কদিন বাদেই চোখ ভরা জল নিয়ে আলেক আমাদের বিদায় দিল। লারিসাদের বাসায় সব মিলিয়ে তিনটে মাত্র রুম। ওদের সবারই রান্নাঘর ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যাবহৃত হয়। আর সব রুমই দিনের বেলায় যেন সুসজ্জিত বসার ঘর আর রাত শোবার ঘর। ডিভান কাম সোফাগুলি এমন করে তৈরি যে কায়দা করে টান দিলেই সোফা রুপান্তরিত হয় দারুন এক খাটে। তারপর বালিশ কম্বল আর চাদরটা বের করে নিলেই হল।
রান্নাঘরে ওদের ছোট ছোট ডাইনিং টেবিল দেখে প্রথমে যে কেউ ঘারড়ে যাবে এত ছোট টেবিলে এতগুলো লোক কেমন করে খায় এই ভেবে! কিন্তু খাবার সময়ে সেই ছোট্ট টেবিলই যেভাবে বড় টেবিলে রুপান্তরিত হয় তাই দেখে বিস্মিত হবে সে ফের!
আমাদের জন্য বরাদ্দ হল লারিসার দারুন গোছানো কোনার রুমটা। রুমের একপাশের সোফা কাম ডবল খাটটা মইনকে আমিই জোর করে দিলাম আর আমি নিলাম অন্য পাশের ছোট্ট সিঙ্গেল খাটটা। এই রুমের বিশেষ বিশেষত্ব ছিল সাথে লাগোয়া ছোটখাট একটা বারান্দা। সেখানেও শুয়ে বসে আরাম করার ব্যাবস্থা আছে। তবে যা দেখে আমরা দুজনেই চমকিত হলাম সেটা হল। বারান্দার পাশ ঘেষেই একটা ছিম ছাম রাস্তা আর তার পরে বহুদুর বিস্তৃত বার্চ পাইন ঘেরা বনভুমি। ওফ কি দারুন নৈসর্গিক দৃশ্য।প্রেম করার জন্য এমন উত্তম জায়গা আর কোথায় মিলবে?
আমারা কেউ জানিনা আমাদের ভবিতব্য কি? শুধু অনুমানটুকু করতে পারি; মইনের ব্যাপারে আমি অনুমান করেছিলাম-লারিসার সাথে তার প্রেম প্রায় অসম্ভব! হয়তো পরিবারের চাপে লারিসা এখন সব কিছু মুখবুজে সয়ে যাচ্ছে কিন্তু সময় বুঝে সে ঠিকই তার আসল রুপ দেখাবে। তখন আপাত সরল মইনের মত বাগাম্বর বাকপটু ছেলেটা কিভাবে সেই পরিস্থিতির সামাল দিবে সেইটে ভাববার বিষয়।ওকে ফেরানোর সাধ্য আমার নেই জেনে চুপ করে থাকলাম। লারিসার মন জয় করে সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার তীব্র বাসনার কাছে আমার সব আশংকাই পরাস্থ হল।
ওই বাড়িতে সাবলেট হিসেবে যাবার পরদিন থেকেই তার শৌর্যের নমুনা দেখাতে চরম ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। ব্যালে নৃত্যের সুনিপুন শিল্পী লারিসার সপ্নের কথা ভেবেই পরদিন প্রমান সাইজের দুটো লাউডস্পিকার সহ একখানা মাগনিতোলা বা ডেকসেট কিনে নিয়ে আসল। মাগাজিন থেকে মাছ মাংস দুধ মাখন পনির কিনে আনল ঢাউস ব্যাগ ভর্তি করে।
তাই দেখে লারিসার মা ভাই বোন বিস্ময়ে হা হয়ে গেল! পেরেস্ত্রোইকার পর তার এমন উত্তম আহার্যে তাদের ভোজন বিলাস হয়েছিল তাই নিয়ে ভাবতে বসে গেল।
লারিসাও দারুন বিব্রত ও বিস্মিত! সাধারন অভিজাত মধ্যবিত্ত ঘরের এই মেয়েটা কোন পুরুষের চোখে তার অতি মুল্যায়িত হতে দেখে বাকরুদ্ধ হল।
রুশ সমাজে পুরুষেরা প্রেমে পড়ে পাগল হয়না-প্রেম করেওনা। শরিরের জন্য উন্মত্ত হয় কিন্তু উম্মাদ হয় না। বাঙ্গালী পুরুষের মত এমন দেখানোর মনোবৃত্তি ওদের সমাজে চরমভাবে বিরল।
মইন যা শুরু করল তা এক কথায় ভীষন রকম পাগলামী!কাজকর্ম সব প্রায় বন্ধ। ফোন আসলে হু-হা করে। আসতেছি আসব বলে তালবাহানা করে। শেষ মেষ উপায় না দেখে আমাকে বলে, ফোন রিসিভ করতে।
বাধ্য হয়ে আমি তার হয়ে মিথ্যে বলি, উনি ভাই ভয়ঙ্কর অসুস্থ!
কিংবা ভুলভাল হিন্দি উর্দূতে ‘ভাই উও বহুত বিমার হ্যায় কিংবা তবিয়াৎ আচ্ছা নেহী হ্যায়।‘কখনো ভাঙ্গা ভাঙ্গা রুমানিয়ান ভাষায় ‘ইল এস্তে ফরতে বোলনভ’কিংবা রুশীয়তে’অন অচিন বোলেন’বিছানা থেকে উঠে ফোন ধরার ক্ষমতা নাইরে ভাই। শুধু পুলিশের গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তারা ফোন করলে সে একটু নড়ে চড়ে বসে।
এইখানে একটা বিষয় বলে নেই;
কিষিনেওতে যতগুলো আদম ব্যাবসায়ী ছিল তাদের অন্যতম ছিল মইন।কাজটা সেখানে অবৈধ! সবাই একটু দিনের আলোয় কম বেরোয়-পারতপক্ষে কোন পার্টি এটেন্ড করে না। সবকিছু থেকে গুটিয়ে রাখে। মইন তার উল্টো!
এর ফলস্বরুপ একদিন তাকে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বাসা থেকে ডেকে নিয়ে সমাদার করে চা সিগারেট খাইয়ে একটা রুমে প্রজেক্টরে শত শত ছবি দেখাল। সে কখন কোথায় যায় সব তাদের নখদর্পনে। মইন সেসব দেখে মূর্ছা যায় আরকি!তার ব্যাবসার হিসাব পাতিও তাদের হাতের মুঠোয়।
তখুনি তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করার মত সব নথিপত্র তাদের ফাইলে বন্দি।আদালতে তার কুকর্ম প্রমান হলে ছয় থেকে আট বছরের কারাবাস নিশ্চিত!
মইনকে তারা দুটো পছন্দ দিল। এক; সব স্বীকার করে জোল খাট অথবা যেমন আছ তেমনি ব্যাবসা কর-আমরা দেখেও না দেখার ভান করব।তার বিনিময়ে এখানকার সব ব্যাবসায়ীদের হাড়ির খবর তাদের দিতে হবে।
যখন তারা বলবে তদন্ডে হাজির হতে হবে। আর সাথে কিছু কমিশন আরকি!
মইনের হাতে দ্বীতিয় অপসনটা গ্রহন করা ছাড়া উপায় ছিলনা। সে এখন আদম ব্যাবসায়ীর লেবাসে পুলিশের একজন গুপ্তচর!
তাই দিনে রাতে যখনি পুলিশ স্মরণ করে তখনই তাকে হাজিরা দিতে হয়।
লারিসার মা বাবা সকাল হতেই কাজে বেরিয়ে পড়ে।আমরা ঘুমাই অনেক বেলা অব্দি। ওদের সাথে ছুটির সকালগুলো বাদে দেখাই হয়না বলা চলে।লারিসাও ভীষন ব্যাস্ত;সকালে কলেজ আর দুপুর থেকে সন্ধ্যে তক তার ব্যালে নৃত্যের প্রাকটিস। আন্দ্রেরও স্কুল আছে। মইন কিন্তু সকালে ঘুমায় না-কান খাড়া অপেক্ষা করে লারিসার বাবা মা বেড়িয়ে যাবার। লারিসা বের হয় ন’টার পরে। ওর বাবা মা বেরিয়ে যাবার পরক্ষনেই লাফ দিয়ে উঠে ইতি উতি উঝি ঝুকি মারে।
গলা খাঁকড়ি দিয়ে আন্দ্রেকে ডাকে-ও জানে ওই ঘরটাতেই লারিসা ঘুমোয়।আন্দ্রে সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখ কচলে সামনে এসে দাড়িয়ে বলে’স্তো’(কি?।
প্রতিউত্তর দেবার মত ভাষা জানা নেই মইনের-একটু লাজুক স্বরে সদ্য শেখা ভাঙ্গাচোড়া রুশ ভাষায় শুধু বলে ‘নিচুভো’নিচুভো’(কিছু না কিছুনা)
আন্দ্রে বোকা ছেলে না-চট করে ধরে ফেলে মইনের মইনের মনের কথা। হেসে বলে, ও ঘুমাচ্ছে -ডেকে দিব?
নিয়েত –নিয়েত(না-না)বলে সে তাড়াহুড়ো করে আমার রুমে এসে আমাকে জোড় করে ঘুম থেকে ডেকে ওঠায়, মিশু ভাই ওঠেন না। খিদে লেগেছে –চলেন নাস্তা বানাই।
সে তখন নিশ্চিত যে লারিসা তখনো বাইরে বেরোয়নি।
খানিকবাদে পরে ঘুম থেকে উঠে লারিসা রান্নাঘরে এসে প্রথমে ঝিম মেরে চেয়ারের উপর হাটু দুটো ভাজ করে হাত দিয়ে চেপে ধরে তার উপরে থুতনী ঠেকিয়ে বসে থাকে। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা এলোমেলো চুল আর হালকা বসনের সেই রুপসীকে মন ভরে দেখে নেয় মইন তখন। আমিও তাকাই বারবার আড় চোখে।চোখাচোখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই-লারিসার চোখ তখনো তন্দ্রাচ্ছন্ন!
উপমহাদেশীয় ভিন্ন স্বাদের রান্না করা সব্জি কিংবা মাংসের ঘ্রান তাকে সেই আধোঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়, একটু এলোমেলো পায়ে হেটে এসে আমার পাশ ঘেষে দাড়িয়ে ঢাকনাটা তুলে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বলে,বাহ্ সুন্দর ঘ্রানতো! কি রান্না করছ?
চট করে মইনও এসে পাশে দাড়ায়। আমাকে বলে জিজ্ঞেস করেন, ও খাবে নাকি?
আমি লারিসাকে জিজ্ঞেস করি,-তুমি খাবে?
ও যেন একটু ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়- হেসে বলে, নারে বাবা তোমরা যে মশলাদার খাবার খাও –সেটা আমার পেটে সইবে না।
আমিও হাসতে থাকি-একটু চেখেই দেখনা। একবার খেলে তুমি আর রাশিয়ান খাবার মুখে তুলতে চাইবে না।
আমার কথায় ও একটুখানি নরম হয়-কি একটু ভেবে পরক্ষনেই আবার বলে,উহু এসব খাবার খেলে আমি মোটা হয়ে যাব। তুমিতো জান ব্যালে নৃত্য শিল্পীদের শরিরে একটুও মেদ থাকতে পারবেনা।
মইন জিজ্ঞেস করল, কি বলল? আমি বলতেই ও বলল- ওকে বলেন আমাদের শরিরের কাঠামোর দিকে তাকাতে। আমরা এইসব খেয়েইতো এমন হালকা পাতলা শরির ধরে রেখেছি।
লারিসা আমাদের দুজনেরই শরিরের দিকে একটুখানি চোখ বুলিয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রান্না করা খাবারের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবে?
আমি আমার দেশীয় খাবারের সত্য মিথ্যা গুনগান গেয়েও তার মন টলাতে পারি না। সংশয়ে দোদুল্যমান তখন তার মন-খাবার না ক্যারিয়ার?
ওদিকে মইন বারংবার অনুরোধ করে-লারিসাকে যে করেই হোক এই খাবারে অভ্যাস্ত করতে,নাহলে বাকি জীবন রাশান খাবার খেতে খেতে লাইফ কুইট(এই বাক্যটা তার নিজের)।
আমি ভাবি, কিআশ্চর্য! এখনো সম্পর্কের সুত্রপাত-ই হয়নি আর সে ঘর সংসার পেতে বসে আছে? একটু খানি রাগ হয়-কিন্তু এই ছেলের উপর রাগ করা বৃথা। সে পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে আছে।
আচমকা লারিসা সিগারেট চায় আমার কাছে, মিশু সিগারেট আছে?
এই দেশে সিগারেট খোর মেয়ের সংখ্যা অনেক বেশী। অন্য সবাই মুরুব্বিদের থোড়াই কেয়ার করলেও-লারিসার বাবা মা বাসায় থাকলে সে কখনোই ধুমপান করে না। এই সময়টাই সিগারেট খাবার সুযোগ পায় সে।তবে আন্দ্রে দেখলে তাকে বকাঝকা করে-বলে, পাপা মামাকে বলে দিব।
আমি রুমে গিয়ে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিলে সে বারান্দায় পেতে রাখা ছোট্ট সোফাটায় গিয়ে বসে-আমি গল্প করতে বসি তার পাশে।
মইন তক্ষুনি উড়তে উড়তে এসে আমার পাশে চেপেচুপে বসে। আসলে ঠিক গল্প করা নয় আমি তখন মইনের দোভাষি।
সে একের পর এক প্রশ্ন করে যায় - আমি তা রুশ ভাষায় শুধাই; লারিসাকে। লারিসাও উত্তর দেয় সহজ সরল কন্ঠে। দুয়েকটা প্রশ্ন সে মইনকেও করে।তবে তার বেশির ভাগ প্রশ্ন আমাকেই; আমি শুধু তালবাহানা করে কথার মোড় ঘুরিয়ে দেই মইনের দিকে!
মইন তখন দারুন খুশী;বিগলিত হয়ে বারবার বলে, মিশু ভাই আপনি না থাকলে যে কি হইত?
আগের পর্বের জন্য Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০২০ রাত ৮:৫৫