বড়দা আমায় ছোটদা বলে ডাকে। বড়দার থেকে আমি পাচ বছরের ছোট। বড়দার মুখে 'ছোটদা' শুনলেই আমার লজ্জা লাগে। মা প্রায়ই বকত, 'ওকিরে, ও না তোর থেকে ছোট ওকে আবার দাদা বলছিস যে বড়'। দাদা হাসত আর আমার গাল টিপে বারবার করে ছোটদা ছোটদা বলত।
আমার জন্যে বড়দার আদর-ভালোবাসার ভাগটা একটু বেশিই ছিল। সেবার ঈদে বড়দার ইয়া লম্বা পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়ে যেইনা বলেছি, 'আমার থেকে এখানা বেশি সুন্দর' বড়দা তখনি পাঞ্জাবীটা নিয়ে গিয়ে অনেক সাধ্য-সাধনা করে ছোট করিয়ে আনলো। মাকে দেখিয়ে বলল, 'দেখছ মা ছোটকে বেশ মানিয়েছে না? '
মা রেগে ভোম হয়ে গেল, রেগে গেলে মায়ের নাকের পাটা ফুলে যায়। আমি বড়দাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা বাবাকে পইপই করে মানা করে দিল যাতে এ ঈদে বড়দাকে আর কিছু না কিনে দেয়। দাদা সব শুনে হাসল।
আমি দাদার পাঞ্জাবী পড়ে দাদার আঙুল ধরে নামাজ পড়তে গেলাম। বড়দার মাঝে নতুন পাঞ্জাবী না পড়ার খেদ দেখা গেল না। বড়দা দু বছর আগের পাঞ্জাবী পড়ে হাসি হাসি মুখে পুরো ঈদের দিন কাটালো।
দুমাস হল নীলাদি আমাকে পড়াতে আসছে। আমি অংক তেমন বুঝিনা। আর এবারের সরল অংক এর মত জটিল কোন অংক দুনিয়াতে আছে বলে আমার মনে হয় না। মাকে বলতেই নীলাদিকে আনিয়ে দিল। নীলাদি নাকি মেট্রিক, আইএ দুটোতেই অংকে লেটার। মায়ের খুব ইচ্ছে আমি এবার বৃত্তি পাই, মা সে উপলক্ষে পুরো পাড়া খাওয়াবে। মা পাড়া খাওয়াতে ভালবাসে।
বড়দাকে কখনোই বিকেলবেলা বাড়িতে পাওয়া যেত না। ওদের সব বন্ধু মিলে পাড়ার মাঠটায় কি এক ইয়াং ক্লাব খুলেছে, সে নিয়েই মেতে থাকে। নীলাদি আসার পর থেকেই বড়দার নিয়ম পাল্টে গেল। নীলাদি আমাকে বিকেল বেলা পড়াতে আসতো। নীলাদির পিছুপিছু বড়দা বাড়িতে ঢুকত। রান্নাঘরে ঢুকে মাকে খোঁচাত, 'তুমি কেমন ছাত্রের মা বলত মাষ্টার এসেছে তবুও তাকে এখনো খেতে দাও নি? ' মা রেগে যেত,'তোর কি মনে হয় ওকে আমি না খেয়ে বিদেয় করি, ভরপেট খেয়ে তবেই না যেতে দি'। সেবার পানি খাওয়ার জন্যে ঘরে ঢুকতেই মায়ের বিরক্ত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আড়াল থেকে কথা শোনা অপরাধ, আমি তবুও দাড়িয়ে রইলাম। মা বিরক্ত স্বরে বলল, 'কি ব্যাপার বলত, তোর কি নীলাকে খুব পছন্দ? ভালোবাসিস-টাসিস নাকি?
বড়দা কিছু বলল না, আমি পর্দার আড়াল থেকে স্পষ্ট বড়দার মুখভর্তি হাসি দেখতে পেলাম।
অব্যাক্ত রাগে আমার গা কাপতে লাগল। বড়দার ভালোবাসা ভাগ হয়ে যেতে দেখে আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। সেরাতেই খাবার সময় মাকে বিচার দিলাম, 'মা আমি নীলাদির কাছে পড়ব না। নীলাদির কাছে আমি অংক বুঝি না'।
বাবা ধমকে উঠল, 'রাহেলা তোমার কি ঙান বুদ্ধি কিছু হবে না নাকি, একটা মেয়েকে পড়াতে রেখেছ! কাল থেকে যেন আর ঐ মেয়েকে না দেখি '।
বড়দার মুখ কালো হয়ে গেল। আমি খুশি হলাম, অন্তহীন খুশি।
কাধে কারু স্পর্শে ঘুম থেকে ধরফর করে উঠলাম। বড়দা ধরে থামিয়ে দিল। ভেজা ভেজা স্বরে বলে উঠল, 'ছোটদা শোন, তুই নীলাকে ছাড়াস না। টিউশনিটা চলে গেলে যে নীলার বাচার উপায় থাকবে না। মেয়েটা ঠিক মরে যাবে'।
বড়দা আমায় জড়িয়ে কেঁদে ফেলল, আমিও বড়দাকে জড়িয়ে ধরলাম। পরদিন মাকে বলে কয়ে আবারো নীলাদিকে বহাল করালাম। সেদিন নীলাদি পড়াতে এসে বারবার আটকালো। সহজ, সরল অংক গুলিয়ে ফেলল। আমি চোখের কোন দিয়ে দেখলাম নীলাদির চোখে জল, লুকিয়ে লুকিয়ে সে জল 'মুছছে। নিজেকে খুব বড় অপরাধী বলে মনে হতে লাগল আমার, খুব বড় অপরাধী ।
আম-কাঁঠালের ছুটি পড়েছে। বিছানায় চীৎ হয়ে রবিঠাকুরের 'শেষের কবিতা' পড়ছি, বড়দা পড়তে দিয়েছে। নীলাদি ছুটির মাঝেও পড়াতে আসছে। ছুটির মাঝে আমার একদম পড়তে ইচ্ছে করে না আবার বড়দার অনুরোধ ফেলতেও পারি না। বইখানা পড়তে দেবার সময় ফিসফিস করে কানে কানে বলেছিল বড়দা, "নীলাদিকে নাকি তার বইয়ের নায়িকা 'লাবণ্যের' মত লাগে। নিজেকে নায়কের আসনে বসিয়ে প্রতিদিন নীলাদির সঙ্গ পেতে চায়। আমাকে তার মাধ্যম বানিয়েছে"।
পরদিন সকালে একটা চিরকুট টেবিলে চাপা দিয়ে বড়দা হাওয়া হয়ে গেল। মায়ের কাছে সেটা নিয়ে যেতেই দেখি বসার ঘর ভর্তি পুলিশ। বাবা চেয়ারে বসে রাগে কাঁপছে, মা আলমারির কোনা ধরে ক্ষীণ সুরে কাঁদছে।
ঘন্টাখানেক পর পুলিশ চলে গেল। অভিযোগ ঘোরতর। নীলাদি থানায় বড়দার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা ঠুকেছে। সকলে চলে যেতেই ঘরে বসে চিরকুট খুললাম,
'ছোটদা'
যা শুনবি, যা দেখবি সব ভুলে যাবি। শুধু এটুকু জেনে রাখ তোর বড়দা কোন অপরাধ করতে পারে না। আমি আপাতত হারিয়ে যাচ্ছি। ভালো থাকিস।
'তোর বড়দা'
আমি জানতাম আমার বড়দা এধরনের কিছু করতে পারে না। আমি নিশ্চিন্ত মনে বিকেলে পাড়ার ম্যাচে ক্রিকেট খেলতে গেলাম। মাঠে ঢুকতেই সকলে আমায় বাতিল করে দিল, দুয়ো দিতে দিতে বাড়ি পর্যন্ত এসে গেল। অতিউৎসাহী কয়েকজন টিনের চালায় ঢিল ছুরে বসল। বাবা লাঠি নিয়ে বের হয়ে এসে সব্বাইকে তাড়ালেন ।
সেরাতে থালার মত চাদ উঠল। শেষরাতে বাবা-মার ঘরে টোকা দিলাম। মা চট করে উঠে এসে জড়িয়ে ধরল। আমি চুপি চুপি মায়ের কানে কানে বললাম 'মা আমি তোমার সাথে শোব'।
বাবা মায়ের মাঝে শুয়ে নিজেকে বড্ড স্মৃতিকাতর বলে মনে হল। বড়দা আর আমি মায়ের কাছে শোব বলে বায়না ধরতাম। একদফা মারামারি পর্যন্ত হয়ে যেত এনিয়ে। মাকে বড্ড অসহায় বলে মনে হতে লাগল। চাঁদের আলোয় ফোটা ফোটা জল গড়াতে দেখলাম তার চোখজুড়ে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। কতদিন ফুসফুস ভর্তি করে মায়ের শরীরের গন্ধ নেয়া হয় না।
মা মা গন্ধে আমার সারা শরীর আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
দিনদুয়েক ধরে বাবা-মার ফিসফিস করে কথা বলাটা বেড়েছে । রাত্রিরে খুব একটা ঘুম হয় না । মাঝে মাঝে মনে হয় পর্দার আড়াল থেকে কে যেন মায়াভরা চোখে নিষ্পলক চেয়ে আছে । খুব পরিচিত একটা গন্ধ ভেসে আসে । মনের ভুল, এছাড়া আর কিইবা হবে । আজকাল আর বাড়ি থেকে তেমন বের হই না, স্কুলেও যেতে ইচ্ছে করে না । দুয়ো শুনতে শুনতে মাথা ধরে যেত একসময় । মাও বারণ করে দিয়েছে যেতে । সন্ধের দিকে মাঠের দিকে মাঝে সাঝে এগোয় । এসময়টাই যা একটু ফাঁকা থাকে । কাল সেসময় নীলাদির সাথে দেখা । দেখামাত্রই চোখ ভিজে এল আমার, পেছন ফিরে হাটা লাগিয়ে দিলাম । নীলাদি হাত ধরে ঘুরিয়ে দিল ।
বিশাল শোন, জানি আমি খারাপ, খারাপ মেয়ে, অনেক অনেক খারাপ মেয়ে । তা না হলে এরকম জঘন্য একটা কাজ করতে পারতাম না । তোর বড়দার মত মানুষকে এভাবে নিমেষে ছোট করে দিতে পারতাম না । কি করব বল, আমি যে......
ঠোঁ কামড়ে ধরে নীলাদি
তোর বড়দাকে খারাপ ভাবিসনে যেন । তবে যে মানুষটা ঠিক মরে যাবে, ঠিক মরে যাবে । বলেই হন হন করে নীলাদি চলে গেল ।
আমার সে রাতের কথা মনে পড়ে গেল । বড়দা ঠিক এভাবে নীলাদির জন্যে কেদেছিল । আমার ছোট মাথায় সম্পর্কের সরল অংকগুলোর উত্তর দিতে পারছিল না । কে জানে আরসবের মত এর উত্তরও হয়তো শূণ্য ।
আজ আমরা চলে যাচ্ছি । নামে মাত্র দামে বাড়ি ভিটে বিক্রি করে দিয়েছে বাবা । ট্রাকে মালপত্র তোলার কাজও প্রায় শেষ । আমগাছটার দিকে চেয়ে হঠাৎই চোখ জল ছুইছুই করতে লাগল আমার । বড়দা বলত, চোখে পাড়বাধানো দুটো দীঘি রয়েছে । বুকে ঝড় উঠলেই পাড় ছড়িয়ে জল উপচে পড়ে । যদি থামাতে চাস তবে কোন টেনে ধর । দীঘির জল দীঘিতেই ফেরৎ যাবে । আজ আর ফেরৎ যায় নি, পাড় ভেঙে পড়েছে যে !
নতুন বাড়িটা বেশ ছোট, উঠোন নেই । দুটো ঘর । তবে এই ভাল, দিনরাত ভাত খেয়ে যাবার মত দুয়ো শুনতে হয় না । পুরো বিকেল পাড়া হেটে বেড়ানো যায়, মাঠে চুপচাপ বসে থাকা যায়, তুলে দেবার কেউ নেই । মাঝে মাঝে শিখার কথা মনে পড়ে । আসবার আগে হাতের মুঠোয় ছোট্ট এক টুকরো কাগজ গুজে দিয়েই পালিয়েছে । লেখা,
ভাল থাকিস
শিখা, না তোর খাসি
কাগজটা পকেটে চেপে ঘুরে বেড়াতে বেশ লাগে । মাঝেমাঝে ভয় হয় । শিখাটার না বড্ড মিল নীলাদির সাথে । এক আধটু অমিল থাকলে কি এমনটা হত ?
ভবনটার এমাথা ওমাথা পুরো ফাঁকা । মাঝে মাঝে অবশ্য ট্রলি ঠেলে ঠেলে দু একজন আসছে । তাদের মাঝে বড়দাকে দেখা যাচ্ছে না । বাবা দু সেকেন্ড বসে থাকতে পারছে না । বারবার এদিক সেদিক করছে । মা চুপচাপ, ঠায় বসে আছে । বড়দা এল পাক্কা দেড়ঘন্টা পর । বোর্ডিং পাশ দেবার মিনিট দশেক আগে । একমাথা চুল হয়েছে বড়দার, মুখে বহুদিনের না কামানো দাড়ি । আমায় দেখে ঠোট টেনে আসল । আমিও চেষ্টা করলাম । ঠোটদুটো বিদ্রোহ ঘোষনা করল । বাবা বড়দার হাতে পাসপোর্ট ভিসা গুজে দিলেন ।
বড়দা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ছোড়দার সাথে কথা আছে । বড়দা আমায় জড়িয়ে ধরল । থেকে থেকে বড়দার বুক কেঁপে উঠছে । ভেজা চোখে হাসতে হাসতে বড়দা প্রশ্ন করল, ছোড়দা তুই কি জানিস আমি তোদের কতটা ভালবাসি ?
আমি উত্তর দিতে পারলাম, আমার ছোট্ট শরীর সে প্রশ্নের ভার বইতে পারল না । পেছন ফিরে ছুট লাগালাম ।
বড়দা হরেকরকম ঘুড়ি বানাতে পারত । এক সকালে বাক্সমতন এক ঘুড়ি বানিয়ে এনে বলল ছোড়দা জানিস এর নাম উড়ালপঙ্খি । চোখ বন্ধ করে তোর সব ভালবাসা এতে জমা কর । আমি সরল বিশ্বাসে চোখ বন্ধ করলাম । উড়ালপঙ্খি উড়ল, একসময় সুতো কেটে গেল । আমার ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে দাদা বলল, জানিস ছোড়দা তোর সব ভালবাসা উড়ালপঙ্খিতে করে উপড়ওয়ালার কাছে পৌছে গেছে, দেখিস উপরওয়ালা তোকে ভালবেসে তোর সবথেকে প্রিয় জিনিসটা পাঠাবে ।
বো বো শব্দে বড়দার উড়ালপঙ্খি উড়াল দিল । আমার জীবনের সবটুকু ভালবাসা কেড়ে নিয়ে উপরওয়ালা তবে কি দেবে আমায় ? আমার যে বড়দাকে ছাড়া কিচ্ছু চাইনা, একদম না ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:০১