somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দূরে কোথায়? রিসপ, লাভায়

১৭ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একদিন ছুটি হবে
ছিয়াত্তর বছর বয়সী একটা মানুষের নাম কিশোর, কিশোর মিত্র। এর আগে এত কাছ থেকে এত আবেগ নিয়ে হঠাৎ পরিচিত একটা মানুষের এতটা শুনেছি কি না, মনে পড়ে না। মানুষটা অদ্ভুত, বড় অদ্ভুত। বৈচিত্র্য দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ। যদিও তার নিজের হিসেবে জীবনের সায়াহ্নে এসে উপলব্ধি, কোনো কিছুই করা হলো না ঠিকমতো এই জীবনে। আপাতঃনিরীহ সদা হাস্যময় বিনয়ী কিশোর নামক এই বুড়ো শিশুটির সঙ্গে দেখা লাভায়। হিমালয়ের কোলের মধ্যে একটা বিষণœ জনপদ। ছায়াঢাকা, কেমন যেন একলা লাগা একটা ভাব। সেই চুপটি করে বসে থাকা গ্রামটার নাম শুনছি অনেক বছর যাবৎ। ২০০২ বা ০৩ থেকে। তখন লোকবসতি তেমন ছিল না বললেই চলে। তখন থেকেই যাচ্ছি, যাই। কিন্তু হয়ে উঠছে না। একসঙ্গে তিনটি নাম ‘কখনো যাব’র তালিকায় আছে তো আছেই। লাভা, লোলেগাঁও আর রিসপ। কিন্তু বাক্স পেটরা নিয়ে আর বেরিয়ে পড়া হচ্ছে না। সময়ে সময়ে ওদেরই ধারে-কাছে দার্জিলিং, কালিম্পঙ বা মিরিক যাওয়া হচ্ছে। হয়তো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি ওদিকটায় যাব বলেই। কিন্তু মাঝপথে রাস্তা বদলে চলে গেছি অন্য কোথাও। এমনই যখন চলছে প্রায় এক যুগ। তো এবার হঠাৎই আবার সিদ্ধান্ত।
ভিসায় অনুমতি দেয়া হয়েছে আকাশপথে ভারত প্রবেশের। তাই বহু চেনা এবং তুলনামূলক কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে বেড়ানোর সহজ বর্ডার বুড়িমারি দিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অতএব সোজা কলকাতা। এতগুলো বছর হয়ে গেল, কত মিষ্টতা কত তিক্ততা। গঙ্গা বা তিস্তায় পানি বা জল গড়াক বা না গড়াক। প্রতিবারই দমদম থেকে সদর স্ট্রিট যাওয়ার পথটা আমায় ব্যাকুল করে তোলে। এত দেখা পথ তবু একঘেয়ে লাগে না। প্রি পেইড হলুদ এম্বাসেডরের জানালা দিয়ে ডান-বাম দেখতেই থাকি। সেই পুরনো পথ, ফুটপাত। গড়িয়াহাট থেকে বিবিডি বাগ লেখা কাঠের জানালায়ালা বাস। গাড়ি মানেই সাদা হলুদ এম্বাসেডার, ফাঁকে ফাঁকে কিউট মারুতি। আলোর মালা পরা বড় বড় শপিং মল থেকে রাস্তার চারচাকার দোকানে ব্যস্ত চাওমিন, রোলের বিকিকিনি। কোথাও বসেছে কাঁচা বাজার। ফুল, সবজি থেকে মাছ। সব তাজা তাজা রঙিন। বি বি গাঙ্গুলী রোডের ঝলমলে সোনার দোকান। গাল ভরা নাম। শত বছরের বাণিজ্য। কিন্তু দোকানে সেই পুরনো দিনের ছাপ স্পষ্ট। গহনার দোকান থেকে মিষ্টির দোকান কোথাও নতুন দিনের চাকচিক্য নেই। সাইনবোর্ডগুলো সেই কবেকার হাতে লেখা। কোন নিয়ন সাইনের আধিক্য নেই। দোকানের সামনে দিয়ে ফুটপাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে রেখে বড় বড় গাছ। গোড়াতে তার শান বাঁধানো। গাছ কাটার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং রয়েছে যতেœর ছাপ। একটা শহরের এই সাধারণত্ব দেখি আর নিজের শহর ঢাকার সঙ্গে অজান্তেই তুলনা করে ফেলি। আমাদের দোকান যা-ই হোক, তার রংবেরঙের নিয়ন সাইন। বনানী এগারো আর ফার্মগেট টু কারওয়ান বাজার ফুটপাত, দোকান সাম্রাজ্যের কথা মনে পড়ে। কোনো দোকানের সামনে কোনো গাছ আছে বলে ভাবতে পারি না। কেন যেন মনে হয় আমরা যত বেশি দেখনদারিতে অভ্যস্ত গুণপনাতে কি ততটা পারি? বছর ঘুরতেই একই দোকান কতবার চেঞ্জ হয়। চেনা মুদি দোকানটা হঠাৎ হয়ে যায় রেস্টুরেন্ট। সময় করে একদিন খেতে গেলাম তো দেখি ওখানে এখন বুটিক শপ। সময় নিয়ে খেয়াল করলে একসময় দেখা যায় বুটিক থেকে পার্লার। এভাবেই আমরা দ্রুত বদলাই। কিন্তু ওরা একই থাকে বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। কোনো কোনো দোকানের ইন্টেরিয়র, সাইনবোর্ডের অক্ষরের টাইপ বলে দেয় পঞ্চাশ বছর যাবৎ চলছে ব্যবসা একই লোকেশনে, একই ভাবে বংশ পরম্পরায়। কলকাতার মানুষের ধীরস্থির এবং সময় ধরে রাখার এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে। আমি মোহিত হয়ে দেখি। আর দেখি সন্ধ্যা বা রাতে মানুষ কেমন নিশ্চিন্তে পথ চলছে। নারী বা পুরুষে কোনো তফাৎ নেই। হেলেদুলে নির্ভাবনায় চলা মানুষ দেখে কেমন যেন হিংসা হয়। শেষ কবে ঢাকার রাস্তায় নিশ্চিন্তে হেঁটেছি, ভাবার চেষ্টা করি। কোনোবারই মনে করতে পারি না। এই দেখাদেখি ভাবাভাবির মধ্যেই চোখে পড়ে সিনেমার পোস্টার, রাজনৈতিক সেøাগান। প্রায় অনেক বার হয়েছে হিসাব করে নয়, কীভাবে যেন আমরা গিয়ে পৌঁছেছি বিশ্বকর্মা পুজোর সন্ধ্যায়। একবার অষ্টমীর সন্ধ্যায়। ধর্মকেন্দ্রিক উৎসবে একটা শহর কতটা মেতে ওঠে সেটাও দেখা আমার কলকাতাতেই। এবং এই পথটাতেই। উৎসবের তিথি হোক বা যেকোনো দিন, কলকাতা জীবনের শহর। জীবনমুখী শহর। অনিচ্ছাতেও বলতে হয়, তিলোত্তমা হওয়ার চেষ্টারত ঢাকায় যাপনের দৈনন্দিনতায় যে জীবন অনুপস্থিত কলকাতার খুব সাদামাটা ছাপোষা মানুষের ভিড়ে সেই জীবনের দেখা মেলে।
এবারো এই এক সন্ধ্যায় দুচোখ ভরে কলকাতা দেখি। এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় সরাসরি শিয়ালদাহ রেলস্টেশন। রাতের ট্রেন পদাতিক এক্সপ্রেস। আমাদের নিয়ে যাবে নিউ জলপাইগুড়ি, কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছে। ভারতে যে এখনও ভ্রমণ মানেই রেল। তা হাড়ে হাড়ে বোঝা যায় যেকোন স্টেশনে গেলেই। রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টাই লোকে লোকারণ্য। ধনী-গরিব, কালো-ফর্সা, বাবু-দেহাতি নানা রকম মানুষ। স্টেশনে তাদের জন্য নানা রকম ব্যবস্থা। এসি, ওয়াইফাই সমেত ওয়েটিং রুম থেকে প্লাটফরমের চাতাল। যার যেটার সামর্থ্য, সেভাবেই সময় ক্ষেপণের ব্যবস্থা। রেলের ব্যবস্থাপনায় চলে রেস্টুরেন্ট। মানুষে গমগম, তবুও ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে মানসম্পন্ন খাবার বিক্রি করে, এখনও ১৫ বা ২০ টাকায় মেলে একজনের আহার। এত বিশাল স্টেশন আর এত লোকের হট্টগোল, হাতে সময় নিয়ে না গেলে ঠিকঠাক ট্রেন খুঁজে পাওয়াও কিন্তু ঝক্কির কাজ। সেই সব ঝক্কি সামলে ওয়েটিং রুমে বসার ঘণ্টাখানেকেরও কম সময়ে ঘোষণা আসে ট্রেনের। ট্রেনও আসে একদম সময় ধরে। মাঝরাতের আগে আগে আমরা চেপে বসি। টু টায়ার এসি কামরা। উঠতে উঠতেই ঘুমের সময় হয়ে যায়। নিয়মমতো সদ্য প্যাকেট খোলা ধবধবে বিছানা বালিশ বিছিয়ে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঘুম। ঘুম যখন ভাঙে তখন বাইরে হালকা নরম আলো। সমান জমিতে চা আর আনারসের ক্ষেত। আর নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেন থেকে নামা মাত্রই একটা ফ্রেশ ঠাণ্ডা বাতাস। মনে করিয়ে দেয় পাহাড়টা কাছেই। ভারতের অন্য সব স্টেশনের মতোই এখানে নামতেই একজন জুটে যায়। যেখানে যেতে চাই, সব ব্যবস্থা করে দেবে। জানি না কীভাবে ওরা যেন আগন্তুক দেখলেই চিনে ফেলে। প্রতিবার চিনেজোঁক টাইপের, এদের সঙ্গে আমাদের তাই দেখা হয়েই যায়। আমরাও এতদিনে শিখে গেছি জোঁক তাড়াবার কায়দা। তাই ফুটওভারব্রিজের মাঝামাঝি যেয়ে চিনেজোঁক রণে ক্ষান্ত দেয়। আমরাও এগোতে থাকি আমাদের মতো।
স্টেশন থেকে বের হয়ে সামনে এগোতেই সার বাঁধা ধাবা টাইপ দোকান। বাছ বিচার ছাড়াই ঢুকে পড়ি একটায়। বয়স্ক সাদামাটা একজন মানুষ এগিয়ে আসেন। বাংলায় কথা বলেন। ঠিক কলকাতার মতো করে নয়। অনেকটাই আমাদের প্রচলিত ভাষার মতো তার কথার টান। পেছনের ছাপড়া রান্নাঘরে দেহাতি মানুষজনের ঘরকন্নার আওয়াজ আসে। ঝরঝরে বাসমতি চালের ভাতের সঙ্গে নানারকম সবজি, আচার। একটা আপন আপন ভাব জাগে। ভালো লাগে। সেই বৃদ্ধ দোকানি বলে দেন ফেরার পথে যেন আবার আসি। পথ চলতে এরকম কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয় জীবনে। খুব সামান্য কিছু মুহূর্তের জন্য। অথচ কি আশ্চর্য, কখনো কোনো এক একাকী সময়ে তাদের কথা মনে পড়ে। কোথায় যেন টান মেরে নিয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য। এই যে ঘর থেকে বাহির হওয়া। ঝরনার মতো ‘কাহারে চায়’ না জেনেই যে ধেয়ে চলা। এর অর্থই তো এখানে। এই যে কিছু স্মৃতি, টুকরো টুকরো, কিছু মানুষ, কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি। এর মাঝেইতো ঘোরাঘুরির আনন্দ, ঘোরাঘুরির প্রাপ্তি।

ওই দূর পাহাড়ে, লোকালয় ছেড়ে দূরে
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে এরপর অটোতে করে শিলিগুড়ি। একটা ছিমছাম শহরতলির ভেতর দিয়েই রাস্তা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। শিলিগুড়ি এসেছি বোঝা যায়, সাইনবোর্ড দেখে নয়। সিধু কানুর মূর্তি দেখে। শহরের মুখে বীরদের রেপ্লিকা। সেই প্রথম বারেই প্রথম নজরে পড়েছিল। তারপর থেকে প্রতিবারই পড়ে। এবার বেশ কয়েক বছর পর শিলিগুড়িতে আসা। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে গোটা ভারতের সংযোগ ঘটায় শিলিগুড়ি। ভৌগোলিক কারণেই তাই বাণিজ্যিকভাবে বিরাট গুরুত্ব বহন করে শহরটা। কয়েক বছরে ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হয়েছে যেন অনেক খানি। সেসময়ের ম্যাট ফিনিশড ছোট শহরটা এখন অনেকটাই কেতাদুরস্ত, ঝাঁ চকচকে। পাশাপাশি আবাসিক এলাকাগুলো রয়ে গেছে একই রকম নিরিবিলি। সেই ছোট দোতলা বা তিন তলা বাড়ি। সামনে কিছুটা খালি জায়গায় ফুলের গাছ। একটা ছোট গেট। মেকাপ গেটাপ সেকেলে থাকুক বা আধুনিক। শহর শিলিগুড়ি কিন্তু সবসময় তুমুল ব্যস্ত। পানির ট্যাঙ্কি বা জংশন নামের জায়গাগুলো সকাল-সন্ধ্যাই জমজমাট। মনে পড়ে কবে যেন একবার শিলিগুড়ি থেকে লাভা যাওয়ার জিপস্ট্যান্ড দেখেছিলাম। এবার খুঁজেই পাই না। এরই মধ্যে দালালদের বাড়াবাড়ি। অবশেষে বাসস্ট্যান্ড থেকে চেপে বসি কালিম্পঙের বাসে। প্রথমবার চট্টগ্রামের মুরাদপুর থেকে রাঙ্গামাটি, একবার মিরিক থেকে দার্জিলিং, অথবা কাঠমান্ডু থেকে পোখারা। এরকম পাহাড়ি পথে বাস জার্নি প্রতিবারই দারুণ মজার। যে গন্তব্যে যাচ্ছি সেখানকার মানুষের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সুযোগ ঘটে এইসব পাবলিক বাসে। তাদের আচার আচরণ, কথাবার্তা সেই এলাকা সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়। অনেকটা যেই দেশে যাচ্ছি সেই দেশের এয়ারলাইনে ভ্রমণ করার মতো। সব দেশেই পাহাড়ের মানুষ তুমুল আন্তরিক। এক কথা, দুই কথাতেই গল্প জমে যায়। ভুলভাল হিন্দি বাংলা মিলিয়ে কথা বলতে বলতে একেবারে বাড়িতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ পর্যন্ত চলে আসে। তো এবারো তার ব্যতিক্রম হয় না। পাশের রো-এর ফিটফাট মঙ্গোলিয়ান বুড়ো তার গল্প বলে যায়। কালিম্পঙের গল্প, ছোটবেলা, বড়বেলা আর বুড়ো বেলায় পাল্টে যাওয়া গ্রাম থেকে শহর বনে যাওয়ার গল্প। আমরা শুনি। মনে পড়ে প্রায় বছর চৌদ্দ আগে ভরা শীতের এক মৌসুমে ফুরফুরে এক সকালে যাচ্ছিলাম মিরিক থেকে দার্জিলিং। এরকমই এক পাবলিক বাসে। পুরো রাস্তায় গান বাজছিল, হিন্দি সিনেমার সুরেলা গান। বাস ভর্তি মানুষের হৈচৈ আনন্দ। তখন কারও মোবাইল ফোন ছিল না। তাই ছিল নিজেদের ভেতর ভাব বিনিময়। এতদিন পরে এখন পাহাড়েও ফুল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। তাই সেই চাচার সঙ্গে আলাপ ছাড়া পুরো তিন ঘণ্টাই কানে আসে মোবাইল ফোনের একপার্শ্বিক কথোপকথন। সবাই যার যার মতো। আমরাও আমাদের মতো জানালায় চোখ রাখি। সেই চেনা পথ। সবুজ রঙ্গিতের ধার ঘেঁষে পথ চলেছে রংপো হয়ে সিকিম। যাওয়ার পথেই একটা পথে ডানে মোড় নেয় দার্জিলিংয়ের দিকে। একটা যায় হঠাৎ বামদিকে মংপোর দিকে। আর সবশেষে যেটা ডানে মোড় নিয়ে দীর্ঘ পাক দণ্ডি পেরিয়ে ওপরে উঠে যায় সেটাই কালিম্পঙের পথ। খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে যখন সহজ রাস্তা আসে। সে রাস্তার ডানে পাহাড়, বামে খাদ। খাদের ধার ঘেঁষে ছোট ছোট সুন্দর বাড়ি। প্রায় সব একই ডিজাইন। একই রকম পর্দা জানালায়। বারান্দা আর সানশেডে একই রকম ফুলের কেয়ারি। এই বাড়িগুলোর পেছনে, খাদের শেষ সীমায় কাঞ্চনজঙ্ঘা জেগে থাকে। শেষবার কালিম্পঙ আসা-যাওয়ার পথে মন ভরে দেখেছিলাম। এবারও আশায় ছিলাম, কিন্তু একটু একটু মেঘ, কুয়াশা সব মিলিয়ে চোখে পড়ে না কাঞ্চনকন্যা।
কালিম্পঙের মূল অংশটুকু ঘিঞ্জি। ঠাসাঠাসি বাড়িঘর। কিন্তু আসল সৌন্দর্য বোঝা যায় মূলত এই পথটাতেই। এ পথ, পথের মানুষজন, ছোট ছোট ঘরবাড়ি দেখলেই মনে হয় যেন অলকানন্দা। ঠিক যেই বাড়িতে এসে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। এত বড় ভারতবর্ষে পালিয়ে থাকার জায়গার অভাব যিনি বুঝেছিলেন সেই ১৯৪০ সালেই। তারপরও শরীর মনের ক্লান্তি কাটাতে ফিরে ফিরে আসা কালিম্পঙে। এখান থেকেই তার শেষ বারের রোগশয্যা। কালিম্পঙের পথে তাই হিমালয়, কাঞ্চনজঙ্ঘা, রবীন্দ্রনাথ এবং হালের প্রেম অঞ্জন দত্ত সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সব মিলে মিশে প্রশ্ন জাগেÑ
‘কবে আমি বাহির হলেম, তোমারি গান গেয়ে,
সে তো আজকে নয়, সে আজকে নয়
ভুলে গেছি কবে থেকে আসছি তোমায় চেয়ে
সে তো আজকে নয়, সে আজকে নয়।’

ঘিঞ্জি কালিম্পঙের ততোধিক ঘিঞ্জি বাসস্ট্যান্ডে যখন বাস এসে দাঁড়ায়, ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে অনেকটা। ঠিক এসময়টাতে পাহাড়ি শহরগুলোতে একটা নরম রোদ এসে গায়ে লাগে। শীতের দুপুরে ভাত খেয়ে গা এলিয়ে দেয়ার মতো অলস মিষ্টি রোদ। টুরিস্ট হিসেবে আমার একটা সাংঘাতিক বাজে বাতিক হলো ফিক্সড হয়ে যাওয়া। যেই না রোদটা দেখলাম, মনে হলো, কী দরকার বাপু এখন আবার এতটা পথ পাড়ি দিয়ে লাভা না ফাভা কোথায় যাওয়ার। তার চেয়ে রাতটা এখানেই থেকে যাই না। আরেকটু বিকেলে গিয়ে দাঁড়াই গির্জার চত্বরে। সন্ধ্যেটা কাটাই ছোট কোনো ক্যাফেতে। ভোর বেলা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে ধীরে সুস্থে ভাবা যাবে কী করা যায়! এই যখন মনের ভাব হয় হয়, ঠিক তখন আবার ভেবে দেখলাম, বাসস্ট্যান্ডে যখন এসেই পড়েছি, একটু খবর নিয়েই দেখি কীভাবে যাওয়া যাবে লাভা। তিন রাস্তার মোড়ে বাঙালি ট্রাফিক পুলিশ। জানিয়ে দিলেন বাস ছাড়ে সকাল আটটায়। এছাড়া আর কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। তবে রিজার্ভ করে নেয়া যাবে মারুতি ভ্যান। ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে পৌঁছতে, ভাড়া আটশ রুপি। বলতে বলতেই হাত ইশারায় ডাক দেন একটা মারুতি। ড্রাইভার মনোজের সঙ্গে আপস রফা করে গাড়ি রেডি হয়ে যায় লাভা যাওয়ার। গাড়িতে ব্যাগ রেখে ওপর দিকে দুই রাস্তা পেরিয়ে খেতে যাই, একটা ছোট্ট ভিড় লেগে থাকা রেস্টুরেন্টে।
ততক্ষণে চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে অফিস থেকে বেরোনোর। জি বাসা নয়, অফিস থেকে। বাসা থেকে বেরিয়েছি আরও সকালে, অফিস টাইমে। পরের এক সপ্তাহের জন্য একেবারে তৈরি হয়ে। ভর দুপুরে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। আর তারপরই ঘটে গেল এতকিছু। আরেক দুপুর শেষে কালিম্পঙে। গন্তব্য তখনও আরও তিন ঘণ্টা দূরে। পাহাড়ের বাতাস, তাই একফোঁটা কøান্তি নেই। চলছি তো চলছিই। কালিম্পঙ ছাড়িয়ে যখন গাড়ি আরও গ্রামের দিকে, ততক্ষণে যেন ছায়া ঘনাইছে বনে বনে। শীতের শিরশিরানিও শুরু হয়েছে কিছুটা। শুধু তা-ই নয়, এই বত্রিশ কিলোমিটার পথে বৈচিত্র্যও বদল হয়। পাতা ঝরানো গাছের বদলে বাড়তে থাকে পাইন, বার্চ আর ফারের সংখ্যা। পথ বুঝিয়ে দেয় আমরা যাত্রা করেছি বনের দিকে। লাভা মূলত ন্যাওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বার। কিন্তু সেই বন উদ্যানের চিহ্ন এসে ছুঁয়ে দেয় আরও আগে থেকেই। দু’পাশের এই অচেনা অঞ্চল, দূরে দূরে সাজানো গোছানো ফিটফাট একেকটা বাড়ি, নীল আকাশ, পাহাড়ের গন্ধ আর ভাঙ্গাচোরা পথ আমাদের পৌঁছে দেয় আলগাড়া। কালিম্পঙ লাভার পথে জংশন মতো আরেকটা জনপদ। মূলত একটা ছোট্ট বাজার, তার চেয়েও ছোট জিপ স্ট্যান্ড। এখান থেকেই একটা রাস্তা উঠে গেছে ওপর দিকে। একটা নিচে। আমাদের গাড়ি গড়ায় নিচের পথটাতে। ছোট ছোট নুড়ি সুরকিময় রাস্তায় গড়াতে গড়াতে গাড়ি পৌঁছে যায় লাভা।

এতদিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে
লাভা মানে শুরুতে লাভা বাজার। যথারীতি পাঁচটা ছোট-বড় পাহাড়ি বাজারের মতো একটা ওয়াচ টাওয়ার। তার পাশেই গোল করে হোটেল, দোকান আর খোলা চত্বরে বাস বা জিপ স্ট্যান্ড। বাজারের মুখে একটা-দুটা হোটেল দেখি। দেখে সোজা চলে যাই ইয়াংকি রিসোর্ট। এতদিন ধরে ইন্টারনেটে দেখে রাখা ছোট ছোট কটেজওয়ালা হোটেল। সামনে থেকে গলির মুখে ছোট্ট দরজাওয়ালা রিসেপশন। রিসেপশন, ডাইনিং পেরিয়ে পেছনে এলে বিরাট উঠান। গাছ ফুলেতে ঢাকা। এর আশপাশ দিয়েই ছোট ছোট কটেজ। আমাদের ঠাঁই হয় পাইন কটেজে। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে কাঠের মেঝেওয়ালা কাঠের ঘর। দুই জনের প্রয়োজনের তুলনায় বেশ বড়। সামনে খোলা বারান্দা। বারান্দার নিচে গাছভর্তি আপেল ফুল। ছোট একটা বাঁশঝাড় আর দূরে তাকালে। কী? কী আবার যার জন্য এতটা পথ যাওয়া। সাদা সাদা বরফের টোপর মোড়ানো পাহাড়। কাঞ্চনজঙ্ঘা নয়, নাথুলার পাহাড়। মানে চীন সিকিম সীমান্তের বেশ কয়েকটি ছোটবড় শৃঙ্গ। তবে বিকেলে নয়, দেখা যায় সকালে। আর সেই বিকালটা? এতটা পথ জার্নি করেও ক্লান্তিবিহীন। এই মার্চে যখন ঢাকায় ফেলে গেছি গনগনে গরম। তখন লাভায় হাড় কাঁপানো শীত। হুট করে নেমে আসে শীতের সন্ধ্যা। দার্জিলিং চায়ের কাপে শীত তাড়ানোর চেষ্টা। কখন বেজে যায় সাতটা। এবার পিপীলিকাদের খাদ্যের সন্ধান। ইয়াংকিতে খেতে হলে অর্ডার দিতে হয় পাঁচটার মধ্যে। তখন অর্ডার দিতে ইচ্ছে হয়নি। তাই ভর সন্ধ্যায় খাবারের খোঁজে বাইরে যাওয়া।
ছোট্ট জনপদ, শীতের সন্ধ্যায় একেবারে জবুথবু। ঘুমে কাতর। রিসোর্টের গেট ছেড়ে একটু চড়াইয়ে উঠলেই গুপী বাঘা রেস্টুরেন্ট। পাহাড়ে বাঙালি খাবার ঘর। রেস্টুরেন্টটা একেবারে আমাদের ফেরিঘাটের ছোট ছোট পাটকাঠির দোকানটাইপ। সামনের দিকে পেট বরাবর কাটা। টিমটিমে লাইটের আলো। কাঠের চেয়ার টেবিল। খাবারের অর্ডার দিলে আধাঘণ্টা পর আসবে। নেপালি মেয়েরা কিচেনে কাজ করে, রাঁধে বাঙালি খাবার। এই দোকানেই পরিচয় হয় কিশোর মিত্রের সঙ্গে। হাসিখুশি ফোকলা দাঁতের মানুষটি দেখভাল করেন খাবারের দোকানটি। চিরকুমার কিশোর একসময় কাজ করতেন চা-বাগানে। রিটায়ারমেন্টের পর আর ফিরে যাননি পৈতৃক নিবাস কলকাতার শোভাবাজারে। বরং থেকে গেছেন পাহাড়ের টানেই। একসময় ফুটবল খেলতেন। দাপ্তরিক কাজে গেছেন দেশের বাইরের দু-একটি দেশেও কিন্তু কখনো বাংলাদেশে আসা হয়নি। আগে ইচ্ছা ছিল আসবেন। এখন বুঝে গেছেন আর আসা হবে না। জীবনে এখন গোছানোর সময় হয়ে গিয়েছে। নতুন স্বপ্ন দেখার সময় আর নেই। তার সঙ্গেই কথা বলে কেটে যায় আমাদের সন্ধ্যা। ভাত খেয়ে ঘরে ফেরা। শীতের রাত সে যেখানেই হোক, বিষণœ। অতএব একটা বিষণœ রাত কাটে, লম্বা যাত্রার পর, গভীর ঘুমে। ভোরবেলা ঘুম ভাঙে তখনও কাটেনি আঁধার কিন্তু কোথায় যেন মোরগ ডেকে ওঠে। কুক্কুরু কুক্ কুক্কুরু কুক। শুরু হয় আরেকটা নতুন দিন, লাভা নামের ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটায়।
ভোর থেকেই জানালার পর্দা সরিয়ে বসে থাকি। সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়। সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে আকাশে ভেসে ওঠে হিমালয়। চকচকে নীল আকাশ। ধবধবে সাদা পাহাড়। লাল সূর্য। সবকিছু মিলে আকাশে জেগে ওঠে অজস্র রং। দিগন্তজুড়ে প্রকৃতির রংলীলা। সকালের প্রথম রোদের খোঁজে ঘর ছাড়ে জোড় শালিক।

হঠাৎ আলোর খোঁজে
পাহাড়ে সব কিছু যেন সময়ের আগে ঘটে। সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। ভোর হয় আগে। মানুষ ঘুমায় তাড়াতাড়ি, জেগে ওঠে আরও তাড়াতাড়ি। সেই সাত সকালে বের হয়ে দেখি, রাস্তায় দুয়েকজন করে বের হয়েছে। লাভা বাজার, এর আশেপাশে, ইয়াংকি রিসোর্ট এই নিয়েই মোটামুটি লাভার মূল শহর। পাহাড়ের একটা ঢালে। রোদ আসে না সহজে। প্রায় সময়ই ঢাকা থাকে ছায়ায়। শীত তাই তুলনামূলক বেশি। রিসোর্ট থেকে বের হয়ে উৎরাইয়ে নেমে কিছুটা এগোতেই সামনে দেখা যায় মনাস্ট্রি। একটু ওপরে। অনেকটা চড়াই বেয়ে উঠতে হবে, রোদে চকচক করছে সোনালি চূড়া। চাতালে ঘুরছে গাঢ় খয়েরি পোশাক পরা মঙেরা। গুটি গুটি পায়ে আমরাও উঠে যাই মনাস্ট্রির মাথায়। শীতের ভোরে একটু উষ্ণতার জন্য। জাপানের আর্থিক সাহায্যে লাভার মতো কোনো এক গহিন গ্রামে গড়ে উঠেছে বিশাল মনাস্ট্রি, সব রকমের সুযোগ সুবিধা নিয়ে। সেই মনাস্ট্রির চাতালে বসে রোদ তাপাই। পাখির চোখে দেখে নেই পুরো লাভা, দূরে কালিম্পঙ।
ভোরের সতেজ রোদ মেখে আবার ঘরের দিকে পা বাড়াই। ফিরতি পথে দেখি খুলে বসেছে মোমোর দোকান। গোর্খা তরুণ রিকের দোকানে সারাক্ষণ একটা সাদাকালো টেলিভিশন চলে। যেই টিভিতে আবার চলে বিটিভি! অবাক হই। জিজ্ঞেস করি, বিটিভি কেন? সোজা সরল উত্তর, ভালো লাগে। আমাদের মোমো দিতে দিতে আরও কথা হয়। জেনে নিই অনেকটা হাঁড়ির খবরও। তরুণের বয়স ২৬। বউ, দুই মেয়ে আর মাকে নিয়ে লাভার সংসার, দোকানের পিছন দিকে। বাবা আর ছোট ভাই সেনাবাহিনীতে। দোকানের পাশের তিনতলা বাড়ির পুরোটা লিজ দেয়া হোটেলের জন্য। বছরে সেখান থেকে পায় প্রায় ৩ লাখ রুপি। কালিম্পঙ থেকে লাভার পথে সুন্দর বাড়িগুলো দেখে প্রশ্ন জাগছিল মনে যে এখানকার মানুষের পেশাই বা কী! সে প্রশ্নের উত্তর পাই রিকের কথায়। প্রায় প্রত্যেক পরিবারের কেউ না কেউ আছে সেনাবাহিনীতে। সৈনিক হিসেবে গোর্খাদের ইমেজ আজও প্রশংসিত। তাই এ এলাকার বেশিরভাগ পরিবারই সৈনিকের পরিবার। এর বাইরে যারা তাদের একমাত্র আয়ের পথ কৃষি। কথা চলতে চলতে শুরু হয় খেলা। বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলছিল তখন। পরদিন বাংলাদেশ-ভারত হাই ভোল্টেজ কোয়ার্টার ফাইনাল। রিকেকে প্রশ্ন করি, কাকে সাপোর্ট করো তুমি। অবাক করে দিয়ে ছোট্ট উত্তর আসে ‘বাংলাদেশ’। বিস্ময়ে আবার প্রশ্ন কেন? এবার উত্তর আরো সোজাসাপ্টা। বাংলাদেশ ভালো খেলে তাই। মাশরাফি আছে, সাকিব, মুশফিক সবাই খুব ভালো প্লেয়ার। এর আগে একবার কাশ্মীরে গিয়ে দেখেছিলাম, বাংলাদেশকে মানুষ চেনে ক্রিকেটের জন্য। সেখানেও গর্বে মাথা উঁচু হয়েছিল মাশরাফি, রাজ্জাকদের গল্প শুনে, কিছু খেটে খাওয়া কাশ্মীরি তরুণের মুখে। আবারো সেই সুখস্মৃতি ফিরিয়ে দিল এক অখ্যাত গোর্খা তরুণ।
এবার আমাদের বলার পালা। বলি, আমরা এসেছি বাংলাদেশ থেকে। বিস্মিত হয় তরুণ। প্রথমে বিশ্বাস করে না। পরে বলে, বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি মানুষ এখানে আসে না। গতবছর এসেছিল একটা গ্রুপ। তারপর আরেকটা প্রশ্ন, বাংলাদেশের অবস্থা কেমন? এই যে টিভিতে দেখায় আগুন, বোমা। সবসময় কি এরকম? উত্তর দিতে কৌশলী হতে হয়। পাল্টা প্রশ্ন করি, অবধারিতভাবে স্বাধীন গোর্খাল্যান্ড প্রসঙ্গে। জানতে চাই প্রতিনিয়ত যে আমরা অস্থিরতার খবর পাই, সেটা ঠিক কি না। ও হাসে। বলে, সব সময় না। আমরাও বলি বাংলাদেশেও এরকম সব সময় না। এখন একটু অস্থির কিন্তু ঠিক হয়ে যাবে।
মোমোর দোকানের পর আবার গুপী বাঘা রেস্টুরেন্ট। সেই কিশোর মিত্র। এই সকালেও সেই একই হাসি। কোথায় যাব, কী করব, গাড়ি পাওয়া যাবে কোথায় সেসব নিয়ে কথা হয়। এই দোকানেই কাজ করে ফিটফাট বছর ষোলর বিনোদ ছেত্রী। মিশুক, চটপটে কিশোর নিজে থেকেই এগিয়ে আসে। বলে, রিসপ যাও। যদি ভিউ দেখতে চাও, তাইলে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। চার কিলোমিটার রাস্তা, ট্রেকিং করে চলে যাবে, আধা ঘণ্টা লাগবে। আমি যাব তোমাদের সঙ্গে গাইড হয়ে। ফিরে এসে স্কুল যাব। শহুরে অলস মানুষ আমরা অন্য কোনো উপায় আছে কি না, জানতে চাই। গাড়িও আছে। বাজারে গিয়ে উঠতে হবে। গাড়িতেও ৪ কিলোমিটার যেতে আধা ঘণ্টাই লাগবে। তবে রাস্তা খারাপ, কষ্ট হবে অনেক। সব শুনে যাব কি যাব না সেই এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। নাকি ইয়াংকি রিসোর্টের পাইন কটেজের বারান্দায় বসেই দিনটা পার করে দিব, ঠিক করতে পারি না।
এরপর দিনটা বড় হয় আরেকটু। রোদের রং হয় রুপালি। আবার আমরা বের হই, সুন্দরের সন্ধানে। এবার ডানদিকে। বাজারের দিকে অথবা বাসস্ট্যান্ডের দিকে। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। লাভায় ওইদিন পরিচ্ছন্নতা দিবস। ছেলে, বুড়ো, নারী, পুরুষ সব পেশার, সব শ্রেণির মানুষ সেদিন পরিষ্কারের কাজ করছে। রাস্তা, ড্রেন, খাল, পাহাড়ের ঢাল সব পরিস্কার করছে এলাকার মানুষ স্বেচ্ছা শ্রমে। ঠিক আগের দিন একই চিত্র দেখেছি কালিম্পঙে। সবাই মিলে পরিষ্কার করছিল পাহাড়ের গায়ে বেঁধে দেয়া পাথরের শ্যাওলা। আজকে দেখি লাভায়। নিজের এলাকা নিজে পরিষ্কার করার এমন উৎসব আগে কোথাও দেখিনি। সবাই বাধ্যতামূলক এ কাজ করে। এদিন স্কুল ছুটি হবে আগে। স্কুলফেরত ছেলে মেয়েরাও পরিষ্কারের কাজ করবে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি, বেশি গাড়ি নেই। কারণ ড্রাইভাররা পরিষ্কারের কাজ করতে গেছে। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েই আমরা ভাবতে থাকি কোথায় যাব, লোলেগাঁও না রিসপ। একেবারে উবু দশ-বিশের হিসাব যেন। শেষ পর্যন্ত জিতে যায় রিসপ। একটা গাড়ি ঠিক করি। লাভা লোলেগাঁও রিসপে গাড়ির বন্দোবস্ত করে স্থানীয় সিন্ডিকেট। যার যার এলাকা নির্দিষ্ট করা আছে। সেই অনুযায়ীই ঠিকঠাক করে দেয়। চার সিটের ফোর হুইলার। চেহারায় জরাজীর্ণ কিন্তু শক্তপোক্ত ছাপ। সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ আসা-যাওয়ার জন্য রিজার্ভ করলে ৭০০ রুপি ভাড়া। যেই রাস্তা দিয়ে কাল এসেছি, সেই রাস্তার দিকেই যায় মিনিট দুয়েক। তারপর একটা মোচড় নিয়ে উপরে উঠতে থাকে। এই উপরে ওঠার জন্য যে পথ, তা আর আসলেই গাড়ি চলার পথ না। হেঁটে যাবার পথ। ইট সুরকি ফেলা পায়ে হাঁটার রেখা মাত্র। গাড়িতে বসে থাকলে জাম ভর্তা অবস্থা। কিছু দূর যাবার পর সিদ্ধান্ত হয়, নেমে যাই। গাড়ি যায় গাড়ির মতো একজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে আরেকজন নেমে পড়ি পথে। যেন পথে এবার নামো সাথী পথে হবে এপথ চলা। আর গাড়ি থেকে নামার পর বোঝা যায় পথের আসল সৌন্দর্য। হাঁটায় অনভ্যস্ত মানুষ হাঁটতে গিয়ে দম লেগে আসে। কিন্তু পাখির ডাকে মন ভরে যায়। কত রকম পাখি ডাকে, নিঝুম বুনো পথে। কত রকম গাছ আর অর্কিড! গাছের ফাঁকে দূরে দেখা যায় সাদা পাহাড়, নীলচে আকাশের গায়।

মেঘের দেশে রোদের বাড়ি, পাহাড় কিনারায়
একসময় পথ ফুরোয় গাড়ির এবং পথিকের প্রায় সমান সময়ে। পাহাড়ের যে চাতালে এসে গাড়ির চাকা এবং পথিকের পা থামে, সেটা এক কথায় অপূর্ব। চাতালের নিচে গভীর খাত। খাতের গায়ে গায়ে ছোট ছোট বাড়ি, সবজি ক্ষেত। আর উদ্ধত শাখার শিখরে অসংখ্য রডোডেনড্রনগুচ্ছ। ওপর থেকেই দেখা যায়। নিচ থেকে চোখ তুলে ওপরে তাকালে দেখা যায় ডানদিকে নাথুলার শৃঙ্গ। বাম দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, উন্মুক্ত, উদ্বাহু। এক পলকে বুঝে যাই, এই সেই জায়গা যার সন্ধানে ছিলাম এতদিন। কোনো রকম সংশয় ছাড়াই বলে দেয়া যায়, পূর্ব হিমালয়ের কোলে সময় বলি বা অবসর কাটানোর সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা রিসপ। একবার, দু’বার নয়, বারবার ফিরে ফিরে আসা যায়। গোপন প্রেমের মতো। কাঞ্চনজঙ্ঘা সামনে রেখে ঝকঝকে সোনা রোদে দাঁড়িয়ে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত, আর লাভা নয়, থাকতে হবে রিসপে। অতঃপর আশ্রয়ের সন্ধান। চাতালের একপাশে পশ্চিমবঙ্গ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের রিসোর্ট, সোনার তরী। এটিকওয়ালা কাঠের বাড়ি। কিন্তু ঘর খালি নাই। অন্যপাশে হোটেল গ্রান্ড ভিউ। হাল আমলে তৈরি কাঠের গায়ে বার্নিশের ঘ্রাণ এখনও তাজা। দোতলার কর্নারে রুম নম্বর নয়। জানালার পর্দা টেনে দিলে পুরাটাই ১৮০ ডিগ্রি হিমালয়ান ভিউ। বারান্দাতেও কাঠের বাহারি টুল টেবিল কিন্তু যাবারই প্রয়োজন পড়ে না। জানালাতেই মুগ্ধ করে দেয়। পরের দিনের জন্য বুকিং কনফার্ম করে ফেলি। এরপর আর কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা। তারপর ফিরে আসা লাভায়, একই পথ ধরে কিছুটা হেঁটে, কিছুটা গাড়িতে।
লাভার আশেপাশে আরও কিছু ঘোরার জায়গা আছে। চা বাগান, ঝরনা এক-আধ ঘণ্টার দূরত্বে। আছে লোলেগাঁও। ড্রাইভার জানতে চায় বিকেলে কোথাও যাব কিনা, সানসেট পয়েন্ট। কিন্তু আমাদের বেড়ানো মানে আসলে দৌড়ঝাঁপ নয়। আমাদের বেড়ানো মানে আলস্যযাপন। গা ছেড়ে বসে থাকা। তাই দৌড়ঝাঁপের চিন্তা না করে বরং মোমোর দোকানে বসে স্থানীয় লোকের সঙ্গে বসে খেলা দেখি। খেলা দেখাটা উছিলা। আসলে দেখি স্থানীয় মানুষের মুখ। গুপী বাঘা রেস্টুরেন্টের কিচেনে বসে তোলা আগুনে হাত তাপাই আর গল্প করি বিনোদ, উর্মিলা আর সংগীতার সঙ্গে। বিনোদ পড়ে স্থানীয় স্কুলে ক্লাস টেনে। অবসরে কাজ করে রেস্টুরেন্টে। লাভায় শুধু স্কুল পর্যন্ত পড়া যায়। কলেজে পড়তে হলে যেতে হয় কালিম্পঙ। এখন যেভাবে চলছে লাভায় চলে যাচ্ছে। কিন্তু সামনে বছর থেকে দরকার অনেক টাকার। পাহাড়ি কিশোর স্বপ্ন দেখে অনেক দূর যাবার। স্বপ্ন দেখে একদিন লন্ডন যাবে বা আমেরিকা। হাত বাড়িয়ে আইফোনটা হাতে নেয়। মুগ্ধ হয়ে দেখে। ওর চোখের সামনে খেলা করে পাহাড়ের মতো বড় স্বপ্ন। পিছনে টান মারে দারিদ্র্য পাহাড়ের অপর পাশে ঘাপটি মেরে থাকা খাদের মতো। আবারো মন্দ্র মন্থরে নামে বিলাসী সন্ধ্যা। পাইন কটেজের বারান্দায় ঝুপ করে আঁধার নেমে আসে। বিদ্যুৎ চলে গেলে। গাছে গাছে ঝোলানো কুপিবাতি জ্বেলে দিয়ে যায় ইয়াংকি রিসোর্টের হরফুন মওলা মানে সব কাজের কাজী বারো তেরো বছরের ছুটে চলা ছেলেটা, যার নাম ভাই।
পরদিন ভোর ভোর ঘুম ভেঙে, ঘর ভাঙি। মানে ইয়াংকির পাট চুকিয়ে রিসপের জন্য প্রস্তুত হই। দু’দিনেই মায়া পড়ে যাওয়া জায়গাটা থেকে বিদায়ের সময় মন খারাপ লাগে। অচেনা অজানা জায়গা, মন খারাপের কোনো কারণ নেই, তবু খারাপ লাগে। জায়গার জন্য যে শুধু তা নয়। খারাপ লাগে কিশোর মিত্রের জন্য, বিনোদ ছেত্রীর জন্য আর খারাপ লাগে স্মৃতির জন্য। দু’দিনের কিছু জমে যাওয়া স্মৃতি ফেলে আসার সময় মন পোড়ায়।
সেই মন পোড়ানো ভাব আবার নিমিষেই উধাও হয়ে যায়, যখন রিসপে পৌঁছি। সেই চাতাল, সেই ধবল শৃঙ্গরা আজ ভোরে আরও উজ্জ¦ল। প্রকৃতির সঙ্গে মিলে যায় কিছু মানুষ এখানেও। আশীষ গুপ্তা। একসময় রবীন্দ্রভারতীতে কাজ করতেন। এখন অবসরে। হাতে সময় এবং সুযোগ মিলে গেলেই চলে আসেন রিসপ। কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে কলকাতায় ফেরেন। কাল যখন আসি তখনই পরিচয় হয়েছিল। আজ যেন মনে হলো বহুদিনের চেনা মানুষ, অপেক্ষায় ছিলেন আমাদের। তিনি উঠেছেন সোনার তরীতে। শিক্ষা, রুচি সাধারণত্বে দারুণ মানুষটি খুব সহজেই আপন হয়ে যান, বন্ধু হয়ে যান। আমি তাকে বলি দাদা তিনি বলেন মা। অল্প সময়েই রবীন্দ্রনাথ থেকে বুদ্ধদেব, শেখ হাসিনা থেকে মমতা, তিস্তা থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে দারুণ আড্ডা জমে ওঠে। রোদে পিঠ দিয়ে বসে। সঙ্গে যোগ হয় ক্রিকেট। ভারত বনাম বাংলাদেশ, বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল। প্রমাণ হয় যা কিছুই ঘটুক না কেন, মানুষ হৃদয়ে এক।

পিদাঁরে পলাশের বন, পালাব পালাব মন
রিসপের সকালটা ছিল মনে রাখার মতো। এসে যখন পৌঁছি তখন হাড়কাঁপানো শীত। সেই সঙ্গে সুন্দর ঝকঝকে রোদ। সেই রোদে লাঠি হাতে নেমে পড়ি সলুকের সন্ধানে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে যাই গ্রামে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট বাড়ি। তেকোনা চাল, নিকোনো উঠোন। উঠোনের কোণে ফুলের বাহার। নানা রঙের, নানা জাতের। আগে ওপর থেকে দেখেছি এবার খুব কাছ থেকে হাত বুলিয়ে দেখি রডডেনড্রনগুচ্ছ। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে পাখির গান। এসব বেশিরভাগ বাড়িই আসলে হোম স্টে টাইপ হোটেল। নিজের বাড়ির কয়েকটা ঘর আলাদা করে রাখা গেস্টদের জন্য। একেকটা বাড়ি থেকে একেকটা সুন্দর, পরিপাটি। বাড়িগুলোর নামও খুব সুন্দর। মেঘের বাড়ি, নীল নয়না এরকম। তবে আমরা শুধু ঘরই দেখি, সেরকম কোন টুরিস্ট দেখি না কোথাও। গ্রামে হাঁটতে গিয়েই গরম লেগে যায়। মনেই থাকে না কতটা ঠাণ্ডা ছিল একটু আগেও। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে আবার পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠি।
ততক্ষণে সেই চাতালে জমেছে আরও কিছু টুরিস্ট। প্রায় সবাই এসেছেন দল বেঁধে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই মিলে এক দল। প্রায় আট-দশজনের একটা দলকে আমরা বেশ মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করি। দলে আছে প্রায় ৭৫-এর দু’জন, এরপর কমতে কমতে এসে থেমেছে দেড় বছরে। তুলনামূলক বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সেন্স অব হিউমার বেশি ভালো। এটা আগেও কোনো কোনো সময় মনে হয়েছে, এবারও মনে হলো, ৭৫ বয়সী দু’জন রসিক মানুষের দেখা পেয়ে। একজন বলল আজকে শীত একটু বেশি। তো আরেকজন জবাব দিল, শীত বেশি তা নয়, বয়স তোমার একদিনে একটু বেড়েছে। ওদের কথা বলার ভঙ্গিতেই হাসি আসে। এরকম আরও ইন্সট্যান্ট কথামালা। আমাদের বিস্মিত করে ওনাদের জীবনীশক্তি, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের সঙ্গে আমরাও জমে যাই। একটা দল এসেছে দ্বিতীয়বারের মতো। এর আগে বছর আটেক আগে এসেছিল। এই আট বছরে তাদের কাছে মনে হচ্ছে, রিসপ কত পাল্টে গেছে। তখন একটা মাত্র হোটেল ছিল, এখন কত! তখন একদম নির্জন গ্রাম ছিল অথচ এখন কত হৈচৈ। সবই আসলে তুলনামূলক আলোচনা। এ পর্যন্ত আমাদের দেখা সব হিমালয়ান গ্রামের মধ্যে রিসপই সেরা। রিসপই সবচেয়ে নীরব। রিসপই সবচেয়ে সুন্দর।
এই প্রথম একটা গ্রাম, যেখানে সামনে তাকালে দুইপাশে দুই চূড়া। একদিকে ধবল শুভ্র নাথুলা, অন্যদিকে চির আরাধ্য কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাতাস এখানে ফুরফুরে। আলো একেবারে স্বচ্ছ। আর প্রায় ৪০ রকম পাখির গানের সুর ভেসে আসে সারাক্ষণ। প্রকৃতিরতো কোনো তুলনাই নেই। জনমানবহীন এই জনপদে যে কয়জন মানুষের দেখা মেলে তারাও প্রকৃতির মতো। হোটেলের নেপালি কেয়ারটেকার, বয়, বাবুর্চিরাও আপন হয়ে যায়, কয়েক ঘণ্টায়। সন্ধ্যার পরে নিচের ডাইনিং হলে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ফায়ার প্লেস ঘিরে বসে, বহু দূরে, বহু ওপরে প্রায় আকাশের কাছাকাছি একটা তুমুল গ্রামে আমরা একটা সন্ধ্যা যাপন করি। নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব কিন্তু আনন্দময় একটা সন্ধ্যা।
রিসপে যখন ভোর হয়, তার অনেক আগে থেকেই শুরু হয় ভোরের অপেক্ষা। জানালার পর্দা সরিয়ে, ঘর অন্ধকার করে বাইরের আলো ফোটা দেখি। কীভাবে একটু একটু করে সরে যায় আঁধার। অল্প অল্প করে সুরমার মতো রং দিয়ে শুরু হয় দিন। তারপর কখন নরম গোলাপি। গোলাপি থেকে সোনালি। সোনালি আলোয় ভরে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। কয়েক মুহূর্ত বাদে সোনালি রং সরে সাদা রং ধরে। সেই মুহূর্তে আমাকে ভাবায় সুকুমার রায়। মনে মনে আওড়াইÑ
‘সোনার মেঘে আলতা ঢেলে সিঁদুর মেখে গায়
সকাল সাঁঝে সূর্যি মামা নিত্যি আসে যায়
নিত্যি খেলে করে রঙের খেলা আকাশ ভরে ভরে
আপন ছবি আপনি মুছে, আঁকে নতুন করে’
ততক্ষণে জেগে গেছে সব পাখি। দুয়েকজন টুরিস্ট। আর প্রিয় রিসপ গ্রাম। মনে পড়ে না শেষ কবে কোথায় এমন করে ভোর হওয়া দেখেছি।
সুন্দর এসে ফিরে যায়
রিসপ থেকে ফিরতে চাইলে আবার লাভা হয়েই ফিরতে হবে। সেই একই ট্রেকিং এর পথে রিজার্ভ গাড়িতে প্রথমে লাভা। লাভা বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল নয়টায় ছাড়ে শেয়ার জিপ, শিলিগুড়ি পর্যন্ত। দিনে এই একটাই। ড্রাইভারের পাশের তিন সিটের টিকেট করা ছিল দু’জনের জন্য আগে থেকেই। বাসস্ট্যান্ডে এসে অপেক্ষা করি, দেখি আর কোনো যাত্রী নেই। শেষ পর্যন্ত আমাদের নিয়েই রওনা হয় বিরাট কোহলির জেরক্স কপি ড্রাইভার সাহেব। এবারের পথ কালিম্পঙ হয়ে না, উল্টোদিকে গরুবাথান হয়ে। সুতরাং যে পাশ দিয়ে লাভায় ঢুকেছি তার উল্টা পাশ দিয়ে বের হই। মানে ইয়াংকি রিসোর্টের পাশ দিয়ে। ওই টুকু সময়ের মধ্যেই চলন্ত গাড়ি থেকে চোখে পড়ে গুপী বাঘায় দাঁড়িয়ে আছে কিশোর মিত্র। বলতে ভুলে গেছি, ভদ্রলোক দিনে কখনো বসেন না। তার ধারণা, বসলেই অলসতা পেয়ে বসবে। তাই যতক্ষণ তাকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। সারাদিন এমনকি ডিনারের সময় পর্যন্ত কখনো তাকে বসতে দেখিনি। ফেরার পথে এক ঝলক দেখে আবার মায়া হয় মানুষটার জন্য। এরপর রিকের দোকান। তারপর মনাস্ট্রিটা বামে রেখে আমরা চলতে থাকি, বিদায় জানাই লাভাকে।
যাত্রা শেষ হয় বটে, কিন্তু যোগ হয় আরও নতুন কিছু অভিজ্ঞতা। পাহাড়ি জনজীবনের টুকরো টুকরো কিছু ছবি ধরা পড়ে এই জিপ যাত্রায়। যেহেতু এই একটি মাত্র গাড়ি সকাল বেলা রওনা হয়ে শিলিগুড়ি যায়, বিকেল বেলা ফিরে আসে। তাই পাহাড়ি গ্রামের মানুষগুলোর প্রায় সবরকমের ছোটখাটো প্রয়োজন মেটায় জিপের ড্রাইভার। লাভা থেকে বেরোতেই দেখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন মাঝবয়সী এক নারী। কিছু টাকা দিয়ে দিলেন ড্রাইভারের হাতে। ফেরার পথে কি একটা ওষুধ কিনে আনতে বললেন। কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ দেখি গাড়ি রাস্তায় নেই। কোন এক মাঠের মধ্যে দিয়ে চলছে। বেশ কিছু বাড়ি, একই রকম সব, বাড়ির সামনে রঙ-বেরঙের ফুলের বাহার। শৈল্পিক, সুন্দর বটে তবে খুব ধনী লোকের পাড়া নয়। হঠাৎ দেখি গাড়ি থামল একখানে। একজনের একটা নষ্ট টেলিভিশন নিয়ে যেতে হবে শিলিগুড়িতে মেরামতের জন্য। এভাবেই আরেকবার থামিয়ে নিল কিছু ঘরের খাবার একলোকের ছেলে থাকে হোস্টেলে, তার জন্য।
সারা রাস্তা ড্রাইভারের এই রানারের মতো কাজ দেখি। বিরক্ত লাগে না বরং ভালো লাগে এই ভেবে যে, সামাজিক বন্ধন কতটা দৃঢ় হলে মানুষ এখনও মানুষের জন্য এগিয়ে আসে। এই এলাকার পথটা কিন্তু আবার এই অঞ্চলের পথের মতো নয়। মানে দার্জিলিংয়ের আশেপাশের রাস্তা যেমন তেমন নয়, অনেকটা মানালি থেকে চন্ডীগড় ফেরার মতো রাস্তা। অনেক উঁচু, প্রচুর সবুজ কিন্তু রুক্ষ এবং লোকজন কম। এরকম রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি যখন নিচে নামে তখন একেবারে ডুয়ার্সের চা-বাগান। গরুবাথান, মালগুদাম পেরিয়ে আস্তে আস্তে এসে পৌঁছোই শিলিগুড়ি। প্রতিবার যাওয়ার পথে শিলিগুড়ি পৌঁছে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে, পাহাড়ের অনুভূতি জাগে। কিন্তু ফেরার পথে শিলিগুড়িকেই মনে হয় রোদে পোড়া খটখটে শহর। ভীষণ গরম। আসলে যাত্রার শুরুতে থাকে ছুটির আমেজ, অদেখাকে দেখার ব্যাকুলতা। সেই পথে যা চোখে পড়ে, তা-ই ভালো লাগে, মুগ্ধ হই। যত আগাই তত আবিষ্কার করি। পরতের পর পরত উন্মোচন করতে করতে যখন পুরোটা দেখা হয়, ফেরার পথে আর বিস্ময় কাজ করে না। বিস্ময় কমে যায় বলে সেভাবে টানেও না। ঠিক যেন মানুষের মতো, সম্পর্কের মতো। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তৈরি সম্পর্কও ধীরে ধীরে ক্ষয়ে আসে। আবার কোনো কোনো সম্পর্ক চিরটাকাল প্রবল আকর্ষণ করেই যায়। যত পুরানাই হোক না কেন, বিস্ময় ফুরায় না, ঠিক যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো। যত দেখি তৃষ্ণা মেটে না। এতসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জলপাইগুড়ি থেকে ওঠা কাঞ্চনকন্যা ট্রেনের টু টায়ারের আপার বার্থে কখন ঘুমিয়ে যাই, টের পাই না। ঘুম ভাঙে ভোরবেলা। ট্রেন তখন কলকাতার কাছাকাছি। সেই কলকাতা, যেখানে আমার কোথাও কেউ নেই। কিন্তু তারপরও সাদামাটা মধ্যবিত্ত শহরটাই আমাকে জাদু করে রাখে বছরের পর বছর।

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:৪১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×