-কি বলেন? আমাকে যেতেই হবে নতুন সেমিস্টার শুরু হবে গ্রীস্মের পরে আমাকে ভর্তি হতে হবে না?
-সেটা পরে দেখা যাবে- আগে দেখেন আপনার টাকা ফেরৎ পান কবে?
-সেটা অবশ্য ঠিক কথা, টাকাটা ফেরৎ না পেলে আমি ভর্তি হব কেমনে?
আমাকে নিয়ে তখন তার আদিখ্যেতার অন্ত নেই। ঘরের খাবার প্রায় ছেড়েই দিয়েছে বললে চলে। সারাদিন আমাকে নিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়ায় আর বড় বড় রেস্টুরেন্টে চলে দামী খাদ্য আর পানীয়ের মহোৎসব।
তার বিজনেস সিক্রেট বলে আমার কাছে এখন আর কিছু নেই। সবখানেই আমার অবাধ গমন। মাঝে মধ্যে তার হয়ে কিছু কাজও করতে হয়। ফাঁকে চলে টুক টাক উপদেশ!
...দু সপ্তাহ বাদে মেয়ের বাড়িতেই আমাদের দাওয়াত। ওর বাবা মার সাথে সাক্ষাৎ পর্বটা সারতে হবে।
রুশ পরিবার মুলত মা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মায়ের কথাই ওদের শেষ কথা। বাবা শুধুমাত্র অনুঘটক।
লারিসার পরিবারও এর ব্যাতিক্রম নয়। তুলনামুলক ওদের পরিবারটা একটু বড়। ভাইবোন তিনজন। ওরা দুইবোন আর সতের বছরের সদ্য যুবক ছোট ভাই আন্দ্রে। বেশ হাসি খুশি দিলখোলা সরল যুবক।এশিয়ানদের এর আগে সামনা সামনি দেখেনি কখনো। আমাদের গায়ের রঙ আর পোশাক দেখেই সে বিমোহিত। মেয়ের বড়বোনের স্বামী দারুন হ্যান্ডসাম! পেশায় পাইলট সেই স্বামীর পাশে ওর বোনকে একদম মানায় না। তার পরেও কেন জানিনা সে তার বউয়ের দুর্দান্ত প্রতাপ আর প্রভাবে সারাক্ষন খোলসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। এমনিতেই পেটে দু চার পেগ না পড়লে রাশিয়ান পুরুষেরা ভীষন রকমের সল্পবাক! তারপরেও তাকে বড় বেশী সল্পভাষী মনে হল। শ্যালিকার বিয়ে নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। ভাবখানা তার এমন যে যাকে খুশি বিয়ে করুক তাতে তার কি! সে এসেছে শুধুমাত্র পারিবারিক পার্টিতে এটেন্ড করতে।
এবার আসি লারিসার বাবা মার কথায়। দুরন্ত ফিগারের সব রুশ মেয়েরা বয়সের সাথে সাথেই কেমন যেন মুটিয়ে যেতে থাকে। সাথে তাদের কমতে থাকে চুলের দৈঘ্য। এটা যেন ওদের ঐতিহ্য ট্রেন্ড বা ফ্যাশান।
পঞ্চাশোর্ধ সব মহিলাদের প্রায় একই আকার আকৃতি। তিন সাড়ে তিন মন ওজনের বিশাল দশাশই শরির-পরনে আজানু লম্বিত ফুল ফুল ছিটের ম্যাক্সি। পায়ে উচু হিল। কুঞ্চিত মাথার চুল,বাহারি রঙ মাখানো খাটো করে ছাটা। ঠোটে কড়া রঙ্গের লিপস্টিক না লাগালে সাজ যেন পূর্ন হয়না। তবুও এই ফ্যাশনে রাস্তা দিয়ে তারা যখন হেলে দুলে হাটে তখন চলনে বলনে একটা মা মা ভাব ফুটে ওঠে। এই বুড়িরা একাধারে জাদরেল কড়া মেজাজের আবার হৃদয়টা যেন দারুন মমতায় মাখানো। অপরিচিত বয়স্ক কোন রমনীর কাছে কিছু চেয়ে কখনো নিরাশ হতে হয়নি।
লারিসার মা কিন্তু এর ব্যাতিক্রম নয়। অবাক হলাম ওর বাপকে দেখে! ছোটখাট টিঙ টিঙে সাজগোজে ভীষন দুরস্ত নিপাট এক ভদ্রলোক। ওর মায়ের পাশে খুব বেশী বেমানান তিনি। এতবড় বিশাল বপুর এক মহিলার পাশে তাকে যেন স্বামী হিসেবে মেলাতেই পারছিলাম না! ভদ্রলোক কথা বলেন কম বেশ ভেবে চিন্তে বুদ্ধিমত্তার সাথে।
লারিসার মা চাকরি করেন মন্ত্রনালয়ে আর বাপও বেশ বড় সরকারি অফিসার। মোটামুটি অভিজাত ফ্যামিলি। আগে অবস্থা বেশ ভাল ছিল কিন্তু এখন মুদ্রাস্ফিতির ধাক্কায় নাকাল হয়ে অবার ও দৈন্যতা লুকাতে যেন ভীষন ব্যাস্ত সবাই। পোরোস্ত্রোইকা কিছু মানুষের জীবনে সাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে সত্য কিন্তু বিগত সত্তুর বছর ধরে যে সমাজ ব্যাবস্থায় তারা অভ্যস্ত তার তার ঘোরটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না কোন মতেই।
দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি আর তথাকতিথ পশ্চিমা আর ইউরোপের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে তারা হিমসিম খাচ্ছে। কি করবে এই ভেবে তারা দিশেহারা? এই অবস্থা লারিসাদের পরিবারের মত আরো শত সহস্র পরিবারের।
এই এরা যেমন ভাবছে; বিদেশি এক ব্যাবসায়ির সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিলেই হয়তো তাদের এই সমস্যার আশু সমাধান মিলবে। ক্যামনে কি উপায়ে মিটবে এইসব ভাবার মত বিচারবুদ্ধি হয়তো তাদের ছিলনা। ব্যাবসা বলতেই হয়তো তারা বুঝত নগদ কাড়ি কাড়ি টাকা।
বর্হিবিশ্ব আর ব্যাবসা সন্মন্ধে তাদের এত বেশী কম ধারনা ছিল যে সেইটেই আমাদের উৎসাহিত করেছিল-এমন চরম মিথ্যেবাদী হবার?
মইনের যে ব্যাবসার ধরন তা আমাদের দেশের লোকেরাই খুব বেশী সুদৃষ্টিতে দেখেনা। এই ব্যাবসায় নগদ টাকার ছড়াছড়ি যদিও কিন্তু পথে বসতেও সময় লাগেনা। তাছাড়া সে শুধু ভীনদেশীই নয় রুশ ভাষাটা পর্যন্ত জানেনা।এই ছেলের সাথে বিয়ে হলে কি করে তাদের মেয়ে সুখি হবে আর এই সমস্যার উত্তরন হবে তা আমি ভেবে পাইনি। এখনো ভাবি এইটে ছিল তাদের খুব বড় রকমের ভুল সিদ্ধান্ত!
এবারও আমি অনুঘটক আর সঞ্চালকের ভুমিকায় লারিসার মা! মইন ওই বাড়িতে গিয়েই প্রথম থেকে নতুন জামাইয়ের মত লাজুক লাজুক মুখে বসে আছে। বেশ বড় টেবিলে খাবার দাবারের প্রাচুর্য। কারো বাড়িতে গেলে আপ্যায়নের শুরুটাই হয় ঘরে বানানো সুস্বাদু লাল মদ দিয়ে। এটা ওদের ঐতিহ্য! আন্দ্রে এখনো পরিপূর্ন যুবক হয়নি তাই পরিবারের সবার সামনে তার মদ খাওয়া বারন। শুধু ওর হাতেই জুসের গ্লাস আর সবার হাতে রেড ওয়াইন।
প্রশ্ন করছে মুলত লারিসার মা।ওর বাবা মাঝে মধ্যে দু-য়েকটা। আর উত্তর দিচ্ছি আমি একা!
মাঝে মধ্যে অবশ্য মইনকেই ইঙ্গিত করে বলছেন, ওকে জিজ্ঞেস করতো ওর ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
যদিও জানি ওর উত্তর কি হবে তবুও ভদ্রতার খাতিরে জিঞ্জেস করলাম, মইন ভাই উনি জিজ্ঞেস করছেন, আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা?
সে একটু লাজুক চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, বলে দেন বিয়ে করে এই দেশে সেটেল হওয়া।‘
-ওকি আমার মেয়েকে নিজের দেশে নিয়ে যেতে চায়না?
- হ্যা আপনার মেয়ে চাইলে অবশ্যই যাবে। তবে ব্যাবসাটা আরেকটু জমলে তবে।
লারিসা বসে আছে গোমড়া মুখে। মাঝে মধ্যে আমার দিকে তাকাচ্ছে- অবশ্য কিন্তু সে চাহনীতে সেদিনকার মত তেমন আবেদন নেই। আমি মনে মনে একটু খুশী কিংবা একটু ব্যাথিত-ও তার এহেন পরিবর্তনে। ধারনা করছি, এই কদিনে তার বেশ মগজ ধোলাই করা হয়েছে!
কথার ফাকে মইন একটা অনুরোধ করে বসল,-আমি কি আপনাদের বাসায় সাবলেট হিসেবে আসতে পারি?তাহলে দু চার ছ’মাস দেখে আপনাদের যদি ভাল লাগে আমাকে- তবে না হয় পাত্র হিসেবে মেনে নিবেন?
মদ্য মাতাল একগুয়ে বেহিসেবি যদিও দারুন বন্ধু বৎসল এই লোকটা এখানে আসলে আমার ধারনা দুদিনেই ফয়সালা হয়ে যাবে। এই ভেবে আমি প্রমাদ গুনলাম। কিন্তু তখন বুঝিনি তার হিসেবটা অন্য খানে।
তবে মইন শর্ত দিল দুখানা- প্রথমত তার সাথে আমি মানে মিশু থাকব আর মাস শেষে ভাড়া নিতে হবে! সেই ভাড়ার অঙ্কটাও বেশ আকর্ষনীয়।‘সেই অঙ্কটা শুনে ওরাতো বটেই আমি নিজেও চমকে উঠলাম!'
প্রথমে একটু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষন ফুসুর-ফাসুর করে ওরা বেশ আন্তরিকতার সাথেই রাজি হল।
মইন আসতে চায় পরের সপ্তাহেই। তাদেরও কোন আপত্তি নেই! তবে আপত্তি মুলত লারিসার- তাকে রুম ছাড়তে হবে বলে।
ওদিকে আন্দ্রেরও মনটা খারাপ হল- তার রুম শেয়ার করতে হবে বলে। তবে মায়ের এক ধমকেই দুজন ঠান্ডা।
আমাদের পুরনো বাড়িতে ফিরে এসে মইন কি মন্ত্রে বুড়িকে বুঝিয়েছিল জানিনা তবে বুড়ির কোন ভাবান্তর টের পেলাম না। শুধু আলেক ভীষন বিমর্ষ হল। মইনতো এতদিন তার বন্ধুর মত ছিল। তাকে ছাড়তে ওর মন চাইছিল না।
এ বাড়ি ছেড়ে যাবার জন্য গোছগাছ চলছিল। যদিও সাবলেট বাড়িতে নিজের কাপড় চোপড় আর যৎ সামান্য লাগেজ ব্যাগেজ ছাড়া গোছানোর আর কিছুই নেই কেননা ওখানে বাড়ি ভাড়া নিলে বিছানার চাদরটা পর্যন্তি কিনতে হয়না।
এর মাঝেই আলেক আচমকা অফার করল, যাবার আগে শেষবারের মত চলনা আমাদের গ্রামের বাড়িটা ঘুরে আসি।
ওর এমন আমন্ত্রনে আমরা পুলকিত হলাম বলাই বাহুল্য। রাশিয়ায় এতদিন এসেছি কিন্তু গ্রামে কখনো যাইনি। সুযোগ যখন এসেছে না হয় দেখে আসি একবার এদের গ্রাম কেমন হয়।
গ্রীস্মের দারুন উজ্জল একদিনে ভাড়ার ট্যাক্সি নিয়ে গেলাম আলেক’দের গ্রামে।
শহর থেকে বেড়িয়ে হাজার হাজার হেক্টর আঙ্গুর ক্ষেত পেরিয়ে আলেক’দের কি দারুন ছিমছাম গ্রাম- আমরা কল্পনাই করতে পারিনা। ছবির মত যেন ঘরবাড়ি গুলো। বেশীর ভাগই কাঠের সুদৃশ্য রঙ করা বাড়ি। প্রত্যেকেরই বাড়ি লাগোয়া বেশ খানিকটা বাগান আর চাষ-বাষের জমি।ঝকঝকে রাস্তার দু ধারে সারি সারি পাইন,ইউক্যালিপটাস আর ক্রিসমাসট্রি। কচি দেবশিশুর মত বাচ্চারা একমনে খেলছে সেই রাস্তা জুড়ে। সেই দুশ্যগুলো আজো আমার মনে হয় সপ্নই ছিল।
সবকিছু মনে নেই তবে পড়ন্ত বিকেলে আলেকদের বাসায় জগভর্তি অতি বিশুদ্ধ রেড ওয়াইন সাথে ওদের বাগান থেকে সদ্য তুলে আনা কচি শশা আর টম্যাটো দিয়ে ঘরের পাশে চাষ করা মৌমাছির টাটকা মধু মিশিয়ে খেতে খেতে আমরা ভেবেছিলাম নিশ্চিত -পুরো জীবনটাই যদি এমন সপ্নের মত সুন্দর হত?
আগের পর্বের জন্য Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০২০ রাত ৯:১৫