁপতে শুরু করল। ক্রমেই এই অস্বাভাবিক শব্দ বাড়ার সাথে সাথে কাঁপনীটা ঝাঁকুনি নিতে পরিনত হতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথম দিকে কেহ কেহ কিছু বলার চেষ্টা করলেও ঘটনার ভয়াবহতা টের পেয়ে সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। এর মধ্যেই পাইলটের প্রথম কথোপকথন এয়ারে ভেসে এলো। পাইলট স্পট করেই বললেন যে, বাম পাশের ইঞ্জিনটায় সমস্যা দেখা দেওয়ায় আমরা বন্ধ করে দিয়েছি, আমরা এখন ইমারজেন্সী ল্যান্ডিং এর জন্য ঢাকার সাথে যোগাযোগ করছি।সেইসাথে তিনি সবার সহযোগীতা চাইলেন। আমার কাছে মনে হচ্ছিল এত ঝাঁকাতে থাকা প্লেন উনি কোন অবস্থাতেই ঢাকা পর্যন্ত নিতে পারবেন না, পথেই ক্রাশ করবে। আমাদের শুধু শুধু সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
(এখানে বলে রাখা ভাল যে পরবর্তীতে আমি পাইলটের থেকে জেনেছিলাম ঐ সময় আসলে কি ঘটেছিল। তিনি বলেছিলেন যে ৩৩০০০ ফুট উপরে থাকা অবস্থায় আমাদের প্লেন এর বামের ইঞ্জিনে হঠাত আগুন ধরে গিয়েছিল, এত উপরে তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৪৫ ডিগ্রী এর নীচে এবং কোন অক্সিজেন না থাকায় আগুন ছড়াতে পারেনি। সিস্টেম অটোমেটিক ইঞ্জিনটাকে বন্ধ করে দিয়েছিল। ডানের এক ইঞ্জিনে প্লেন টা চলছিল। কিন্ত আগুনে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে সে সম্বন্ধে তাঁর কোন ধারণা ছিল না। হতে পারে ল্যান্ডিং গিয়ার, প্রোপেলারেরে ব্লেড বা ইলেক্ট্রিক ওয়ার বা অন্য কিছু নষ্ট হয়ে থাকতে পারে, তিনি সেটা ধরে নিয়েই সম্পূর্ণ ক্লাম থেকে বিমান চালিয়েছিলেন।)
আমি নিজেকে কোন ভাবেই বুঝাতে পারছিলাম না পরিস্থিতি টা নিয়ন্ত্রণে আছে। ইতিমধ্যেই ঘর ঘর শব্দ টার সাথে তাল মিলিয়ে প্লেনের ভিতরের ঝাঁকুনি টা ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল। আমার সামনের মনিটরে আমি প্ল্যানের অবস্থান দেখার চেষ্টা করলাম, প্লেন টা তখনও ৩০০০০ ফুট উপরে এবং মিয়ানমারের কাছাকাছি সাগরে অবস্থান করছে। এর মধ্যে পাইলট মাইক্রোফোনে আবারও এসে বলল আমাদের অবস্থানের সবচেয়ে কাছের এয়ারপোর্ট মিয়ানমারের মিন্দালাও এয়ারপোর্টে জরুরী অবতনের জন্য যোগাযোগ করেছি, আমরা ঢাকাতে না গিয়ে মিন্দালাও এর দিকে যাচ্ছি এবং যথারীতি সবার সহযোগিতা চাইলেন। তখন ভিতরের পরিস্থিতিটা বলে বুঝানোর মত না, সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। ঝাঁকুনিটা ক্রমাগত বাড়তে ছিল এবং সেই সাথে অস্বাভাবিক ঘর ঘর শব্দ। ঝাঁকুনি গুলো এমন তীব্র ছিল যে প্লেন ভিতরে হাঁটার মত কোন পরিস্থিতি ছিল না। এক পর্যায়ে ঝাঁকুনিতে আমাদের সামনের টয়লেটের দরজাটা খুলে গিয়ে পাশাপাশি বারি খেতে লাগল, বিমানবালাসহ কারও সাহস হল না উঠে গিয়ে দরজা টা বন্ধ করতে। বিমানে বেশীর ভাগ যাত্রী ছিল বাংলাদেশী বিধায় চতুর্দিক থেকে দোয়া দরুদ আর কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। আমার পাশের অন্য সিটে বসা মহিলা তাঁর দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছেন, আমাদের বরাবর সামনে বসা বিমানবালাটা এক মিনিটের জন্যও কান্না থামায়নি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি এমন দোলায়মান ভয়ংকর রাইডে বসে আছি যা আমাকে মৃত্যু উপত্যকায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যা থেকে আমি চাইলেও আমার আর মুক্তি নেই।আমি আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না পাছে আমার ভয়ার্ত মুখ দেখে সে আরও ভরকে যায়। আমার মেয়ে এমনিতেই অনেক চাপা স্বভাবের, কোন কিছুই সে সহজে প্রকাশ করে না। আমি বললাম মা দোয়া যা জান সেগুলো পড়। সে বলল হ্যাঁ আব্বু আমি পড়ছি। মরণের ভয় আমাকে পেয়ে বসল। জীবনে অতটা ধার্মিক আমি কখনই ছিলাম, তারপরেও আল্লাহ্ কাছে ফরিয়াদ করলাম, আমি জীবনে জ্ঞানত কোন পাপ আমি করিনি, নামাজ রোজার গাফিলতি ছাড়া, তুমি আমার প্রস্থান আল্লাহ্ এভাবে করাতে পার না। আল্লাহ্ আমাকে বাঁচাও, আমার যে কোনই প্রস্তুতি নাই। আমি যে কারো জন্যও এখনো কিছু করতে পারিনি। ছোট সময় বাবা হারানো সংসারে আমি অনেক কষ্টে বড় হয়েছি। সব প্রিয় জনের মুখ গুলো মনে হতে লাগল। স্কুল কলেজ জীবনে হোস্টেল থেকে ছুটিতে যখন বাড়ীতে যেতাম, আমার ছোটরা রাতে কে আমার সাথে গুমাবে এই নিয়ে মারামারি লেগে যেত, শেষে সবাই জড়াজড়ি করে এক সাথেই ঘুমাতাম আমাদের ছোট্ট ঘড়টায়। এই ভালবাসার দায় আছে আমার উপর। এগুলো মিটাতে পারিনি, মিটাতে পারিনি বউ বাচ্চাদের দায়। আমার তেমন কোন সহায় সম্পত্তি নাই, তারপরও যা আছে তা নিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে কখনো খোলামেলা আলাপ করা হয়নি। যদিও আমার স্ত্রীর সহায় সম্পত্তি নিয়ে অনাগ্রহ থাকার কারণে তাঁর নামেই যে কোথায় কি রেখেছি সেটাও তাঁকে ঠিক মত জানানো হয়নি। নিজের এই বোকামির কথা মনে করে আরও খারাপ লাগতে লাগল। আমি গত হলে আমার অস্ট্রেলিয়ার সবকিছু সে কিভাবে সামাল দিবে। তাঁর একাকী যুদ্ধ টার কথা মনে করে খুব খারাপ লাগছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমার প্রস্থান দুই দুইটা পরিবারকে একবারে অসহায় করে ফেলবে। আমার সবচেয়ে ভালবাসার মানুষ শাইয়ান এবং আমার স্বপ্নের শাইয়ান ফাউন্ডেশনের কথা মনে করে কান্না সম্ববরণ করতে পারছিলাম না। খোদাকে বলাছিলাম, তুমি এদের জন্য হলেও আমাকে বাঁচাও এবং এই প্লেন টাকে রক্ষা কর। পরক্ষনেই মনে হল, প্রকৃতি কখনই discriminate করে না-সাদা বা কালো, ভাল বা মন্দ, ধনী বা দরিদ্র, যুবক বা বয়স্ক, হিন্দু বা মুসলিম বা খ্রিস্টান হিসেবে। অতএব প্লেন ক্রাশ করলে আমি যেই হই অন্য সবার মত আমারও পরিনতি অবধারিত।কাজেই আমার সেই প্রস্তুতি নেয়া উচিত। আমি তখন, আমি মারা গেলে পাসপোর্ট দেখে লাশটা যেন চিহ্নিত করতে পারে সেই জন্য আমার এবং আমার মেয়ের পকেটে পাসপোর্টটা ঢুকিয়ে নিলাম। ইমারজেন্সি কিট গুলো কিভাবে কাজ করে সেটাও আবার মেয়েকে দেখিয়ে দিলাম, যদিও ক্রাশ করলে এগুলো কোন কাজেই দিবে না। দুয়া দরূদ ও তওবা পরতে লাগলাম। এর মধ্যেই পাইলট বলল আমরা আর পাঁচ মিনিট পরেই ল্যান্ড করতে যাচ্ছি, কিন্ত এটা ছিল তাঁর একটি টেকনিক আমাদের শান্ত রাখার জন্য। আসলে তারও প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর প্লেন ল্যান্ডিং এর জন্য তৈরী হয়। আমি অস্ট্রেলিয়াতে Air Crush Investigation নামে একটি TV programme এক সময় প্রায় নিয়মিত দেখতাম। সেই অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতায় আমি জানতাম প্লেন বেশীরভাগ ক্ষেত্রে উঠার সময় ও ল্যান্ডিং এর সময় ক্রাশ করে থাকে। আর আমাদের প্লেনের যে অবস্থা তাতে আমার বিশ্বাসই হতে চাইল না যে এটা কোনভাবে ল্যান্ড করানো সম্ভব!!! মিন্দালাও এয়ারপোর্টের অনেক আগে থেকেই প্লেনটা অনেক নিচে দিয়ে চলছিল, আমরা নীচের পাহাড়, পাহাড়ের চূড়ার প্যাগোডা দেখতে পাচ্ছিলাম। এর কারণ পাইলট পরবর্তীতে আমাকে বলেছিল যদি ক্রাশ করে তাহলে যেন ক্ষতি কম হয় এবং এক ইঞ্জিনে চলার সময় ডানের ইঞ্জিনটাও সমস্যা করছিল। যে ব্যাপারটা আমরা যাত্রীরাও টের পেয়েছি তখনই কারন ডানের ইঞ্জিন টা যখন বন্ধ হত, তখন প্লেনে কোন শব্দ থাকতো না, বন্ধ হয়ে যেত ঝাঁকুনিটাও। এই রকম হয়েছে দুই বার, আবার চালু হয়েছে। প্লেনের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি অবশ্য আমাদের চেয়ে পাইলটই বেশী টের পেয়েছে, তারপরও সে নার্ভ শক্ত করে যে কিভাবে চালিয়ে গেছেন তা আল্লাহ্ই ভাল জানেন। আমরা ল্যান্ডিং এর জন্য প্রস্তুত হলাম। আমি মেয়ে কে বললাম, মা আমি যা যা করব, তুমিও খুব দ্রুত তাই তাই করবে। সেই সময় সবাই কে কি করেছে, কে কারটা খেয়াল করে। সবাই জীবনের শেষ মুহূর্ত, নয়তো জীবন টা নতুন ভাবে ফিরে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। প্লেন টা মনে হলে একটু ডানে কাত হয়েই ল্যান্ড করল এবং খুব শক্ত ব্রেক চেপে খুব স্বল্প দূরত্বে থামিয়ে দিল। আর সবার সেকি অনুভূতি, যা জীবনেও ভুলব না। সবার সেকি কান্না, চতুর্দিকে কান্নার রোল পরে গেল। সেই কান্নার মাঝেই কেহ কেহ তালিও দিল পাইলটের দক্ষতা দেখে। জানালা দিয়ে দেখলাম রানওয়ের চতুর্দিকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী। সবাই দোড়াদোড়ী করছে কিন্ত কেহ কাছে আসছে না।কেহ ভিডিও করছে, কেহ ছবি তুলছে, কিন্ত কাছে আসতেছে না। এর মধ্যে আমাদের পাইলটের আবার সেই অভয় দেয়া কণ্ঠ বলছিল- আমাদের প্লেন থেকে ফুয়েল লিক হচ্ছিল যেটা আমরা জানতাম না। গ্রাউন্ড স্টাফদের পরামর্শে আমরা সব ধরণের মেশিন বন্ধ করে দিচ্ছি, সাময়িক অসুবিধার জন্য জন্য দুঃখিত।স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের এখান থেকে নিয়ে যাবে। তারপর অনেক সময় এসি ছিল না, অনেকক্ষন বসে থেকে থেকেছি, নীচে পানি মারতে দেখেছি। পরে অন্য যায়গা তে প্লেনটা টেনে নিয়ে আমাদের নামিয়েছিল। বেঁচে যাওয়ার আনন্দে কারো কোন Impatient দেখিনি। আমরা মুসলিম যারা ছিলাম, তাঁরা প্রায় সবায় নেমেই নফল নামাজ পড়েছিলাম। লম্বা সময়(প্রায় দশ ঘণ্টা) বসিয়ে রেখেছিল তারপরও কেহ কোন কিছু বলেনি। সবাই শুধু বলেছে, জীবনটা ফিরে পেয়েছি এর চেয়ে বড় আর কি চাওয়ার আছে। সবার মাঝে এই আলোচনাই শুধু ছিল এটা কি হয়ে গেল!!! সবাই পরে পাইলট কে কাছে পেয়ে সেকি আবেগ, ইংরেজী না জানা চাচারাও এসে বাংলায় তাঁকে জড়িয়ে ধরে অনেক কথা বলছে, যা আমি পাইলটকে ভাষান্তর করে দিয়েছি। পাইলট বলেছিল তাঁর চব্বিশ বছরের পাইলট জীবনে এই রকম ঘটনা এই বারেই প্রথম ঘটেছে। তাঁর সাহসিকতার জন্য আমিও তাঁকে ধন্যবাদ দিয়েছি।
এই ঘটনায় অনেক শিক্ষা হয়েছে আমার ব্যক্তি জীবনে। এই ঘটনার পর অনেকের ফোন ধরিনি কারণ মানষিক অবস্থাটা কয়েক দিন ভাল ছিল না। শুধু পরিবারের লোকজনের বাহিরে খুব কম মানুষের সাথে ঘটনাটা শেয়ার করেছি। মনে পড়ে, বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক ঘাত প্রতিঘাতে বড় হয়েছি, কাছেই কান্নাটা আমার সয়ে গিয়েছিল কিন্ত ঘটনার পরদিন অনেক বছর পর অঝোরে কেঁদেছিলাম যখন মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম। মা ছেলে প্রায় ৭/৮ মিনিট কোন কথাই বলতে পারিনি। আল্লাহ্ কাছে অনেক শোকরিয়া যে উনি পাইলটের দক্ষতার উছিলায় বা মানুষের দোয়ার উছিলায় আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এই জন্য।আমার মনে পড়ে, দূরের বা কাছের অনেক মানুষ আমাকে গায়ে হাত দিয়ে মন খুলে দোয়া করতে দেখেছি, আমার দুই মাও আমাকে সব সময় গায়ে হাত দিয়ে দোয়া করেন।তাঁদের দোয়ার বরকতে আমি আজও বেঁচে আছি। আমার দুর্ঘটনার কথা শুনে যারা আমাদের এলাকার বিভিন্ন মসজিদে জুম্মার নামাজের পর বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করেছিলেন এবং অংশগ্রহণ করছিলেন, তাঁদের সবাইকে আমার অন্তরের অন্তরস্থল থেকে ধন্যবাদ। আমার ব্যক্তিগতভাবে কোন শক্রু নেই, কারো সাথে অভিমান থাকতে পারে কিন্ত কারো সাথে আমার দ্বন্দ্ব নেই। এই নতুন করে বেঁচে থাকায়- আমার উপস্থিতি কোথাও দ্বন্দ্বের জন্য হবেনা, ভাঙ্গনের জন্য হবেনা, হবে শুধুই গড়ার জন্য, বন্ধনের জন্য। আমি আমার স্বপ্নের শাইয়ান ফাউন্ডেশন কে নিয়ে নতুন করে এগিয়ে যেতে চাই।আহা জীবন, আসলেই জীবনটা অনেক সুন্দর। সবাই দোয়া করবেন আমাদের ঝামেলা মুক্ত, শান্তি পূর্ণ জীবনের জন্য। আমিও আপনাদের জন্য একই দোয়া করি।
বিঃ দ্রঃ আমাদের এই দুর্ঘটনার খবর সিঙ্গাপুরের মিডিয়া এবং বি বি সি তে এলেও বাংলাদেশের প্রথম সারির কোন মিডিয়াতে আসে নাই, কারন কেহ তো মারা যায়নি। বাংলাদেশের মিডিয়াতে শুধু মারা যাওয়ার সংবাদ দেয়া হয়, আমাদের আগ্রহ শুধু নাকি মারা যাওয়া মানুষদের নিয়ে, জীবিতদের নিয়ে নয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৮ ভোর ৫:৪০
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×