somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি আত্মজীবনীর খসড়া-পর্ব ২

১৯ শে আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব দেখুনে এখানে
Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব
রহমত দু’হাতে চোখ মোছেন। তবুও অন্ধকারে চেরাগের জমে থাকা অশ্র“ফোঁটা। আবেদা খাতুন আড়চোখে আলোতে তার চোখের পাতায় চিকচিক করে ওঠে তা দেখে ফেলেন। আর কোন কথা বলেন না। তিনি জানেন এখন এ নিয়ে কোন কথা বললে রহমতের মনে শুধুই ব্যর্থতার মরা কান্না আছড়ে পড়বে।
রহমত ছেড়া গামছাখানি কাঁধের উপর রেখে উঠে দাঁড়ান। ঘরের পাশে রাখা মাটির কলস থেকে মাটির বদনায় এক বদনা পানি ঢালেন। সে পানি ছিটিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নেন। ধুতে ধুতে আল্লাহর কাছে পানাহ চান- ‘হে আল্লাহ আমার কোন গুনাহ থাকলি তার ফল আমারে দেও। আমার বাচ্চাগুলো আজ দুইদিন ধরে না খায়ে আছে। আমি যে বাবা হয়ে ওদের মুখের দিক তাকাবার পারতেছি নে। ওরা তো তোমার কাছে কোন পাপ করে নাই। ওগারে এত কষ্ট দিতেছো কে? আল্লাহ তোমার তো দয়ার কোন শ্যাষ নাই। ইট্টু দয়া করো। আমার বাচ্চাগুলানরে আর উপাস রাইখো না।’
মুখ-হাত ধুয়ে ফিরে ঘরের বারান্দায় মুখ কালো করে বসেন। সেখানে রান্না করা কলমি শাক নিয়ে অপেক্ষা করছেন আবেদা খাতুন। বসতেই আবেদা একখানা প্লেটের এক পাশে একটুখানি শাক এগিয়ে দিলেন। রহমত গোগ্রাসে সেই শাক খেতে থাকেন। আবেদা পাশে বসে সে দৃশ্য দেখতে থাকেন।
খেতে খেতে রহমত আবেদাকে জিজ্ঞেস করেন- ‘আচ্ছা বউ, সবটুকু শাক যে আমারে দিলা। সহালে পোলাপান কি খাবেনে?’
‘সে চিন্তে আপনার করা লাগবেন না।’
‘কে, আমি তো ওগার বাপ না। কেন সে চিন্তে করবো না?’
‘আগে আপনার জান বাঁচান তো, ওগের চিন্তে পরে করবানি।’
‘না বউ, আমি আমার সন্তানগার খাবার খায়ে ওগেরে অনাহারে রাখবো! এ অয় না।’
‘তাইলি কি করবার চান আপনি? না খায়ে মরবার চান? আপনি মরে গিলি আপনার সন্তানরা খুব ভাল থাকপেনে? ওরা এতিম হবেন না? ওরা কার মুখের দিকে তাকাবেনে। আপনি এহন এই খাবার না খাইলি আপনি বাঁচে থাকপার পারবেন?’
রহমত কোন কথা বলেন না। শাকের প্লেট সামনে নিয়ে বসে থাকেন। আবেদা খাতুন তা দেখে বলে ওঠেন- ‘কি হইল খান না ক্যা?’
কোন উত্তর দেন না রহমত। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন আবেদার দিকে। আবেদা আর কথা না বাড়িয়ে নিজেই হাত লাগান শাকের প্লেটে। হাত ভরে শাক নিয়ে রহমতের মুখে তুলে দেন। রহমত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই শাক খেতে বাধ্য হন। খাওয়া শেষ করে মাটিতে পাতা খেজুর পাতার মাদুরে শুয়ে পড়েন দু’জনে।
বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না কারো। এপাশ-ওপাশ করেন দু’জনে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝি ঝি পোকা ডাকছে ঘরের পাশে। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। গ্রাম-গাঁয়ে রাত নামে অনেক আগেই। কৃষকরা সারাদিন খেটেখুটে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন ক্লান্ত শরীরে। খেয়ে-দেয়ে সন্ধ্যা রাতেই শুয়ে পড়েন তারা। জমাট বাঁধা আঁধার চারদিকে। রাত বাড়ার সাথে সাথে সেই রাতের গাঢ়ত্ব বাড়তে থাকে। গ্রাম-গাঁ ডুবে থাকে এক সমুদ্র অন্ধকারে।
আবেদা খাতুন পাশ ফিরে শুয়ে ছিলেন এতক্ষণ। সবেমাত্র স্বামীর দিকে ফিরে শুয়ে তিনি বললেন- ‘শোনেন, একটা কাম করলে অয় না?’
‘তুমি ঘুমাও নাই?’
‘না! ঘুম আসে না।’
‘তা তুমি কি কবার চাও?’
‘আপনি কি আমার কথা শুনে রাক করবেন না?’
‘নারে বউ, তুমি আজও আমারে চিনলা না!’
‘কি যে কন না আপনে। আমি যদি আপনেরে না চিনি তাইলে কে চিনবি!’
‘আরে আমি তো তোমারে পরীক্ষা করলাম। তুমি ছাড়া আমার আর কিডা আছে!’
‘তা কও না তুমি কি কইবার চাইছিলে!’
‘আমি কই কি আমাগার বড় ছাওয়ালডারে স্কুলে দিলে কেমন অয়? পড়ালেহা না শিখলি ও কি করে খাবি? আমি চাই নে আমার ছাওয়ালও আমাগার মতো না খায়ে দিন কাটাক। আপনি দেহেন পড়ালেহা না শিখলি ওরও তো পরিণতি এক হবি। তাই চলেন ওরে আমারা স্কুলে ভর্তি করে দেই। কন আপনি রাজি?’
‘তুমি খুব গুছায়ে কথা কইতে পার বউ। তোমার কথা মনে হইতেছিল কোন দেবী আমাকে ভবিষ্যত বাণী করতেছে। না বউ আমি চাই নে আমার ছাওয়াল আমার মতো না খায়ে ঘুমাক। আমি চাইনে আমার ছাওয়াল তার সন্তানগারে না খাওয়ায়ে ঘুম পাড়াক। কিন্তু একটা কতা আছে ও পড়তে গেলে আমরা সংসার চালাব কিভাবে? আমার এতদিনকার হিসাব ছিল আর কয়দিন পরেই আমার কষ্ট কাটে যাবি। আমার ছাওয়ালডা কামাই শিকবি। সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসবি।’
আবেদান খাতুন বলেন- ‘আপনি এত ভাঙ্গে পড়তেছেন ক্যা? আমিতো আছি। আমি না অয় সংসারের হাল ধরব।’
‘তুমি সংসারের হাল ধরবা? তা কি করে সম্ভব?’
‘আপনার দোয়া থাকলি সবই সম্ভব। আল্লাহ হাত দেছে-পাও দেছে। আমি সেই হাত-পাও খাটায়ে খাব।’
‘তুমি মাঠে কাম করবার চাও?’
‘না। তা করব ক্যা? আপনি দেইখেন আমি সম্মান নিয়ে কাম করে এই সংসার চালাব। আমার ছাওয়ালপান ঠিকই পড়ালেহা শিকবি।’
‘তুমি যদি পার তাইলে আমার আপত্তি নাই। ছাওয়ালরে স্কুলে ভর্তি করে দেও।’
‘আপনি সত্যি কইতেছেন?’
‘হ বউ হ!’
‘আল্লায় আপনের-আমার মনের আশা পূরণ করুক।’
এত কষ্টের মাঝেও যেন একটু আনন্দ ঝিলিক মেরে গেল আবেদা-রহমতের সংসারে। ঘন কালো মেঘের মাঝে বিজলি যেমন ঝিলিক মেরে যায় তেমনি একটু খানি হাসি খেলে গেল এই দম্পতির মুখে। এ হাসি এই আনন্দ যে উপভোগ করেছে একমাত্র সেই এর মর্ম এর স্বাদ উপলব্ধি করতে পারে। কথা শেষ করে অনাবিল ঝঞ্ঝাটমুক্ত মাথায় ঘুমিয়ে পড়ল দু’জনে।
পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলেন রহমত। উঠে নামাজ পড়লেন। আল্লাহর কাছে প্রাণ খুলে প্রার্থনা করলেন- ‘হে আল্লাহ! আজ আমার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ। আজ আমি আমার ছাওয়ালডারে স্কুলে ভর্তি করব। তুমি আমার মনের আশা পূরণ করো। আমার ছাওয়ালরে অনেক বড় বিদ্যান বানায়ে দিও। তুমি ছাড়া আমার আর কোন সম্বল নাই। আমার সামনের দিনগুলিতে তুমি বিপদ থেকে আমারে, আমার পোলাপানরে রক্ষা করো। আমার স্ত্রীর মনের আশা পূরণ করো।’
ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে আহাদ। বাবাকে বাড়ি দেখে সে একেবারে অবাক হয়ে যায়। কাল না সকালে বাবা তার বিদেশে গেছে! ছোট ভাইবোন ভাতের জন্যে কত কান্নাকাটি করে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে! মা তাদের মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন! বাবা ফিরে এসেছে, তার মানে বাবা বিদেশে কাজ পায়নি। আবার উপোস থাকতে হবে। আহাদের বুক ফেটে কান্না আসে। কিন্তু সে কাঁদতে পারে না।

প্রথম পর্ব দেখুনে এখানে
Click This Link
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

লিখেছেন সুম১৪৩২, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৫



দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×