somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফ্রি টাউনের কটন ট্রি

২৪ শে জুন, ২০১৫ ভোর ৪:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাজার মত দাঁড়িয়ে আছে শহরের কেন্দ্র বিন্দুতে


কটন ট্রির নাম প্রথম শুনেছিলাম ডেভিড কামারার মুখে। আমরা সিয়েরালিওনে যাবার আগে থেকেই সে ছিলো আমাদের গডরিচ ক্যাম্পের হরফুন মাওলা। ঘরের চাল ছাইতে হবে তো ডাকো কামারাকে, ক্যাম্পে দেয়াল তুলতে হবে, কামারা জানে কোথায় পাওয়া যাবে বিল্ডিং ব্লক। মেসে বিশেষ কোন খাবার রান্না হবে, ডেভিড জানে মাল মসলা কোথায় সুলভ। আমার এসব কিছুর দরকার ছিলোনা। আমি অবাক হলাম এক শুক্রবারে তাকে মসজিদে দেখে। বিস্ময়ে আমার চোয়াল ঝুলে যেতে দেখে সে বলল, স্যার আই অলসো য়্যাম দ্য মুয়াজ্জিন হিয়া। আমি কিছু বলার আগেই সে বলল ডেভিড’স মাই ক্রিশ্চিয়ান নেইম অনলি। আমার ঘোর কাটলো সব কথা শোনার পর। এখানে ভালো স্কুলে পড়ার জন্যে ক্রিশ্চিয়ান নাম রাখতে হয়। ক্রিশ্চিয়ান মিশনারীরা চালায় সেসব স্কুল। মুসলিমদের চান্স পাওয়া কঠিন। ডেভিডের আসল নাম দাউদ আলি কামারা। খ্রিষ্টান নাম থাকলেও স্কুল আর এনজিও তে ঢোকা সোজা। তাঁর স্কুলের কাজটি হয়েছিলো ঠিকই, তারপর যুদ্ধ লেগে গেল। ভয়ে এনজিওরা আসা কমিয়ে দিলো। ডেভিডের দিন কাটে বানসিগের ফাইফরমাশ খেটে। খ্রিস্টান নামটি এখন আর কোন কাজে লাগছে না।

আমি ব্যানসিগের লিয়াজো অফিসার। কারণে অকারণে আমাকে সিয়েরা লিওনের ইমিগ্রেশন, নানান দেশের এম্বাসি, আর সরকারি অফিসে ঘুরে বেড়াতে হয়। এক বিকেলে ডেভিড উঠে বসলো জীপের পিছনে। আমি যদি তাঁকে কটন ট্রি অব্দি পোছে দেই সে এভার গ্রেটফুল থাকবে। আমাদের যশোরে একটি তুলো তলা আছে, সেখানে ইন্ডিয়ান পণ্যের চোরাই মার্কেট বসতো এক সময়। বন্ধু, স্বজনের হাজার অনুরোধেও আমি সেখানে যাইনি। আজ এত দূরে, এসে আবার তুলোতলার চক্কর! আমি বললাম কোথায় তোমার সেই তুলো তলা। কামারা বাংলা বোঝে। সে বলল, নো তুলো তলা স্যার। ইট’স কটন ট্রি। বললাম, আমার ন্যশনাল ব্যাংকে কাজ আছে। সে বলল, নো বব্লেম। সুপ্রীম কোর্ট বিল্ডিং, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ন্যাশনাল ব্যাংক সব ওখানেই।

ন্যাশনাল ব্যাংক, ন্যাশনাল মিউজিয়াম সব কিছু এখানেই

অনেক দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম গাছটি। কামারাকে সিয়াকা স্টিভেন্স রোডের মোড়ে নামিয়ে দিতে গিয়ে বৃক্ষের বিশালতা দেখে নেমে গাড়িতে বসে থাকতে পারলাম না। গাছের চারিদিকে বাঁধাই করে বেদির মত করে দেওয়া হয়েছে। বেদির উপর বিভিন্ন সময় মেলা বসে। উতসব হয়। এই বৃক্ষের কান্ডের ব্যাস এখন ৩৬ ফুট ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ২৪ জন মানুষ লাগে এই গাছটিকে বেড় দিয়ে ধরতে। শাখা প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে পৌনে পাঁচশ’ ফুটের মত। দাউদ কামারা গাড়ি থেকে নেমে গাছের তলায় হাটতে থাকলো।

বেড় দিয়ে ধরতে লাগে ২৪ জন

একটি মাত্র গাছ কী ভাবে একটি শহরের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে যায় সেটা শুনলাম কামারার মুখে। সে বলল, দিস ইস স্যার, দ্যা সেন্টার পয়েন্ট অব ফ্রি টাউন।
মনে হল বেশ তো রাজধানীর ঠিক মাঝ খানে চারিদিকে শাখা প্রশাখা মেলে দিয়ে রাজার মত দাঁড়িয়ে আছে বাবা শিমুল গাছ। কামারা বলল, ইউ নো হাউ ওল্ড দিস ট্রি ইজ! ফ্রিটাউনের মানুষরা বলে এই গাছের বয়স পাঁচশো বছর। (একটি শিমুল গাছ এত দিন বাঁচে কীনা আমি জানিনা, গাছের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে, বিশেষজ্ঞ নই)।

কী প্রকান্ড ! কান্ড

আড়াইশ’ বছর আগে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে সব ক্রীতদাস বৃটিশদের পরাজিত করে আটলান্টিক পাড়িদিয়ে ফ্রিটাউনের পত্তন করেছিলেন অথবা ১৭৯২ সালের ১১ মার্চ যে সব ক্রীতদাসকে আটলান্টিকের এপা্র এনে ব্রিটিশ রাজ মুক্ত করে দিয়ে ছিলো, সমুদ্র থেকে মুখ তুলেই তারা দেখতে পেয়েছিলো এই গাছটিকে। সে যেন সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলো, তাদের অভ্যর্থণা জানাবার জন্যেই।

শিল্পীর চোখে; আড়াইশ' বছর আগের কটন ট্রি

সেই সদ্য মুক্ত মানুষগুলি এই বিশাল এই গাছ টিকে ঘিরে শুরু করলো বিজয় উৎসব। এই গাছের ঋজুতা তাদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখালো। অন্ত্যজ ক্রীতদাসদের গ্র্যনভেল বস্তি ধীরে ধীরে বদলে গেলো ফ্রি টাউন শহরে।
সেই থেকে এই শিমুল গাছটি এই শহরের অভিভাবকের মত। শোকে, অসুখে উৎসবে, পার্বণে সবাই ছুটে আসে শহরের কেন্দ্রস্থলে কটনট্রির কাছে। আমার সেদিনের কাজ মাথায় উঠলো। সন্ধ্যা নেমে আসছিলো, ডেভিডকে দেখে মনে হল, সে মুনাজাতের ভঙ্গিতে কথা বলছে গাছের সাথে। আমার সাথে চোখা চোখি হতেই লজ্জা পেয়ে গেলো। বললাম, তুমি কী গাছের সাথে কথা বলছিলে।
সে প্রথমে কিছু না। ফেরার পথে বলল, ইউ নো কটন ট্রি ক্যান হিয়া পিপুল। বললাম বেশ তুমি কী বলছিলে। সে বলল, আই ওয়াজ প্রেইং। দেয়ার আর সো মেনি থিংসস টু প্রে।

পুনশ্চঃ
ডেভিড কামারার নামটি ডেভিড নাও হতে পারে, মনে করার চেষ্টা করছি
ব্যানসিগঃ বাংলাদেশ সিগন্যালস, সিয়েরালিওনের মানুষরা উচ্চারণ করতো বানসিগ
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৫ ভোর ৪:০৯
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×