(তিনটি অণুগল্প)
১।
হাঁটছি।
ঢাকা শহরের পরিচিত দৃশ্য। চারদিকে গাড়ির হর্ণ আর মানুষের কোলাহল। ফুটপাতে দোকানীদের পসরা। নিন্ম আয়ের মানুষেরা সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিধেয় কাপড় কেনার জন্য ধর দাম করছেন। মাঝে মাঝে ‘একদর একশা, বাইচ্চা লন একশ, দেইখ্যা লন একশ’ দোকানীদের হাঁক ডাক শোনা যাচ্ছে। মানুষের গ্যাদারিং, গাড়ির আওয়াজ, চিৎকার শোরগোলে গুলিস্তানে আলাদা একটা টোন পাওয়া যায়। আমার পাশে পঞ্চাশোর্ধ দুই বৃদ্ধাকে হেঁটে আসতে দেখলাম। একজনকে বেশভূষাতে গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষ মনে হল অপরজন মধ্যবিত্ত ধাঁচের। রোডের অপর পাশ দিয়ে রিক্সা করে এক তরুণী অতি মর্ডান ও য়ূরোপীয় ধাঁচের টাইট ফিট পোশাক পড়ে রিক্সার চড়ে চলে যাচ্ছে। গ্রাম থেকে আসা বৃদ্ধা চাঁচাকে মেয়েটির দিকে কতক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। কিছুক্ষণ নিবিড়ভাবে পর্যাবেক্ষণ করার পর মহূর্তে রিক্সাটি তাদের অতিক্রম করে গেল। চাচা মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে কি জানি আওড়াইলেন, তারপর বলে উঠলেন, “ খাদিজার বাপ, মুতে কোনহান দিয়া মুতে!”
************************************************************************************************************************
২।
হাঁটছি।
যাদের পকেটে টাকা কম থাকে তারা একটু বেশী হাঁটেন। দশ পনের টাকার রিক্সা ভাড়া তারা হেঁটে পুষিয়ে নেন।
রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম।জ্যামে আটকে পড়া বাসে কিছু নিম্ন আয়ের মানুষ ঠান্ডা পানির বোতল বিক্রি করেন। এই সমস্ত লোকদের কাছে গরম আর্শিবাদ। কারণ গরম আসলে তারা দু টাকা ইনকাম করতে পারে। পনের-বিশ টাকা দিয়ে একটা বোতল কিনে এতগুলো টাকা গচ্ছা দেয়ার মত মানুষ আমি নই। কিন্তু জৈষ্ঠ মাসের তীব্র গরমে ছাতি ফেঁটে যাওয়ার দশা। তাই চায়ের দোকান থেকে দুই টাকায় এক গ্লাস পানি কিনে গলাটাকে ভিঁজালাম। মেসে দুপুরের খাবার দেয়া নাই তাই অনিচ্ছা সত্বেও হোটেলে খেতে হবে। বড় হোটেলে খেলে টাকা বেশী লাগে তাই মেইন রোড থেকে একটু দূরের হোটেলে খেলে বিল কম আসে, তাই সেখানে খেতে গেলাম। খাওয়ার মেন্যু নিয়ে তিনবার ভাবলাম। শেষ পর্যন্ত চাষ করা কৈ মাছ আর ডাউল দিয়ে পেটটা ডান্ডা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সামনের টেবিলে দু’জন ছেলেকে খাবারের অর্ডার করতেই খাবার হাজির হয়ে গেল। চৌদ্দ পনের বছরের একটি ছেলে তাদের জন্য খাবারের আঞ্জাম দিয়েছে। খদ্দের দুইজনের মধ্যে একজনের চুলে স্পাইক, গলায় কিসের যেন একটা মালার মত আছে, ডান হাতে ব্রেস লাইট আর বাম হাতে ঘড়ি পরিহিত। অপর একজন শার্ট, প্যান্ট পরিহিত সাধারণ মানের মনে হলো। চুলে স্পাইক করা ছেলেটি কিছুক্ষণ পরপর বলে উঠল, তোর গ্লাসে ময়লা পরিস্কার করে নিয়ে আস, চামচ কত দিন ধরে ধুস না, তোদের পাকের ঘর বেশী ভালো না, বাবুর্চি কোন দেশের ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পর ডাউল দিতে বললে; ছেলেটি ডাউল নিয়ে আসলো কিন্তু অন্য কাষ্টমারদের চাপাচাপির কারণে ডাউলের বাটিটা ভালোভাবে টেবিলে রাখতে পারেনি। কিছুটা ডালের ছিঁটা টেবিলের উপর রাখা মোবাইলের উপর পড়ল। সাথে সাথে ছেলেটির গালে ঠাস করে একটি চড় পড়ল। চড়ের আওয়াজে আমি মাথা উঁচু করে তাকালাম। স্পাইক করা ছেলেটিকে বলতে শুনলাম, জানিস এই মোবাইলের দাম কত! তোকে বেঁচলে এই মোবাইলের দাম হবে? আমার কি দোষ, পিছন থেকে ধাক্কা না দিলে এমনটা হত না! কথা শেষ হতে না হতেই ছেলেটির গালে আরেকটি ঠাস আওয়াজ হল, আবার কথা বলিস বেয়াদপ, এটুকু বলে যখন আরেকটি মাড়বে তখন দোকানের মালিক এসে স্পাইক ছেলেটির হাত ধরে নিবৃত করল। কিন্তু আমি ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলাম যেটুকু ডাউল মোবাইলে পড়েছে এতে মোবাইল নষ্ট হওয়ার কথা না।
হোটেল বয় ছেলেটির দুগালে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেখলাম। এই অশ্রুতে আমার সব তৃষ্ণা মিটে গেল এবং কি খাবারের ক্ষিদাও।
*************************************************************************************************************************
৩।
হাঁটছি।
রামপুরা ব্রিজ থেকে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত। বিকালে হাঁটতে আমার ভালো লাগে। সূর্য তার তেজ হারিয়ে ফেলে। যে কেউ তেজ হারালে আশে পাশের পরিবেশটা তাকে উপভোগ করে। ফারসি, রোমান, বার্জেন্টাইন, মুসলিম, হান, চেঙ্গিস, ইংরেজ, স্পেন প্রভূতি জাতিগুলো তাদের তেজ হারিয়ে অন্যকে স্বস্তি দিয়েছে।
মাঝে মাঝে শিলা মেয়েটি সাথে থাকলে ভালো লাগে। শিলার নাকি তরুণ-তরুণীদের ফিসফাস আওয়াজ অনেক পছন্দ। কখনও কখনও সে নিজেই আমাকে ফোন দেয় সাথে হাঁটার জন্য। আমি সাথে থাকলে তার বেশ উপকার হয়, ছবি তুলার বেগার খাটাতে পারে। আমারও বেশ উপকার হয়, সেটা শিলা বুঝতে পারে না। এই সমস্ত জায়গায় একা হেঁটে বেড়ালে অধম ও বেচারা বেচারা লাগে, মন মড়া হয়ে থাকে, তার চেয়ে শিলা মেয়েটি পাশে হাঁটলে অত্যান্ত এই সব ভাবনা আসে না। হাতির ঝিলে হাটলে একটি বিষয় চোখে পড়ে, এখানকার যারা ভ্রাম্যমান বাদাম, চা-সিগেরেট বিক্রেতা তাদের কে মাঝে মাঝে মাঝে দৌড়ের উপর থাকতে হয়। লাল পোষাক পরিহিত গার্ডদের দেখলেই এদিক ঐদিক সরে যায় আর মোটর বাইকে দু’একজন টহলদার দেখলে জান বের হওয়ার উপক্রম। সামনে পড়লে আর রক্ষা নেই; সমস্ত মালামাল ঝিলের পানিতে বির্সজন দিয়ে দিবে। সেদিনও একই কান্ড দেখলাম। দু’জন মোটর সাইকেল আরোহী আমাদের সামনে এসে থামল। একজন চৌদ্দ পনের বছরের বাদাম বিক্রেতাকে দেখলাম জোরে দৌড় মারতে। শিকারী হায়েনার সামনে পড়লে নিরহ হরিণ শাবক যেভাব প্রাণপনে দৌড় দেয় ঠিক সেভাই দৌড় দিল। আরোহী লোক দুটাকে দেখলাম হিংস্র জানোয়ারের মত অঙ্গভঙ্গি করতে। ছেলেটি দৌড়ের বেগ ঠিক রাখতে না পেরে সামনে বোরকা পরিহিত এক মেয়ের সাথে ধাক্কা খেল এবং তার ডালা থেকে অনেকগুলো বাদাম ছিটকে পড়েছে। মেয়েটির সাথে থাকা প্যান্ট কোর্ট পরিহিত ত্রিশ বত্রিশ বয়সের একজন মানুষ সম্ভবত মেয়েটির স্বামী নিরহ বাদাম বিক্রেতাকে চড় মেরে বলতেছে, ‘এই শালার ব্যাটা,পথ দেখে দৌড় দিতে পারিস না। তোগো হকারদের জ্বালায় ঢাকা শহরে টেকা বড় দায়’। ছেলেটি ঠায় দাড়িয়ে থাকল। কোন কিছু বলছেনা। মটরসাইকেল আরোহী দু’জন চলে গেছে। তারা ভাবছে উচিত শিক্ষা হয়েছে। আর মেয়েটি কিছু বাদাম কুঁড়িয়ে ছেলেটির ঢালায় রাখছে। সম্ভত মেয়েটি তার স্বামীর ঘরে পান থেকে চুন খসালে এই ধরণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। তার হয়ত ছেলেটির জন্য মায়া লেগেছে। এই সমস্ত ব্যাপারে মেয়েদের মনে মায়া মহব্বত একটু বেশী।
আমি রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিদের উপর একটু বিরুক্ত হলাম আর শিলা জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
**********************************#################################**************************************
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:০৯