somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নারিকেল জিঞ্জিরার দেশে - টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্বের লিংক

১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪

আমরা প্রায় সকাল সাতটার দিকে টেকনাফ চলে এলাম। চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ আসার পথটা ছিল অদ্ভুত রকমের সুন্দর। চিকন রাস্তা, বিপরীত দিক থেকে মাত্র দুটি গাড়িই যাওয়া-আসা করতে পারে। আবার মাঝে মাঝে ক্রস করার সময় যেকোন একটিকে রাস্তা ছেড়ে একটু বাইরে চলে যেতে হয় যাতে অন্যটি অনায়াসে ক্রস করতে পারে। সুর্য উঠার পর পরই মানুষজন যার যার কাজে বেরিয়ে পড়েছে। এত ভোরবেলায় মানুষ বেরিয়ে পড়েছে তারপরেও কোথাও কোন ব্যস্ততা নেই, তাড়াহুড়ো-দৌড়াদৌড়ি নেই।


আমি মাঝে মাঝে অনেক ভোরে গাড়ী নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটন ডিসির দিকে বেরিয়ে পড়ি, সেই ভোরেও দেখি গাড়ির লম্বা লাইন, ট্রাফিক, সবার মাঝেই অন্যকে ফেলে আগে চলে যাওয়ার একটা প্রবণতা, ড্রাইভিং সিটে বসেই কেউ কেউ নাস্তা করে, কেউ কফিতে চুমুক দেয়, কেউবা রেডিওতে সংবাদ শুনে - দিনের শুরুই হয় ব্যস্ততা আর মাল্টি-টাস্কিং দিয়ে। কিন্তু এখানে পুরো পরিবেশ জুড়ে একটা স্থিরতা আছে। ছোট ছোট বাচ্চারা মসজিদের দিকে যাচ্ছে আরবি শিক্ষার জন্য। আবার কোন কোন মসজিদে প্রায় ৩০/৪০ জন বাচ্চা সমস্বরে কায়েদা, আম-পারা ইত্যাদি পড়ছে। তাদের পড়ার আওয়াজ আমি বাসে বসে শুনতে পাচ্ছি। কাউকে কাউকে দেখলাম ক্ষেতে কোন একটা কাজ করছে। দোকানিরা তাদের ছাপড়া দোকানগুলি খুলছে, চা বা অন্যকিছুর জন্য কাস্টমারের বিরাট লম্বা লাইন নেই। অনেকদিন পর এরকম কিছু দৃশ্য চমৎকার একটা ভালো লাগা তৈরি করে দিল।


বাস থেকে নামার সাথে সাথেই ছোট ছোট বাচ্চারা চারপাশে ঘিরে ধরলো। এদের বয়স দশ পার হয়নি। সামনেই জাহাজের টিকিট কেনা-বেচার একটি স্থান। চারিদিকে খোলা ও উপরে টিনের ছাদ দেওয়া বড় একটি জায়গা। বসার জন্য অনেকগুলি লম্বা বেঞ্চ ও টেবিল লাগানো আছে। পাশেই আছে বিভিন্ন জাহাজের (তারা এটাকে জাহাজই বলে) টিকিট কাউন্টার। বুঝতে পারলাম, ঢাকা থেকে টিকিট না কেটে এখানে এসেও টিকিট করা যায়। জাহাজে উঠার আগে এখানে এসে সবাই অপেক্ষা করে, প্রাতঃকৃত্য সেরে নেয়। বাথরুমে যাওয়ার জন্য যথারীতি লম্বা লাইন ও অপরিষ্কার। আমার এতে সমস্যা হয়নি কারণ আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, এটা এমনই হবে। বাচ্চারা সবার কাছেই ঘোরাফেরা করছে। এখান থেকে জাহাজে লাগেজ পৌঁছে দেওয়ার বিনিময়ে কিছু পয়সা পাবে। কিন্তু কাউকেই দেখলাম না, তাদের কাছে লাগেজ দিতে। যাত্রীরাও তাদেরকে পয়সা দিতে নারাজ। আমাদের জাহাজ ছাড়বে সকাল সাড়ে ন’টায়। ধীরে ধীরে সময় ঘনিয়ে এল। একটু রাস্তা পেরিয়ে কাঠের সাঁকো দিয়ে আমরা জাহাজে গিয়ে উঠলাম।


এখানে আসার আগে জানতাম না যে, কেয়ারী সিন্দবাদ ছাড়াও অন্যান্য কোম্পানির জাহাজও আছে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার জন্য। কেয়ারীর পাশাপাশি অন্য জাহাজও দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে কোন সিট নাম্বার নেই। যে যার সুবিধামতো বসলেও জাহাজ ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে বেশিরভাগ যাত্রীই বাইরে চলে এল। উপরে খোলা আকাশ আর নীচে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশি রেখে কে ভেতরে বসে থাকবে? কিছুক্ষণ পরই আমাদের পিছু নিল একদল সামুদ্রিক গাংচিল! যাত্রীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস। সবাই এদেরকে বিস্কিট, চিপস খাওয়াচ্ছে। মনে হচ্ছে, সেন্টমার্টিন পর্যন্ত সারাটা পথ এরা আমাদেরক সংগ দিবে, আনন্দ দিবে।


মাঝে মাঝে মনে হল, বিবর্তনের ধারায় আমাদের দুটি পাখা তৈরি হল না কেন? এই ইচ্ছাটি মনে হয় সবার মধ্যেই আছে। কাজেই অদূর ভবিষ্যত মানুষের দুটি করে পাখা থাকার সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না! জাহাজে খাবার-দাবারও বিক্রি হয়। একটি ছেলে কাছে এসে কফির কথা বলতেই কফি খাওয়ার ইচ্ছে হল। মনে পড়ে গেল, আমি যখন ম্যাসেচুসেটস বে-তে গিয়েছিলাম তিমি দেখার জন্য, তখন দুটি বাডউইজার বিয়ার নিয়েছিলাম। তখন অন্তরা সাথে ছিল না। সেই দ্রুত গতির জাহাজের সাথে বিয়ার যেমন উপভোগ্য, ঠিক তেমনই এই ধীরগতির জাহাজের সাথে কফিই হবে চমৎকার! চড়া দামে ছোট প্লাস্টিকের গ্লাসের তিন ভাগের এক ভাগ পূর্ণ দুটি কফি নিয়ে এল অন্তরা, সাথে আছে চিপস।


চিপসের প্রায় পুরোটাই গেল গাংচিলগুলোর পেটে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অন্তরা একটি একটি চিপস বাইরে শূন্যে ছুঁড়ে মারছে আর গাংচিলগুলো অদ্ভুত দক্ষতায় সেগুলো পানিতে পরার আগেই ছোঁ মেরে মুখে পুরে নিচ্ছে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী না করলে আফসোস থেকে যাবে। টেকনাফ ছেড়ে আমাদের জাহাজ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মাছ ধরার নৌকা দেখতে পাচ্ছি। যাওয়ার পথে একপর্যায়ে এক পাশে দেখেছিলাম পাহারের সারি। ঠিক পৌঁছানোর কিছু আগে অন্যান্য যাত্রীরা জাহাজের এক পার্শে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলেছিল, ওটা মায়ানমার। আমদের দেশে ট্যুরিজম ব্যাপারটা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। নাহলে সারাটা পথ জাহাজ কতৃপক্ষের কেউ একজন সেন্ট মার্টিনের ইতিহাস শোনাতে পারতো, যাওয়ার পথে যা যা দেখা যাচ্ছে, তার একটা বর্ণনা দিতে পারতো।



প্রায় তিন/সাড়ে তিন ঘণ্টা কীভাবে পার হয়ে গেল টের পেলাম না। কেয়ারী সিন্দবাদের জাহাজ আমাদের সেন্ট মার্টিন পৌঁছে দিল। বাক্স-পেটরা সহ জাহাজ থেকে বের হয়ে দ্বীপে নেমে এলাম। কোলাহলপূর্ণ বাজার। লাইন ধরে অনেকটা রিক্সার মতো করে প্রচুর ভ্যান দাঁড়ানো আছে। আগে থেকে আমাদের কোন হোটেল ঠিক করা ছিল না। তবে আমার কাছে তথ্য ছিল যে, সেন্ট মার্টিনে দুই ধরনের হোটেল আছে - এক, বাজারের মধ্যে বা বাজার এলাকার কাছাকাছি কিছু হোটেল, যেখান থেকে বাজারে সহজে যাতায়াত করা যায়; দুই, আরেক ধরনের হোটেল বীচের কাছাকাছি যাতে সহজেই বীচে যাওয়া যায়। আমার উদ্দেশ্য ছিল বীচের কাছাকাছি হোটেলে থাকা, তাই ব্লু মেরিনের কথা অনেক শুনলেও সেটা তালিকা থেকে আগেই বাদ দিয়েছিলাম। বরং ঠিক করেছিলাম যে, ঘুরে ঘুরে দেখে হোটেল নির্বাচন করবো। পর্যটনের একটি হোটেল আছে সেখানে। প্রথমে সেখানে যাওয়া স্থির করলাম। এবার ভ্যান ঠিক করার পালা। যে ভাড়ায় ভ্যান ঠিক করেছিলাম, আর পরে আবার সন্ধ্যার দিকে হোটেল থেকে যে ভাড়ায় একই জায়গায় খাওয়ার জন্য এসেছিলাম - দুইয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য বললে কম বলা হবে।

সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৮:৪৭
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×