গত আগস্টের মাঝামাঝি দিকে ইরানের সেনাপ্রধান জেনারেল বাকেরি তুরস্ক সফর করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইরানের কোনো সেনাপ্রধানের সেটাই ছিল প্রথম তুরস্ক সফর। অতঃপর পাল্টা সফরে এলেন তুরস্কের সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল হুলুসি অকার। আজ আবার ইরান সফরে এলেন স্বয়ং তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এটি অবশ্য তুর্কি প্রেসিডেন্টের ৩য় বারের মত ইরান সফর। তবে তুর্কি প্রেসিডেন্টের এবারের ইরান সফরের মধ্যে অনেক তাৎপর্য রয়েছে বলেই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
৬ বছর পেড়িয়ে সিরিয়া যুদ্ধ প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে ইরান সমর্থিত আসাদ সরকার ক্ষমতায় টিকে আছেন। অন্যদিকে মাত্র গত সপ্তাহে ইরাকের বারজানির আঞ্চলিক কুর্দি সরকার ইরাক থেকে বেরিয়ে গিয়ে সেখানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। যদিও ইরাক থেকে বেরিয়ে গিয়ে কুর্দিদের ঘোষিত এই স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ কি হবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু এখন পর্যন্ত একমাত্র ইসরাইল ছাড়া আর কোন দেশ কুর্দি স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নাই। তাছাড়া তুরস্ক, ইরান এবং সিরিয়ার মাঝে অবস্থিত কুর্দিরা তাদের সহায়তা ছাড়া কিভাবে স্বাধীনতা ভোগ করবে সেটা রহস্যের বিষয়। ইতিমধ্যে ইরাকের আহব্বানে সারা দিয়ে কুর্দিদের জন্য আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে ইরান, লেবানন, তুরস্ক। কুর্দিস্থানে সকল প্রকার আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে।
ইরাকের কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইরান ও তুরস্ক একই অবস্থানে রয়েছে। ইতিপূর্বে ইরান ও তুরস্কের সেনাপ্রধান ইরাকের কুর্দিস্তানের বিতর্কিত গণভোট ও বিচ্ছিন্নতার বিরোধিতা করেছেন। তারা দুজনই ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার ও দেশটির ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন।
এরপরই আজ একটি উচ্চ পদস্থ প্রতিনিধি দল নিয়ে ইরান সফরে এসেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ইরান ও তুরস্ক দীর্ঘকাল ধরে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে সম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পরিপেক্ষিতে দু'দেশই বিরোধ এড়িয়ে অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে পারে।
সিরিয়ার ব্যাপারে তুরস্কের বর্তমান অবস্থান এবং উত্তর ইরাকের পরিবর্তিত পরিস্থিতির ব্যাপারেও আঙ্কারার স্পষ্ট নীতির আলোকে বলা যায়, আঙ্কারা এ অঞ্চলের বাস্তবতা আগের চেয়ে অনেক বেশি উপলব্ধি করছে। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমিয়ে এনে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা জোরদারের ব্যাপারে তুরস্ক এখন আন্তরিক বলেই মনে হচ্ছে। অথচ সিরিয়া যুদ্ধের প্রথম দিকে বিদ্রোহীদের সব থেকে বড় সহায়তা করত এই এরদোগান সরকার। বিদ্রোহীদের সমর্থনে রাশিয়ান সামরিক বিমান পর্যন্ত ভূপাতিত করেছিল সেই সময়ে।
তবে বাস্তবতা পাল্টেছে এরদগানের বিপক্ষে সঙ্ঘটিত ব্যর্থ কুয়ের পর থেকেই। তখন থেকেই ক্রমে ইরান, তুরস্ক এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। সিরিয়া সঙ্কট দূরীকরণে অনুষ্ঠিত আস্তানা বৈঠকের উদ্যোক্তা এই তিন দেশই ইতিমধ্যে বিদ্রোহী আর সিরিয়ার সরকারের মধ্যে যুদ্ধকে একটি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সিরিয়ান সেনারা এখন বিদ্রোহীদের পরিবর্তে আইএসের সাথে লড়াই করতে পারছে সিরিয়ায় আইএস ৮৫% জায়গা থেকে উৎখাত হয়েছে।
তবে সিরিয়ার প্রায় ৩০ শতাংশ জায়গা দখল করেছে অ্যামেরিকা সমর্থিত কুর্দি বাহিনী। যদিও এখনো তারা সিরিয়ার সরকারের সাথে দন্দে জড়িয়ে পড়ে নাই বা সিরিয়ার থেকে বের হয়ে স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে নাই তারপরও সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইরাক, ইরান সিরিয়া এবং তুরস্ক মিলে প্রায় সাড়ে তিন কোটি কুর্দি জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা বিশ্বাস করে তারা এই চারটি দেশের মাঝে স্বাধীন কুর্দিস্থান প্রতিষ্ঠা করবে।
সুতরাং দেশ ৪ টি স্বাভাবিক ভাবেই তাদের দেশ ভেঙ্গে নতুন রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতা করবে। এখানে ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিহার করে বৃহতর স্বার্থে ৪ টি দেশ এক হতে যাচ্ছে, যার মুলে রয়েছে ভৌগোলিক অখণ্ডতা। আগে থেকেই সিরিয়া ইরান ও ইরাকের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন ছিল কিন্তু এবার তুরস্ক এই জোটে যুক্ত হচ্ছে যা নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১:৪৬