somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাগদা তো-ভ রাশিয়া-১৫

০৫ ই জুলাই, ২০১৩ সকাল ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের সেই গুরু লাপাত্তা বেশ কয়েক মাস। মস্কোতে পরিচিত অপরিচিত সব জায়গায় ফোন করেও তার কোন হদিস পাইনি। এদিকে সেই অঘটনটার পর একটা বছর হেলা ফেলায় কেটে গেল, মালদোভিয়ায় অলস সময় কাটাতে কাটাতে হাফিয়ে উঠছিলাম, অন্যের গলগ্রহ হয়ে আর কতদি তাছাড়া এখানে মানে মস্কো থেকে এতদুর বসে গুরুর খোঁজ পাওয়া দুরুহ! তাকে পেতে হলে কিংবা বলা চলে হাতে নাতে ধরতে হলে মস্কোতে ডেরা বাধতে হবে।
ঠিক সপ্তাখানেক আগে মস্কো থকে আমার এক পরম শুভাকাঙ্খী বন্ধু ফোন করে জানাল যে, সে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে, চাইলে ওর ওখানে গিয়ে থাকতে পারি তার এই অনাকাঙ্খিত প্রস্তার তুখুনি লুফে নিয়ে তল্পিতল্পা বেধে ছুটেছি মস্কো অভিমুখে।
ফের সেই দুঃখ কষ্টের কথা-অনেকগুলো মানুষের কান্নাভেজা মুখ! বুকের ভিতর তীব্রভাবে খামঁচে ধরা অনাত্মীয় কিন্তু অতি আপনজন কিছু নারী পুরুষের ভালবাসার বন্ধন ছিড়ে আসার কষ্ট!
সেই বন্ধুটি ট্রেন স্টেশনে এসেছিল আমাকে রিসিভ করতে । ওর বাসায় গিয়ে আমার তো চক্ষুস্থির! এ দেখি আরেকখানা মিনি হোস্টেল! এখানে সে একানয , আরো চার পাজজন এসে জুটেছে।
তবে তাদের দেখে ভীষন পুলকিত হলাম, কেননা সবাই আমার পূর্ব পরিচিত। পুরোনো বন্ধুদের কাছে পেয়ে সাত পাঁক নেচে নিলাম!
ফের শুরু হল আমাদের ম্যারাথান আড্ডা, রাত জেগে কার্ড খেলা, হেড়ে গলায় কোরাস গান। রান্না নিয়ে নিত্য নতুন গবেষনা আর সব শেষে ক্লান্ত হয়ে গলা জড়াজড়ি করে ঘুমানো।
মস্কো ফিরে আসার সপ্তাহ দুয়েক বাদে আমার তাম্বুভ ইনিস্টিটিউটের ক্লাস মেট শিশির একদিন ফোন করে বলল, সে নাকি গুরুর খোজ পেয়েছে! প্যাট্রিস লুমবুম্বায়(প‌্যাট্রিস লু্মবুম্বা ছিলের ডোমেনিক রিপাবলিক অফ দ্যা কঙ্গোর প্রথম প্রধান মন্ত্রী-Peoples' Friendship University of Russia'র নাম পাল্টে একসময় তার নামে দেয়া হয়েছিল। বিদেশি বিশেষ করে তৃতিয় বিশ্বের ছাত্রদের সবচাইতে বেশী স্কলারশিপ দেয়া হতো এই ইউনিভার্সিটি থেকে- রুস্কাইয়া ব্লুদার কোন এক পর্বে এই ইউনিভার্সিটি নিয়ে গল্প করার ইচ্ছে রইল।) তুহিন নামে এক বাঙ্গালী ভদ্রলোকের রেস্টুরেন্টে (সম্ভবত :মস্কোর প্রথম বাংলাদেশীদের রেস্টুরেন্ট ) প্রতিদিনই সন্ধ্যার পরে আড্ডা দেয়।
সেই দূর্ঘটনাগুলোর পরে যে আর্থিক দৈন্যতা শুরু হয়েছিল তার রেশ এখনও চলছে। বন্ধুদের বদান্যতায় মাঝের ভয়াবহ সার্বিক অবস্থার সামান্য উন্নয়ন হলেও এখনও পকেট গড়ের মাঠ। এভাবে আর কতদিন? যার জন্য আমার এই দুরবস্থা তার সামনাসামনি হয়ে টুটি চেপে ধরে পুরোটা না হোক- সামান্য কিছু আদায় করতে সংকল্পবদ্ধ হলাম।
শিশিরকে আমি সেখানে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলে সে সানন্দেই রাজী হল।
ভিসা ছাড়া পাসপোর্টটাই পকেটে পুরে মেট্রোর ভাড়া এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে একদিন সন্ধ্যায় বের হলাম।
‘রিচনোই বোখজালে’র প্রবেশ পথে শিশিরের অপেক্ষা করার কথা ছিল । তাকে সাথে নিয়ে মেট্রোর ট্রেন বদল করে আমরা প্যাট্রিক লুবুম্বায় পৌছুলাম। ওখান থেকে বাসে করে ‘বাংলাদেশ রাশিয়ান ছাত্র মৈত্রী হলে’। অনেক অনেক দিন বাদে এখানে এলাম -অশপাশটা একটু পাল্টায়নি, একদম সেরকমই আছে!
ওভারকোট আর পশমের কান টুপিতে আপাদমস্তক ঢেকে পথে দু-চারজন প্রবাসী ছাত্রকে জিজ্ঞেস করে প্রচন্ড শীতে হাফ চিল হয়ে হোটেলে গিয়ে পৌছুলাম ।
হোস্টেলের বিশাল অডিটেরিয়াম ভাড়া নিয়ে করা সেই বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে(পরবর্তীতে যে কয়জন বাঙ্গালী মস্কোতে বিলিওনার হয়েছিলেনএই রেস্টুরেন্টের মালিক তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।) ঢুকতেই শত বাঙালীর হৈ-হুল্লোড় উচ্ছাসের শব্দে চমকে উঠলাম। এত শব্দে কানপাতা দায়! সিগারেটের ধোয়ায় ধোয়াচ্ছন্ন রেস্টুরেন্টের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গিয়ে ম্যানেজার ভদ্রলোককে গুরুর কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি আঙ্গুল উচিয়ে বাঁশ ও বেতের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা রুমের দিকে ইশারা করলেন। আমরা দুজনে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে রুমটাতে ঢুকতেই ‘গুরুর ’মুখোমুখি হলাম।
তিনি আমাকে দেখে পাক্কা দু-সেকেন্ড হা করে অবিশ্বাসী দৃস্টিতে চেয়ে রইলেন! ঘোর কাটতেই হৈ হৈ করতে করতে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার অকৃত্তিম আবেগ ও উচ্ছাসের তোড়ে আমার জমিয়ে রাখা এতদিনের ক্ষোভ নিমিষেই বাস্প হয়ে উড়ে গেল । প্রথম উচ্ছাসের রেশ মলিন হওয়ার পূর্বেই সে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল অন্য একটা রুমে যেখানে বসে তার গুটিকতক বন্ধু আলাপে মশগুল, সামনে ছিপি খোলা ভদকার বোতল।
তাদের মাঝে আমাকে জোর করে বসিয়ে দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল ‘তার ছোট ভাই বলে’! তার বন্ধুরা আমাকে রুশ দেশী পন্থায় পানীয়ের আমন্ত্রন করলে আমি সবিনয়ে প্রত্যাখান করলাম ।
শুরু হল আমার সেই গুরুর গপ্পো। তার ছেলেমানুষী হাসি আর সরল লাজুক চাহনী আমাকে আমার এতদিনের ভয়ঙ্কর কস্টের কথা বলতে বাধা দিল! সেরাতেই সে আমার সৌজন্যে একটা পার্টি থ্রো করল(পুরো টাকাটাই দিয়েছিল তার বন্ধু স্বয়ং সেই রেস্টুরেন্ট মালিক।) হোটেলের সেরা খাবার খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে তাকে হোটেলের এককোনে ডেকে নিয়ে আমার বর্তমান অবস্থার কথা সংক্ষেপে সেরে লাজ-শরমের মাথা খেয়ে কিছু টাকা চাইলাম?
তিনি ব্যাথিত চোখে আমার দিকে চেয়ে পকেটের অলি-গলি হাতড়ে হাজার পাচেক রুবল*(প্রায় বার ডলার) আমার হাতে গুজে দিয়ে বললেন, পরের সপ্তাহেই তার সাধ্য মত বড় অংকের কিছু টাকা জোগাড় করে আমাকে পৌছে দিবেন। আমার আর কস্ট করে তাকে খুজতে হবে না। টাকাটা তিনি নিজেই গিয়ে দিয়ে আসবেন আমার কাছে।
বিদায় নেবার আগে বার বার হাত ধরে ক্ষমা চাইলে আমিই মহত্ব দেখিয়ে তাকে নিবৃত করলাম!
রাত বারটায় শেষ মেট্রো । দেরী হলে ট্যাক্সিতে যাওয়া ছাড়া গতান্তর নেই । কাছে যে টাকা কয়টা আছে তা ট্যাক্সি ভাড়া দিতেই শেষ হয়ে যাবে । তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে কতদুর হেটে দৌড়ে বাসে উঠে মেট্রো ষ্টেশনে গিয়ে পৌছুলাম টায় টায় বারটার সময়। প্লাটফর্মে দাড়াতেই ট্রেন এসে গেল। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম।
শিশির অনুরোধ করল এত রাতে বাসায় না ফিরে তার হোস্টেলে যেতে।আমার বাসায় যেতে হলে দুবার ট্রেন বদল করতে হয় তারপরে মেট্রো থেকে অনেকটা পথ একা একা হেটে যেতে হবে মস্কোর পরিস্থিতি বিশেষ ভাল না -অহরহ ছিনতাই হচ্ছে। ঝামেলা এড়াতে ওর অনুরাধে সাড়া দিলাম । ভাবলাম; ভালই হবে অনেকদিন বাদে হোস্টেলের হোস্টেলের পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। ট্রেনের কামরা প্রায় পুরোটাই ফাঁকা এককোনে মধ্য বয়েসী দু'জন মাতাল বসে বসে ঝিমোচ্ছে তাদের হাত থেকে মেঝেতে পরে যাওয়া বিয়ারের বোতল দুটো ট্রেনের ঝাকুনীকে এদিক ওদিক গড়িয়ে-গড়িয়ে ট্রেনের শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে অদ্ভুদ শব্দ-ব্যাঞ্জনার সৃস্টি করছিল। (সবসময় দেখে আসা মস্কোর ঝকঝকো তকতকে মেট্রো ট্রেনের সাথে এ দৃশ্য ভীষন রকম বেমানান!)
আমরা বসে আছি মাঝখানে, অন্যপাশে একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা কাউকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের উন্মত্ত ভালবাসায় মত্ত!
এ আর কি এরকম দৃশ্য এখানে অহরহ-ই চোখে পরে-তবে তাদের ঘনিষ্ঠতার মাত্রা একটু বেশীই ছিল।
শিশির কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। বিরস দৃস্টিতে সেদিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে আমিও চোখ বুজলাম।... পর্ব ১৫ শেষ
আগের পর্বের জন্য;
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৩ দুপুর ১২:১০
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×