somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুভ জন্মদিন প্রিয় ঋত্বিক ঘটক

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাজশাহী মত ছোট্ট একটা শহরে প্রতিদিন বিকালে একটি নির্দিষ্ট সাইকেলের টুংটাং আওয়াজ পাওয়া যেত।
এই সমাজের বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী সাইকেলের সামনের সিটে ছেলেরা আর পেছনের সিটে মেয়েদের বসার কথা থাকলেও, এই সাইকেলের ক্ষেত্রে সেটার ব্যতিক্রম দেখা যেত। সামনের সিটে চালকের আসনে থাকতেন ভবি নামের দশ বছরের একজন মেয়ে আর ক্যারিয়ারে ভবা নামের দশ বছরের একজন ছেলে। সম্পর্কে তারা ভাই বোন বলেই হয়ত লোকজন তাদের একসাথে সাইকেল চালানো কে বাঁকা চোখে দেখত না। তাছাড়া ততদিনে সবাই জানতেন, জেলার সাবেক ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সুরেশচন্দ্র ঘটকের সবচেয়ে ছোট ছেলেমেয়ে এরা। রাজশাহীর সব মানুষের কাছে তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন, আটটি ভাষা জানা একজন মানুষের প্রতি সম্মানটা খুব সম্ভবত মন থেকে আপনাআপনিই চলে আসে।
দুই ভাই বোনে ফেরত আসা যাক। প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে তাদের গন্তব্য ছিল রাজশাহীর বিখ্যাত পদ্মা নদী। "তাদের" বললে কিছুটা ভুল বলা হয়, ছোট ছেলে মানে ভবার আগ্রহ ছিল বেশি প্রতিদিনের পদ্মার দর্শনে। পদ্মার কাছাকাছি আসতেই ক্যারিয়ার থেকে নেমে দৌড় দিয়ে পদ্মার কাছাকাছি এসে হাতের বাঁশিটা বালিতে রেখে সে নেমে পড়তো পদ্মার হাঁটু পানিতে। হাতের আজলায় ঢোক গিলে পদ্মার পানি খেত প্রতিদিন কারণ তার মতে পদ্মার পানি পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম পানি, সবচেয়ে সুস্বাদু পানি। পানি খেয়ে ফিরে আসার সময় ভবা তার বাঁশিতে সুর তুলত। অদ্ভুত রকমের বিষণ্ণ ছিল সেই বাঁশির সুর।

ভবা আর ভবির পরিবার খুবই সংস্কৃতিমনা ছিল। ভবির পুরো নাম প্রতীতি দেবি। পাঁচ ভাই আর চার বোনের বড় সংসার। ভবার পুরো নাম হচ্ছে... না থাক। আসল নামে যথাসময়ে ফেরত আসা হবে, তাহকে নিয়েই এই লেখা কিনা। ;)
ভবার জন্ম ঢাকায় হলেও বাবার সরকারী চাকরির সূত্রে ঘুরতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। সেই সূত্রানুযায়ী ভবার স্কুল ও চেঞ্জ হত কয়েক বছর পর পর। তবে সবচেয়ে বড় চেঞ্জটা মনে হয় আসলো ক্লাস এইটে পড়ার সময়। কানপুরের টেকনিক্যাল স্কুলে পাঠানো হয় তাকে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা কানপুরে এসে খুব কাছ থেকে গরীবদের দুঃখ কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখতে পান এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে ক্লাস এইটে থাকা অবস্থায় তিনি শ্রমিকদের ওভারটাইম আদায়ের সংগ্রামে রাস্তায় মিছিলে নেমে যান। ফলে তাকে রাজশাহীতে ফিরিয়ে এনে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। কানপুরের গরীবদের দুঃখ কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখা ছেলে যে কলেজিয়েট স্কুলের অপেক্ষাকৃত ধনী ছেলেমেয়েদের সাথে বেশিদিন পড়তে পারবে না- সেটাতে খুব একটা অবাক করা কোন ব্যাপার ছিল না। এই জগতে কেও যখন আবদার শুনে না, তখন জন্মদাত্রী মা শুনেন, সেটা অন্যায় আবদার হলেও। মা ইন্দুবালা দেবীকে বিশেষ অনুনয় করে কলেজিয়েট স্কুল ছেড়ে রাজশাহীর বিবি স্কুলে ভর্তি হন। তবে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় তাকে আবার এক প্রকার জোর করেই সেই পুরনো কলেজিয়েট স্কুলেও ভর্তি করা হয়। জীবনে একই স্কুলে তিনবার ভর্তি হওয়ার নজির মনে হয় খুব কমই আছে! (এর আগে ক্লাস ফাইভে থাকতেও এই স্কুলে পড়েছিলেন!) ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলেও মাস্টার্সে এসে পড়াশুনা শেষ না করেই ইতি টানেন- কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ার জন্য। এছাড়া ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য ছিলেন। নাটক লিখেছেন, নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন এবং দিন শেষে অভিনয়ও করেছেন।

এসব কাজ করতে করতেই একদিন চলচ্চিত্রে জড়িয়ে পড়েন, সিনেমাতে হাতেখড়ি হয় বাঙালি পরিচালক বিমল রায়ের কাছে। বিমল রায় কলকাতা ছেড়ে মুম্বাই তে চলে গেলে তিনি কাজ শুরু করেন নির্মল দে এর সাথে। এতদিন অন্যদের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করলেও, ১৯৫২ সালে পরিচালক হিসেবে নিজের প্রথম সিনেমা বানান, সিনেমার নাম নাগরিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবন যন্ত্রণার এক বস্তুনিষ্ঠ শিল্পরূপ দেখা যায় এই সিনেমাতে। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হল নিজের জীবদ্দশায় তার এই সিনেমাটি মুক্তি পায় নি, মুক্তি পায় তার মৃত্যুর দেড় বছর পরে। নাগরিক বানানোর পরে বেশকিছু সময়ের জন্য বলতে গেলে হারিয়ে যান তিনি সিনেমা থেকে, নাটকের কাজ আবার করতে লাগলেন। তার লেখা "দলিল" নাটকটি মুম্বাই সম্মেলনে সর্বভারতীয় নাট্য সম্মেলনে প্রথম পুরষ্কার পেল। মজার ব্যাপার হল, নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন আমাদের এই ভবা নিজেই। এর মাঝে তৈরি করলেন বেশ কিছু হিন্দি তথ্যচিত্র।
সময় গড়াচ্ছিল কিন্তু সিনেমা হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত প্রমোদ লাহিড়ীর অনুরোধে ১৯৫৭ সালে তৈরি করেন অযান্ত্রিক নামের সিনেমাটি। এমন অদ্ভুত সিনেমা সেই যুগের মানুষ আর দেখেনি- অদ্ভুত তার প্লট- এক গাড়িচালকের সাথে তার গাড়ির "অযান্ত্রিক" প্রেম। গাড়ির রেডিয়েটরে পানি ঢাললে ব্যাকগ্রাউন্ড এ পানি গেলার "ঢকঢক" আওয়াজ শুনানো হয়েছিল এই সিনেমাতে সেই ১৯৫৭ সালে- যেটা অনেকে দেখলেও বিশ্বাস করতে চান না! এরপর তৈরি করলে নিজের অন্যতম বিখ্যাত সিনেমা মেঘে ঢাকা তারা, ১৯৬০ সালে। সংসারের খরচ জোগানো বোনটি নিজে যখন অসুস্থ হয়ে যায়, কাশতে কাশতে যখন গলা ছিঁড়ে রক্ত বের হয়- সেই রক্ত কেও যাতে না দেখে এজন্য বালিশে চাপা দিয়ে নিজের মুখ ঢাকার চেষ্টার সময় নিজের ভাইয়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়া, ভাইয়ের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য না বুঝে- কি রে? কি লুকাচ্ছিস আমার কাছে? কেও চিঠি দিয়েছে নাকি রে? লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ছিস নাকি? - সংলাপ বলে অবশেষে নিজের বোনের রুমালে রক্ত আবিষ্কার করার দৃশ্য যেন প্রতিটা দর্শকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে। সিনেমার শেষের দিকে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে- দাদা, আমি বাঁচতে চাই দাদা, আমি বাঁচতে চাই!- বলে নায়িকার সেই বাঁচার ইচ্ছা প্রতিটা মানুষকে ছুঁয়ে যেতে বাধ্য! এই কারণেই সম্ভবত মেঘে ঢাকা তারা তার নির্মিত সবচেয়ে সফল সিনেমা, ব্যবসায়িক দিক থেকে। এরপরে দুটি সিনেমা নির্মাণ করলেন- ১৯৬১ তে কোমল গান্ধার আর ১৯৬২ তে সুবর্ণরেখা।

আমাদের এই ভবার আসল নাম ঋত্বিক কুমার ঘটক, সবার কাছে যিনি ঋত্বিক ঘটক নামে বেশি পরিচিত। ভারতীয় বাংলা সিনেমার কথা বললে সত্যজিতের নামের পাশেই যার নাম চলে আসে। ২৫ বছরের সিনেমার জীবনে মাত্র আটটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা তিনি নির্মাণ করেন যার পাঁচটিই নির্মাণ করেছেন ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সালের মাঝে। এটার পেছনে একটা কারণ আছে।
পদ্মার চরে বসে ঋত্বিক যখন নিয়মিত বাঁশি বাজাচ্ছেন ছোটবেলার অভ্যাসমত, সেই সময় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা এই ভারতীয় উপমহাদেশকে দুইভাগে ভাগ করে ফেললেন। ঋত্বিক এই জিনিস কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। পরিবারসহ রাজশাহী ছেড়ে তাকে কলকাতায় যেতে হলেও তার মনে পড়ে রইল সেই পদ্মার চরে।
পানিতে ডুবে যাওয়া মানুষ খড়কুটা ধরে আঁকড়ে বাঁচতে চায়, ঋত্বিক ও চাইলেন। দেশ বিভাগের সীমাহীন কষ্টকে মানুষের কাছে ফুটিয়ে তুলতে, নিজের যন্ত্রণাকে ছড়িয়ে দিতে তিনি হাতিয়ার বানালেন সিনেমাকে। তিনি বারবার বিলাপ করে বলতেন - আমাকে আমার শেকড় থেকে টেনে উপড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। আর বাংলার বিভাজনকে সবসময় তিনি বলতেন "ভাঙ্গা বাংলা"। কলকাতায় অসংখ্য বাস্তুচ্যুত মানুষকে মানবেতর জীবনযাপন করতে দেখে তিনি প্রচণ্ড কষ্ট পেতেন। রাজনীতি না বুঝা সাধারণ মানুষদের কষ্ট তাকে এতটাই আলোড়িত করেছিল যে নিজের ক্যারিয়ার আর জীবন নিয়ে তিনি চিন্তা একেবারেই বাদ দিয়ে দিলেন। নাটক সিনেমা যাই করলেন সব করলেন দেশ বিভাগের ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়ানো মানুষদের নিয়ে যাদের অনেকেই হয়েছে ভিখিরি অথবা বেশ্যা। সম্ভবত এই কারণেই ঋত্বিককে চরিত্র কল্পনা করতে হয়নি, আশেপাশে যাদেরকে দেখেছেন তাঁদেরকে বাস্তবসম্মতভাবেই সিনেমাতে বন্দি করতে পেরেছিলেন। এসব চরিত্রের কষ্ট এত শৈল্পিক আর সূক্ষ্মভাবে তিনি তুলে এনেছেন যা ভারতীয় সিনেমাতে খুবই দুর্লভ।
সত্যজিৎ রায় ঋত্বিক সম্পর্কে বলেছেন- ঋত্বিক বাবু একটু গুছিয়ে যদি ছবি বানানোতে মনোযোগী হতেন তাহলে তিনি ভারতের সিনেমার সবাইকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম তারকা হয়ে আলো ছড়াতেন। আমরা সবাই কোন না কোনোভাবে হলিউড দ্বারা প্রভাবিত, কিন্তু ঋত্বিক ছিলেন সম্পূর্ণভাবে এই প্রভাব থেকে মুক্ত। রাশিয়ার নাটক আর সিনেমার কিছুটা প্রভাব থাকলেও দিনশেষে তার কাজে থাক্ত নিখুঁত বাঙ্গালিয়ানার ছাপ।"

১৯৪৮ থেকে ১৯৭১- অনেক সময় পার হল এর মাঝে। প্রিয় পদ্মা দেখতে এতদিন তার প্রয়োজন হত পাসপোর্টের। দেশ স্বাধীন হবার পরে তিনি বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন আনন্দে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ আর ঋত্বিক আমন্ত্রিত হলেন। পদ্মা পাড়ি দিয়ে তারা দুইজন যখন ঢাকার দিকে আসছিলেন, তখন ঋত্বিক বারবার শিশুর মত আনন্দে লাফাতে লাফাতে সত্তজিতকে বারবার পদ্মা নদী দেখাচ্ছিলেন, দেখাচ্ছিলেন তার ছেলেবেলার আবেগের কেন্দ্রস্থল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার খবরে ঋত্বিক যতটা আনন্দ পেয়েছিলেন, ততটা দুঃখও পেয়েছিলেন। পৃথিবীতে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ সেই ভবি অর্থাৎ আমাদের প্রতীতি দেবী বিয়ে হয়েছিল বাংলাদেশের অভিনেয়া ও এক সময়ের ডেইলি স্টারের সম্পাদক সঞ্জীব দত্তের সাথে যিনি ছিলেন ১৯৪৮ সালে গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো প্রথম ব্যক্তি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ছেলে। ১৯৭১ সালে নির্মমভাবে ধীরেন্দ্রনাথ কে তার কুমিল্লার বাড়িতে হত্যা করা হয় এবং পাকিস্তানীরা তার সুন্দর বাড়িটিকে একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ঋত্বিকের বোন আর বোনজামাই রক্ষা পেলেও তাদের একমাত্র ছেলে রাহুল পাকিস্তানীদের অত্যাচারে আজীবনের জন্য মস্তিষ্কবিকৃতির স্বীকার হয়ে যায়। স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে এসে ঋত্বিক শুধু বীভৎসতার গন্ধই পেয়েছিলেন।
ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবনের সৃষ্টি হয় একসময়। তাদের সেই সুন্দর বাড়িটির ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া গিয়েছিল অদ্বৈত মল্লবর্মণ এর তিতাস একটি নদীর নাম বইটি। প্রতীতি দেবীই বইটি ভাইকে পড়তে দেন। রাতে বোনের পাশে শুয়ে শুয়ে বইটি পড়তে পড়তে তিনি যেন এক অন্য দুনিয়াতে হারিয়ে যান। মাঝরাতে বোনকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বলেন- তিনি তার নতুন সিনেমার আইডিয়া পেয়েছেন! আইডিয়া লেখার জন্য তার হাতটা নিশপিশ করছিল, ফাউন্টেন পেন একটা পাওয়া গেলেও সারা বাড়ি খুঁজেও কোন কাগজ পাওয়া গেল না। রাগে দুঃখে নিজের বোনের দুই হাতে স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করলেন ঋত্বিক। বোন বললেন- লেখাগুলো তো কাল সকালেই মুছে যাবে দাদা! হতাশ হয়ে পড়লেন ঋত্বিক, একটু কাগজের জন্য একটা আইডিয়া মারা যাবে?! আশা দেখালেন বোন নিজেই, নিজের একটা সাদা শাড়ি বের করে দিলেন, সেই শাড়ির উপরে সারারাত ধরে চলল তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমার স্ক্রিপ্ট এর লেখনী।

১৯৭৩ সাল, শুটিং চলছে তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমার। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা ঋত্বিকের শরীর, অথচ কারো কথা না শুনে তিনি একটার পর একটা শট নিয়েই যাচ্ছেন। অবশেষে শেষ শটটা "ওকে" বলে তিই তিতাসের বালুতে গড়িয়ে পড়লেন। শুভাকাঙ্ক্ষী ইন্দিরা গান্ধী অসুস্থ ঋত্বিকের জন্য বিমান পাঠালেন, সাথে আসলেন আরেক বিখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেন। তাদের বিমানটি যখন পদ্মার উপর দিয়ে যাচ্ছিল, তখন মৃণাল সেন ঋত্বিকের চোখে তাকিয়ে দেখলেন- তার চোখ দিয়ে অঝোরে পদ্মার জল বয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলার সেই স্মৃতির কথা মনে করে মৃণাল কে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ শব্দ করে কাঁদতে থাকলেন তিনি, বিমানের ইঞ্জিনের শব্দে সেই কান্নার শব্দ ঢাকা পড়ে গেল।

ঋত্বিক ঘটক একেবারেই পাগলাটে এক পরিচালক ছিলেন, নিজের ইচ্ছামত কাজ করতেন। প্রচণ্ড অর্থকষ্টে ভুগেছেন বেঁচে থাকা অবস্থায়। এরপরেও সিনেমাকে ছাড়েন নি। সত্যজিৎ যেখানে বলতেন- চলচ্চিত্রের কাজ সমাজ পরিবর্তন নয়, সেখানে ঋত্বিক বলতেন উল্টো কথা- চলচ্চিত্র দিয়ে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব! "আপনি কেন সিনেমা বানান" এর উত্তরে তিনি বলেন- কেন বানাই? কারণ আমি একেবারেই পাগল! আমি সিনেমা না বানিয়ে থাকতে পারি না। আমাদের তো কিছু করে বাঁচতে হয়, তাইনা? তাই আমি সিনেমা বানাই, অন্য কোন কারণ নাই। সিনেমা আমার কাছে শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ার, আমি লড়তে জানি, পরোয়া করি না। আর হ্যাঁ, সিনেমা বানানো হয় না, তৈরি হয়।"

সিনেমা নিয়ে যিনি ভাবতে বলতেন আর বলতেন-"ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস কর!" সেই মানুষটার আজকে জন্মদিন।
। প্রজন্ম সম্ভবত ঋত্বিক ঘটককে খুব কমই চিনে, ঋত্বিক নাম শুনলে তার সামনে হয়ত ঋত্বিক রোশন নামক সুদর্শন চেহারার এক নায়কের ছবি ভেসে উঠে যেটা সমস্যা না, সমস্যা হল ঋত্বিক ঘটক কে না চেনা। তবে চিনুক বা না চিনুক, পৃথিবীতে যতদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন গর্জে উঠবে, ততদিন সেই আন্দোলনের ভিড়ে মোটা ফ্রেমের, কাঁচাপাকা চুল দাড়ির একজন ঋত্বিক ঘটকের চিৎকারকে শুনতে পাওয়া যাবে।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৬
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×