somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঐ মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু সিস্টেমেটিক কিলিং এ মরছেন (উৎসর্গ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে)

০৮ ই নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৪:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আসকর আলী মারা গেলেন ২১শে জুলাই ২০০৯ এ। বয়স ৬৫ বৎসর আনুমানিক। যদিও আমার অনুমান ছিল তাঁর স্ত্রী ই আগে বিদায় নেবেন। খতিজা বেগমের শরীরে লীভার সংক্রমণের প্রমাণ স্পষ্ট হচ্ছিল প্রকট ভাবেই। প্রথমে স্ক্যাভীজ মনে করেছিলাম, যদিও ভুল ভেঙ্গেছিল পরের ডায়াগনোসিসেই। কক্সবাজার হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল। ওখান থেকে জার্মানীর লিভার কন্স্যালটেন্সী নিশ্চিত জবাব পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি আর আমার সহকর্মী আশা করছিলাম একদিন খতিজা বেগম আর ঘুম থেকে উঠবেন না আর হয়ত এটাই তার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে।

দূরারোগ্য ব্যাধি, দূরারোগ্য দারিদ্র, দূরারোগ্য পরিস্থিতিতে খাতিজা বেগম বেঁচে রয়েছেন এখনো; কিন্তু আসকর আলী চলে গেলেন একেবারে আচমকাই। খবরটা পেলাম ২৩ এ...। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করার সাড়ে সাত হাজার টাকার অর্ধেক পাওয়া গিয়েছিল বাকীটা এলাকার মানুষজনের বদান্যতা। কক্সবাজারের দক্ষিণ কুতুবদিয়া বস্তির উচ্ছেদকৃত মানুষের টাকায় দাফন হয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার।

আসকর আলী ছোটলোকের বাচ্চা কিনা? বাংলাদেশের ৯০ ভাগ লোক কি বড়লোকের বাচ্চা?
মুক্তিযোদ্ধারা কি বড়লোকের বাচ্চা ছিলেন? কতজন ছিলেন? ভবিষ্যতে কতজন থাকবেন?
অবসর প্রাপ্ত পুলিশ কর্মচারী আসকর আলীর সারদার ট্রেনিং কাজে এসেছিল। নিজের জায়গা থেকে উচ্ছেদকৃত হয়ে, নিজের সারাজীবনের সঞ্চয় চোখের সামনে ভেঙ্গে মিশে যাবার পরও হার মানেন নি।
তত্ত্বাবধায়ক সামরিক সরকার কক্সবাজারের বিমানঘাঁটি সম্প্রসারিত করার নামে একদিনের নোটিশে ৮৩০ঘর ৭-৮ হাজার মানুষের জীবন, আশ্রয় এক লহমায় ভেঙ্গে দিয়েছিল। আসকর আলীর সাথে যখন এই বিষয়ে কথা হচ্ছিল তখন তিনি হতাশ অশ্রুসজল হয়ে বলেছিলেন; নিজের দেশের মানুষ পাক বাহিনীর চাইতে বেশি অত্যাচার করেছিল সেদিন।

উচ্ছেদের পর এই জনগোষ্ঠীকে যেখানে অস্থায়ী জায়গা দেয়া হয়েছে সেটা সমুদ্রের জোয়ার প্রবণ এলাকায়, প্রায়শই পানি আটকে থাকে। এই বলপ্রয়োগী পূর্নবাসনে আশ্রয়দাতা ও দিক নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন আসকর আলী। উনি বীরপ্রতীক ছিলেন না, বীর উত্তমও ছিলেন না কিন্তু একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই জীবনে যাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে তারা হয়ত এই অনুভূতিটা বুঝতে পারবেন। এই মানুষগুলোর ভেতরে এমন একটা কিছু আছে যা আপনাকে বারবার একটা অমোঘ শক্তির কথা মনে করিয়ে দেবে। দ্রারিদ্র বয়স শ্রেণী নির্বিশেষে এমন একটা আলো, দ্যুতি এবং পরিশেষে গভীর বেদনা ধ্বিক ধ্বিক জ্বলতে থাকে যেটাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বাঙালী রক্তের সবচেয়ে শক্তিশালী শুদ্ধ মেধাবী স্রোত ধারার স্পন্দন আপনি এমনভাবে টের পাবেন, যেটা আপনাকে আশাবাদী করতে বাধ্য। আমাকেও করেছে বারবার। তাই আমি ছুটে গেছি।

কোন রকম প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছাড়া আমাদের তিনি সাহায্য করেছেন নিরলসভাবে। এই মহত্ত্ব, এই দৃঢ়তা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে আমার পূর্ব পৃরুষের শক্তিমত্তাকে, দৃঢ়, যোদ্ধাসত্তাকে।

সেই আসকর আলী খুন হলেন। হ্যা আসকর আলীর মত মানুষেরা প্রতিদিন রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থাপনায় খুন হন। ঠিক এই মুহুর্তে হচ্ছেনও অবশিষ্ট্য দূর্লভ এই মানুষেরা। এরা কেউই মসনদে নেই। এরা কোনদিনই মসনদে বসেন না। এরা মসনদের বলি। কিভাবে?

মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণিত হবার জন্য তাকে যাচাই বাছাইয়ের পরীক্ষা দিতে হয়েছে বারবার বহুবার। নিজের যুদ্ধ অঞ্চল সিলেট থেকে কক্সবাজারে সদস্যপদ স্থানান্তরণের জন্য আবেদন করতে হয়েছে। ধর্ণা দিতে হয়েছে। কোনদিন সরকারের কাছ কিছু চাননি, শান্তিটুকু ছাড়া। সরকার তাকে প্রতিদান হিসেবে শান্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। উচ্ছেদ হয়েছেন নিজের গৃহ থেকে, নিজের অস্তিত্বের শেষ সম্বলটুকু গুড়িয়ে দিয়েছে সরকারী বুলডোজার। আশ্রয় হয়েছে উচ্ছেদকৃতের বস্তিতে।

দারিদ্রের শৃঙ্খলে নিষ্পষিত হয়ে, আত্ম সম্মানের শোকে মারা গেছেন আসকর আলী। বাড়ীতে ক্ষুধায় থাকতে না পেরে তার কনিষ্ঠ মেয়ে পালিয়ে যান চট্টগ্রামে, সেখানে মাদক ব্যাবসা আর পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িয়ে পড়েন। বহুদিন ধরে খোঁজ খবরের পর সেখানে ছুটে যান আসকর আলী। চট্টগ্রাম জেল থেকে মেয়েকে ছাড়িয়ে বাসায় নিয়ে আসেন। এর ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যান। একজন আসকর আলীর এই যে উপায় হীনতা তা উন্মোচন করে দেয় রাষ্ট্রের মুখোশ। এখানে আওয়ামী বিএনপি বাম জামাত সবাই এলিট। গণমানুষের শক্তি আর সামর্থ্যের ব্যবস্থাগত হত্যাকান্ডে সবাই অংশীদ্বার।


মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এই ব্লগ, টুকরো টুকরো সেমিনার, আমাদের গণস্বাক্ষর ইত্যাদির চাইতে এত বড় বিষয় তা সম্ভবত আমরা অনুমানও করি না। করলে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চাইতে বড় মনে করার সাহস হোত না আসলে। আর যারা আছেন মুক্তিযোদ্ধা- রাজাকার ধোঁয়া ব্যবসায়ী তাদেরও সাহস অনেক। আমারাই দিয়েছি আসলে। ক্রমান্বয়ে আপস করতে করতে। আমি কখনো ব্যক্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বুঝি না। শেখমুজিব জিয়া দিয়েও নয় অথবা ব্লগের অমি রহমান পিয়াল দিয়েও নয়। ব্যাক্তি পিয়াল যদি “পর্ণ ব্যবসায় (বানোয়াট অভিযোগ বা সত্য যে কোন অর্থেই)” নামেন তাতে মুক্তিযুদ্ধের শুদ্ধতা নষ্ট হয় না । কারণ আমার মুক্তিযুদ্ধ তার উপর নির্ভর করে না। আসলে কারোরই করে না। মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর করে এর চেতনার উপর। আর এই চেতনা সচল রাখতে যে যতক্ষণ আছেন আমি তার সাথে আছি। এই চেতনার উপর দাগ মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের ব্যাক্তিগত ভুলে কেবল তৈরী হয় না, হয় এইটা নিয়ে নির্বোধ ব্যক্তি নির্ভরতায়। যখন মানুষজন তাদের চিন্তা উপলব্ধির ভার অন্যের উপর দিয়া রাখেন; সেইটার মাধ্যমে খালাশ পাইতে চান তখন। আমি এই খালাশ পাওয়ার জায়গা বন্ধ করার আহবান জানাই। তা না হলে শত শত নিজামী জন্ম নিব এই মাটিতে, আর শত শত আসকর আলী মারা যাবেন ক্ষুধা আর অমর্যাদায়।


১৮টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×