আমার তখন বারো বছর বয়স। মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টামির অভ্যাস ছিল। কোন কিছুর মধ্যে নতুনত্ব থাকলে তাকে জানার জন্য চরম আগ্রহ জন্মাত। বনে বাঁদারে ঘুরে বেড়াতাম ইচ্ছে মত। এজন্য মায়ের হাতে কতদিন যে মাইর খেয়েছি তার ইয়াত্তা নেই। কিন্তু আমাকে ধমিয়ে রাখতে পারিনি বরং আমার এ্যাডভেঞ্চার টাইপের দুষ্টামি দিন দিন বেড়েই চলছিল। আমাদের বাড়ির থেকে প্রায় দশ বারো মিনিট হাঁটা পথ দূরে একটি প্রকান্ড আম বাগান এবং তার কিছু দূরে একটি পুরানো কবরস্থান আছে। বাগানে মূলত আম গাছ ছিল বেশী কিন্তু গাছগুলো ছিলো খুবই বয়স্ক আর কবরস্থানে বুনো প্রজাতির বিভিন্ন গাছ জন্মাত। বাগানটিকে মুরুব্বিরা শূণ্য বাগান বলে ডাকতেন।
আমার একজন ফরহাদ নামে বন্ধু ছিল। আমি আর সে সময় পেলেই বাগানে গিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। ঘুঘু পাখির বাসা ভেঙ্গে বাচ্ছা নিয়ে খেলা করতাম। সেখানে কিছু শিয়াল ও বেজি বসবাস করত। আমরা প্রায় সেখানে যেতাম বলে তাদের সাথে মাঝে মাঝে চোখাচোখি হত এবং তাদের সাথে ভাব বিনিময় করতাম। একদিন ফরহাদ কবরস্থানের উপর দিয়ে হাটার সময় তার পা হাঁটু পর্যন্ত ভিতরে ঢোকে যায়। কবরের ভিতরকার বাঁশের চালি পঁচে দুর্বল হওয়ার কারণে এরকম হয়েছে। সে যখন পা কে কবর থেকে টেনে উঠালো তখন কবরের কিছু মাটি সরে গিয়ে ভিতর থেকে মাথার খুলি উঁকি দিয়ে হেসে উঠলো। খুলির চোখ দুটি ছিল ফাঁকা এবং দাঁতগুলো চকচক করছিলো। ফরহাদ খুব সহজে ভয় পাওয়ার ছেলে না। কিন্তু খুঁলি দেখার সময় সে খুব গরম বাতাম অনুভব করেছে এবং ভিতরে কিসের যেন অদ্ভুদ চিৎকার শুনতে পেয়েছে। এতে ফরহাদ ভয় পেয়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। এ ঘটনার পর থেকে সে দীর্ঘ দিন জ্বরে ভুগছে। এবং আম বাগানে আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।
তারপর থেকে আমিও আম বাগানে আসা যাওয়া একে বারে ছেড়ে দিয়েছি। শুধু একটি ঘুঘু পাখি ডিম ফুটে যে বাচ্ছা বের হয়ে হয়েছিল তার লোভ সামলাতে পারিনি। একদিন ঘুঘুর বাচ্ছা আনার জন্য একা একা বাগানে প্রবেশ করলাম। সব কিছু আগের মতই আছে। শুধু অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে ঘুঘু পাখির ছানাগুলো আগে থেকে একটু বড় হয়েছে এই যা। আমি নিয়্যত করেছি, এই ছানা ধরে আনার পর আর কোনদিন পাখির ছানা ধরব না। এবং মায়ের অনুগত্য ছেলে হিসেবে খাতায় নাম লিখাবো।
এর আগে অনেক পাখির ছানা ধরেছি কিন্তু মায়ের হাতে মাইর খাওয়ার ভরে সেগুলো কখনো বাড়ি আনা হয়নি। হয় বন্ধুদের কে দিয়েছি নয়ত কোন মুরুব্বি অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে আমাদের থেকে কিনে নিয়েছে। এখন থেকে জীবনে আর পাখির ছানা ধরব না বলে স্মরণীয় করে রাখতে ঘুঘুর ছানা দুটি বাড়িতে নিয়ে আসলাম। পাখির ছানা দেখে মা ইচ্ছে মত বকুনি শুরু করলেন। যেখান থেকে এনেছি সেখানে রেখে আসার জন্য কড়া আদেশ দিলেন। আমি অনেক অনুনয় বিনয় করার পর মা রাজি হলেন বাড়িতে রাখার জন্য; শুধু শর্ত দিলেন এখন থেকে লেখাপড়ায় নিয়মিত হতে হবে এবং সকল প্রকার দুষ্টামি বর্জন করতে হবে। আমি মায়ের শর্ত পালন করার জন্য আগেই মনস্থির করে ছিলাম, তাই আগপিছু না ভেবেই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। এখন থেকে আমি ভালা পোলা।
ছোটা কাকাকে অনুরোধ করার পর একটি খাঁচা কিনে দেন। খাঁচাতে যথা রীতি পাখির ছানা দুটিকে ভরা হলো। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। বাজার থেকে খাবার কিনে আনা হলো। স্কুলে যাওয়া আগে এবং স্কুল থেকে ফিরে খাবার দিতে আমি ভুল করতাম না। স্কুলে যাওয়ার আগে মা’কে কড়া নির্দেশ করে যেতাম ঠিক বারোটা বাজে যেন খাবার দেয়া হয়। ঘুঘু ছানার কারণে আমার আমূল পরিবর্তন দেখে মা খুব খুশি হয়েছিলেন। এর পর থেকে তাকে যা বলতাম সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন।
দেখতে দেখতে ছানা দুটি আগে থেকে বড় হয়ে গেছে। এখন হাল্কা ডানা ঝাপটায়। উড়ার জন্য এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতে চায় কিন্তু খাঁচা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। মা বিষয়টি খেয়াল করে ছানা দুটিকে ছেড়ে দেয়ার মনস্থির করেছেন কিন্তু তাদের প্রতি আমার অত্যাধিক ভালোবাসা এবং ছানা দুটির কারণে দুষ্টুমি ছেড়ে দিয়েছি দেখে তিনি বেশি দূর আগাতে পারলেন না। মা ছোট চাচার মাধ্যমে বাঁশ দিয়ে ঘরের পার্শ্বে বড় আকৃতির একটি খাঁচা বানালেন। যাতে ছানা দুটি হাল্কা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করতে পারে। এটি চারকোণা আকৃতির এবং অনেকটা কবুতরের খোপের মত ছিল। ছানা দুটি ছোট খাঁচা থেকে বড় খাঁচাতে স্থানান্তর হওয়ার কারণে তারা অন্ত:সুখ অনুভব করেছে। তাদের ডানার ঝাপটানোর পরিমান আগে থেকে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বড় খাচায় স্থানান্তর পর এখন থেকে আরেকটি জিনিষ প্রত্যেক্ষ করছি, ছানা দুটির মা’ কিভাবে যেন দেখে ফেলেছে খাঁচার ভিতর তাদের আদরের সন্তান বন্দি হয়ে আছে। তাই মা ঘুঘুটি দিনে দু’এক বার করে খাঁচার উপর দিয়ে উড়ে যায়। এবং বাড়ি থেকে অনতি দূরে গাছের উপরে বিলাপ করে ডেকে উঠে। তাদের মায়ের ডাক শুনে ছানা দুটিও চিহি চিহি করে ডেকে উঠে। হঠাৎ ছানা দুটির উপর তাদের মায়ের এই ধরণের নজরদারিতে আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। এবং মনে খুব অশান্তি বিরাজ করে। তাই মা ঘুঘুটি যাতে ছানা দুটিকে আর দেখতে না পারে সে জন্য খাঁচার উপর কাপড়ে দিয়ে ঢেকে রেখেছি।
এঘটনার পর থেকে আসে পাশের পরিবেশটা পরিবর্তন হতে থাকে। আমাদের পালিত কুকুরটা হঠাৎ নিঁখোজ হয়ে যায়। বৃদ্ধ দাদুর পুড়ানো ঘাড় ব্যাথাটা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মিথ্যা অভিযোগে ভাইয়ার চাকুরি চলে যায়। রাতের সময় পুকুরে ঝুপঝাপ আওয়াজ হয়। ফজরের আজানের সময় একটি অপরিচিত পাখি ভয়ংকর কন্ঠে দু’থেকে তিন বার ডেকে উঠে। তার সাথে সাথে আমার শারীরিক এবং মানুষিক নানা পরবর্তন লক্ষণ করলাম। সব সময় মাথা হাল্কা চিন চিন ব্যাথা করে। রাতে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখি। এসব স্বপ্নে মধ্যে কোনটা ভয়ংকর, কোনটা এ্যাডভেঞ্চার, কিছু কিছু প্যারানরমালা টাইপের ঘটনাও ঘটতে থাকে। প্যারানরমাল ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নিজ গ্রাম সহ আসে পাশের কোথাও মানুষ মারা গেলে আমি তা একদিন আগে স্বপ্নে দেখতাম এবং তা হুবাহু সত্য হিসেবে পরিলিক্ষত হত । সকাল বেলা মা’কে এই প্যারানরমাল সম্পর্কিত ঘটনা বললে মা প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু পরে যখন মাইকিং করা হত অমুক গ্রামের অমুক ব্যক্তি ইন্তকাল ফরমায়েছেন----ইন্নালিল্লাহি… তখন মা খুব অবাক হতেন এবং আমার এই প্যারানরমাল ঘটনাগুলো তাকে বিচলিত করত।
ইতিমধ্যে আমার জন্য ফকির কবিরাজ দেখা শুরু করা হয়েছে। তারা নানা রকম তাবিজ, কবজ, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। বরং আগে থেকে বেশি প্যারানরমাল ঘটনার সন্মুখীন হচ্ছি। একদিন একটি প্যারানরমাল অথচ ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলাম। আমাদের বাড়ির কাজের লোক রহিমা খালা আত্মহত্যা করবেন। এ স্বপ্ন দেখার পর আমি আর ঘুমাতে পারিনি। এর আগে যতদিন এই সমস্ত স্বপ্ন দেখেছি সবগুলো মা’কে খুলে বলেছি, কিন্তু আজকেরটা বলতে পারছিনা। কারণ যতটা খুলে বলেছি তার সবগুলো সত্য হয়েছে, যদি এটা বলি তাহলে এটাও সত্য হবে! রহিমা খালার আত্মহত্যা করবেন ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল এবং কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। খালার স্বামী ছিল বজ্জাত। মাঝে মাঝে রিকসা চালায় এবং নেশা করে। অনেক সময় খালাকে মারধোর করেন। খালা তার মেয়ে রহিমার জন্য সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছেন, অন্যের বাড়িতে জি-গিরি করেন। তাছাড়া খালা কত ভালো লোক। আমাকে অনেক আদর করেন। তাদের বাড়ি থেকে আমার জন্য মাঝে মাঝে পেয়ারা, জাম নিয়ে আসেন। আমি সেগুলো তৃপ্তিসহকারে ভক্ষম করি। খালার আত্মহত্যা কিছুতেই সহ্য করা যাবে না।
খালা আত্মহত্যা করবেন; এই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তাই মা’কে মাথা ব্যাথার অজুহাত দেখিয়ে স্কুলে যায়নি। অধীর আগ্রহে বসে আছি খালা কখন আমাদের বাড়িতে আসবেন, আর কখন তার মুখটা দেখে নিশ্চিত হব খালা মরেনি, বেঁচে আছেন। কিন্তু আজ খালা আসার জন্য দেরি করছেন। আমার ভিতরে হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকল। সকাল বেলা কিছু খায়নি। মা বার বার আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর খালা আমাদের বাড়িতে উদয় হলেন। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি, যাক খালা তাহলে মরেনি। খালার মুখে হাসি হাসি ভাব লেগে আছে।
দুপুরের পর টেবিলে বসে অংক করছি, এমন সময় খালা আমার পাশে এসে বসলেন এবং আমার মাথায় এবং পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, বাবা জলিল তোমার কাছে দশ টাকা হবে, পান কিনে খাবো। খালার কথা শুনে আমি অবাক হয়েছি। খালা আমার থেকে কোন দিন কিছু চায়নি। আজকে চেয়েছে। আমার কাছে তখন দশ টাকার দু’টি নোটি ছিল, আমি ড্রয়ার থেকে বের করে সংঙ্গে সংঙ্গে খালাকে দিয়েছি। খালা পান খেয়ে আমার জন্য দোয়া করবেন। খালা টাকা নিয়ে আজকে একটু তারাতাড়ি বাড়ি চলে গেলেন। আমিও মাঠে খেলতে যাবো ভাবছি। তার আগে ঘুঘুর ছানা দুটিকে পানি এবং খাবার দেয়া দরকার। তাদের খাবার দিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে মনে মনে ভাবলাম, আমাদের কাজের বেটি রহিমার মা যেহেতু বেঁচে আছেন সেই খুঁশিতে তোমাদের মুক্ত করে দেয়া উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ, সাথে সাথে খাঁচার দরজা খুলে দিলাম। পাখির ছানা দুটি মহুর্তের আকাশে উড়ে গিয়ে ডানা ঝাপটালো, আমি কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে তাদের স্বাধীনতার রাজ স্বাক্ষী হলাম। এ সময় মা’ এসে আমাকে ঝড়িয়ে ধরলেন। সম্ভবত পাখির ছানা মুক্ত করার কারণে তিনি সবচেয়ে বেশি খুঁশি হয়েছেন।
সন্ধ্যার পর খবর আসলো রহিমার মা ইঁদুরের বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিষ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে ততটা শরীরে ক্রিয়া করতে পারেনি। স্থানীয় লোকজন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। গতকাল রাতে নাকি খালার স্বামী নেশা করার টাকা না পেয়ে খালাকে খুব বাঁজে কথা বলেছিল। চেয়ারম্যান বিষয়টি অবগত হয়ে থানা পুলিশ কে খবর দিলেন, অত:পর পুলিশ এস খালার স্বামীকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছেন। এই ঘটনার একদিন পর আশ্চার্যভাবে আমাদের হারানো কুকুরটা বাড়িতে ফিরে এসেছে, ভাইকে তার বস চাকুরিতে পুর্ণবহাল রেখেছেন। দাদু আগে থেকে সুস্থ্যতাবোধ করছেন।আমার চিন চিন মাথা ব্যাথা দূর হয়ে গেছে কিন্ত আগের মত দুষ্টামি করা শুরু করে দিলাম।
তারপর থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর কোন দিন পাখির ছানা ধরব না।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ৯:৫১