somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাগদা তো-ভ রাশিয়া-১৬

১৩ ই জুলাই, ২০১৩ সকাল ১১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের স্টেশনে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগবে। চোখ বুজে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! ঘুম ভাঙল এক সহৃদ যাত্রীর ধাক্কায়। ‘এই তোমরা কোথায় নামবে?’
অ্যাঃ! চমকে উঠে চোখ রগড়ে দেখি আমাদের ষ্টেশনে এসে গেছি। ঘুমন্ত শিশিরকে জাগানোর সময় ছিলনা।তার হাত ধরে কোন মতে টেনে নামাতেই ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
চলন্ত সিড়ি বেয়ে যখন ভু-গর্ভস্ত মেট্রো ষ্টেশন থেকে উপরে উঠছি তখনও মনে হয় ঘুমের ঘোরে ঢলে পরছিলাম!
ষ্টেশনের দরজা দিয়ে বের হয়ে আন্ডারপাস দিয়ে উল্টো দিকে বের হবার সময় মনে হল আমরা ভুল ষ্টেশনে নেমেছি। এই ট্রেন ষ্টেশনটা দেখতে অবিকল আমাদের ষ্টেশনের (অরিয়েখবা) মত।
মস্কোতে একই ধরনের দুটো মেট্রো ষ্টেশন আমাদের এযাবৎ চোখে পড়েনি। ওদের প্রত্যেকটা স্টেশন একটার সাথে আরেকটার এত বেশী পার্থক্য যে, সদ্যাগত কোন পর্যটকেরও ভুল হবার কথা নয়।
যাহোক ভ্রম ভাঙলে স্মরন হল আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছি । আমাদের গন্তব্য দু-ষ্টেশন আগে! যেপথ দিয়ে বর হয়েছি সেপথ দিয়ে আর ঢোকা যাবেন, পেরেখদ বা আন্ডার পাস দিয়ে কিছুটা ঘুর পথে এগিয়ে গিয়ে প্রবেশ পথ দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। আন্ডারপাসের মধ্যিখানে প্রায় পুরো জায়গাটা দখল করে অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে জটলা করে আড্ডা দিচ্ছিল। শীতের দিনে এতরাতে এরকম দৃশ্য অস্বাভাবিক! কিন্তু আমাদের এসব নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই।শুধু ছেলে ছোকড়া হলে কথা ছিল কিন্তু সে আড্ডায় মেয়েদের উপস্থিতি খানিকটা স্বস্তি-ই পেয়েছিলাম।
ওদের কাছাকাছি গিয়ে অনুরোধের স্বরে একটু খানি রাস্তা ছাড়ার জন্য বললাম ‘দয়া করে কি আমাদের যেতে দিবে’?
‘অবশ্যই’বলে কয়েকজন একসাথে হো হো করে হেসে উঠল!
রাস্তা ছেড়ে দেবার জন্য অনুরোধ করার প্রতি উত্তরে এভাবে উচ্চস্বরে হাসির কারন বুঝলাম না?ওদের এই আচমকা উচ্চকিত হাসি আর রহস্যপূর্ন চাহনীতে আমরা বেশ ঘাবড়ে গেলাম! দু তিনটে ছেলে ততক্ষনে দেয়ালের পাশ থেকে একটু খানি সরে দাড়িয়ে আমাদের হেটে যাবার পথ করে দিয়েছে।
প্রকম্পিত পদক্ষেপে দুপা এগুতেই ছেলেগুলো চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরল। ওদের মধ্যে থেকে সাস্থ্যবান ও দীর্ঘদেহী দু’জন এগিয়ে এসে আমাদের দু'জনকে হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা মেরে দেয়ালের দিকে আরো খানিকটা চেপে ধরে হাসি হাসি মুখে কঠিন স্বরে বলল ‘কোন রকম চেল্লা হল্লা করবা না। ভাব দেখাবে যে, তোমরা আমাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছ । ঠিক আছে?’
কাষ্ঠ হেসে শুকনো ঠোটে জ্বিহ্বা ছুইয়ে বললাম ‘যথা আজ্ঞা!’
আমাদের ঘিরে দাড়িয়ে আছে চারজন আর ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে আড্ডা দিচ্ছে দুটো মেয়ে আর তিনটে ছেলে। এদিকে ওদের কোন ভ্রুক্ষেপ-ই নেই। কি নিখুত অভিনয়!
ওদের কাছে অস্ত্র ছিল কিনা জানিনা। তবে আমাদের মত দু'জন ভেঁতো বাঙ্গালীকে পিটিয়ে মোরাব্বা বানানোর জন্য অমন দু'চারখানা পেশী বহুল হাত-ই কাফি। কোন রকম টু ফ্যা করলে চিরতরে নুলা-ন্যাংড়া হয়ে যাবার সমুহ সম্ভবনা। কি আর করার অগত্যা হাসি হাসি মুখেই ওদের সাথে গল্প জুড়লাম!
-‘কোত্থেকে এসেছ?’
-‘বন্ধুর হোটেলে দাওয়াত খেয়ে ।’
-‘বাঃ বেশ। মালটাল খেয়েছ?’
-‘ন্ না।’সঙ্গে সঙ্গে দু -তিনজন খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল!
একজন ব্যাঙ্গাত্বক স্বরে বিশ্রী হলুদ দাতগুলো( বেশীরভাগ রাশানদের দাত-ই কিছুটা হলদেটে- আর জিহ্বা কালচে) বের করে হাসতে হাসতে বলল, -‘তাহলে কি বাবু-এখনও জুস খাও?’
পাশের কঠিন চেহারার দানব আকৃতির ছেলেটি গম্ভীর কন্ঠে বলল ‘আমরা বন্ধুরা মিলে বেরিয়েছি ড্রিঙ্ক করার জন্য। কাছে টাকা পয়সা নেই। পকেটে যা আছে বের কর?’
মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, 'এত কস্টের টাকা কয়টা এক ঝটকায় বেরিয়ে যাবে?’তখুনি দু’জন মাঝ বয়েসি লোক গল্প করতে করতে আন্ডার পাস দিয়ে এগিয়ে আসছিল । ওদেরকে দেখেই ছেলেগুলো ,যেন অনেকদিন পরে পুরোনো বন্ধুকে ফিরে পেয়েছে,তেমনি আবেগ ভরা কন্ঠে চরম উচ্ছাসে আবোল-তাবোল গল্প জুড়ে দিল।
লোকগুলো কাছে এগিয়ে আসতেই ওরা সম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিল । ভদ্রলোক দুজন আমাদের এই উচ্ছল আড্ডার অন্তরালে অন্যকোন উদ্দেশ্য কাজ করছে এ সন্মন্ধে বিন্দু মাত্র সন্দেহ না করে নিজেদের মাঝে গল্প করতে করতে ধীর পদক্ষেপে হেটে হেটে এগিয়ে গেলেন।
ও পাশ দিয়ে ওরা বেরিয়ে যেতেই আমাদের সেই ভন্ড বন্ধুদের নকল মুখোশ খুলে পড়ল।
‘পকেটে কি আছে বের কর?’সেই দানবটা হিস হিস করে বলল।
কোন ঝামেলার দরকার নাই রে বাপ! অতিদ্রুত আমরা দুজন পকেট হাতড়ে সবকিছু বের করে তাদের সামনে মেলে ধরলাম । ... শুধু আমার কাছে অল্প কিছু টাকা দেখে হয়তো ওরা সন্তুস্ট হলনা।
‘আর কিছু নেই?’বলেই আমাদের দুজনের হাত থেকে পাসপোর্ট দুখানা নিয়ে মেলে ধওে চোখ নাচিয়ে বলল ‘কি আছে কিছু।’
তারপর আমাদের দিকে সরাসরি চোখের দিকে চেয়ে দু হাত দিয়ে সে'দুটো টেনে ধরে ছেড়ার ভঙ্গী করল।
তখুনি শিশির ভীষন ভাবে আঁতকে উঠে চিৎকার করে বলে উঠল ‘প্লিজ পাসপোট ছিড় ..’কথা শেষ না হতেই ‘ধাপ’করে ভোঁতা শব্দে কেঁপে উঠল পুরো দেয়াল!! সেই সাথে শিশিরের ভয়ঙ্কর আর্ত চিৎকার ‘আঃ!
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হা হয়ে গেলাম! এদের কাছ থেকে এত নিঃশংসতা আমি আশা করিনি ।
আমি প্রচন্ড বিস্ময় ও আতঙ্ক নিয়ে তাকালাম শিশিরের দিকে ! সামনে দাড়ানো ছেলেটার ঘুষির তোড়ে তার মাথাটা প্রচন্ড জোরে দেয়ালে ঠুকে এখন গর্দানের উপর উবু হয়ে ঝুলছে। পাথরের মেঝেতে ঝড়ে পড়ছে ফোটা ফোটা রক্ত!
এবার মনে হয় আমার পালা‘ভাবতেই ফের আতঙ্কে সারা শরীর হিম হয়ে গেল! মরিয়া হয়ে ক্ষীন কন্ঠে ওদেরকে বললাম ‘দয়া করে অযথা মের না । আমাদের কাছে আর একটা টাকাও নেই। নিজের হাত মেলে ধরে বললাম আমাদের কাছে যা আছে সবকিছু নিয়ে যাও। পাসপোর্ট ফেলে দাও ছিড়ে ফেল যা খুশী কর কিন্তু আঘাত কোর না।’
আমার অসহায়ত্ব ও করুনা ভিক্ষার সর্ব্বোত্তম প্রকাশ দেখে ওরা হয়তো মনে মনে খুশী হল। কিংবা শিশিরের আঘাতটা এত মারাত্বক হবে ওরা হয়তো ভাবতে পারেনি সে কারনেই খানিকটা নরম হল কি? কে জানে?
আমাকে বলল ‘বেশ! দু হাত উপরে তোল।’আমি হাত তুলতেই ওরা একজন চরম ক্ষিপ্রতায় পুরো শরীর চেক করে নিল।একই ভাবে শিশিরের চেক করা শেষে হতাশ হয়ে পাসপোর্ট দুটো আমার হাতে ফেরত দিয়ে বলল‘ঠিক আছে ওই টাকা গুলোই দাও।’
আমি টাকাটা তার হাতে দিয়ে নিচু স্বরে ভয়ে ভয়ে বললাম, যদি কিছু মনে না কর একটা কথা বলি?’
‘কি কথা?’
‘আমাদের বাসায় ফিরে যাবার ভাড়া নেই। এত রাতে মেট্রোও পাবনা। যদি...’
ছেলেটার কঠিন মুখ সরল হল। ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটল। পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে নিজের মনেই বলল‘বেদনী বিল্ল্যাত(অসহায় বা ভিখেরী)’। দু’শ রুবলের একটা নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল ‘যা ফোট!’
টাকাটা হাতে নিয়ে আমি তাদের ধন্যবাদ দিয়ে শিশিরের একহাত আমার কাধের উপর দিয়ে ডান হাত দিয়ে ওকে বেস্টন করে কোন মতে টেনে টেনে বাইরে নিয়ে এলাম ট্যাক্সি ধরব বলে ।
......
এই পর্ব শেষ
আগের পর্বের জন্য;
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:১৭
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×